বন্দিনী পর্ব-০৫

0
453

#বন্দিনী
#পর্ব_৫
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
ঝনঝন শব্দ তুলে টাইলসের মেঝেতে গড়াগড়ি খেলো ছু*রি খানা। শর্মী দু’হাতে মুখ ঢেকে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। কাঁদল অনেকক্ষণ। জীবনে তো পাওয়ার কিচ্ছু নেই, তবুও কেন মায়া বোধ হচ্ছে? কেন হাত কাঁপছে? কেন অবচেতন মন বলছে, না না- এ যে মহাপাপ! এতবড় ভুল তুই করিস না শর্মী। বাবার সামনে কোন মুখে দাঁড়াবি?
শর্মী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বার কয়েক বাবার নামটি ধরে অস্ফুটে উচ্চারণ ও করল। ঠিক এমনই সময়ে মেইন ডোর খোলার শব্দ হলো। শর্মী দ্রুত গতিতে উঠে দাঁড়াল। চোখমুখ মুছতে মুছতেই শাওনের উপস্থিতি টের পেল, তার ঠিক সম্মুখ বরাবর। শাওনের চোখেমুখে ধিকি ধিকি জ্বলা আগুন। শর্মী এগিয়ে আসতে আসতে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

‘কি…কি হয়েছে?’

শাওন জবাব দিলো না। হুট করে ওর চোখ চলে গেল ফ্লোরে, পড়ে থাকা ছু*রিটার দিকে। শাওন এগিয়ে গিয়ে ওটা তুলল।

‘এটা এখানে কেন?’

‘আ..আপেল কা*টতে গিয়ে…পড়ে গেল হাত থেকে…’

শাওন মেদুর মুখে শর্মীর সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘আমার কপালের কোথাও কি লেখা আছে, আমি গাধা?’

শর্মী তড়িঘড়ি করে এদিক ওদিক মাথা নাড়লো,

‘ছিঃ ছিঃ তা কেন থাকতে যাবে!’

‘তাহলে মিথ্যে বলে কি প্রমাণ করতে চাইছো? বাসায় যে আপেল নেই, তা কি আমি জানি না?’

শর্মী দাঁত দিয়ে জিভ কা*টলো সঙ্গে সঙ্গে। মুখ ফসকে আপেলের কথা বলে ফেলেছে! শর্মী নিজের পক্ষে কিছু একটা বলতে নিচ্ছিলো, শাওন এক হাত ঘুরিয়ে ওর ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে এলো বুকের কাছাকাছি।

‘একদম মিথ্যে না, একদম না। যা জানতে চাইবো সত্যি করে বলবি। তুই বেরিয়েছিলি আবার? আবার যোগাযোগ করেছিস জোনাকির সঙ্গে?’

শর্মী ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল।

‘না, একদম না! আমি কীভাবে বের হবো। তুমি আমায় আঁটকে গেছো শাওন।’

‘নিশ্চয়ই কোনো ছলচাতুরী করে বেরিয়েছিস। নইলে ও এতবড় একটা স্টেপ নিতে যাবে কেন! তুই ওকে ম্যাসেজ দিয়েছিস? ফোনকল? বল কি করেছিস?’

‘শাওন, বিশ্বাস করো, আমার মৃ*ত বাবার কসম খেয়ে বলছি, আমি আর জোনাকির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করিনি। আমার কাছে কোনো ফোন নেই। তুমি নিজে আমার ফোনটা ভেঙে দিয়েছো। আমাকে বাসায় লক করে বাইরে যাও। আমি কীভাবে কি করব? বিশ্বাস করো শাওন…’

শাওন ছেড়ে দিলো। শর্মী মিথ্যে বলছে না। ওর বাবার নাম করে ও মিথ্যে বলবেও না। আর ও যা বলেছে তা যুক্তিগত। ওর ফোন সেদিন শাওন ভেঙে ফেলে। এরপর থেকেই শর্মী ওর কাছে বন্দী। বাহিরের আলো পর্যন্ত দেখতে পায় না। ওর পক্ষে সম্ভব নয় জোনাকির সাথে কন্ট্যাক্ট করা। তাহলে কেন নিজের জীবন দিতে গেল জোনাকি! কি এমন কারণ?

শাওন ঝটপট শাওয়ার করে তৈরি হয়ে নিলো। একবার হাসপাতাল যাওয়া প্রয়োজন। বের হওয়ার সময় শর্মী সাহস করে আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না। শাওন তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে আসতে গিয়ে তালা লাগাতে ভুলে গেল। দরজার মুখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো শর্মী। শাওন চলে গেল।

মা-রা টের পেয়েছে অনেকক্ষণ পরে। দারোয়ান এসে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথম খবরটা জানালো। চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে জোনাকির ঘরে গিয়ে দেখল, ও নেই, ঘর ফাঁকা। পরমুহূর্তেই দ্বিতীয় দৌড়ে নিচে এসে দেখল, জোনাকির শরীরটা জ*বাই করা মু*রগীর মতো থরথর করে কাঁপছে। মাথার পেছন দিক দিয়ে র*ক্তে ভেসে যাচ্ছে। হাত-পা, গায়ের কুসুম রঙা জামাটা- সব লাল…টকটকে লাল! চিত্রা একটা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল। ফয়সাল এলো, আশেপাশে থেকে লোকজন এলো, কেউ বোধহয় পুলিশ কল করল, পুলিশ ও এলো। সবাই ধরাধরি করে জোনাকিকে হাসপাতালে ভর্তি করালো।

বাড়ির সবাইকে জেরা করে এক গাদা প্রশ্ন করল পুলিশ। শাওনের সঙ্গেও দেখা হলে তাকেও অনেক গুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হলো। সব শেষে তারা আপাতত বিদায় নিয়ে চলে গেলে ফয়সাল তেঁতে উঠল চিত্রার উপর, হাসপাতালের ওয়েটিং ওয়ার্ডে বসেই।

‘আর কত, আর কত জ্বালাবি তোরা? তোর সাথে আমার কোনো সংসার নাই আর। আজকের পর থেকে তুই তোর মতো, আমি আমার মতো!’

চিত্রা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘এসব কি বলছো তুমি! এতবড় একটা বিপদে…’

‘বিপদ ঘাড়ে টেনে আনলে আমার সেখানে কি বলার আছে? কোন নাগরের জন্য তোর বোন এই কাজ করল দেখ গিয়ে। ফাও ক্যাচালে পড়ব আমি এখন!’

‘তুমি কেন ক্যাচালে পড়বে ফয়সাল? তুমি তো কিছু করোনি।’

‘পুলিশ সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোর? একে তো তোদের বাপ নাই, সংসারের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। তার উপর তোর বোন অবিবাহিত, সুন্দরী। যদি বলে বসে এরা যে আমি কিছু করতে চেয়েছি ওর সাথে যেটা মেনে নিতে না পারায় এই ধরনের কান্ড ঘটিয়েছে, তখন কি বলবি তোরা হ্যাঁ?’

চিত্রা হা-মুখ করে তাকিয়ে রইলো।
মা বললেন,

‘বাবা তুমি একটু শান্ত হও! ও কেন এই কাজ করল, আমি বুঝেছি। খুব ভালো করে বুঝেছি।’

‘বুঝেছি তো আমিও মা। কিন্তু এখন বুঝে লাভ কি? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ওর বেঁচে থাকাটাই এখন..’

চিত্রা কেঁদে ফেলল।
শাওন এগিয়ে এলো এইবার। শক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

‘কি বুঝেছেন আপনারা? আমাকেও একটু বোঝান! জোনাকি এরকম টা কেন করল? একদম সত্যি করে বলবেন, আমি মিথ্যে পছন্দ করি না।’

মা তাকাল, চিত্রাও শক্ত কণ্ঠে জবাবে বলল,

‘আপনার কারণে। ও আপনাকে বিয়ে করতে চায় না। আমরা সবাই জোর করছিলাম, তাই..’

ফয়সাল এগিয়ে এসে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো এ পর্যায়ে।

‘কার সাথে খটরমটর করে কথা বলিস তুই! তোর বোনের সাত কপালের ভাগ্য যে আমার বন্ধু ওকে বিয়ে করতে চেয়েছে। নইলে কি আছে তোদের? ভিখিরি যেন কোথাকার!’

পুনরায় হাত তুলে থাপ্পড় লাগাতে নিলে চিত্রা খপ করে ফয়সালের হাত চেপে ধরে নিজে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ফয়সালের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ ফেলে দিলো।

‘আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, আত্মসম্মান বোধ আছে। অনেক হয়েছে! অ-নে-ক হয়েছে ফয়সাল! আর না…তোমার জুলুম আর সহ্য করব না আমি। তুমি কি সম্পর্ক ভাঙবে, আমিই সব সম্পর্ক ভাঙলাম। তোমার মতো জানোয়ারের সাথে থাকার চেয়ে একা থাকা অতি উত্তম।’

‘এতবড় সাহস! এতবড় সাহস!’

ফয়সাল রাগে কিড়মিড় করতে লাগল। মা দিশেহারা হয়ে কাঁদছেন। একদিকে বড় মেয়ের সংসার ভাঙছে, অন্যদিকে ছোট মেয়েটা ভেতরে- মৃ*ত্যুর সাথে লড়ছে প্রতিটি মুহূর্ত…
শাওন আর ফয়সাল চোখাচোখি করল।

চিত্রা বলে উঠল,

‘সাহসের শুরুটা দেখলে সবে… আরও দেখতে চাও? আর কোথায় কোথায় দাগ ফালাবো, বলো…’

ফয়সাল আক্রোশপ্রসূত এগিয়ে আসতেই পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর রীতিমতো ভূমিকম্প ফেলে দিলো সকলের মাঝে। বিশেষ করে শাওনের ভেতর। পরিচিত কণ্ঠটি গলায় যেন পাথর বেঁধেছে। পাহাড়ের ন্যায় অটল সেই সুর…বলল,

‘রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু! দুই শুয়োর এক হয়েছে…বাহ!’

শর্মী!
শাওন হা করে চেয়ে রইলো। ফয়সালও চিনলো। শর্মীর ব্যাপারে সেও জানে। সব জেনেও রাজী হয়েছিল। মূলত শাওনই প্রস্তাব দিয়েছিল। জোনাকির সৌন্দর্য ওকে প্রলুব্ধ করেছে। ফয়সাল ভেবে দেখল, কোনো কিছু ছাড়াই বিদেয় করতে পারলে,ক্ষতি কি? শাওন বলেছিল, যতদিন বিয়েটা না হচ্ছে, ততদিন শর্মীকে আঁটকে রাখবে ও। তারপর বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে পরেরটা পরে দেখা যাবে। হয়তো শর্মীকে তালাক দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললেও ফেলতে পারে!

শাওন গটগট পায়ে এগিয়ে গিয়ে শর্মীর সামনে দাঁড়াল। কণ্ঠস্বর নিচুতে নিয়ে দাঁতে দাঁত ঘঁষে জিজ্ঞেস করল,

‘এসব কি হচ্ছে! তুমি এখানে কেন?’

শর্মী হাসল,

‘সতীনের এতবড় বিপদ, দেখতে আসবো না?’

‘নাটক করো না। চুপচাপ বাসায় যাও। নইলে… ‘

‘আবার মা*রবে? গায়ে হাত তুলবে? এছাড়া আর কোন যোগ্যতাটা আছে তোমার বলো তো!’

‘শর্মী!’

‘চিৎকার করলে উঁচু গলায় করো। বিড়ালের মতো মিনমিন করছো কেন?’

শাওন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ কোন শর্মীকে দেখছে সে!

শর্মী বলল,

‘দেখে নাও, দেখে নাও, মনপ্রাণ খুলে দেখে নাও। হয়তো আজকের এই দেখাই আমাদের শেষ দেখা!’

‘মানে?’

‘মানে এরপর তো তুমি চলে যাচ্ছো জেলে। ওখানে নিশ্চয়ই টিফিন সাজিয়ে আমি দেখা করতে আসবো না!’

‘হোয়াট রাবিশ! শর্মী তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?’

‘পাগল ছিলাম! এখন সুস্থ হইছি।’

পেছনে উৎসুক জনতার মতো সবাই চেয়ে। শাওন পুনরায় ওকে চলে যাওয়ার জন্য বলতেই পেছনে এসে দাঁড়াল জনা চারেক অফিসার। শর্মীর হাতে একটা ফাইল। সে শাওনকে দেখিয়েই সিগনেচার করে দিলো।

শাওন জিজ্ঞেস করল,

‘কিসে সাইন দিচ্ছো তুমি? এই শর্মী..’

শর্মী পুনরায় মুচকি হাসল,

‘যেটা চেয়েছিলে এতদিন…ডিভোর্স পেপারে…’

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে