বন্ধুত্বের সারাবেলা

0
594
আমার বন্ধু মুহিত দীর্ঘ তিন বছর পর আজ অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেছে ৷ এয়ারপোর্টে আমাকে দেখেই ও বলল, ‘দস্ত বাড়ি যাওয়ার আগে চল কোথাও বসে চা সিগারেট খাই৷ অনেক দিন টং দোকানে চা খাইনা ৷ দেশে থাকতে যারা টং দোকানে চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা দেয়, দেশের বাইরে গেলে এই চায়ের আড্ডাটা তারা খুব মিস করে ৷ তাছাড়া কত দিন বাদে তোর সাথে দেখা ৷ চা খেতে খেতে সব কথা বলা যাবে৷’ আমি মনে মনে বললাম, ‘হ্যা, অনেক দিন পর নতুন করে বাঁশ খেতে যাচ্ছি ৷ তুই কাছে থাকা মানে বিপদের বন্ধু হয়ে যাওয়া৷’ মুহিতের কারনে আমরা বন্ধুরা কলেজে থাকতে বেশ বড় রকমের ঝামেলার মধ্যে পড়েছিলাম৷ যেহেতু আমি ওর ভাই এর মত বন্ধু ৷ কাজেই সব চেয়ে বেশি ঝামেলায় আমাকেই পড়তে হয়েছিলো৷
তখন আমরা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি ৷ ক্লাস ফাঁকি দেয়ার অপরাধে আমাদের দুই জনকে ডাকা হলো প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ৷ আমরা নিষ্ঠার সাথে, অপরাধের মাথা ঝুকে দাঁড়িয়ে আছি৷ প্রিন্সিপাল স্যার মন দিয়ে কাগজে কি যেন লিখছে৷ এই সময়ে আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, চোরের মুখে যে মায়া মমতা থাকে এবং ফাঁশির পূর্বে অপরাধীর মুখে যেই অসহায়ত্ব লেখা থাকে যে, এই বার বেঁচে গেলে আজীবন ভালো হয়ে চলব৷ এই দুটি ভাব মিশে আমাদের মুখে লেগে আছে ৷ কিছুখন পর মুহিতের আচরন ব্যাতিক্রম হয়ে উঠলো ৷ ও রীতিমত কোমর নাচিয়ে বেলি ডান্স দেয়া শুরু করলো ৷ আমি ওকে খুঁচিয়ে বা চোখের ইশারায় স্বাভাবিক হতে বলেও কোন লাভ হয়নি ৷ সে ক্রমাগত উফ! নাহ! উফ!– শব্দ মুখ দিয়ে বের করতে লাগলো৷ প্রিন্সিপাল স্যার লেখা শেষ না করেই মুহিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন সমস্যা?’ কোমর নাচন চলমান রেখেই মুহিত বলল, ‘উফ! নাহ!’ — ‘এমন অস্বাভাবিক আচরন কেন করছো? সোঁজা হয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াও৷’ — ‘উফ নাহ! পারছি নাহ! উফ’…! সকালে ক্লিন শেভ করা স্যারের ফ্রেশ মুখখানায় রাগের আগমন ঘটলো ৷ আমি সেটি দেখেও টেনশনে পড়ে গেলাম মুহিতকে নিয়ে ৷ কারন ওর খুব জোরে বাথরুম ধরেছে ৷ স্যারের রাগ কোন মতে সামলে নিতে পারলেও, ঐ মুহূর্তে মুহিতকে সামলানো অসম্ভব৷
আমি কমল স্বরে ব্যস্ত ভাবে স্যারকে বললাম, ‘স্যার, ওর খুব বাথরুম পেয়েছে ৷ ওর পেট ভালো না৷’ সে মুহূর্তে কলেজের জনপ্রিয় ক্রাশ আমেনা বানু৷ যার ফেসবুক আইডি নাম আরিদ্ধা স্পৃহা, স্যারের ঘরে প্রবেশ করলে, ওর সামনে আত্মসম্মান না খোয়ানোর জন্য মুহিত বলল, ‘আই এম ওকেহ স্যার৷’ স্যার এক পলক মুহিতের দিকে তাকিয়ে, আমেনা বানুর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন, ‘কি দরকার মা’…? আমেনা বানু চুলের বেণী নাচিয়ে খিল খিল শব্দে বলল, স্যার আমি গত নয় দিন ক্লাসে আসিনি ৷ একটু সর্দি জ্বর হয়েছিলো ৷ সেটির দরখাস্ত নিয়ে এসেছি৷ স্যার গ্যাড়া দাঁত বের করে এমন ভাবে হাসলেন, দেখে মনে হয়েছে বানুর কথায় তিনি অত্যন্ত লজ্জা পেয়েছে৷ হাত বাড়িয়ে দরখাস্তটি নিয়ে বানুকে বলল, ‘ঠিক আছে৷ তুমি এখন যাও৷’ বানু চলে গেলে মুহিতের বেলি ডান্স আবার শুরু হয় ৷ ওর অবস্থা একদম লাস্ট স্টেজে এসে ঠেকেছে৷ কোন দুর্ঘটনা ঘটবার আগেই ও দৌঁড়িয়ে স্যারের বাথরুমে ঢুকে পড়ে৷ মহোদয় মুহিতের ওপরের রাগটা ঝাড়লেন আমার ওপর ৷ খুব টেকনিকেলি ঝাড়লেন৷ মাইরেও দেয়নি ৷ বাসায়ও জানায়নি৷ শুধু সাদা কাগজে আমার সাক্ষর নিলেন৷ এবং বললেন, এর পর দুই দিন ক্লাসে অনুপস্থিত দেখলে এই কাগজে যা খুশি তা লিখে দুই জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে ৷ সাথে আরো জুরে দিলেন, আমি উপস্থিত থাকলেও, মুহিত ক্লাসে না আসলে সেই শাস্তি আমার কাঁধে এসে জুটবে৷ কাজেই মুহিতকে ক্লাসে রাখার বড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এরপর নিয়মিত ক্লাস করেছি৷ কিন্তু নিয়মিত ছাত্র হওয়ার পরেও মুহিতের কারনে আরেকবার ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম৷ তো একদিন সকালে ক্লাসে ঢুকে দেখি মুহিত গম্ভীর মুখে বসে আছে ৷ ওর ফর্সা চেহারাটায় কালো মেঘ জমে আছে ৷ বুঝলাম কোন একটি বিষয়ে ও চিন্তিত কিংবা মন খারাপ ৷ বন্ধুর খারাপ সময়ে আমি কতটা সিরিয়াস হতে পারি তাই দেখানোর জন্য একটু ঢং করে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘কি হইছে বন্ধু? হইছে টা কি…?’ ও মুখ দিয়ে ফুঁস করে একটা শব্দ বের করে আর কিছু বলল না ৷ কিন্তু হাব ভাবে বুঝতে পারলাম যে সমস্যাটা প্রেম জনিত৷ কারন নিশি নামের একটি মেয়ের সাথে ওর নতুন সম্পর্ক হয়েছে ৷ ও যেভাবে মেয়েটির কাছে থেকে যা আশা করছে, তা পাচ্ছে না৷ হয়তো সে বিষয়েই চিন্তাগ্রস্ত ৷ আমি ওর পেটে খোঁচা দিয়ে বললাম, ‘নিশির সাথে কোন ঝামেলা হইছে?’ ও আবার মুখ দিয়ে ফুঁশ করে শব্দ বের করে বলল, ‘না মামা৷ ওর সাথে ঝামেলা হলে চিন্তার কিছু ছিল না ৷ যেই ঝামেলাটা হইছে সেটা বড় ধরনের ৷ কালকে রাতে আয়েশা ম্যাডামকে মেসেজ দিয়ে বলেছিলাম— ম্যাডাম কালকে ক্লাস হবে? ম্যাডাম হ্যা রিপ্লে দিল ৷ আমি সিন করে নিশির সাথে চ্যাট করতে লাগলাম ৷ চ্যাটের মাঝে একটা সিগারেট ধরিয়ে ওকে লিখলাম, জানো নিশি, আমি কখনও কাউকে কিস করি নাই৷ কিভাবে করে তাও জানিনা৷ আমার বন্ধু মুহিত বলেছে আমি যেন তোমার গালে একটা কিস দেই৷ উউমমাাহহহ…! তোমার ভালো লেগেছে? ও রিপ্লে দিল, ‘মুহিত ছেলেটা কোনটা?’
তোর আর আমার ছবি ওকে দিয়ে বললাম, ‘এইযে আমার পাশের জন৷’ ও সিন করে রিপ্লে দিল, ‘সকালে ক্লাসে দেখা হবে৷’ আমি ওর এই মেসেজের অর্থ বুঝতে না পেরে, মেসেজটি আবার পড়তেই মেসেঞ্জারের নামে চোখ পড়ল ৷ নামটি দেখার সাথে সাথেই আমার মরহুম ছোট কাকার স্ট্রোক করে মৃত্যুর দৃশ্যটি চোখে ভেসে উঠলো ৷ স্ট্রোক করার পূর্বের সব লক্ষনগুলো আমার মধ্যে অনুভব করতে লাগলাম৷ হায় আল্লাহ! নিশি ভেবে আমি আয়েশা ম্যাডামকে একি বললাম ৷ আবেগের প্রেসার এত হাই হয়েছিলো যে আমি কার সাথে চ্যাট করছি তাই বুঝলাম না! আমি মুহিতের কথা শোনে মাতৃভাষা হারিয়ে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছি ৷ চুপ করে বসে থাকতেই আয়েশা ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন৷ উনি আমাদের হিসাব বিজ্ঞান পড়ান৷ কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়ে আমাদের কলেজে চাকরি নিয়েছে৷ ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন ৷ ম্যাডামের সুশ্রী চেহারায় এককালে ভারতবর্ষের মহিলা সিরিয়াল কিলার, ফুলান দেবীর রূপটা চলে এলো৷ ফুলান দেবী বেহমাই গ্রামে এক লাইনে ২২জন ঠাকুরকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে ৷ আর আমরা তো কেবল দুজন৷ ম্যাডামের জন্য কাজটা খুব সহজ বলেই মনে হচ্ছে৷ বুকের ওপর হাত দুটি আবদ্ধ করে, ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আলাভোলা বন্ধুকে দিয়ে ম্যাডামের সাথে বেয়াদবি করো৷ এর পরিনাম কি জানো?’ আমি পরিনাম জানার জন্য ম্যাডামের মুখে তাকালাম ৷ সে এক পাশের রহস্যের হাসি হেসে ক্লাস না করিয়েই বেরিয়ে গেলেন৷ ম্যাডামের সেই হাসির রহস্য উদঘাটন হলো টেস্টের রেজাল্ট দেয়ার পর ৷ আমি যে হিসাব বিজ্ঞানে ফেইল করব ৷ এবং এই ফেইলের কারনে গার্ডিয়ান নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা লাগবে৷ ম্যাডাম এই দৃশ্যট সেদিন অগ্রিম ভেবেই ঐ মুচকি হাসিটা দিয়েছিলেন৷ সেই ঘটনার পর মুহিতের কারনে আবার ঝামেলায় পড়েছিলাম ৷ এইচ এস সি পরীক্ষার পর ৷ বন্ধুরা মিলে আমাদের বাসার ছাদে বারবিকিউ করার প্লান করলাম ৷ তেল, মসলা, লবন, সিক, কয়লা সব জোগাড় করে মুহিতকে তিন কেজি মুরগি কেনার টাকা দিলাম৷ মুহিতের প্রেমিকা নিশি খুব বড় মনের মানুষ৷ কারন নিশি বড় মন নিয়ে মুহিতের কাছে যখন তখন যা কিছু দরকার তা চেয়ে বসে ৷ আমার বন্ধুটি আবার উদার প্রকৃতির মানুষ ৷ তার সব উদারতা মেয়েদের প্রতি ৷ ওর জীবনে মেয়েদের একটা শ্রেণী করা আছে ৷ ক্রাশেরা এক শ্রেণীর, প্রেমিকা আরেক শ্রেণীর ৷ তো মুহিত সব থেকে বেশি উদার প্রেমিকার জন্য৷ যখন ওকে টাকা দিয়ে পাঠানো হল, তখন নিশি ওকে ফোন দিয়ে আব্দার করে মোবাইলে যেন পঞাশ টাকা ফ্লেক্সি করে দেয় ৷ যেহেতু মুহিত উদার প্রকৃতির মানব ৷ কাজেই ও মুরগি এবং নান রুটি কেনার সব টাকা লোড করে দিয়েছে নিশিকে ৷ তারপর কোথা থেকে যেন দুটা মুরগি ধরে নিয়ে আসে৷ আমরা মুরগি পেয়ে, সেটি কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে মাথা ঘামালাম না ৷ ছাদের ওপর যখনই মুরগি দুটো জবাহ করতে যাব, সে সময়ে হন্তদন্ত হয়ে কয়েক জন মহিলা ও পুরুষ আমার পিতা মাতাকে সাথে করে ছাদে উঠে এসেছে৷ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে একজন মহিলা বলল, ‘এই ছেলেটাই আমাদের মুরগি চুরি করেছে ৷ আমি এটি শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ৷ টাকা দিয়ে মুরগি কিনে আনিয়েছি, চুরি করতে যাব কোন দুঃখে৷ যেই মহিলাটি চুরির প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো, সেই ভদ্র মহিলা আমার হাত থেকে মুরগি কেড়ে নিয়ে বলল, এইতো আমার মুরগি৷ চুরি করে চোরের দলেরা উৎসব করছে৷ তিন বছর পর মুহিতের সাথে বসে সিগারেট ফুঁকছি ৷ পুরোনো সৃতি সব বায়োস্কোপের মত চোখের সামনে ভাসছে ৷ মনে হচ্ছে অতীতের সৃতিগুলো এইতো সেদিনের ৷ বন্ধুত্বের সৃতি বন্ধুত্বের ভালোবাসা কখনো পুরনো হয়না৷ সময়ের কারনে বন্ধুত্বের দূরত্ব বাড়লেও, সৃতি- ভালোবাসা সময়ের দূরত্বকে হার মানিয়ে মনের মধ্যে আজীবন সতেজ থাকে…৷ ( সমাপ্ত ) ~ মাসায়েখ পনি …৷

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে