প্রিয় অভিমান পর্ব-২২+২৩

0
1029

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২২|

রুহানি টেবিলের উপর মাথা রেখে বসে আছে আর ওর বন্ধুদের বকবক শুনছে। ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে ফালাক ওকে এড়িয়ে চলে গেল। বুঝতে পারছে না এতকিছুর পর ফালাকের না ওর রাগ করার কথা।

রুহানি মাথা তুলে উঠে বসে। ওর ভালো লাগছে না। মন খারাপ আর তার উপর বন্ধুদের এই বকবকানি বিরক্ত লাগছে।

রুহানি উঠে দাঁড়াল। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে নুশা বলল,
“কই যাস এত জবরদস্ত আড্ডা ছেড়ে?”

“তোদের এই জবরদস্ত আড্ডায় বিরক্ত লাগছে। হাওয়া খেয়ে আসি।”

নুশা মিনমিন করে বলল,”প্রেমে পড়লে প্রেমিক ছাড়া সব পানসে লাগে।”

রুহানি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। নুশা মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে বলল,”আমি কিছু বলি নি।”

রুহানি ব্যাগ নিয়ে দুম করে বেরিয়ে গেল। রুহানির রাগ লাগছে ফালাক ওকে এড়িয়ে কেন গেল? সেদিন তো ওই ওকে অপমান করেছিল। রুহানি তো একটা প্রতিউত্তর করে নি। এর জবাব ওর চাই।

ফালাক যেখানে যেখানে থাকতে পারে তার সব জায়গায় খোঁজা শেষ। অবশেষে ফালাককে লাইব্রেরীতে পাওয়া গেল।

ফালাক বই খুলে বসে আছে। শুধুমাত্র পড়ার ভান করে যাচ্ছে। মাথায় ঘুরছে অন্য কিছু। নুশা কেন ডেকেছিল? আর সাথে রুহানিও ছিল। ফালাক এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোর করে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া ব্যস্ত। ফালাক পাতা উল্টাতেই রুহানি নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারে বসল।

রুহানি নিচু গলায় ফালাকের দিকে হেলে বলল,
“ফালাক!”

ফালাক রুহানির দিকে চেয়ে চমকে গেল। ও কখন এসে বসেছে খেয়ালই করে নি।
ফালাককে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
“দু-মিনিট কথা বলতে চাই।”

ফালাক ফিসফিস করে বলল,
“এটা লাইব্রেরী, গল্প করার জায়গা না। তাই প্লিজ কথা বলো না।”

“আমি তো চেঁচিয়ে কথা বলব না।”

ফালাক ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“রুহানি বিরক্ত করো না প্লিজ। আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা কলাম পড়ছি।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে চুপ করে গেল। তারপর সোজা হয়ে বসে রইল। ফালাক আড়চোখে রুহানির দিকে তাকাল। ও গাল ফুলিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছে। ফালাক পাত্তা না দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিল। দুই লাইন পড়ার পর বুঝতে পারল ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি করে ঢুকবে রুহানি ওর পাশে বসে ওর মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। ফালাক বই রেখে উঠে গেল। রুহানি ফালাককে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কনফিউশনে পড়ে গেল ও বসে থাকবে না উঠবে।
ফালাক ওকে বুঝার সময় না দিয়ে হনহন করে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে গেল। রুহানিও দ্রুত লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ফালাকের পেছনে পেছনে গেল।

রুহানিকে পেছনে আসতে দেখে ফালাক বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি চাই তোমার পেছনে পেছনে আসছো কেন?”

রুহানি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর শুকনো হেসে বলল,
“আমি পেছনে পেছনে আসছি না তুমি আমাকে পেছনে পেছনে ঘোরাচ্ছো?”

ফালাক ওর কথা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, এটা তোমাকে বলার পর, তুমি জানার পরেও আমাকে কেন ঘোরাচ্ছো? শুনলেই তো হয়।”

ফালাক নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না? একজন মানুষ যখন বারবার কাউকে এড়িয়ে যায় তার মানে এটাই যে সে মানুষটা তার জন্য বিরক্তিকর। তুমি কি বুঝতে পারছো না তুমি আমার জন্য কতটা বিরক্তিকর?”

রুহানি মাথা নিচু করে নিল। তারপর মাথা উঁচু নিচু করে বুঝাল তার অবস্থান। চোখে পানি চলে এসেছে ওর। এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না। ফালাকের তিক্ত কথাগুলো ওকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। ফালাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।

রুহানি বুঝতে পারছে না ওর দোষটা কোথায়। কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে৷ ফোনের অপর পাশ থেকে নুশা ওকে বিভিন্নভাবে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুহানির একই কথা,
“সেদিন ফালাক আমাকে কত আজেবাজে কথা বলেছে। আমার হোটেলে নাচ করা নিয়ে কটু কথা বলেছে। আমাকে লোভী বলেছে। আমি নাকি টাকার জন্য সব করতে পারি। বাজে ইংগিতও করেছে। এতকিছুর পরেও আমি গিয়েছি ওর কাছে আর ও আমার সাথে কি করলো? নুশা আমি কি এই ব্যবহার ডিজার্ভ করি?”

“একদম না৷ তুই কাঁদছিস কেন? ও তোকে পায়ে ঠেলেছে, ও পস্তাবে। কিন্তু তোকে এর জবাব নিতেই হবে।”

“জবাব নেব কি করে? ও তো আমাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। আমি সুযোগ পেলে তো কিছু বলব? কিন্তু সে সুযোগই পাই না।”

“হামলা কর ওকে। ওর বাড়িতে চলে যা। শুনেছি ভার্সিটির এইদিকে কোন এক ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে গিয়ে ধরবি।”

“কিন্তু নুশা…”

“ডোন্ট ওরি, আমি যাব তোর সাথে। বাইরে অপেক্ষা করব৷ আর তুই কবে থেকে কাউকে ভয় পেতে শুরু করলি?”

“এড্রেস?”

“ম্যানেজ করে নেব। এখন তুই কান্নাকাটি বন্ধ কর।”

রুহানি কান্নাকাটি বন্ধ করলেও ফালাকের ফ্ল্যাটে যাবে এটা ভেবে নার্ভাস লাগছে।

.

মাঝে কেটে গেছে আরো দুটো দিন। রুহানি ফালাকের সাথে দেখা করে অপমান আর ইগ্নোর করার জবাব নেবে। সন্ধ্যা বেলায় রুহানি আর নুশা ফালাকের বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে হাজির। দশ তলা বিল্ডিংয়ের আটতলায় একটা ফ্ল্যাটে ফালাক থাকে।
রুহানি ফালাকের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জোরে একটা শ্বাস নিল। নিজেকে শক্ত করে কলিং বেল চাপল। দু’বার বেল বাজাতেই ফালাক দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। রুহানি ফালাকের চাহুনিকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ফালাক তখনও দরজার সামনে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি হুট করে ওর ফ্ল্যাটে কি করছে?

রুহানি ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক দেখছে। আর উঁকিঝুঁকি মারছে। ফালাক ওর বিহেভিয়ার দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারছে না।
ফালাক দরজা বন্ধ করে রুহানির সামনে গিয়ে বলল,”হুয়াট?”

রুহানি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আর কে থাকে এখানে?”

ফালাক চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“মানে? কে থাকবে? কেউ থাকে না, আমি একাই থাকি। তুমি এই সময় এখানে কি চাও সেটা বলো। পারমিশন ছাড়া হুট করে কারো ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওয়া কোন ধরনের অসভ্যতা?”

রুহানি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আমার মতো মেয়েদের আচরণ তো এমনই। সময়, স্থান কিছুই মানে না৷ প্রয়োজনে যেখানে সেখানে চলে যায়। অবাক হওয়ার কি আছে?”

ফালাক রুহানির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। তারপর বলল,
“এখান থেকে যাও।”

রুহানি সন্দেহ নিয়ে বলল,”দূর দূর করছো কেন? কে আছে এখানে? কাকে ভয় পাচ্ছো?”

তারপর রুহানি ফালাকের রুমের দিকে যাচ্ছিল। ফালাক ওর হাত চেপে ধরে ফ্লাটের বাইরে বেরিয়ে এলো। রুহানি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, ছটফট করছে। ফালাক রুহানিকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। ছাদে নিয়ে রুহানির হাত ছেড়ে দিল।

রুহানি চারদিকে চেয়ে বলল,
“আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?”

ফালাক শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি বুঝেছি তুমি তোমার কথা না বলে আমার পিছ ছাড়বে না। নেও বলো কি বলবে। আমি শুনছি।”

“হ্যাঁ, শুনতে হবে। জবাব চাই আমি। আমার প্রতি তোমার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি? তুমি আমাকে সেদিন এত এত কথা শুনালে, এত আজেবাজে কথা বললে, আমি অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে গেলাম। সেসব নাহয় বাদই দিলাম। তারপর থেকে তুমি আমার সাথে কি আচরণটা করছো? কেন করছো?”

ফালাক রুহানির দিকে আগাতে আগাতে বলল,
“কি করেছি আমি? তোমার থেকে দূরে থাকছি এর বেশি তো কিছু করি নি। না-কি তুমি এটা চাও আমি আগের মতো তোমার পেছনে ঘুরঘুর করি? হাহ! এটাই চাচ্ছো?”

রুহানি পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমি এর কথা বলছি না। তুমি ভালো করেই জানো তুমি কি করছো।”

ফালাক হোহো করে উচ্চস্বরে হেসে বলল,
“আমি একটা মেয়েকে ভালোবেসে ছিলাম কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে নি, অন্য একজনকে ভালোবেসেছে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে তাই আমি তার থেকে সরে এসেছি, তাকে এড়িয়ে চলছি, ভালোবাসার আগুন চোখের পানিতে নিভানোর চেষ্টা করছি। ব্যাস!”

রুহানি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু এখন আর বলতে পারছে না।
ফালাকের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
রুহানি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
“তোমার আমার কথা শোনা উচিত ছিল। সবটা জানা উচিত ছিল। কিছু না জেনে না শুনে কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা কি ঠিক? আহিলের সাথে দু’বছর আগে থেকেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”

রুহানির কথা শুনে ফালাক রিয়েক্ট করতে ভুলে গেল। তার মানে রুহানি অনেক আগে থেকেই অন্য কারো। রুহানির প্রতি অন্য কারো অধিকার। ফালাক শুধুমাত্র তৃতীয় পার্সন হয়ে ওদের মাঝে ঢুকেছিল। ফালাক ছলছলে চোখে বলল,
“বেশ, তাহলে আমিই মাঝে ঢুকে পড়েছিলাম। তোমার এটা আগে বলা উচিত ছিল। রুহানি চলে যাও। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার যন্ত্রণা বাড়িও না। প্লিজ চলে যাও।”

ফালাক চোখের কোনা থেকে পানি মুছে ছাদ থেকে চলে যাচ্ছে। রুহানি ফালাককে ডাকছে কিন্তু ফালাক দাঁড়াচ্ছে না। ফালাকের বুকের ভেতরটা হুহু করছে। উত্তাল পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ একটা চাপা আর্তনাদ যন্ত্রণা দিচ্ছে। রুহানির ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে না।

রুহানি চিৎকার করে বলল,
“ফালাক আই লাভ ইউ।”

ফালাক থমকে দাঁড়িয়ে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে দুঃখে কষ্টে ওর কান গেছে। রুহানি ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ফালাক আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।”

ফালাক ঘুরে দাঁড়াল। রুহানি বসে বসে কাঁদছে। ফালাক ওর দিকে এগিয়ে গেল। রুহানির পাশে বসে কাঁপা গলায় বলল,
“কি বললে তুমি?”

রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। যখনই আহিলের সাথে বিয়ের কথা ভাবি দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রথমে বুঝতে পারি নি, পরবর্তীতে তোমার মুখটা বারবার ভেসে উঠতো। যখন বুঝতে পেরেছি তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি।”

ফালাকের হৃদয় জুড়ে আলোড়ন শুরু হয়েছে। প্রাপ্তির অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীর সুখ ওর কাছে এসে ধরা দিয়েছে।
ফালাক রুহানির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আমি যা শুনতে চেয়েছি তোমার কাছে তুমি বলতে এসেছো অথচ আমি ফিরিয়ে দিয়েছি? কত বড় অপদার্থ আমি।”

“তা তো অবশ্যই। কতবার বলতে চেয়েছি কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি। আমি এতটা টানাপোড়েনের মাঝেও তোমাকে বেছে নিয়েছি কিন্তু তোমার সাপোর্ট পাই নি।

ফালাক অসহায় ফেস করে বলল,
“সরি রুহানি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবে না।”

রুহানি চুপ করে আছে৷ ফালাক দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে বলল,
“বাদামি চোখের কণ্যা মনের লেনদেনটা অফিসিয়ালি হয়ে যাবে কি? গ্রহণ করবে কি আমায় বিল্লিরাণী? ”

রুহানি দু’হাতে চোখের পানি মুছে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে ফালাককে জড়িয়ে ধরল। শুভ পরিণয়ে একে অপরকে বেঁধে নিল।

চলবে…..

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৩|

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পুরো কলোনিতে বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকার কলোনির কর্দমাক্ত রাস্তা বাজ পড়ার কারণে দিনের আলোর মতো ঝলমলিয়ে উঠছে আবার মুহুর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছে। এমনই বর্ষণরত রাতে হাজারো যুবক-যুবতী প্রেম গাথা তৈরি করছে। ছন্দে, উপমায় নিজেদের সুপ্ত অনুভূতি প্রকাশ করছে। ফালাক আর রুহানি ফোনালাপে প্রেম-কাব্য রচনা করছে। রুহানি চাঁদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিল। শীত শীত লাগছে।

ফালাক বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুয়ে বলল,
“রুহানি বারান্দায় এসে দেখো কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে।”

“হু, সাথে বাজ পড়ছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি বারান্দায় যাব না। দরজা বন্ধ করে দিয়েছি অনেক আগে।”

“রুহানি যে এত ভীতু জানতাম না তো। বাজ পড়ার শব্দে ভয় পায়? হাও সুইট!”

“মজা করছো না? আমার সত্যিই ভয় লাগে। হার্ট দুর্বল কি-না তারপর দেখা গেল হার্ট এটাক করে মরে টরে গেলাম।”

ফালাক রাগ দেখিয়ে বলল,
“এসব কি বলো? মরে-টরে যাবে মানে কি? যদি আরেকবার মরে যাওয়ার কথা বলো তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা ভাই, বলব না।”

ফালাক নাক ছিটকে বলল,
“ভাই? সিরিয়াসলি?”

“উমম, তাহলে কি আংকেল লাগো তুমি? আংকেল বলব?”

“কি বলবে সেটা আগামীকাল ভার্সিটিতে আসো তারপর বুঝাচ্ছি। আর শুনো তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

রুহানি উঠে বসে বলল, “কি কথা?”

“সেটা আগামীকাল সামনাসামনি বলব। এখন ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে। আর হ্যাঁ আমাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ভুলো না।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “আচ্ছা। গুড নাইট।”
ফালাক কিছু না বলে কান পেতে রইল। ফালাকের উত্তর না পেয়ে রুহানিও চুপ করে রইল। তারপর মুচকি হেসে ফোন কেটে দিল।

.

রুহানি আজ পরিপাটি হয়ে ভার্সিটিতে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছে। কোনো কমতি চোখে পড়ছে না। আজ রিলেশনের প্রথম দিন ফালাকের সাথে দেখা হবে। তাই কোনো কমতি থাকা যাবে না। রুহানি শেষ বার নিজেকে দেখে পূর্নতার হাসি হাসল।

.

ভার্সিটিতে ঢুকতেই রুহানির ফোনে টুং শব্দ করে মেসেজ এলো। রুহানি দ্রুত মেসেজ ওপেন করল। ফালাক মেসেজ করেছে। ওকে পুকুর পাড়ে যেতে বলেছে।
রুহানি পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখে ফালাক পা ভিজিয়ে বসে আছে। রুহানি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ফালাক ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। রুহানি চুপচাপ ওর পাশে বসে আছে।
ফালাকও কিছু বলছে না।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ফালাক বলল,
“তুমি এত ঠান্ডা কবে হলে? এমন চুপ করে বসে আছো কেন?”

“আচ্ছা, কিছু বলার কথা কার? তোমার না আমার? তুমিই তো কিছু বলার জন্য ডেকেছো। এখন চুপ করে আছো।”

ফালাক পা উঠিয়ে বলল,
“ভালো কথা মনে করেছো।”

ফালাককে খুবই সিরিয়াস মুডে লাগছে। রুহানিও সিরিয়াস হয়ে ওর কথা শোনার প্রস্তুতি নিল।

“আচ্ছা, আহিলের সাথে কথা বলবে কবে? ওর সাথে কথা বলে সব ক্লিয়ার করা জরুরী। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নয়তো পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে। তুমি আজই ওর সাথে কথা বলবে। এই টেনশন আর নিতে পারছি না। একদিনেই হাপিয়ে গেছি। সারারাত ঘুমাতে পারি নি।”

রুহানি আমতা আমতা করছে। রুহানির এমন ফেস দেখে ফালাক কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল।
“হোয়াট রুহানি? কিছু বলছো না কেন?”

রুহানি ফালাকের দিকে অসহায় ফেস করে তাকাল। তারপর বলল,
“বুঝতে পারছি না কি করে সবকিছু ফেস করব।”

ফালাক সংকোচিত করে বলল,
“কি করে ফেস করবে মানে? তুমি কি আহিলকে সব ক্লিয়ার করতে চাও না? ওর লাইফ থেকে বেরিয়ে আসতে চাও না?”

রুহানি ফালাকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রতিউত্তরে বলল,
“রাগ করছো কেন? আমি অবশ্যই চাই এসব থেকে বেরিয়ে আসতে। আমার কি ভালো লাগছে? আমি ভাবছি বাবা আর মা’য়ের কথা। বিশেষ করে বাবার কথা। জানি না তাদের কি রিয়েকশন হবে। বাবা এমনিতেই অসুস্থ।”

ফালাক রুহানির বাবার অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে বলল,
“সবাইকেই সত্যিটা ফেস করতে হবে। কিন্তু প্রথমে তুমি আহিলের সাথে কথা বলো। ওকে তোমার আর আমার সব কথা বুঝিয়ে বলো। ও যদি বুঝে যায় আর নিজে থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখুনি আংকেল আন্টিকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।”

রুহানি ফালাকের কথার সাথে একমত হয়ে বলল,
“ঠিক বলেছো। আমি আগামীকালই আহিলের সাথে দেখা করে সব কিছু জানাব। দেখা যাক কি হয়।”

“তুমি চাইলে আমি উনার সাথে কথা বলতে পারি। যদি তুমি বলতে না পারো। আর বলার পর না জানি উনার কি রিয়েকশন হবে। তাই আমি তোমার সাথে যেতে চাইছি।”

রুহানি বাঁধা দিয়ে বলল,
“প্রয়োজন নেই ফালাক। আমি একাই সব ম্যানেজ করে নেব। তোমার যাওয়াটা উচিত হবে না। আমাদের একা কথা বলা উচিত।”

ফালাক কিছুক্ষণ উশখুশ করে বলল,
“তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”

রুহানি বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
“আহিল আমাকে খেয়ে ফেলবে না। উনি বাঘ-ভাল্লুক না। আর আমি উনাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা রাখি।”

ফালাক রুহানিকে রেগে যেতে দেখে বলল,
“ওকে ওকে তুমি একাই যেও।”

ফালাক মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
“দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনো।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,”আরও?”

ফালাক রুহানির হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“রুহানি প্লিজ কিছু লুকাবে না। ইতস্ততও করবে না। আমি তোমার পর নই। ইন ফিউচার আমাদের বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। তাই আমি যা জিজ্ঞেস করি বলবে প্লিজ।”

রুহানি ফালাকের মুখের দিকে চেয়ে আছে। ফালাক ওকে কি জিজ্ঞেস করবে। এত ফর্মালিটি কিসের জন্য।
ফালাক আবারও বলতে শুরু করল,
“কি হয়েছিল তোমাদের সাথে? তুমি বলেছিলে আপনজন তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি তোমাদের কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরের খবর তো তোমরা আর তোমাদের আপনজনরা জানে। তাই আমাকে সবটা বলো।”

রুহানি ইতস্তত করে বলল,”বাদ দেও পুরনো কথা।”

“তুমি কি এখনো আপন ভাবতে পারো নি? আমি কি তোমার পর?”

ফালাকের ইমোশনাল কথায় রুহানি বলতে শুরু করল,
“আমার মামা লোভী প্রকৃতির মানুষ। অনেক বার উনার জন্য আমাদের কোম্পানি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে আর বাবা বারবারই মাফ করে দিয়েছেন। কিন্তু লাস্ট টাইম একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। আমরা যে ডিলটা পেতে যাচ্ছিলাম তাতে মামা বাগড়া দেয়। আর বাবা রেগে যায় খুব। অনেক ততর্কবিতর্ক হয়। মামা বাবাকে হুমকি দিয়ে যায় এক প্রকার। ডিল সাইন হয়। ব্যাংক লোন পাশ হয়, লোন পাই, কাজও শুরু হয়। মামা সহ্য করতে পারে নি। কেননা ডিলটা তার চাই। সে আমাদের কোম্পানির কাউকে হাত করে সব ইনফরমেশন লিক করে দেয়। এতে ডিলের কিছু শর্ত লঙ্ঘন হয়। অনেক ঝামেলা হয় এক পর্যায়ে ডিল ক্যান্সেল হয়ে যায়। তারপর মামলা, উকিল, কোর্ট এসব করে অনেক দিন যায়। আমাদের কোম্পানির অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করে। পরবর্তীতে নানান সমস্যা এটা সেটা সব শেষ।”
রুহানি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর চোখ ছলছল করছে।

ফালাক রুহানির হাত চেপে ধরে বলল,
“শক্ত হও রুহানি। উনাকে উনার পাপের শাস্তি পেতে হবে। আমি সব তদন্ত করার জন্য মামলা করব, আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যদি তুমি অনুমতি দেও।”

রুহানি মুখ তুলে ফালাকের দিকে চেয়ে বলল,
“যদি ভালো রেজাল্ট না আসে। তাহলে শুধু শুধু এসব ঝামেলায় জড়ানোর কি প্রয়োজন?”

ফালাক রুহানিকে আশ্বস্ত করে বলল,
“চেষ্টা তো করে দেখতে পারি। আমার উপর ভরসা রাখো। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। আমি জানি তোমার আত্মসম্মান অনেক বেশি। তাই যত টাকা খরচ হবে আমি সব টুকে রাখব। তুমি পরে আমাকে ফেরত দিয়ে দিও।”

রুহানি কেন জানি আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। ওর মামাকে শাস্তি দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছে৷
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে কি করতে হবে?”

“সে-সব সময় হলেই জানাব৷ এখন তুমি আহিলের ব্যাপারটা দেখো।”

.

রুহানি ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আহিলকে ফোন করে দেখা করার কথা বলতে হবে। কিন্তু ফোন করতে পারছে না। কেন যেন উশখুশ করছে। তখনই রুহান ওকে ডাকতে এল।
“আপু আহিল ভাই এসেছে। তোর সাথে না-কি কি দরকার।”

আহিলের কথা শুনে রুহানি লাফিয়ে উঠে বসে। তারপর এক প্রকার দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। আহিল ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ওকে বিষন্ন লাগছে খুব। রুহানিকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার সাথে একটু জরুরী কথা ছিল। আমার সাথে একটু ছাদে যাবে প্লিজ।”

এত রাতে ছাদে কি কাজ এসব প্রশ্ন মনে এলেও রুহানি যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল।

রুহানি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতেই আহিল ওর বরাবর দাঁড়াল। তারপর বলল,
“আমি যে এত বছর তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, কাউকে আমার জীবনে আসতে দেই নি তার প্রতিদান কে দিবে?”

রুহানি বিস্ময় নিয়ে বলল,
“প্রতিদান! কিসের প্রতিদান? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“আমি তোমার আর তোমার প্রেমিকের কথা বলছি। এইজন্যই তুমি বারবার আমাকে বিয়ে করবে না বলেছো। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি। তোমার প্রেমিক আছে বলেই যখন বাবা বিয়ে ভেঙে দেয় তুমি প্রতিক্রিয়া দেখাও নি। এইজন্য তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইতে না। এখন আমার কাছে সব ক্লিয়ার। তুমি আমাকে এতবছর ধোঁকার মধ্যে রেখেছো। কিন্তু কেন?”

রুহানির মাথা ভনভন করছে। ফালাকের ব্যাপারটা যে জেনেছে সেটা বুঝতে পারছে। এতে সুবিধাই হলো কিন্তু ওর নামে যে অভিযোগ এনেছে তা তো ভুল।
“আপনার মাথা ঠিক আছে? আপনি কি বলতে চাইছেন আমি আপনার সাথে কমিটমেন্টে থাকার পরেও অন্য জনের সাথে রিলেশনে গিয়েছি? যদি আপনি এটাই মিন করে থাকেন তবে আপনি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন। আপনার বাবা বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সাথে সাথে আমার আর আমার পরিবারের জন্য সব সেদিনই শেষ হয়ে গেছে। তারপর ফালাক আসে আমার জীবনে। কিন্তু আমার জীবনে এতটাই ঝড় বয়ে গেছে সে সাহস করতে পারি নি, বুঝেও বুঝতে চাই নি। নিজের অনুভূতিকে এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্তু একটা সময় আর পারি নি। তাই আপনাকে বলেছি আমি বিয়ে করব না। ফালাকের কথা না বলার কারণ হচ্ছে তখন ফালাক আর আমার সম্পর্ক ছন্নছাড়া ছিল। রাগ-অভিমান চলছিল। আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে দুজনেই অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। তাই সময় চেয়েছি। গতকাল সব ঠিক হওয়ার পরে আপনাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। এই যে দেখুন ফোনটা আমার হাতে। আমি আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আপনার সাথে যখন দেখা হয়েই গেল তখন বলছি আমি আর ফালাক একে অপরকে ভালোবাসি। আপনার জানার অধিকার আছে তাই জানালাম। আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলেও সেই অনুভূতি আপনার প্রতি আমার তৈরি হয় নি যা ফালাকের জন্য হয়েছে।”

রুহানি এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে জোরে শ্বাস নিল।
আহিল স্তব্ধ হয়ে আছে। ওর দৃষ্টি মেঝের দিকে।
আহিলের ভেতরে ঝড় বইছে। কি করবে বুঝতে পারছে না।
রুহানিকে ছোট্ট করে বলল,
“জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি আজ আসছি।”
আহিল এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল।

.

রুহানি বাড়ির ভেতরে যাওয়ার পর ওর মা বারবার জিজ্ঞেস করছে,
“আহিল কি বলল? কোন সমস্যা?”

“মা কিছু হয় নি। এমনি এসেছিল কথা বলতে।”

“কিন্তু ওকে দেখে তো তা মনে হচ্ছিল না। কিছু হয়েছে? বল না?”

“মা, আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করো।”
রুহানি বিরক্তি নিয়ে ফোন ঘাটতে ঘাটতে ঘাটতে রুমে যাচ্ছে।
রুহানির মা একা একা বলছে,
“যাক কিছু না হলেই ভালো। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কি না কি হয়েছে। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।”

রুহানি মায়ের বিড়বিড় কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মায়ের দিকে ঘুরে মায়ের আস্বস্ত মুখটা দেখে বলল,
“কেন মা ভয় কেন পেয়েছিলে? আহিল হাতছাড়া হয়ে গেল কি-না, তোমার মেয়ের কপাল পুড়লো কি-না এসব ভাবছিলে? মেয়ের কথা ভাবার সময় আছে তোমাদের?”

রুহানির মা ওর কথা শুনে হতবাক।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে