বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-০৩

0
1744

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৩.

অনিমার কথা শুনে অবাক হল আদ্রিয়ান। কী বলছে এই মেয়ে? বর্ষণ কীকরে কারো কাছ থেকে কিছু কেরে নিতে পারে? কীকরে কারো দুর্ভাগ্য হতে পারে? ওর দৃষ্টিতে তো বর্ষণ শুধুই সৌভাগ্য নিয়ে আসে। নিস্তেজ প্রকৃতিকে সজীব করে তোলে। প্রকৃতিকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। আদ্রিয়ান ভেতরে গিয়ে ভেতর থেকে একটা চাদর এনে অনিমার গায়ে জড়িয়ে দিল। যার ফলে অনিমার প্রায় পা অবধি ঢেকে গেল। অনিমা চমকে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। ও ওই শার্ট পরেই এখানে এসছিল? ওর তো খেয়ালই ছিলোনা। এসব বিষয়ে এতোটা বেখেয়ালি কবে থেকে হল ও? ইতস্তত করে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

” এখানে এলে যে ঘুম আসছে না?”

” না।”

আদ্রিয়ানও এবার অনিমার পাশে রেলিং ধরে দাঁড়াল। অনিমা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি দেখে এমন মনে হচ্ছে যেন অনেক অভিযোগ, ক্ষোভ, কষ্ট প্রকাশ করছে এই বৃষ্টির প্রতি। আদ্রিয়ান গভীরভাবে লক্ষ্য করছে অনিমার চাহনী। আচ্ছা! এই মেয়েটার তো এখন ওকে হাজারটা প্রশ্ন করার কথা ছিল। কিন্তু ও এত চুপচাপ কেন আছে? কী এত ভাবছে?

আদ্রিয়ান অনিমার কাধে হাত রাখতে গেলেই অনিমা একপ্রকার দূরে সরে গেলো। ভীত দৃষ্টিতে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে
শুকনো একটা ঢোক গিলল। আদ্রিয়ান বুঝল মেয়েটা ভয় বা শক কোনোটাই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। না, এখন ওকে একটু নরমাল করতে হবে। নাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। আদ্রিয়ান অনিমার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই বলল,

” তোমারও ঘুম আসছে না, আর আমারও। তো দুজনেরই যখন ঘুম আসছেই না তাহলে কী করা যায় বলোতো?”

অনিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান হেসে বলল,

” কফি খাবে? ক্লান্তি কেটে যাবে। আর গল্পও করতে পারব।”

অনিমা কিছু না বলে মাথা নিচু করে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ‘ একটু আগেই তো কফি খেল, আবার খাবে?’ এই প্রশ্নটা মনে আসলেও, ঠোঁটে আসলো না অনিমার। আদ্রিয়ান আর অনিমার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই চলে গেল কফি আনতে। কয়েক মিনিট পর আদ্রিয়ান দুহাতে দুটো কফির মগ নিয়ে এল। এসে দেখল অনিমা এখনও একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আর বাইরের দিকে দেখছে। আদ্রিয়ান গিয়ে গলা ঝাড়তেই অনিমা চমকে উঠল। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকালো। এতো ভয় কেন পায় মেয়েটা? আদ্রিয়ান অনিমা হাত ধরতেই অনিমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আদ্রিয়ান এবার অনেকটা গায়ের জোরেই অনিমা টেনে ব্যালকনিতে রাখা সোফাটায় বসালো। আদ্রিয়ানের এই ব্যালকনিটা বেশ বড়। আর বৃষ্টিতে বাইরে থেকে জ্বল ছিটেও আসেনা। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে কফির মগ এগিয়ে দিতেই অনিমা একটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপাকাঁপা হাতে মগটা নিল। আদ্রিয়ান কফির মগে চুমুক দিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,

” তুমি কী এরকমই চুপচাপ? না-কি আমায় ভয় পাচ্ছো?”

” ভয় পাওয়াটা কী স্বাভাবিক নয়?”

হঠাৎ অনিমার শান্ত কন্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল আদ্রিয়ান। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

” যাক, এতক্ষণে ম্যাডামের মুখে একটু.. নরমালি কথা ফুটেছে।”

অনিমা আবারও বলল,

” আমি সেখান থেকে বেড়িয়ে এলাম কীকরে? আমার কিছুই মনে পরছে না কেন? হ্যাঁ মনে পরছে কিন্তু আবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সবটা ঝাপসা! কেন স্পষ্ট মনে পরছেনা? কী হচ্ছে আমার সাথে?”

বলে আবার মাথার চুল খামচে ধরতে গেলেই আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে ফেলল। তারপর নরম কন্ঠে বলল,

” আপাতত কিচ্ছু মনে করতে হবেনা। কফিটা চুপচাপ খেয়ে নাও। ভালো লাগবে?”

অনিমা হালকা চেঁচিয়ে বলল,

” কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? আমার মাথা এত ব্যাথা কেন করছে?

” তোমার এখন একটু রিলাক্স করা দরকার। প্রচন্ড ট্রেসের মধ্যে আছো তাই এমন হচ্ছে। কফিটা খেলে ঠিক হয়ে যাবে। খাও!”

অনিমা আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকাল। আদ্রিয়ান হাসি মুখেই চোখের ইশারায় ওকে কফিটা শেষ করতে বলল। অনিমা মনে অনেক সংকোচ আর প্রশ্ন নিয়ে আস্তে আস্তে কফির মগে চুমুক দিল। আদ্রিয়ান এবার অনিমাকে আরও স্বাভাবিক করতে বলল,

” আচ্ছা! আমাকে আগে কখনও দেখেছো তুমি?”

অনিমা আনমনেই বাইরের দিকটা দেখতে দেখতে বলল,

” আপনার গান আমি রোজ শুনতাম। আমার মন ভালো করার ঔষধ ছিল আপনার গান।”

আদ্রিয়ান টেডি স্টাইলে হাসল। এরপর একটু গলা ঝেড়ে বলল,

” শুনতে? কেন? এখন আর শোননা? আমার গলা খারাপ হয়ে গেছে এখন?”

” না, আমার ভাগ্য খারাপ হয়ে গেছে।”

অনিমার এই অতি স্বাভাবিক ভাব প্রকাশটা আদ্রিয়ানের কাছে অতি অস্বাভাবিক লাগলো। অনিমা ধীরে ধীরে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। আদ্রিয়ানও আর কোন কথা বলল না। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে অনিমাকে দেখেই যাচ্ছিল ও। বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। কফি শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাইরের বৃষ্টির গতি কমে গেছে। খুবই ধীরে পরছে এখন। অনেকক্ষণ পরপর আকাশটা চমৎকার ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠতে। তবে বজ্রপাতের শব্দেটা এখন আর নেই বললেই চলে। অনিমা একদম চুপ করে আছে। একটা অস্বস্তিকর নিরবতা বিরাজ করছে চারপাশে। সেই নিরবতা কাটাতে আদ্রিয়ান বলল,

” তোমার কী এখন কিছু প্রয়োজন?”

অনিমা অনেকটা টলতে টলতে বলল,

” ঘুম! ঘুম পাচ্ছে আমার।”

আদ্রিয়ান জানতো এমন কিছু একটাই হবে তাই অনিমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে উঠিয়ে দাঁড় করালো। এরপর আস্তে আস্তে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চাদরটা ঠিকভাবে গায়ে জড়িয়ে দিল। অনিমার চোখে প্রচন্ড ঘুম ভর করেছে। চোখে পাতা খুব ভারী লাগছে। খুলে রাখতে পারছেনা কিছুতেই। অনিমা আস্তে করে বলে উঠল,

” আব্বু একটু বিলি কেটে দাও না।”

আদ্রিয়ান কথাটা শুনতে পেল। ও হাসল অনিমার এই বাচ্চা আবদারে। আলতো করে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” ঘুমিয়ে পরো, আমি বিলি কেটে দিচ্ছি।”

বলে আলতো হাতে বিলি কাটতে শুরু করল অনিমার মাথায়। ও কী করছে নিজেই বুঝতে পারছেনা। মাথায় হাত রেখে হলেও এই প্রথম কোন অপরিচিত মেয়েকে এভাবে স্পর্শ করছে ও। কিন্তু এই মেয়েটার করুণ আবদার আদ্রিয়ানের মনে নাড়া দিয়েছে। ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এটা মেয়েটার প্রতি ওর সহানুভূতি। অন্যকিছুতো না। নিজের মনকে এটাই বোঝালো আদ্রিয়ান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিমা পুরোপুরি ঘুমিয়ে পরল। আদ্রিয়ান জানতো এমনটা হবে কারণ কফির সাথে ঘুমের ঔষধ মেশানো ছিল। আসলে ঐরকম কিছু হওয়াতে অনিমা শক পেয়েছে ভীষন। তাই এরকম অস্বাভাবিক ব্যবহার করছিল হয়ত।আর মেয়েটাকে শক থেকে বেড় করতে আগে একটা প্রপার ঘুম দরকার। কাল সকালে ওঠার পর ঠিক স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এটাই বিশ্বাস আদ্রিয়ানের। আদ্রিয়ান উঠে যেতে নিলেই অনিমার কন্ঠ শুনে থেকে গেল। অনিমা ঘুমের ঘোরেই কাঁদোকাঁদো কন্ঠে কিছু একটা বলছে। আদ্রিয়ান অনিমার পাশে বসল। কান পেতে শুনতে চাইল ও কী বলতে চায়। অনিমা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলছে,

” আব্বু আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ। এখানে সবাই খুব খারাপ আব্বু। খুব খারাপ ওরা সবাই। আমি এখানে থাকব না। তোমার কাছে যাবো, প্লিজ নিয়ে যাও।”

এটুকু বলে থেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার বলল,

” ঐ ছেলেটা আরও খারাপ। জঘন্য খারাপ। আমি, আমি আর রি..”

আদ্রিয়ান আর কিছু শুনতে পেলনা আদ্রিয়ান তার আগেই অনিমা চুপ হয়ে গেল। আদ্রিয়ান একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। কী হয়েছে সেটাতো ওর জানা নেই। কিন্তু যা-ই হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি। আদ্রিয়ান উঠে গিয়ে নতুন কয়েকটা মোম জ্বালালো আদ্রিয়ান। সবগুলো মমবাতি জায়গা মত রেখে সোফায় গিয়ে হেলান দিয়ে বসল। আজ রাত ঘুমাবেনা ও। মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখাটা জরুরী। থুতনিতে হাত রেখে একদৃষ্টিতে দেখতে অনিমা মুখটা। আজকেই তো প্রথম দেখল এই মেয়েটাকে। মাত্র কয়েকঘন্টার পরিচয় ওর সাথে। কিন্তু এই অল্প সময়ের একটা মায়া কাজ করছে ওর অনিমার প্রতি। অদ্ভুত এক টান অনুভব করছে। কী আছে মেয়েটার মধ্যে? এত মায়া কীকরে? নিজের চারপাশে যেন আস্ত এক মাথায় আবরণী তৈরী করে রেখেছে। কী বলা যায় এরকম মেয়েকে? এতো আস্ত এক মায়াবিনী? মায়াবিনী! বাহ, নামটাতো বেশ! মেয়েটার সাথে বেশ মানানসই। ওকে মায়াবিনীই বলা যেতে পারে। ওর মায়াবিনী। ওর? সত্যিই কী ওর? ওর হোক, বা না হোক মায়াবিনী তো? সকলেই মায়ায় পরতে বাধ্য। সকলেই? যদি তাই হত তাহলে মেয়েটার অবস্থা এরকম কেন? কিছু মানুষরূপী অমানুষ তো অবশ্যই আছে যাদের মনে এই কোমল মায়াবিনীর কোন মায়াই প্রভাব ফেলেনা। তাইতো তারা এত নিষ্ঠুর হয়েছে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে এক নির্ঘুম বর্ষণের এক রাত পার করে ফেলল আদ্রিয়ান।

_____________

সকাল বেলা সোফায় আয়েশ করে বসে চা খেতে খেতে নিউস পেপার সবে হাতে নিয়েছেন রঞ্জিত চৌধুরী। হঠাৎ করেই হন্তদন্ত হয়ে বাইরে থেকে একটা অল্পবয়সী ছেলে এল । হাফানো কন্ঠে বলল,

” ঝামেলা হয়ে গেছে স্যার।”

রঞ্জিত চৌধুরী বিরক্তি নিয়ে বললেন,

” সকাল সকাল আবার কী হল?”

” ভাবীকে আমরা..”

রঞ্জিত চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ছেলেটা ইতস্তত করে বলল,

” না মানে ঐ মেয়েটাকে আমরা যেই গ্যাং এর কাছে দিয়ে এসছিলাম তারা কাল রাতে মেয়ে বিক্রি করার সময় পুলিশের হাতে ধরা পরে যায়। আর মেয়েগুলোও ছাড়া পেয়ে গেছে তার মধ্যে ভা.. অব্ ঐ মেয়েটাও ছিল।”

রঞ্জিত চৌধুরী চোখ মুখ রাগে হিংস্র হয়ে উঠল। এত কষ্ট করে সব প্লান করল। অথচ কী ফল এটা? উনি রাগী কন্ঠে বলল,

” পুলিশ ওখানে কীকরে পৌছালো?”

ছেলেটা অসহায় মুখ করে বলল,

” আমি তা জানিনা স্যার।”

” মেয়েটা কোথায়?”

” পুলিশ নিয়ে গেছিল। সেখান থেকে কোথায় গেছে তা কেউ জানেনা।”

” মেয়েটাকে খোঁজার ব্যবস্থা কর যা। তাড়াতাড়ি।”

ছেলেটা যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে বলল,

” স্যার ভাই ফোন করেছিল। উনি পরের মাসেই বাংলাদেশ আসছেন।”

এটা শুনে রঞ্জিত চৌধুরী রাগ আর ভয় দুটোই হল। চায়ের কাপ আছাড় মেরে বললেন,

” জাহান্নামে যা।”

ছেলেটা ভয় পেয়ে একপ্রকার দৌড়ে চলে গেল। রঞ্জিত চৌধুরী তাড়াতাড়ি সোফায় বসলেন। অতিরিক্ত উত্তেজনা তার শরীরের জন্যে এমনিতেও ভালো না। কিন্তু করবেন টা কী? একটা ঝামেলা মেটাতে গিয়ে বিশাল এক ঝামেলা এসে পরেছে তার কাঁধে। উনি কিছু একটা ভেবে বিড়বিড় করে বললেন,

” নাহ ও ফিরে আসার আগে ঐ মেয়ের ব্যবস্হা করতেই হবে। ও এসব জানলে সব ভেস্তে যাবে। তার আগে আমায় একবার আমার শালকের সাথে কথা বলতে হবে।”

বলেই কোথাও একটা ফোন লাগালেন উনি। যা করার দ্রুত করতে হবে খুব দ্রুত।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে