প্রিয় নোমান ও সয়ন!

0
651

প্রিয় নোমান ও সয়ন!

আমাদের গ্রামটা এখনো অন্যরকম। শীতকাল। প্রচণ্ড শীত পড়েছে এবার। সন্ধ্যা মেলাতেই হিমহিম করে কুয়াশা নামতে থাকে। আকাশে ঝকঝকে চাঁদ। দেখতে থালার মতো। গাঢ় কুয়াশা আর গাছগাছালির কারণে সেই আলো মাটি পর্যন্ত খুব একটা আসেনা। রাস্তাঘাট নীরব,নির্জন। সামান্য পাতা নড়ার শব্দটুকুও কানে আসে। হঠাৎ হঠাৎ কবুতরখেকো একটা প্রাণী এদিক সেদিক লাফিয়ে পড়ে। নীরবতা আর নির্জনতায় সেই আওয়াজটুকু বেশ বড় হয়ে কানে বাজে। সেকী ভয়ের অনুভূতি! সমগ্র শরীরজুড়ে কেমন একটা হিমহিম শিহরণ খেলে যায়।
বুঝলি “সয়ন”! এই অন্ধকারে যখন তোর বাড়ির সামনে দিয়ে আমি মসজিদে যাই,তখন ইচ্ছা করেই আলো জ্বালিনা। ভাবি,এক্ষুণি তুই অন্ধকারের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলবি,কিরে কেমন আছিস(!) কখন আসলি?তারপর তোর সেই পুরোনো স্বভাব,আমার শরীর চাপড়াতে শুরু করবি। তোর যে কত কথা! সংগীত,কবিতা,আমার প্রতি মিনিটের হিসাব। মুখ যে তোর বন্ধ হয়না। কত পথ আমরা একসাথে হেঁটেছি। বাজারে,পূর্ণিমার রাতে দিঘির পারে,সমস্ত জায়গা ঘোরাঘুরি,সবশেষে কবিরের চায়ের দোকান। কিন্তু এখন?? থাক সে কথা। আচ্ছা তোর ছোট বোনটার কথা কি মনে পরে? বলতে গেলে তোর জান,প্রাণ। ওর সাথে শুয়ে শুয়ে কি জ্বালাতনটাই না করতি ওকে। বারবার গায়ে হাত বুলিয়ে টেনে টেনে বলতি,ভাইয়ের ফা-জিয়া,ভাইয়ের ফু-জি-য়া। যতক্ষণ না ও ঘুমিয়ে পড়ে। আর ও বিরক্ত হয়ে বলতো,ধুর,ধু–র। ওকে কি বলে বুঝ দেয়া হয়েছে জানিস? ভাইয়ার গায়েতো কোন রক্ত নেই,ওখানে শোয়ালে ভাইয়ার গায়ে রক্ত ফিরে আসবে।
সেদিন দেখি তোর বাবা কালো চশমা পরে কেমন এলোমেলো হাঁটছে।
আমি বলি-কী দাদা,কই গেছিলেন?
-একটু আলেখারচর গেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। চোখে কিছু দেখিনা।

আমি আর কিছুই বলিনা। চোখে না দেখার কারণটা আমি বুঝতে পারি। তোর মৃত্যুর পর দাদার চোখে তাকানো যায়না। সবসময় চোখদুটো ছলছল করে। তোর দোয়া অনুষ্ঠানের আগের দিন আমার দু’হাত চেপে ধরে বড় করুণ ভঙ্গিতে তিনি বলেন,ভাইয়া কালকে দোয়ায় থাকবেনতো? তখন আমার দুচোখ ভিজে ওঠেছিলো। সন্তানের শান্তি কামনায় এমন করুণ অনুরোধ পিতা-মাতা ছাড়া কেই-বা করতে পারে?!!

আচ্ছা “নোমান”! তুই কি ইঙ্গিত পেয়েছিলি কোন? নতুবা এমন জ্বলজ্বল স্মৃতিগুলো কেনো রেখে গেলি? তোর ছোট ভাই নূরুর সাথে তোর ঝগড়া নিত্যদিনের। আমাদের সেমিফাইনাল খেলার কথা। ম্যাচের কয়েকদিন আগে তুই অধিনায়ক আরাফাতকে বলেছিলি,নূরুকে শুরুতে নামাবিনা। ‌‌‌‌ভাইয়ারে(তোকে)আগে নামাবি। ‘ঠ্যাকায়া ঠ্যাকায়া খেলুম,দেখবি ম্যাচ জিতে গেছি’। সেই ম্যাচ আর খেলা হয়নি। আত্মীয়দের সাথে কিছুটা মনোমালিন্য ছিলো। কিন্তু আগেরদিন সবার সাথে সেধে সেধে কথা বলে আসলি।এ কাজটা তুই খুব ভালো করেছিস।নতুবা দুঃখ,কষ্টে লোকগুলোর যে…..। শত হোক রক্তের বন্ধনতো। মৃত্যুর আগেরদিন স্ত্রীকে অসিয়তও করলি এবং যাওয়ার সময় বারবার ডেকে বললি,আমার আজ যেতে ভালো লাগছেনা। আমি কি যাবো শারমিন? তোর স্ত্রী বলেছে,মানুষ পঁচিশ বছরে যতটুকু আদর করে,চার বছরে তুই নাকি তারচে বেশি আদর করেছিস। তুই মাঝেমধ্যে দুঃখ করতি,বাবা ছাড়া তোকে কেউ দেখতে পারেনা। এমনকি মা-ও না। কিন্তু এখন তোর জন্যে সবচে বেশি কাঁদে তোর মা। আমার মনে আছে,কোন এক জননী ছেলেদের সাথে প্রচণ্ড ঝগড়ার পর দুধ নিয়ে এসে বলেছিলেন “আমিতো মা-কুত্তা”,তাই বারবার তোদের কাছে আসি। তখন শ্রুতিকটু লেগেছিলো আমার কাছে,এখন বুঝি এর মর্ম। তোর মৃত্যুর পরদিন তোর মেয়ে নুহা কাঁদতে কাঁদতে ঘুম থেকে ওঠে।
-আম্মু আম্মু বাবাতো চলে যাচ্ছে।
-কেমন পোশাক পরে এসেছে বাবা?
-ওই যে কালকে যে সাদা পোশাক পরেছিলো। আমাকে বাবা সারারাত কোলে করে ঘুমিয়েছ। কিন্তু এখন যে চলে যাচ্ছে?

যে রাতে ও তোর জন্য খুব কাঁদে,পরদিন খুব সকালে ওকে কবরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কেমন মায়া মায়া চোখে তাকায় ও।কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলে,যাহ! বাবা এখানে না। ঢাকায় গেছে,আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে। তোর কবুতরপ্রেম ছিলো প্রবল।সকাল-সন্ধ্যা তোর কবুতরগুলো কেমন খাপছাড়াভাবে পড়ে থাকে এখন।

রাত গভীর হয়। পাতায় পাতায় শিশির পড়তে থাকে। পাতার উপর শিশির পড়ার শব্দ শুধু শুনেই অনুভব করা যায়। আমি কান পাতি। কুয়াশাচ্ছন্ন এই শীতের রাত্রে বেওয়ারিশ ভাসতে থাকা শব্দগুলোতে আমি কান পাতি। আমার কানে ভেসে আসে সন্তান হারানোর ব্যথায় কাতর দুই মায়ের চাপা আর্তনাদ।
আমার এ দুর্বল হৃদয়ের একটাই কামনা,তোদের সামনে উদ্ভাসিত হোক এমন এক দিগন্ত,যার মিষ্টি আলোর কোমল পরশে তোরা ছুটে চলবি আলোর দিকে। আলো। শুধু আলো আর আলো।

ইতি
তোদের

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে