বর্ষণ মুখর দিন পর্ব-১০

0
878

#গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১০

একে একে সবগুলো গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।বাকি রইলো দুটো গাড়ি।নিয়াজ আর জারাকে একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে নিয়াজের বাবা এদিকের কিছু কাজ সেরে আরো কয়েকজন নিয়ে পরে আসবেন।
কান্না করতে করতে জারা চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।ঘাড় আর মাথা টনটন করছে।কেমন মনে হচ্ছে যারা যেন গোল গোল হয়ে ঘুরছে।সিটে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝে থাকে জারা।নিয়াজ জারাকেই দেখে যাচ্ছে।মনে মনে প্রশান্তি হচ্ছে কিছু মুহূর্ত আগ থেকে জারা তার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গিয়েছে।।।
অর্ধাঙ্গিনী শব্দটার মানে অনেক গভীর।জারার হাতটা ধরতে গেলেই নিয়াজের ফোন বেজে উঠে।বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে বাবার ফোন।কল রিসিভ করতেই নিয়াজের বাবা জানালেন,তোর শশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।নিয়াজ উত্তেজিত হয়ে বলল,কি বলছো বাবা।হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেনো?

নিয়াজের কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই জারা চোখ মেলে তাকায়।নিয়াজ বলল,আচ্ছা আমরা আসছি।ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে জারার বাসার দিকে যেতে বলে নিয়াজ।জারা নিয়াজকে প্রশ্ন করে,কে অসুস্থ?আমার বাবা,মা ঠিক আছে তো?
নিয়াজ জারার হাত নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে বলল,সবাই ঠিক আছে।বাবা আমাকে একটা কাজে আবার তোমাদের বাসায় যেতে বলেছে।
জারার দৃষ্টি দেখে নিয়াজ বুঝতে পারলো তার মিথ্যে জারা বিশ্বাস করেনি।
নিয়াজের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জারা ফুঁফিয়ে উঠে বলে,সত্যি করে বলুন,কার কি হয়েছে।আমি স্পষ্ট আপনাকে বলতে শুনেছি কেউ অসুস্থ।
নিয়াজ জারার পিঠের উপর হাত দিয়ে জারাকে আগলে ধরে বলল,তুমি উত্তেজিত হইওনা।আসলে তোমার বাবা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
জারা ফুঁপিয়ে কান্না করে দিয়ে বলে,আমি জানতাম হয় বাবা নয়তো মা দুজনের একজনের কিছু হয়েছে।জারা কেঁদেই চলেছে।নিয়াজ কিছুতেই জারাকে শান্ত করতে পারছে না।প্রায় আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে এখন আবার জারার বাসায় ফিরতে হচ্ছে।

নিয়াজের বাবা জারার বাবার সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসছিলেন।তাসিনের বাবা মাথায় হাত রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজে চলেছেন।উদ্দেশ্য তাসিনের মাকে না দেখলে জারার মাকে বলবেন এক কাপ চা দিতে।হঠাৎ গ্লাস ভাঙার আওয়াজ হতেই উনি পাশ ফিরে তাকান।নিয়াজের বাবাও পেছন ফিরে তাকান।জারার বাবা বুকে হাত চেপে সোফায় হেলে পড়ে আছেন।পানির গ্লাস নিতে গিয়ে গ্লাসটাও নিচে পড়ে ভেঙে গেছে। তাসিনের আর নিয়াজের বাবা এসে জারার বাবাকে ধরেলেন।তাসিনের বাবা সবাইকে ডাকলে বাড়ির সবাই ড্রইংরুমে চলে আসেন।মুহিত হাসানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নিয়াজের বাবা নিয়াজকে আবারো ফোন করে বলে দিয়েছেন উনারা হাসপাতালে আছে।নিয়াজ জারাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে।ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে হাঁটতে জারার কষ্ট হচ্ছে তবুও বাবাকে দেখার জন্য একহাতে লেহেঙ্গা ধরে যত দ্রুত সম্ভব হেটে চলেছে।নিয়াজে রিসিপশন পেশেন্টের নাম বলে কোথায় আছে জেনে নিয়েছে।জারার হাত একহাতে মুঠো করে ধরে জারার বাবাকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেদিকে গেলো।হাসপাতালে বাড়ির বড়রা কজন এসেছে।তাসিন আর তুহিনও বাসায় তখন বাসায় ছিলোনা।তারাও এখন হাসপাতালে চলে এসেছে।মহিলা কাউকে আনা হয়নি।জারা দৌঁড়ে গিয়ে ওর চাচাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে,বাবা কোথায় আমি বাবাকে দেখবো।জারার চাচা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,কাঁদিস না মা।ভাইজান ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহকে ডাক।নিয়াজ এসে জারাকে বুকের সাথে আগলে নিলো।জারাও নিয়াজের পিঠ খামছে ধরে কেঁদে যাচ্ছে।ডাক্তার পরীক্ষা করে বেরিয়ে আসতেই সবাই সেদিকে এগিয়ে গেলো।ডাক্তার বললেন,উনারতো আগে থেকেই হার্টের সমস্যা আছে।নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে চিন্তা করেছেন যার কারণে বুকে ব্যথাটা দেখা দিয়েছে।চিন্তা করবেন না উনি এখন ঠিক আছেন।কিছুক্ষণ পর গিয়ে দেখা করে আসতে পারবেন।

মুহিত হাসান উপরের দিকে তাকিয়ে সিটে শুয়ে আছেন।মেয়েটাকে পরের হাতে তুলেতো দিয়েছেন।মেয়েটা সুখী হবে কিনা এসব নানা চিন্তা করে বুকে চিনচিনে ব্যথা হতেই পানির গ্লাসটা নিতে চাইলেন।হাত ফসকে গ্লাস পড়ে গিয়ে উনি সোফায় হেলে পড়েন।বুকের ব্যথাটা হঠাৎ করেই তীব্র হয়ে উঠলো।
সবাই মিলে মুহিত হাসানের সাথে দেখা করে বেরুলেন।জারা বাবার বুকে মাথা দিয়েই ফুঁফিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।মুহিত হাসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,এত কাঁদতে হয়না মা।বাবা এখন ঠিক আছি।তবুও জারা কাঁদছে।নিয়াজ জারাকে টেনে বলল,তুমি যে বাবার বুকে মাথা রেখেছো বাবার যে বুকে ব্যথা বাবার কষ্ট হচ্ছে তো।জারা চট করে মাথা সরিয়ে নিয়াজের দিকে তাকালো।মুহিত হাসান মুচকি হেসে বললেন,আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছেনা।জারা চোখ গরম করে বলল,তুমি সব সময় এমন করো।তোমার কষ্ট হচ্ছে তার পরেও বলছো তুমি ঠিক আছো।জারার বাবা নিঃশব্দে হাসলেন।সন্তান যখন বুকে মাথা রাখে তখন কষ্টকে কষ্ট বলে মনে হয়না।

রাত একটায় জারা নিয়াজ নিয়াজের বাবা রওনা দিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।নিয়াজের বাবা সামনেই ড্রাইভারের সাথে বসেছেন।নিয়াজ জারাকে নিয়ে পেছনে বসেছেন।নিয়াজের বাবার সাথে যে ক’জন যাওয়ার বাকি ছিলো উনাদেরকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।জারার চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে কত বছর ধরে ঘুমায়না।সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।তলিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে।নিয়াজের বাবাও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছেন।বয়স্ক মানুষ আজকে উনার উপর অনেক ধকল গেছে।ড্রাইভার আর নিয়াজ জেগে আছে।জারার ঘুমানোর অনেকক্ষণ পর নিয়াজ আস্তে করে জারার মাথাটা ওর ঘাড়ে রেখে একহাতে জড়িয়ে রাখে।জারার খবর নেই সে ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে নিয়াজ জেগে যায়।কখন যে চোখটা লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি।বাবা সামনে সোজা হয়ে বসে আছেন।জারার দিকে একপলক তাকালো নিয়াজ।নিয়াজের শেরওয়ানি মুঠো করে ধরে ঘুমিয়ে আছে জারা।ওরা ঢাকায় চলে এসেছে।আর কিছু পথ বাকি আছে নিয়াজের বাসা আসতে।
ড্রাইভার নিয়াজের বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই নিয়াজের বাবা নেমে পড়লেন।নিয়াজ জারাকে মৃদুস্বরে ডাক দিলো।নিয়াজের বাবা একপলক পেছনে তাকিয়ে বললেন,অনেক ক্লান্ত মেয়েটা।ডেকো না তুমি নিয়ে এসো।বাবার কথায় নিয়াজ এদিক ওদিক তাকায়।ব্যাপারটা কেমন দেখায় বাবার সামনে বউকে কোলে নিয়ে হাঁটবে?

নিয়াজের বাবা বললেন,এত সংকোচের কিছুই নেই নিয়ে এসো।নিয়াজ বাবার কথা মতো জারাকে টেনে কোলে নিতে গেলেই জারা জেগে যায়।নিয়াজকে নিজের অনেক কাছে দেখে পিছিয়ে যায়।যার দরুন মাথায় হালকা বাড়ি খায়।নিয়াজ সরে গিয়ে বলে নেমে এসো বাসা এসে গেছে।জারা গাড়ি থেকে নেমে নিয়াজের পিছু পিছু হাঁটা ধরলো।মাথা তুলে একপাল বাড়িটার দিকে তাকালো।বাড়ির নকশা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই বাড়ির মানুষ গুলো কতটা শৌখিন।দরজায় দাঁড়িয়ে মিসেস রেনু অপেক্ষা করছিলেন।নিয়াজের বাবা ঢাকার ভেতরে ঢুকেই বাসায় ফোন করে দিয়েছেন।সবে মাত্র সকাল ছয়টা বাঝে।সব আত্মীয় স্বজনরা এখন নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।মিসেস রেনু কি কি নিয়ম পালন করা লাগে সেগুলো শেষ করে নিয়াজকে বললেন জারাকে ঘরে নিয়ে যেতে।এমনিতেই সবার উপরে অনেক ধকল গেছে।নিয়াজ সোজা হেঁটে চলেছে।জারা কি করবে বুঝতে পারছেনা।নিয়াজের পিছু পিছু যাবে কিভাবে?কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।মিসেস রেনু নিজের ঘরে চলে গেলেন।

নিয়াজ একবার পেছনে তাকিয়ে মাকে না দেখে জারার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলো।জারাকে সব চেঞ্জ করে নিতে বলেছে।নিয়াজ রুমেই চেঞ্জ করে খাটে শুতে গিয়ে দেখলো পুরো খাট ফুল দিয়ে সাজানো।নিয়াজ ফুল গুলোকে ঝেড়ে বিছানা পরিষ্কার করে শুয়ে পড়েছে।জারা মেকাপ তুলে আস্তে আস্তে লেহেঙ্গা পাল্টে একটা শাড়ি পড়ে নিয়েছে।রুমে এসে দেখলো নিয়াজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।জারা হেঁটে হেঁটে বারান্দা খুঁজে বের করে ফেলেছে।বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।এখন ঘুমালে সহজে ঘুম ভাঙবেনা।সবাই কি ভাববে?বলবে নতুন বউ এত বেলা অব্দি ঘুমায়।তাছাড়া নিয়াজের পাশে ঘুমাতেও কেমন সংকোচ হচ্ছে।

নিয়াজ চোখ খুলে বারান্দায় এসে জারার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো।খাটে শুইয়ে দিয়ে বলল,এখন ঘুমাও।কেউ কিছু মনে করবেনা।সবাই জানে আমরা অনেকরাত অব্দি হাসপাতালে ছিলাম।জারা মোচড় দিয়ে উঠতে গেলেই নিয়াজ পাশে শুয়ে জারাকে জড়িয়ে ধরে।জারার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহগো হাত গুলো মনে হয় একমণ ওজনের হবে।নড়তে পারছেনা বেচারি।জারার মোচড়ামুচড়িতে নিয়াজ জারার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে বলল,একদম নড়াচড়া করোনা।নিজেও ঘুমাও আমাকেও ঘুমাতে দাও।
জারার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে।নিয়াজ ওর এত কাছে চলে এসেছে।চোখ মুখ খিঁচিয়ে জারা আল্লাহকে ডাকছে নিয়াজ যাতে সরে যায়।নিয়াজ অলরেডি ঘুমিয়ে পড়েছে।জারা ও নড়তে না পেরে নিয়াজের হাতের নিচে চাপা পড়েই ঘুমিয়ে গেছে।

জারা বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারে নি।মনে মনে একটা চিন্তা ছিলো সবাই কি ভাববে?ঘুম ভেঙে দেখতে পেলো নিয়াজ একহাত জারার উপর দিয়ে রেখেছে।জারা নিয়াজের হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।নিয়াজের পাশে তার ফোন ছিলো।স্ক্রিন অন করে সময় দেখতে গিয়ে ওয়ালপেপারে রিহার জন্ম দিনে শাড়ি পড়া জারার একটা ছবি দেখলো।মূলত ছবিটা জারার মুখ চেপে হাসি থামানোর সময়ই নিয়াজ তুলেছিলো।জারা ফোন রেখে দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে একেবারে গোসল করে নিয়েছে।রুমে এসে চুল মুছে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।বউ মানুষ হালকা লিপস্টিপ না দিলেও কেমন খালি খালি দেখা যায়।জারা ট্রলি থেকে সাজগোছের সব জিনিস রেখে লিপস্টিপ তুলি নিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে নিলো।

নিয়াজ পাশ ফিরে শুতে গিয়ে ওর মনে হলো ও কিছু একটা দেখেছে।চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো জারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে।নিয়াজ অনেকক্ষন ধরে নেশাগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থাকলো।মন বলছে উঠে গিয়ে জারার চুলে মুখ ডুবিয়ে দে।চোখ বলছে সালা চুপটি করে ঘুমা।অবশেষে সবকিছুর সাথে যুদ্ধ করে নিয়াজ চোখ বন্ধ করে নিলো।জারা মাথায় ঘোমটা টেনে নিচে চলে গেলো।আটটা বেজে গেছে।বড়রা উঠে পড়েছে সবাই।একজন মহিলা জারকে দেখে বললেন,ওমা বউমা তুমি এখন নিচে আসতে গেলে কেনো?তোমরাতো সকালেই এসেছো।ঠিক মতো ঘুমাতেও তো পারোনি।জারা মুচকি হেসে বলল,অনেক্ষণ তো ঘুমালাম।মিসেস রেনু রান্নাঘরে সবকিছুর তদারকি করছেন।সকালে কে কি খাবেন সেসবের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।জারার গলার স্বর শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে জারাকে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলেন।এখন নিচে নেমে আসার কি দরকার ছিলো।জারা মিষ্টি হেসে মিসেস রেনুকে বললেন,আমার এখন আর ঘুম আসবেনা।তাই নিচে চলে এলাম।জারাকে সোফায় চুপটি করে বসে থাকতে বলে মিসেস রেনু আবারো ছুটলেন রান্নাঘরে।
#চলবে…….।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে