ফ্রেম বন্দী ভালোবাসা পর্ব-০৫

0
807

#ফ্রেম_বন্দী_ভালোবাসা
#পর্ব:5
#সুরাইয়া_আয়াত

জ্ঞান হারানো মাত্রই স্নিগ্ধতাকে তুলে গাড়ীতে বসাল সৌরভ , তবে সবটা অজানা জন্য কাছে যে এরপর কোথায় যাবে আর মেয়েটাকে নিরাপদে তার বাড়িতে পৌছে দিতে পারবে। কিছুই জানে না যে ও, মেয়েটার বাড়ি কোথায়, তার নামটা কি, কিছু জানে না সৌরভ। মেয়েটার কাছে আদৌ কোন ফোন আছে কি সে বিষয়টা নিয়ে খানিকটা ভাবলো ও।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়া মাত্রই কথাগুলো মাথায় আসতে শুরু করলো, মেয়েটার জ্ঞান থাকলে হয়তো মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করা যেত যে তার বাড়ি কোথায় যদিও সে সুযোগটি সৌরভের হতো কি তা ওর জানা নেই কারণ স্নিগ্ধতা হয়তো কখনোই এত স্বাভাবিক ভাবে সৌরভের পাশের সিটে বসে ওর সাথে স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলতে পারতো না।
কি করবে বুঝতে না পেরে স্নিগ্ধতার দিকে তাকালো সৌরভ, পড়ে গিয়ে হাতটা খানিকটা কেটে গেছে সেই কাটা জায়গা থেকে ছিটে ছিটে রক্ত বেরোচ্ছে কিছু কিছু জায়গায়, ঠোঁট কেটে যে রক্ত বার হয়েছে সেই রক্তটা শুকিয়ে গেছে আর ঠোঁটের কোণে কালচে বর্ন ধারন করেছে।
ধীরে ধীরে স্নিগ্ধতার দিক থেকে চোখ সরালো সৌরভ, হতবিহ্বল লাগছে নিজেকে, মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়।

অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা চালাচ্ছে এই ছোট্ট মস্তিষ্কে কিন্তু সাফল্য পাচ্ছে না খুব একটা। পুনরায় স্নিগ্ধতার দিক থাকলো , খুব গভীর ভাবে তাকালো আর ভাবতে চেষ্টা করলো।

স্নিগ্ধতাকে এখানে আশফি আর সিয়াম মাঝ রাস্তা থেকে ফেরার পথে কিডন্যাপ করেছে, ভাভর্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে ঘটনাটা ঘটেছে তাই নিশ্চয়ই স্নিগ্ধতার কাছে কোন ব্যাগ ছিল আর তাতে কম সে কম কিছু একটা হলেও এমন কিছু থাকবে যাতে এটা জানা যাবে যে মেয়েটার ফোন নাম্বার বা বাড়ি কোথায় বা হয়তো তার নাম। গাড়ি থেকে নামলো সৌরভ, ছুটলো নিজের ঘরের দিকে। তড়িঘড়ি রুমে ঢুকে এদিক ওদিক দেখলো ও। সারা রুমে চোখ বোলালো যে কোথাও ব্যাগ আছে কি কিন্তু সুবিধার হলো না বিশেষ, বিছানায় বসে আশফিকে কল করতে যাবে তখনই চোখ গেল রুমের এক কর্নারে থাকা চেয়ারের নীচে, একটা লেডিস ব্যাগ পড়ে রয়েছে, ছুটে গিয়ে সেটা তুলে নিলোও যেন এক্ষুনি ওটা কেও চুরি করে নেবে। ব্যাগটা নিয়ে পাশে রাখলো, ক্ষনিকের দৌড়াদৌড়িতে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে ওর। নিশ্বাস প্রস্বাসের হার স্বাভাবিক হলেই ব্যাগটাতে দৃষ্টিপাত করলো। প্রথমে খানিকটা সংকোচ বোধ হলো যে অন্যর ব্যাগ এ এভাবে না বলে হাত দেওয়া উচিত কি না আর দিলেও তা চূড়ান্ত অপরাধ,। সেই অপরাধবোধে হাত কাঁপছে সৌরভের, কিন্তু এছাড়া উপায় নেই, ব্যাগটা না খুললে জানতেও পারবে না যে মেয়েটার বাড়ি কোথায় তাই দ্বিধা বোধ কাটিয়ে ব্যাগটা খুললো, বেশি কিছু না থাকলেও ব্যাগে একটা হিসাব বিজ্ঞান এর বই পেলো সৌরভ কিন্তু এটা এই মুহূর্তে যে ওর কোন কাজের না তা সৌরভের বুঝতে অসুবিধা হলো না। সৌরভ অন্য কিছুর সন্ধানে আছে যেমন কোন নোটবুক বা ডায়েরি যা থেকে কোন ফোন নাম্বার পাওয়া যাবে সহজেই ওর যোগাযোগ করতেও সুবিধা হবে।
ডায়েরিটা অনেক দ্বিধা নিয়ে খুললো সৌরভ, বুঝতে পারছেন না আদেও ঠিক করছে কি। প্রথম পেজ খুলতেই দেখলো বড়ো বড়ো অক্ষর লেখা
“স্নিগ্ধতা এসতেহাম। সেখানে গড়গড় করে ঠিকানাটাও লেখা আছে তবে কোন ফোন নম্বর নেই। এড্রেস দেখে খুশি হলেও রাগ হলো খানিকটা স্নিগ্ধতার বোকামোতে যে মেয়েটা একটা ফোন নাম্বার অবধি লিখে রাখেনি। সৌরভ দাঁত কিঁড়কিঁড় করে বলে উঠলো
” স্টুপিড কোথাকার। ”
কথাটা বলে এড্রেসের ছবি তুলে ডায়েরিটা ব্যাগে ভরতে যাবে তখনি হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেল, বিরক্ত বোধ করে ডায়েরিটা তুলতে গেলেই ডায়েরির খোলা পাতা সামনে এলো।
কিছুটা অগোছালো ভাবে লেখা আবার সেগুলো লেখার পর পেন দিয়ে কাটাকুটি করা তবুও তার লেখা স্পষ্ট।

মানুষ এমনটা কখন করে?

সৌরভ ভাবলো।

যখন কোন মানুষ কোন কিছুর প্রতি অধৈর্য বা বিরক্ত হয়ে পড়ে তখন মনের বিচলতাকে কাটানোর জন্য এমন করে থাকে কারন এতে কষ্টটা লাঘব হয়। কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট হলেও সাইকোলজির প্রথম একটা ধ্যান জ্ঞান আর ভালোবাসা আছে সৌরভের তাই মাঝে মাঝেই লাইব্রেরিতে গিয়ে টুকটাক সাইকোলজির বই পড়ে আর তার একটাই উদ্দেশ্যে মানুষের মন পড়া আর মনের অবস্থা বুঝে কথা বলা ও তার কাজের প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া, কিন্তু স্নিগ্ধতার ক্ষেত্রে কাজটা একদম ব্যাতিক্রম হলো কেন তার উত্তর সৌরভের কাছে নেই। স্নিগ্ধতাকে সৌরভ বুঝতে পারেনি হয়তো বোঝার চেষ্টা করলেও বোঝেনি কারন স্নিগ্ধতার মনের বাইরের শক্ত খোলসের মতো অভিমান আর বিশাদে ভরপুর।
কৌতুহল হলে তাকে আটকানো মুশকিল আর ঠিক এমনটাই হলো, ডায়েরিটা সৌরভ পড়লো, ডায়েরির লেখা গুলো ওকে আকর্ষিত করছে আর তা পড়ার কৌতূহল জাগাচ্ছে বারবার।
” পারছি না আমি আর, আর পারছি না এসব সহ্য করতে, আর কত? আচ্ছা মানুষের সহ্য আর ধৌর্যের সীমা কি এতোটাই ঠুনকো যে এতো সহজে তা ভেঙে যায়। ওরা আর আমার বাবার চরিত্রের সাথে তুলনা করে আমার চরিত্র কেও কলঙ্কিত করেছে। ওরা আমাদের কে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে দেবে না যার চেষ্টা করি প্রতিটি মুহূর্তে। কেন তুমি চলে গেলে বাবা? তুমি কি এতোটাই নিষ্ঠুর যে তোমার স্নিগ্ধ পরীর থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে। জানো কতো রাত আমি গোপনে কাঁদি! ওদের অপমান করে বলা কথা গুলো এক একটা আমার মনে এসে লাগে। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না গো তুমি ফিরে এসো। শেষ করোনা তোমার এই মান অভিমানের পালা।”

কথাগুলো লিখেও কেটে দিয়েছে স্নিগ্ধতা। সৌরভের শরীরের মাঝে যেন বিপরীত পতিক্রিয়া হতে শুরু করলো, একটু আগে যে চোখে রাগ ফুটে উঠছিলো এখন সেই চোখে স্নেহের ছায়া, স্নিগ্ধতার কথা মনে পড়লো ওর, তারমানে মেয়েটা ভালো নেই, মানষিক বিদ্বেষ আর দোটানায় আছে। যার আছে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষিদে কিন্তু চাইলেও দোটানায় সেই ক্ষিদে মেটাতে পারেনা।

সৌরভ আর ডায়েরিটা খুললো না, ব্যাগে ভরে নিলো, হয়তো এই ডায়েরির প্রত্যেকটি পাতায় এমন বিষাদে ভরা কারোর কাতোরউক্তিতে। ব্যাগটা নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল ও, কয়েকদিন বাসায় ফিরবে না ও।
ব্যাগটা গাড়িতে রেখে ড্রাইভ শুরু করলো, লোকেশন ওর জানা।

*

“মেয়েটা এখনো ফিরলো না, রাত গড়িয়ে দিন হলো, এখন আট টা বাজে আমার মেয়েটাতো ফিরলো না আমেনা। ”

আমেনা ঢোক গিলে বলল
” ভাবি ভয় পাইয়ো না, ভয় পাইলে কাম হইবো না, শান্ত থাহো। তোমারে ডর করলে চলবো না। আর একটুহন দেহো তারপর না হয় পুলিশের কাছে যামু গা, যদি স্নিগ্ধা ফিইরা আসে। ”

কথাটা শোনা মাত্রই লিলুফা উঠে দাঁড়লেন।
“নাহ আর দেরি করলে হবে না, এক্ষুনি যেতে হবে, আমার মেয়ে কোথায় গেল জানতে হবে। ”

কথাটা বলে ঘর থেকে বেরোলো লিলুফা, ওনাকে উঠতে দেখা আমেনাও ছুটে গেলেন। লিলুফা বাসা থেকে দু পা নামাতেই থমকে গেলেন, মাথায় কাপড় টেনে সামনের দিকে থমথমে হয়ে চেয়ে রইলেন। সামনে এক ছেলে স্নিগ্ধতাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে এমনভাবে যে এই মেয়েটার বাড়ি একটা বস্তি এলাকায় হতে পারে তা ও ভাবেনি। লিলুফা ছুটে স্নিগ্ধতা বলে চিৎকার দিতেই সৌরভ ওনার দিকে তাকালো, উনি কাঁদছেন আর স্নিগ্ধতার মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। সৌরভ ওনাকে দেখে বলল
” স্নিগ্ধতা আপনার মেয়ে? ”

উনি স্নিগ্ধতার মাথায় চুমু দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন
” হমম, আমার মেয়ে, কাল রাত থেকে বাসায় ফেরেনি, আমি তো ভাবলাম। ”
কথাটুকু বলে লিলুফা কাঁদতে লাগলেন। সৌরভের মাঝে অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো ওর সামান্য রাগের কারনে না জানি ও কতো জনকে চিন্তায় ফেলেছে। সৌরভ ভাবলো যে ওনাকে সত্য টা বলবে আর যখন কিছু বলতে যাবে তখন আমেনা বলে উঠলো
” এই ছেরা তুমি কেডা। আমাগো মাইয়ারে কই পাইলা? ”

সৌরভ সত্তিটা বলতে গিয়েও বললো না, কোনকিছুর আশঙ্কা করেছে ও। গলিতে ঢোকার পথে একটা বউ স্নিগ্ধতাকে এমন অবস্থায় দেখে নানা নোংরা কথা বলতে লাগলেন আর প্রতিবেশি মহিলা গুলোকেও তা বোঝাতে লাগলেন, সৌরভের বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হলো না যে নিঃসন্দেহে উনি স্নিগ্ধতার শুভাকাঙ্খী নন, আর আমেনাকে দেখও সৌরভ তাই ভাবলো তাই বলল
“স্নিগ্ধতার হাতে এসিড পড়েছিলো ল্যাবে তাই হসপিটালে ছিলো সারারাত, এখন ঠিক আছে। ওকে কোথাও শুইয়ে দিলে ভালো হতো। ”

আমেনার কোঁচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হলো, সন্দেহের রেশটা কমলো স্নিগ্ধতার হাত দেখে তা ব্যান্ডেড করা। আমেনা ওর ঘরে স্নিগ্ধতাকে শুইয়ে দেওয়ার কথা বললো।
সৌরভ গিয়ে স্নিগ্ধতাকে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে কাধ থেকে ব্যাগ খুলে দিয়ে চলে যেতে নিলেই লিলুফা পিছু ডাকলো
” অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, আমার মেয়েটাকে সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে দেওয়া জন্য, আবার এই এই গরিবের ঘরে এসো বাবা। ”

সৌরভ হাসলো তবে হাসিটা ছিলো অর্থহীন, লোক দেখানো হাসি , ভিতর থেকে ও খুশি নয় যা যা হলো তা দেখে।

সৌরভ চলে যেতে নিলেই উনি ডেকে উঠলেন
” বাবা তোমার নামটা বললে না তো। ”

সৌরভ পিছু ঘুরলো না, কেবল বলল
” সৌরভ, আবরার সৌরভ। ”

কথাটা বলে দ্রুত পা চালালো ও, নিজের মাঝে অপরাধ বোধ কাজ করছে ভীষনরকম, হয়তো এর পর যা হবে তার জন্য কেবল ও দায়ী।

#চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে