বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-০২

0
1066

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

২.

মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে কাকভেজা তনুজা জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা কাপড়ে গায়ে লেপ্টে থাকায় কাঁটা দিয়ে ওঠছে বারবার। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে সালেহা কিংবা তনুজা কারোই মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।

রুদ্র হাতের বালতি নীচে রেখে এগিয়ে যায় তনুজার সামনে। তনুজা ভয়ে সালেহার সঙ্গে সেটে দাঁড়ায়। কিন্তু, রুদ্র যেন ওর ইচ্ছেকে বুঝার চেষ্টা করছে না। হেঁচকা টান দিয়ে সালেহার কাছ থেকে তনুজাকে নিজের হাতের দখলে নিয়ে আসে রুদ্র।

সালেহা কিছু বলবার জন্য মুখ খোলার আগেই রুদ্র হুংকার দিয়ে তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— এই মূহুর্তে এই ঘর ছেড়ে সোজা স্নান ঘরে চলে যাবে। দাসীরা তোমার পরনের কাপড় নিয়ে আসছে।

সালেহা রুদ্রের এমন ব্যবহার দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। তনুজাকে চোখের ইশারায় বললেন, এই ঘর থেকে চলে যেতে। তনুজা নিজের নানীর কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে এই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে অসংখ্য বকা এবং গালি দিচ্ছে রুদ্রকে।

তনুজা চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেলে সালেহা রুদ্রকে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

— শুনলাম, তোমার প্রথম স্ত্রীকে একা রেখে নাকি চারদিন আগে বাংলাদেশে এসেছো? তোমার কি একটুও লজ্জাবোধ হওয়া উচিত নয় রুদ্র ! প্রথম স্ত্রীকে রেখে তোমারই ফুফুজানের একমাত্র মেয়েকে গতকাল কোনো গুরুজনের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে বিবাহ করে নিয়ে এসেছো। তনুজা যদি একবার জানতে পারে ভীনদেশে তোমার আরও একটি স্ত্রী আছে। তখন, তনুজার মনে কিরুপ প্রভাব পরবে? আর, তোমার প্রথম স্ত্রী মেঘলা, ওকে কি জবাব দিবে তুমি?

রুদ্র চুপচাপ ওর দাদিজানের কথা শুনছেন। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সত্য এবং বাস্তবতাকে আজ গ্রহন করতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে রুদ্রের।

ভেতরে ভেতে নিজের বিবেকের কাছে হেরে যায় রুদ্র। অবনস্ত মুখমন্ডলে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায় রুদ্র। নিজের মাঝে সেই কাঠিন্য ভাবটুকু ফুটিয়ে তুলে সালেহাকে এবং উনার প্রশ্নকে এড়িয়ে চলে যায় রুদ্র।

সালেহা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে পরেন জল চৌকিতে। ভাবছেন আসন্ন দিনগুলো হয়তো সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে না।

স্নানঘরে প্রবেশ করতেই তনুজা দেখতে পেলে ভেতরে আগে থেকেই দু’জন দাসী দাঁড়িয়ে আছে। এই দুজন দাসীকে খুব ভালো করে চেনে তনুজা। কয়েক বছর পূর্বে এই বাড়িতে এলে তাদের সঙ্গে বসে তনুজা কতশত গল্পগুজবে মেতে থাকত তার ইয়ত্তা নেই।

দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দাসীসহ তনুজা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলো দরজা সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র ।

রুদ্র হাতের ইশারা দেখালেই দুজন দাসী স্নানঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়।

দাসীদের চলে যেতে দেখে তনুজা অস্বস্তিতে পরে যায়। গতকাল ওভাবে হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়া। এই জমিদার বাড়ির নাতনি হিসেবে বহুবার তনুজা এই বাড়িতে কদম রেখেছে। কিন্তু, গতকাল রুদ্রের স্ত্রী হিসেবে কদম রাখতেই অস্বস্তি আর লজ্জা তনুজাকে ঘিরে ধরেছে।

— ভেজা শরীরে থাকলে আজ সত্যি গায়ে জ্বরের বাসা বাঁধবে। গরম পানি দিয়ে গোসল সেড়ে বের হও। তোমার শেষ হলে আমি গোসল করব।

শেষের কথাটি মিনমিনে গলায় বললো রুদ্র। তনুজা রুদ্রের কাছ থেকে বারবার গোসল করার আদেশ শুনতে শুনতেই ওর হটাৎ মনে হলো, যে কেনই বারবার রুদ্র এমন আদেশ দিচ্ছে? গতকাল রাতে কি ওদের মাঝে কিছু হয়েছিল?

— গোসল করার এত তাগাদা দিচ্ছেন, কেন? আপনার আমার মাঝে সেরকম কিছু হয়েছি কি?

তনুজার কাছ থেকে এমন সোজাসাপটা কথা শুনে রুদ্র অবাক হয়ে যায়। লজ্জাবতী গাছের ন্যায় যেি মেয়ে কারো সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে নেতিয়ে যেতে সেই মেয়ে আজ চোখে চোখ রেখে এমন প্রশ্ন করছে!

— হয়নি কিন্তু হতে কতক্ষণ? তাছাড়া, নববধুর বিয়ের পরদিন সকালে যদি ভেজা চুলে না থাকে, তবে লোকে কি বলবে?

তনুজা রুদ্রের কাছ থেকে এমন জবাব পেয়ে সন্তুষ্ট নয়। অসন্তুষ্ট মনে রুদ্রকে স্নানঘর থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। রুদ্র কাল বিলম্ব না করে স্নানঘর থেকে বের হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ফুল বাগানে চলে যায়।

বাগানে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্রের নজর পরলো, ডানপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একশবছর পুরনো জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। তবে, এই জমিদার বাড়ির একটি অংশ আজও অক্ষত অবস্থায় আছে।

জমিদার বাড়ির অক্ষত অংশের দিকে তাকালে মনে হয় রোজ কেউ এই জায়গাটাকে নিজ হাতে পরিষ্কার করে রাখে। কিন্তু, এখানে কে-বা আসবে পরিষ্কার করার জন্য? কারণ, এই জায়গা পরিত্যক্ত হিসেবে পরে আছে। দাসী কিংবা প্রহরীরা কেউই এই জায়গায় আসে না। কদাচিৎ প্রয়োজন হলে সালেহা কিংবা রুদ্রের বড়ো অর্থাৎ এই জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলের প্রথম স্ত্রী কাছ থেকে অনুমতি পেলে তবেই আসতে পারবে তার আগে নয়।

রুদ্র আর এই জায়গার ব্যাপারে আর না ভেবে পা পিছিয়ে রওনা হয় স্নানঘরের দিকে। এতক্ষণে হয়তো তনুজার স্নান নেয়া হয়ে গেছে।

স্নানঘরের সামনে এলে রুদ্র দেখলো, তনুজা স্নানঘরে নেই। তারমানে, তনুজা স্নান শেষ করে নিজের কামরায় চলে গিয়েছে। রুদ্র স্নানঘরে ঢুকে পরে। স্নান শেষ করে নিজের কামরায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় রুদ্র। পথিমধ্যে, তনুজার অস্তিত্ব টের পেয়ে থমকে দাঁড়ায় রুদ্র।

সালেহার কামরায় দক্ষিণের জানালার পাশে বসে রোদ গায়ে মাখাচ্ছে তনুজা। ভেজা চুল সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। কপালের সামনে ঝুলে কয়েকগাছি চুল। ফর্সা গায়ে গোলাপি রঙের টাঙ্গাইলের শাড়িটা বেশ মানিয়েছে। হাফহাতা ব্লাউজ পরনে বিধায় ফর্সা হাতদুটো থেকে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। নাকে নেই কোনো নাকফুল। কানে নেই দুল। তবুও যেন তনুজাকে অনন্য সুন্দরী দেখায়।

সালেহার কামরার মুখ্য দুয়ারে দাঁড়িয়ে রুদ্র এতক্ষণ অব্দি তাকিয়ে আছে তনুজার দিকে। তনুজার দিকে তাকালে রুদ্রের মনে কেমন অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে! কই মেঘলার মুখের দিকে তাকালে তো এমন শান্তি অনুভব হয় না রুদ্রের?
তবুও, তনুজার থেকে মেঘলার ঢের ভালো। মেঘলা রুদ্রের সকল চাওয়া পাওয়াকে মূল্যায়ন করতে জানে। আর, তনুজা শুধু রুদ্রকে কষ্ট আর লাঞ্চনা দিয়ে গেছে। রুদ্র দ্রুতগতিতে সেখান থেকে প্রস্থান নেয়। নিজের কামরায় গিয়ে মেঘলার নাম্বারে কল দেয়।

—————

— রুদ্র কাউকে না জানিয়ে আমার মেয়েকে এমন অবস্থায় রেখে কি করে বাংলাদেশে চলে গিয়েছে?

— বেয়াইসাহেব,আপনি শান্ত হোন। বাংলাদেশে গিয়েছে হয়তো কোনো জরুরি কাজেই। রুদ্র অনেক যত্নশীল মেঘলার ব্যাপারে, তাই না মেঘলা?

নিজের শ্বাশুড়ির কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেঘলা ওর বাবাকে বলে,

— আব্বা, আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন। রুদ্র এমন নয়। দেখবেন কিছুদিনের মধ্যে সে ফিরে আসবে।

মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হলেন মিজান সাহেব। মেয়ে এবং মেয়ের শ্বাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে রওনা হলেন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য।

—-রুদ্র আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছে আমার সন্তানের জন্য একটি ভালো মায়ের ব্যবস্থা করতেই সে বাংলাদেশে গিয়েছে। অতিশীঘ্রই, রুদ্র ফিরে আসবে।

নিজের ভরাট উদরের ওপর হাত রেখেই মনে মনে কথাগুলো বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুললো মেঘলা।

——————

—এত সুন্দরী একটা মেয়ের স্বামীর কিনা প্রথম স্ত্রী আছে। লেখাপড়া শেষ করে চব্বিশ বছর বয়সে এসে কিনা নিজের দেখে দশবছর বয়সে বড়ো একলোককে বিয়ে করতে হলো তনুজার। কেন ও কি দেখতে শুনতে খারাপ? বরং, রুদ্রের সঙ্গে তনুজা বেমানান।

কথাগুলো বলছিলেন রুদ্রের বড়ো মা রুক্মিণী। পাশে বসে আছেন রুক্মিণীর ছোট বোন। দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে পানের বাটাখানা পায়ের ওপর রেখে একখান পান সাজিয়ে নিজের বড়ো বোনের সামনে এগিয়ে দিয়ে রুক্মিণীর ছোট বোন বলছে,

— বুবু। একটা কথা বলি?

— বলে ফেল।

বড়ো হা করে মুখে পানটা ঢুকিয়ে একটুখানি চুন জিহ্বার আগায় লাগিয়ে চিবাতে চিবাতে কথাটি বলে রুক্মিণী।

— এত কিছু করার পরও সেই তো রুদ্র তনুজাকে বিয়ে করলো রুদ্র বাবা। তোমার এতদিন সব পরিকল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রুদ্রের ঘরে এখন তনুজা।

— খবরদার, সুষমা। আর একবার যদি তোর মুখ থেকে এই কথা শুনি তবে ভালো হবে না বলে দিলাম।

হুংকার দিয়ে কথাটি বলে ওঠে রুক্মিণী। সুষমা ভয়ে জড়সড়ভাবে বসে থাকে খাটের ওপর। বোনকে কখনো এইভাবে রেগে যেতে দেখেনি সে।

রুক্মিণী রাগান্বিত অবস্থায় ঘরের এপাশ-ওপাশ পর্যন্ত পায়চারি করতে থাকে। এমনসময় মোবাইল ফোনে কল আসে। মালদ্বীপের নাম্বার। রুদ্রের বাবা কল করেছেন। রুক্মিণীর মাথায় হটাৎ করেই শয়তানি বুদ্ধি এসে কড়া নাড়ে। নিজের শ্বাশুড়ির আদেশকে অমান্য করে রুদ্রের সঙ্গে তনুজার বিয়ের ঘটনা রুদ্রের বাবার সঙ্গে বলে দিবেন ভেবে পৈশাচিক হাসি দিয়ে কল রিসিভ করে রুক্মিণী।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে