ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ১১

0
2757

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

নীলিমা আবিরের কথায় কান না দিয়ে আপনমনে ওর জিনিসপত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আবির আবারো বলে-
” Oh, hlw! শুনতে পাচ্ছেন….?”
ভ্রু- কুঁচকে ফিরে তাকায় নীলিমা। আবিরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, এভাবে জ্বালাতন করছেন কেন?
রেগে যায় আবির, What? কি বলছেন আপনি? আমি আপনাকে জ্বালাচ্ছি??? শান্ত গলায় নীলিমার জবাব, তা নয়তো কি? দেখতেই পারছেন আমি ব্যস্ত আছি। তারপরও ষাড়ের মত চিল্লিয়ে’ই যাচ্ছেন….!!!

কি বললেন আপনি? আমি ষাড়? আগের চেয়ে দ্বিগুণ রেগে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে আবির। আলমারি’টা বন্ধ করে ফিরে তাকায় নীলিমা। কোমরে হাত রেখে রাগী মুডে জবাব দেয়, নাহ! আপনি ষাড় নন, ষাড়ের মত। উফফ! যা বাচালের পাল্লায় পরলাম না…..!!!
কথাটা বলে হাতে ঝাড়ু নিয়ে নীলিমা আবিরের স্টাডি রুমের চলে যাচ্ছিল, পথ আগলে দাঁড়ায় আবির। নীলিমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আমি বাচাল???
উত্তর দেয় নীলিমা- আপনি শুধু বাচাল নয়, আপনি সাংঘাতিক রকমের খাটাশও বটে! নীলিমার ঝাড়ু নাড়িয়ে কথা বলা দেখে সে স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিল আবির, খাটাশ শব্দটা শুনে আবার ফিরে আসল।
” কি বললেন আমি খাটাশ?”
অনেকটা রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁতে দাঁত চেপে পাল্টা প্রশ্ন করল নীলিমা, ভাই! আপনি আমায় সত্যি করে একটা কথা বলবেন? আপনি কি জন্ম থেকেই এরকম টাইপের? আবিরের রাগটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবার।
” আপনার সাহস তো কম নয়, আপনি এখন আমার জন্মের দোষ দিচ্ছেন???”
উত্তর দেয় নীলিমা, উল্টাপাল্টা বুঝেন কেন? আমি আপনার জন্মের দোষ দেইনি। আমি জানতে চাচ্ছি আপনি কি জন্মগত ভাবেই এ স্বভাবের অধিকারি নাকি? মানে এই যে মানুষের পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করেন, সেটা আপনার কোন সময়কার অভ্যাস? শৈশবকাল, বাল্যকাল, যৌবনকাল নাকি নাকি এই বয়সের মানে বৃদ্ধকালের….???
——- আমি বৃদ্ধ???(আবির)
—— হ্যা, আপনি বৃদ্ধ? (নীলিমা)
—— প্রমাণ…..(আবির)
——- ২বছর আগে দেখেছিলাম চুল পেকে গেছে, আজ দেখলাম বকবক না করলে ভালোই লাগে না আপনার…(নীলিমা)
——- What?(আবির)
——- এত ইংলিশ বলবেন না। কথায় কথায় ইংলিশ বলা মানুষ নীলি পছন্দ করে না। যায় হোক বৃদ্ধ মানুষ যখন, বুঝিয়ে দেয়াটা নীলির কর্তব্য। নীলি শুনেছে বুড়ো হলে মানুষের চুল পেকে যায় এবং সারাদিন শুধু আজাইরা বকবক করে। ঠিক যেমনটা এখন আপনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে। সেই হিসেবে আপনার এখন বৃদ্ধ কাল। নীলি আশা করছে, ও আপনাকে বুঝাতে পেরেছে। নীলি চায় ওর কথাগুলো ভুল প্রমাণিত হলেও কোনো কথা বলবেন না আপনি। আর যদি বলেই ফেলেন, তাহলে মনে করবেন আপনি সত্যি সত্যি’ই বৃদ্ধকালে আছেন।(নীলিমা)
——- হে আল্লাহ! আমায় বইসহ উপরে উঠিয়ে নিয়ে যাও…..(আবির)
——- হি, হি, হি, হি…(নীলিমা)

Stopped!
কানে হাত দিয়ে জোড়ে চেঁচিয়ে উঠে আবির। কেঁপে উঠে নীলিমা, হাসি বন্ধ হয়ে যায়। নীলিমার বা হাতটা মুঠোয় বন্দি করে ফেলে আবির। তারপর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, নীলি এতকিছু জানে তো এটা জানে না কারো বাসায় অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করা, এভাবে চিল্লিয়ে, ভ্রু- নাচিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলা একধরনের অভদ্রতা….?!!!
আমার প্রশ্ন এখানেই, আত্মসম্মান বলতে যে একটা জিনিস আছে সেটা কি আদৌ নীলির আছে?
——…….. (নীলিমা)
আমার তো মনে হয় নাই। থাকলে ভদ্রলোকের বাড়িতে এভাবে অভদ্রের মত আচরণ করত না। ভদ্র মানুষের মত’ই সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে যেত। কিন্তু নীলি তা না করে রাতের ভিতর বাসায় খবর দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে আসছে। হা, হা! ওকে দেখে তো আমার ব্যাকরণের একটা প্রবাদ মনে পড়ে গেছে, বসতে দিলেই শুইতে চায়। আসলেই, বাঙ্গালির স্বভাব’ই এরকম। ঠিক যেমনটা এখন নীলি অর্থাৎ আপনার মধ্যে দেখছি। কথাগুলো একনিশ্বাসে বলে আবির থামে। প্রতিউত্তরে কিছুই বলেনি নীলিমা। শুধু আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝাড়ু নিয়ে স্টাডিরুমে চলে গেল। আবির গোসল করে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল, প্লেটে করে কয়টা পরোটা আর একটু ডাল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে নীলিমা। একরাশ বিরক্তির দৃষ্টিতে আবির নীলিমার মুখের দিকে তাকায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে নীলিমা, ব্রেকফাস্ট’টা করে যান। খাবারের সাথে রাগ করতে নেই। না খেয়ে চুপচাপ চলে যায় আবির, যাওয়ার আগে শুধু এটুকু বলে যায়-
” বেহায়া মানুষ কোনো কালেই আবিরের পছন্দ ছিল না….”

আবির কলেজে চলে যাওয়ার একটু পর নীলিমাও হসপিটালে চলে যায়। যাওয়ার আগে রুমে তালা লাগিয়ে যায়। দিনটি ছিল বুধবার। কলেজের হাফ ডে। বুধবার দিন কলেজ দুপুর ১টা ২০মিনিটে ছুটি হয়ে যায়। অন্যদিন ছুটির পর স্টাফ রুমে বসে আড্ডা দিলেও সেদিন কেন জানি আবিরের আড্ডায় মন বসছিল না। হালকা টিফিন করে সবার থেকে বিদায় নেয় আবির। গেইট খুলে রুমের সামনে এসে থেমে যায়। দরজায় ইয়া বড় তালা ঝুলানো। রাগে, দুঃখে আবির ওর হাতটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারে। অতঃপর ছাদে চলে যায়। ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে গেইটের সামনে রিক্সা থেকে কেউ একজন নামছে। এ নীলিমা নয়তো…?!!!
দৌঁড়ে নামে আবির ছাদ থেকে। হ্যা, নীলিমায় ছিল। এর’ই মাঝে নীলিমাও সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে। সিড়ির পাশে’ই ময়লা ফেলার ঝুড়ির সাথে পুরনো জুতা রাখার বাক্স রাখা। তার’ই একপাশে পলিথিনে মোড়ে চাবি রাখা। চাবি হাতে নিয়ে মিটমিট হেসে দরজা খুলে নীলিমা। আঁচলে চাবি বাঁধতে বাঁধতে বলে, সংসার চালাতে বুদ্ধি লাগে। সাথে সাথে আবির আঁচল থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে আলমারির উপর ছুঁড়ে মারে। জবাবে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় নীলিমা।

লাঞ্চের জন্য দুপুরে তাড়াহুড়ো করে ভাত তরকারী রান্না করে আনে নীলিমা। টেবিলে খাবার পরিবেশন করে আবিরকে ডাক দেয়- ” শুনছেন? খাবার রেডি।”
কপালে হাত দিয়ে চোখ বোজে চিন্তাজগতে ডুবে গিয়েছিল আবির, ঘোর কাটে নীলিমার ডাকে। শুয়া থেকে উঠে বসে ভ্রু-কুঁচকে বলে উঠে আবির-
” বেহায়া দেখেছি, তবে আপনার মত বেহায়া দেখিনি।”
কষ্ট পায় নীলিমা কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনি। আবার আবিরকেও বিরক্ত করতে চায়নি। তাইতো চুপচাপ আবিরের কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে যায়। কিছু না মুখে দিয়ে’ই খাবারগুলো ঢেকে রেখে দেয়। সন্ধ্যার পর পড়ার জন্য স্টাডি রুম থেকে বই নিতে আসছিল আবির, তখনি নীলিমাকে বিছানায় গড়িয়ে কান্না করতে দেখে। পেটে হাত রেখে ওহ মাগো, ওহ আল্লাহ’গো বিছানার এপাশ ওপাশ করছে নীলিমা। আবিরের ভেতরটা কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠে। বই রেখে ধীর পায়ে আবির নীলিমার পাশে গিয়ে বসে। নরম স্বরে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে নীলিমা? অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় নীলিমা, গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট আর একটু পানি প্লিজ…!!!
আবির ওর রুমে নিয়ে একটা গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট নিয়ে আসে। কিচেন থেকে পানির জগটা আনার সময় কৌতূহলবশত পাতিলের ঢাকনা মেলতে’ই ‘থ’ হয়ে যায়। পাতিল ভর্তি ভাত, তরকারী। না চাইতেও চোখের কোণায় জল চলে আসে আবিরের। গ্লাসে করে একগ্লাস পানি নিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে আবির। গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট আর পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে একগ্লাস পানি খেয়ে নেয় নীলিমা।
” আরেক গ্লাস প্লিজ…..”
আবির পানির জগটা নিয়ে এসে আরো একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয় নীলিমার দিকে। সে পানিটুকুও ঢকঢক করে গিলে ফেলে নীলিমা। আবির আবারো পানি দেয়। এবারো নিমিষেই গ্লাস খালি করে ফেলে। চোখের কোণের জমে থাকা অশ্রু ফোঁটাগুলো একটু একটু করে আবিরের গাল গড়িয়ে নিচে পরছে। কাঁপা হাতে আরো একবার গ্লাস বাড়ায় নীলিমা। আবির জগের অবশিষ্ট পানিটুকু ঢেলে দেয়। এবার একটু পানি মুখে নিয়ে হাতে রাখা ট্যাবলেট’টা খেয়ে সাথে সাথে খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে পরে। আবির বই নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

রাত্রে খাবারের জন্য ডাক দিতেই টেবিলে এসে বসে আবির। খাবার মুখে দেয়ার একপর্যায়ে পাশে দাঁড়ানো নীলিমার মুখের দিকে তাকায় একবার। কিছুটা অস্বস্তিতে পরে যায় আবির। মনে মনে বলে, বুঝলাম না, খাবার’ই তো খাচ্ছি। তার জন্য এমন হা করে তাকিয়ে থাকার কি আছে??? খাওয়া শেষে চলে যাওয়ার সময় বলে যায় আবির, খেয়ে নিন। নীলিমার মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। নজর এড়ায় না আবিরের। এই হাসি’ই একদিন আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পাগলের মত হয়ে যায় আবির। কিছু না বলে ঠাস করে নীলিমার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়।

রাত্রে যে যার মত ঘুমিয়ে পরে। আবির বেডরুমে, নীলিমা স্টাডিরুমে।

প্রবলবেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ঝড়ের তান্ডবে সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। আবিরের রুমের এক জানালা আরেক জানালার সাথে লেগে ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছিল। বাহির থেকে বৃষ্টির ফোঁটা এসে আবিরের রুমের বিছানার চাদর অনেকটা ভিঁজিয়ে দেয়। শুয়া থেকে উঠে বসে জানালাগুলো লাগাতেই স্টাডিরুমের বারান্দার ঐ দিকের জানালার কথা মনে পড়ে। ঐ জানালা তো লাগানো হয়না ২দিন ধরে। এতক্ষণে তো মনে হয় জানালার কাঁচগুলো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। দৌঁড়ে যায় আবির নীলিমাকে ডাকতে। দরজা ধরতেই খুলে যায়। তাড়াতাড়ি ভেঁজা পর্দাটা উঠিয়ে জানালাগুলো লাগিয়ে নেয় আবির।
” দরজাটা লাগিয়ে ঘুমান, চোর ঢুকতে পারে….” এটা বলে খাটের দিকে তাকাতে’ই ভয়ে চমকে যায় আবির। একজোড়া চোখ ওর দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে আল্লাহ নাম জপে লাইটটা অন করে আবির।
—— একি?!!!!
আপনি নিচে গেলেন কেন?(আবির)

এমনিতেই যা শীত, আর উপর প্রবলবেগে ঝড়। শীতে মরার যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল নীলিমার। এদিকে এ রুমে গায়ে দেয়ার জন্য পাতলা কাথা ছাড়া কিচ্ছু নেই। আবিরকে ডাক দিতেও ভয় হচ্ছিল কারণ ওর রুমে যেতে মানা। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়ে’ই অসহায়ের মত খাটের উপর মোটা করে পাতানো লেপের ভেতর ঢুকে যায় নীলিমা।

বিস্ময়ে হতবাক আবির প্রশ্ন করে আবারো-
” খালি খাটে শুইতে গেলে পিঠে ব্যথা পাওয়া যাবে, তাই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলোর নিচে কেন ঢুকেছেন আপনি?”

জবাব দেয় নীলিমা, খুব শীত করছে। তাই…..

আবির ওর রুমে গিয়ে ওর কম্বলটা নিয়ে আসে। ” নিন! এবার দয়া করে বিছানা এলোমেলো না করে এর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসুন।”
নীলিমা নিচ থেকে বেরিয়ে আসে বিছানার উপর। কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুতে’ই লাইট’টা অফ করে দেয় আবির। চলে যাবে ঠিক তখনি হাতে টান পরে। ফিরে তাকায় আবির। অনেকটা করুণ নীলিমার জবাব- আমি এর ভেতরে শুধু শীতের জন্য যায়নি, আমার খুব ভয়ও পাচ্ছিল।
লাইট’টা জ্বালিয়ে প্রশ্ন করে আবির- তো…????
উত্তর দেয় নীলিমা, আজকে এ রুমেই থাকুন না….

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে