প্রিয়দর্শিনী পর্ব-২৫+২৬

0
778

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__২৫

সময় স্রোতের ন‍্যায় বহমান। খুব দ্রুতগতিতে আবিদ দর্শিনীর বিয়ের দিন এগিয়ে এসেছে। আজকে তাদের গায়ে হলুদ আগামীকাল বিয়ে। মোটামুটি সব আত্মীয়স্বজনদের বিয়ের কার্ড দেওয়া হয়েছিল। সকাল থেকে দু’পরিবারেই আত্মীয়স্বজনদের আগমন। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর বিয়ে মানে বিশাল ব‍্যাপার স‍্যাপার। এই সাতদিন ধরে বিয়ের অনেক তোড়জোড় ছিল দু’পরিবারের। চৌধুরী ভিলাতো জাঁক জমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। এদিকে ব‍্যাতিক্রম নেই মুহতাসিম ভিলারও। আশরাফ মুহতাসিমের নির্দেশনায় মুহতাসিম ভিলা পরিপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। দর্শিনীর গায়ে হলুদ মুহতাসিম ভিলাতে হবে। শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে সম্পূর্ণ করা হবে। এই তুখোড় আইডিয়াটা উজানের ছিল। কমিউনিটি সেন্টার এখান থেকে বেশি দূরে নয় তাই আশরাফ মুহতাসিম উজানকে সমর্থন করেন। তিনি নিজে সবকিছু ঠিকঠাক করে চৌধুরী পরিবাকে জানিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু বিয়ের দায়িত্ব উজানের উপর। তাই উজান কোনরকম ত্রুটি ছাড়া বিয়েটা সম্পূর্ণ করবে বলে আশরাফ মুহতাসিমকে আশ্বস্ত করে।

ইতিমধ্যে দর্শিনীর বন্ধুদের মধ‍্যে দিয়া, নাদিম, হৃদিতা, মিহিরিমা উপস্থিত হয়েছে মুহতাসিম ভিলায়। দর্শিনীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে তারা দারুণ মজা করবে বলে ঠিক করেছে। তাদের মধ‍্যে একমাত্র আহানাফই আসেনি। শেষে দর্শিনী আহানাফকে ফোন করে আসতে বলে। আহনাফ নিদারুণ কষ্ট বুকে চেপে রেখে জানায় সে বিয়ের দিন উপস্থিত হবে। পরবর্তীতে দর্শিনী আর তেমন কিছু বলেনি। আহানাফের সিদ্ধান্তকে দর্শিনী শ্রদ্ধার সঙ্গে মূল‍্যায়ন করেছে। কিন্তু আহানাফের মনোঃকষ্ট তার কাছে অজানা অস্পষ্ট থেকে গেলো। আহানাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন সুইচ অফ করে দেয়। অবাস্তবিক কল্পনা করে আহানাফ বিষণ্নতায় ডুবে যায়।

এদিকে মুহতাসিম ভিলায় সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। প্রজ্জ্বলিনী নিজেকে নিয়েই ব‍্যাস্ত ছিল এইকয়েকদিন। সে কোনো প্রকার বাঁধা দেয়নি বিয়েতে। সেদিনের পর থেকে যথাসম্ভব নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। তাকে দেখে সহজে কেউ বুঝবে না, সে বোনের বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে উৎসুক। তবে আবিদের প্রতি রাগটা তার এখনো থেকে গেছে। যেমন, সুযোগ পেলেই কালনাগিনীর মতো ফোণা তুলে ছোবল দিতে ভুলবে না। প্রজ্জ্বলিনী প্রিয় বোনের শত্রু নয়। কিন্তু আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীকে থামানোর জন‍্য তাকে কতো কিছু করতে হবে।

.

সকাল দশটায় চৌধুরী ভিলায় আবিদের গায়ে হলুদ হওয়ার পরে,সেই হলুদ দর্শিনীকে লাগানোর জন‍্য আদিবা,পুস্পিতা, সঙ্গে আবিদের রিলেটিভদের মধ‍্যে দু’একজন বোন মুহতাসিম ভিলায় এসেছিল। তাদের উপস্থিতিতে দর্শিনীর গায়ে হলুদ হয়। সবাই মিলে আবিদকে ছোঁয়া হলুদ দর্শিনীর পুরো শরীরে লেপ্টে দেয়। অর্ধভেজা কাঁচা হলুদ শাড়ি পরিহিত, হলুদে ছোঁয়া দর্শিনীর বেশকিছু ছবি তুলে নেয় আদিবা। আদিবা মিষ্টি হেসে সব ছবি পাঠিয়ে দেয় আবিদকে। এদিকে নিজের রুমে শুয়ে আবিদ ফেসবুক স্ক্রল করছিলো। তার গায়ে হলুদ আগেই সম্পূর্ণ হয়েছে। বাসা ভর্তি মেহমানদের সামনে অসস্থি হচ্ছিলো বলে আবিদ নিজের রুমেই আছে। হঠাৎ হোয়াটসএপে নোটিফিকেশন আসলে সে দ্রুত চেক করে। মূলত আবিদ নিজেই আদিবাকে দর্শিনীর হলুদ ছোঁয়া ছবি পাঠাতে বলেছিল। সে দর্শিনীকে অর্ধভেজা শাড়িতে, হলুদ ছোঁয়া আকর্ষণীয় রূপে দেখে মৃদু ঢোক গিলে ফেলে। দর্শিনীকে আজ প্রচুর আবেদনময়ী লাগছে। কাঁচা হলুদ শাড়িটা ভিজে যাওয়ার জন‍্য মেয়েলি অবয়ব হালকা ভাবে স্পষ্ট। হঠাৎ আবিদের রাগ হয় বিয়ে বাড়ি মানেই অসংখ্য ছেলেরা থাকবে স্বাভাবিক। এখন দর্শিনীকে যদি কোন ছেলে অর্ধভেজা শাড়িতে দেখে কী হবে তাহলে? হবু বর হিসাবে তার মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তাহলে অন‍্য ছেলেদের কী হবে ভেবে তার রাগ হয়। সে দ্রুত আদিবাকে ফোন দেয়। ব‍েচারী আদিবা খাওয়া দাওয়া আনন্দ ছেড়ে ভাইয়ের ফোন রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই আবিদের নিটোল গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা যায়।

‘প্রিয়দর্শিনীকে বলে দেও, তার আশেপাশে কোন ছেলে যেন না থাকে। আমি চাইনা তাকে এভাবে কোনো ছেলে দেখুক।’ যথেষ্ট গম্ভীর ভাবে বলে আবিদ।

আদিবা ভাইয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। কথার মর্ম বোঁধগম্য হতেই মৃদু মেজাজ দেখিয়ে বলে,

‘আপুর গায়ে হলুদ তো হয়ে গেছে ভাইয়া। শুধু মেয়েরাই ছিল কোন ছেলে অ‍্যালাউ ছিলোনা। সবেমাত্র আপুকে গোসল করিয়ে রুমে পাঠানো হলো। বেকার বেকার অযথা চিন্তা করছো। রাখছি এখন সবাই খাওয়া দাওয়া করব।’ বলেই ফোনটা কেটে দেয় আদিবা।

আবিদ নির্বোধের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়। সত‍্যিই কী সে বেকার চিন্তা করছে? তার আদুরে বোন তাকে পাত্তা দিলোনা। এইযে দর্শিনীকে সবাই হলুদ ছুঁয়ে দিয়েছে। অথচ হবু বর হিসাবে হলুদ ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার তার সবচেয়ে বেশি রয়েছে। কিন্তু সেটাতো সম্ভব ছিলনা। সম্ভব হলে সে নিজ হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিতো তার সুদর্শিনীকে। তবে তার শরীরে ছোঁয়া হলুদই দর্শিনীকে লাগানো হয়েছে। এটা ভেবে মিষ্টি হাসে আবিদ।

এরমধ্যে আবিদ দর্শিনীকে অনেকবার ফোন দেয়। এদিকে দর্শিনী বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়ায় ব‍্যাস্ত ছিল। তার ফোনে চার্জ ছিলো না বিধায় আবিদ বারবার ফোন বন্ধ পেলো। শেষে মেজাজ চওড়া করে বেচারী আদিবার থেকে খোঁজ খবর নিচ্ছিলো। আদিবা বিরক্ত হয় আবিদের কার্যক্রমে তবুও ভাইকে ঠিকই কো-অপারেট করছিলো। এদিকে দর্শিনীর প্রতি মেজাজ হারিয়ে ফেলে আবিদ।

বিকেলের দিকে দর্শিনীকে কাঁচা হলুদ রঙের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। ধবধবে ফর্সা শরীরে কাঁচা হলুদ লেহেঙ্গা, লাইট মেকআপ, রজনীগন্ধা গোলাপ সংমিশ্রণে তাজা ফুলের গহনায় দর্শিনীকে অপ্সরার মতো সুন্দর লাগছিল। সবার নজর ছিল তার উপরে। দর্শিনীর সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে গেছে। আবিদের যেহেতু মেহেদী অনুষ্ঠান হবে না। তাই সবাই নিদ্বির্ধায় দর্শিনীর মেহেদী অনুষ্ঠানে থেকে গেছে। পার্লার থেকে চার পাঁচজন জন আর্টিস্ট এসেছে। দর্শিনীকে নিপুণ ভাবে মেহেদী পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। দু’হাত ভর্তি মেহেদীর মাঝে আবিদ নামটা জ্বলজ্বল করছে। দর্শিনী মৃদু লজ্জা পায়। এভাবেই আবিদ তার অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে মিশে যাচ্ছে। প্রতিটা মোমেন্টের ছবি তুলে আদিবা আবিদকে পাঠিয়ে দেয়। অন‍্যদিকে আবিদ দর্শিনীকে দেখার জন‍্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

দর্শিনীর মেহেদী সন্ধ্যায় বিভিন্ন আইটেমের খাবার দাবার, নাচ-গান, আনন্দ উৎসবের সবরকম ব‍্যবস্থা ছিল। আবিদের আত্মীয়দের মধ‍্যে আদিবা, মিথিলা, ইশিতা এছাড়া দর্শিনীর ফেন্ডসদের মধ‍্যে দিয়া, হৃদিতা, মিহিরিমা সবাই একসঙ্গে সুন্দর গানে ডান্স পারফরম্যান্স করে। একদিকে সবাই মেহেদী সন্ধ্যা দারুণভাবে উপভোগ করে। অন‍্যদিকে নাদিম সহ দুজন ক‍্যামেরা ম‍্যান সবকিছু ফ্রেম বন্দি করতে থাকে। সবাই আনন্দ উৎসবে মেতে থাকলেও প্রজ্জ্বলিনী দূরুত্ব বজায় রেখেছিল। এসবকিছু তার জন‍্য চক্ষুশূল হয়ে গেছে।

.

মেহেদী উৎসব শেষ হতেই আদিবারা চলে যায়। রাত হয়ে এসেছে। আত্মীয়স্বজনরা ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। প্রিয়মা বেগম এবং বেশ কিছু কাজের লোকজন কালকের জন‍্য যাবতীয় কাজকর্ম সেরে নেয়। উজান আর আশরাফ মুহতাসিম, তারাও বসে নেই। একেরপর এক ফোনকল দিয়ে সবাইকে সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে ভালোভাবে। কমিউনিটি সেন্টারের যাবতীয় কার্যাবলী এখন শেষ। এবার শুধু কালকের অপেক্ষা, বিয়েটা ভালোয় ভালোয় সম্পূর্ণ হোক সবার একটাই প্রত‍্যাশা।

দর্শিনী রাতে ফ্রেশ হয়ে এসে দ্রুত ফোনে চার্জ দেয়। একটু চার্জ হতেই তড়িঘড়ি করে ফোনটা অপেন করে। সে আবিদের অনেকগুলো ফোনকল, মেসেজ পায়। মূলত আদিবা যাওয়ার আগে বলে দিয়েছে ভাইয়া খুব রেগে আছে তুমি ফোন রিসিভ করোনি তাই। ব‍্যাস! আদিবার কথা শুনে দর্শিনী বুঝতে পারে ফোনে চার্জ না দিয়ে সে কতোবড় ভুল করেছে। তৎক্ষণাৎ ফোন দেয় আবিদকে। আবিদ ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করেনা। একবার, দুবার, দশবার দেওয়ার পরও রিসিভ করেনি আবিদ। দর্শিনীর মনটা কেঁদে উঠে। এমন পরিস্থিতিতে আবিদ তাকে অহেতুক ভুল বুঝুক সেটা দর্শিনী চায়না। এতোকিছু ভাবনার মাঝে লাস্ট মোমেন্টে ফোনটা রিসিভ হয়। দর্শিনী উদগ্রীব হয়ে জিগ্যেস করে,

‘রাগ করেছেন আমার উপর?’

‘তাতে কার কী এসে যায়? আমার জন‍্য তো কারো কাছে পর্যাপ্ত সময়ও নেই। আমি রাগ করলেই বা কী দর্শিনী? কারো কাছে আমার আকুলতা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবকিছু নিছক উপহাস মাত্র।’ ___আবিদের ভাবলেশহীন উত্তর।

দর্শিনীর এখন মাথা ঠুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে কী ইচ্ছে করে ফোন অফ করে রেখেছিল? নাকি সে বলেছে আবিদের জন‍্য তার কাছে সময় নেই? তার স্বপ্ন পুরুষ অকারণে তার উপর অভিমান করছে।

‘আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী!’

দর্শিনীর কাঁপাকাঁপা শীতল কন্ঠস্বর। হঠাৎ আবিদের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। ফোনটা কানের কাছে নিয়ে সে নিশ্চুপ থাকে। দর্শিনী এবার আবিদের গাঢ় নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে। দুজনের নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। দর্শিনী একটু থেমে বলে,

‘সরি! ফোনে চার্জ ছিলনা। আজকে অনেক আত্মীয়স্বজন ছিল সবাইকে রেখে উপরে যেতে পারিনি, ফোনে চার্জটাও দেওয়া হয়নি। আমার উপর রাগ করবেন না। আপনার জন‍্য আমার সবচেয়ে বেশি যায় আসে। এগুলো নিছক উপহাস নয়, ভালোবাসি!’

আবিদ নিঃশব্দে হাসে। দর্শিনীর উপর প্রথমে অভিমান করেছিল সে। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার পর কোন অভিমান স্পষ্ট নেই। মেয়েটা যে আবিদের ভালোলাগা এবং ভালোথাকার মাধ্যম। তার উপর এতো সুন্দর করে মেয়েটা ভালোবাসি বলল আবিদ কীভাবে রাগ করবে? আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,

‘একটা শর্তে রাগ করবো না।’

দর্শিনী উদগ্রীব হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জিগ্যেস করে,

‘কী শর্ত?’

‘এখন এই মুহূর্তে গার্ডেন এড়িয়ায় আসবেন। আমি আপনার জন‍্য অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি। ফোন ধরছিলেন না বলে অনেক টেনশনে ছিলাম। অবশেষে বাধ‍্য হয়ে আপনাকে দেখতে আসতে হলো নাহলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। এভাবে আপনাকে দেখার ইচ্ছে আমার আজীবন থাকুক দর্শিনী।’

দর্শিনী অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে! আবিদ এখন এখানে কী করছে? দর্শিনী আবিদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘কিহহ! আপনি এখানে?’

‘হ‍্যাঁ কোন সমস্যা?’

‘সমস্যা নয় কিন্তু….!’

‘কোন কিন্তু নয়। আপনি আসবেন নাকি চলে যাবো?’

দর্শিনী বিচলিত হয়ে বলে,

‘আসছি একটু অপেক্ষা করুন।’

দর্শিনী সোনালী পাড়ের মসৃণ হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত। আবিদ বলেছিলো বিয়ের পর দর্শিনীকে প্রতিদিন শাড়িতে দেখতে চায়। মূলত সে শাড়িতে অভ‍‍্যস্থ হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। দর্শিনী মাথায় একটা চাদর পেচিয়ে ধীরে ধীরে সবার অগোচরে নিচে নামতে থাকে। বাড়ি ভর্তি মেহমান রয়েছে। কেউ যদি আবিদকে এখানে দেখে কী ভাববে সবাই?এটা ভেবেই দর্শিনীর প্রেশার ফল করছে। আবার আবিদের সঙ্গে দেখা না হলে মানুষটা রাগ করবে। সবশেষে ভেবেচিন্তে দর্শিনী গার্ডেনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে আসে।

#চলবে

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__২৬

রাত বারোটার কাছাকাছি। জোৎস্নায় পরিপূর্ণ রজনী। আবিদ দূরে গাড়ি পার্ক করে চাবিটা হাতের আঙ্গুলে নিয়ে অবিরাম ঘুড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। মূলত দর্শিনীর একঝলক দেখা পাওয়ার জন‍্যই অপেক্ষা করছে আবিদ। দর্শিনীকে দেখার জন‍্য বন্ধুদের সঙ্গ ত‍্যাগ করে এখানে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে বেচারা। হঠাৎ চাঁদের পরিপূর্ণ আলোতে দর্শিনীকে চাদরে আবৃত অবস্থায় দেখে আবিদ মনোমুগ্ধকর হাসে। দর্শিনীর ভীতস্থিত চাহনী আবিদের অসাধারন লাগে। এদিকে দূর থেকে আবিদকে মিটমিট করে হাসতে দেখে দর্শিনী বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। মৃদু রাগ করে দর্শিনী। এভাবে দেখা করার কী আছে? আগামীকাল থেকে লোকটির সামনে সর্বদা থাকবে। তাকে সবসময় দেখতে পারবে। লোকটি কী ভুলে গেছে?

আবিদ দর্শিনীকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। মেয়েটাকে হলুদ শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এতো সুন্দর হতে কে বলেছে তার সুদর্শিনীকে? চাঁদের মতো সুদর্শিনী মেয়েদের যে কলঙ্ক লটে যায়। অবশ‍্য চাঁদেরও তো কলঙ্ক থাকে। তবুও সে সুন্দর। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী এই তেজস্বিনী কন‍্যার, কলঙ্ক হতে রাজি থাকবে সর্বদা। আবিদ দর্শিনীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলে,

‘সুন্দর লাগছে আমার সুদর্শিনীকে। এই চাঁদের মতো সৌন্দর্য দেখার জন‍্য আমি এমন ঝুঁকি বারবার নিতে রাজি দর্শিনী।’

দর্শিনী আবিদের কথায় মিহি কন্ঠে ব‍্যাস্ত হয়ে বলে,

‘এতো রাতে এখানে কী করছেন? কী কারণে ডাকলেন আমায়? বাসার সবাই দেখে ফেললে কী হবে জানেন? বাসা ভর্তি মেহমান রয়েছে।’

আবিদ নির্বিকারভাবে বলে উঠে,

‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। সকাল থেকে আমি এতোবার ফোন দিয়েছি আপনার কোন সাড়াশব্দ ছিলনা। আপনি নিজেও ফোন ম‍্যাসেজ কিছু চেক করেননি! আর না দিয়েছেন। বউকে মেহেদী পড়ে কেমন লাগছে, শাড়িতে তাকে কেমন মানাচ্ছে? এসব দেখার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে তাহলে!’

দর্শিনী নিশ্চুপ থাকে কিছুক্ষণ। আবিদ দর্শিনীর সামনে এগিয়ে আসে। তারপর দুজনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। আবিদ ছয় ফুট উচ্চতার বলিষ্ঠ সুপুরুষ সেখানে দর্শিনী পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। আবিদ দর্শিনী পাশাপাশি দাঁড়ালে, দর্শিনী আবিদের কানের নিচে পড়ে। আবিদ দ্রুত দর্শিনীর মাথা থেকে চাদরটা সরিয়ে দেয়। দর্শিনীর সামনের কিছু এলোমেলো মসৃণ চুল সুন্দর করে কানে গুজে দেয় আবিদ। মুগ্ধ হয়ে নিজের সুদর্শিনীকে দেখতে থাকে। দর্শিনী চমকে উঠে আবিদের কান্ডে। আবিদ মৃদু হেসে বলে,

‘যে জন‍্য এসেছি সেটা পূরণ হয়ে গেছে। এবার বিয়ের আগে শেষবার আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। বিয়ের পরে তো এভাবে পারমিশন নেওয়া হবেনা। আমরা যেহেতু আনম‍্যারিড, তাই পারমিশন চাইছি?’

দর্শিনী আবিদকে আড় চোখে চেয়ে দ্রুত হাত বাড়িয়ে দেয়। জোৎস্না রাত চারিদিকে আলোর সমাহার। দর্শিনীর নরম কোমল হাতটা ধরে আবিদ আচমকা এক টান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দর্শিনী আবিদের বুকের উপর এসে পড়ে। দর্শিনী অপ্রস্তুত ছিল আকস্মিক ঘটনায়। দর্শিনী ভেবেছিল আবিদ তাকে ছুঁয়ে দেখবে সেটা ভেবেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এভাবে জড়িয়ে ধরবে ভাবেনি। আবিদ দর্শিনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দুজনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। একসময় আবিদ দর্শিনীর কপালে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। অধর মৃদু প্রসারিত করে হাসিমুখে দর্শিনীর দিকে তাকায়। তারপর সবার অগোচরে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে যায়। যাওয়ার আগে অবশ‍্য দর্শিনীকে বলে যায়,

‘আমি সৌভাগ্যবান জানেন তো? এইযে পৃথিবীতে ধাবিত হওয়া চাঁদকে নিজের করে পাচ্ছি। কালকের জন‍্য প্রস্তুতি নিন। আপনার জন‍্য আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করব। কাল দেখা হবে মিসেস আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী।’ ব‍্যাস! আবিদ আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।

দর্শিনী নিটোল দৃষ্টিতে আবিদের যাওয়ার পানে তাকায়।একটা সময় পরে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। আবিদের অনাকাঙ্ক্ষিত সারপ্রাইজ গুলো দর্শিনীর অনেক পছন্দের। এইযে বিয়ের আগেরদিন আবিদের এমনভাবে দেখা করতে আসা দর্শিনীর ভালো লেগেছে। দর্শিনী চাঁদের আলোয় চারপাশে সতর্কতার সঙ্গে চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর চাদর জড়িয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।

.

আজ আবিদ দর্শিনীর বিয়ে। আজকে যেহেতু জুম্মার পবিত্র দিন। শাহরিয়ার চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এমন পবিত্র দিনে আবিদ দর্শিনীর বিয়ে সম্পূর্ণ হবে। বিয়ে সম্পূর্ণ করার পর সবাই একসঙ্গে জুম্মার নামাজ আদায় করবে। এবং আবিদ দর্শিনীর নতুন জীবনের জন‍্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। বেলা দশটা বাজছে সাড়ে দশটায় চৌধুরী পরিবারের সবাই কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। তারপর সেখানে নাস্তা করবে। শাহরিয়ার চৌধুরী সবাইকে তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ার জন‍্য বলছেন। চৌধুরী পরিবারের ছেলেরা সবাই মোটামুটি তৈরি। মেয়েদের মধ‍্যে আদিবা, পুস্পিতা, অনুসা বেগম, আরো কয়েকজন এখনো রেডী হচ্ছেন। ইতিমধ্যে বরের গাড়ি সহ মুহূর্তেই আরো চার পাঁচটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। বরের ব্লু মার্সিডিজ গাড়িটা সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আবিদ সবেমাত্র গোসল সেরে বের হয়। সে তার বলিষ্ঠ শরীরে লাল সাদার সংমিশ্রণে বিয়ের শেরওয়ানি জড়িয়েছে, মাথায় বরের পাগড়ি, হাতে রোলেক্স ব‍্যান্ডের ঘড়ি, পায়ে ম‍্যাচিং জুতা, আর বরাবরের মতো ম‍্যানলি পারফিউম দিয়েছে। ব‍্যাস! বর সাজে একদম তৈরি ম‍্যাজিস্ট্রেট আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। আবিদ সুটবুট ছাড়াও বরের সাজে যথেষ্ট সুদর্শন। আবিদের অনেক বন্ধু-বান্ধব আজ উপস্থিত আছে। সবাই তার বিয়ে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। আবিদ পুরোটা সময় নিশ্চুপ ছিল। বন্ধুদের কথায় দু’একবার হেসেছে। আপাতত বন্ধু বান্ধবদের হাসি ঠাট্টায় পাত্তা দেওয়ার ইচ্ছে নেই তার। তবে সে তার দর্শিনীকে বধূ রূপে দেখার জন‍্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

আত্মীয়স্বজনরা সবাই ধীরে ধীরে গাড়িতে চড়ে বসে। আবিদ আরহান, এবং আবিদের বন্ধুরা বরের গাড়িতে বসে পড়ে। একটু পরেই তারা কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সবার মাঝে আসফির কথা মাথায় আসতে আবিদ আরহানকে আসফির ব‍্যাপারে জিগ্যেস করে। আরহান খোঁজ নিয়ে জানায় শাহরিয়ার চৌধুরীর গাড়িতে আছে আসফি। আবিদ আসফিকে নিয়ে কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে চায়না এজন্য আরহানকে গাড়ি চেন্জ করতে বলে। আসফি আবিদের সামনে থাকলে আবিদ অন্তত নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে। তার ধারণা আসফি কোন সমস্যা ক্রিয়েট করতে পারে। আরহান ভাইয়ের কথা মতো আসফিকে তার গাড়িতে পাঠিয়ে নিজে বাবার গাড়িতে করে রওনা দেয়। আসফি চুপচাপ আবিদের পাশে এসে বসে। যদিও মনের মধ‍্যে আবিদের জন্য বিতৃষ্ণা, রাগ, জেদ। বিসমিল্লাহ বলে সবার প্রথমে আবিদের গাড়ি রওনা দেয়। তারপর এক এক করে বাকি গাড়ি গুলো।
.

প্রিয়দর্শিনীর পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাই অনেক আগে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছে। উজান আর আশরাফ সাহেব সবাইকে ওয়েলকাম করার জন‍্য প্রস্তুত। এদিকে পার্লার থেকে মেকআপ আর্টিস্ট এনে দর্শিনীকে আলাদা একটা রুমে ব্রাইডাল সাজানো হচ্ছে। লাল কারুকাজ করা ভারী লেহেঙ্গা, ভারী জুয়েলারি, মাথায় চুল স‍্যাট করে ভারী ওড়না দেওয়া। সবশেষে ফাইনাল স্মুদ মেকআপ। ধবধবে ফর্সা গালে গোলাপি আভা,ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক। দর্শিনীকে আজ মারাত্মক সুন্দর লাগছে। যেন কোনো হুরপরী! নজর ফেরানো দায় হয়ে গেছে সবার। প্রিয়মা বেগম মেয়েকে দেখেই চোখের কোণ থেকে কাজল লাগিয়ে দেয় দর্শিনীর কানের পিছনে। প্রজ্জ্বলিনী নিজেও মুগ্ধ হয়ে বোনকে দেখে। দর্শিনীর সঙ্গে দিয়া, হৃদিতা, মিহিরিমা সবাই ছিল। সবাই দর্শিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। ইতিমধ্যে পার্লার থেকে আসা দুজন আর্টিস্ট কাজ শেষে পেমেন্ট নিয়ে চলে যায়। এদিকে মিহিরিমা হাসি ঠাট্টা করে বলে,

‘ম‍্যাজিস্ট্রেট আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী আজ প্রিয়র থেকে চোখ ফেরাতে পারবেনা মিলিয়ে নিস দিয়া।’

মিহিরিমার কথায় দিয়া হৃদিতা দুজনেই হেসে হ‍্যাঁ বলে। দর্শিনী মিহিরিমার কথায় কোন প্রতিত্তর করেনা। ইতিহাস সাক্ষী প্রত‍্যেক বান্ধুবী হচ্ছে জন্মগত হারামি। তাদের কথার প্রতিত্তর করতে নেই। এজন‍্য দর্শিনী প্রতিত্তর করে দুষ্টু কথাবার্তা শুনতে একদম ইচ্ছুক নয়। দর্শিনীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে তিনজন আরো জোরে হেসে উঠে। এরমধ‍্যেই শোনা যায় বাইরে হইচই হচ্ছে বর এসেছে, বর এসেছে বলে। দিয়া, মিহিরিমা, হৃদিতা বরপক্ষের সবাইকে ফুল দিয়ে ওয়েলকাম করতে একসঙ্গে বেড়িয়ে যায়।

প্রিয়দর্শিনী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। আজ সে সবকিছু লাল পড়েছে। মাথা থেকে পা পযর্ন্ত লাল রঙে সুসজ্জিত প্রিয়দর্শিনী। মারাত্মক সুন্দর লাগছে তাকে বউ সাজে। বিয়ের দিন প্রতিটা মেয়েকেই সুন্দর লাগে। কিন্তু প্রিয়দর্শিনীকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক বেশিই সুন্দর লাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখে দর্শিনী সামান‍্য প্রশংসা করে। প্রিয়দর্শিনীকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে এটা যেন অন‍্যরকম অনুভূতি। আজকে নতুন এক সম্পর্কের সুচনা হবে। সে মৃদু হাসার চেষ্টা করে। স্বপ্নের নায়ক আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীকে বরের সাজে দেখার জন‍্য তার এমন অস্থিরতা কাজ করছে।

আবিদ সবেমাত্র গাড়ি থেকে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার উপর ফুলের বর্ষণ শুরু হয়। দর্শিনীর বান্ধবীরা দুইসারিতে দাঁড়িয়ে আছে ফুলের ট্রে হাতে। আবিদ ভিতরে প্রবেশ করতেই ফুল ছুঁড়বে বলে। দর্শিনীদের পক্ষে দুজন ক‍্যামেরাম‍্যান আবিদের পক্ষে আরো দুজন। তারা বিয়ের পুরো কার্যক্রম ক‍্যামেরাবন্দি করছে। নাদিম নিজের পার্সোনাল ক‍্যামেরায় দর্শিনী তারপর আবিদের ছবি তুলতে থাকে। বরপক্ষকে শুভেচ্ছা জানাতে উজান আর আশরাফ মুহতাসিম সহ সবাই আসে। আশেপাশের বাকি আত্মীয়স্বজন নতুন বরকে দেখার জন‍্য উদগ্রীব। প্রিয়মা বেগম এবং রেহানা বেগম চার পাঁচ পদের মিষ্টি এনে আবিদকে খাইয়ে দেন। তার কিছুক্ষণ পরেই আশরাফ মুহতাসিম সবাইকে নিয়ে এয়ারকন্ডিশার নিয়ন্ত্রিত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সুসজ্জিত কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করে।

বরপক্ষকে সকালের নাস্তা করানো হয়েছে। একটু পরেই শুরু হবে বিয়ের কার্যক্রম। বরের জন‍্য সুসজ্জিত স্টেজের পাশে কাজী সাহেবকে বসতে দেওয়া হয়েছে। মূলত বিয়ের সব কাগজপত্র রেডী। এখন শুধু বিয়েটা পড়ানো হবে এবং রেজিস্ট্রি হবে। আহানাফ আসবেনা আসবেনা করেও এসেছে। ব‍্যাতিক্রম নেই ডাক্তার নিহাল রায়হানেরও। আসার পর থেকে কেউ আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর মুখোমুখি হয়নি। তারা শুধু ফর্মালিটি রক্ষার্থে এসেছে। এবং সবার থেকে দূরুত্ব বজায় রেখেছে।

.

সবাই যখন ব‍্যাস্ত। দর্শিনী রুমের মধ‍্যে একা ছিল। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুড়ি পড়ছিলো। হঠাৎ জোরে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে দর্শিনী। অকসাৎ পিছনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। দর্শিনী কস্মিনকালেও ভাবেনি একে এই মুহূর্তে এখানে দেখবে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে