প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১৩+১৪

0
320

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ )
পর্ব সংখ্যা (১৩)

রাত্রির মাঝ ভাগ। ঘড়ির কাঁটা চলছে নিজের খেয়ালে। আশপাশের কোনো বাড়িতেই আলো নেই। অদূরে রাস্তায় থাকা ল্যামপোস্টের ক্ষীণ আলো জ্বলছে। অপার সৌন্দর্যের এই শহরটাকে নিস্তব্ধ দেখাচ্ছে। প্রিয়তার চোখ যায় আকাশের দিকে। তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। নেত্রপল্লব ভিজে একাকার হয়। আলগোছে মুছে নেয় নোনা জল। প্রহরের হাতের মুঠোয় হাত চেপে ধরে ছাদের কোণে বসে আছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে নাক টানছে। হেচকি উঠছে অনবরত। নাক লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। অন্ধকারে ও চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। প্রহর ফোনের বাটন চেপে সময়টা দেখে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রিয়তার হাতের পিঠে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে বলে,

” আর কাঁদে না। মাথা ব্যথা করবে।

প্রিয়তা শোনে না। ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁত দিয়ে। মোলায়েম কণ্ঠে বলে,

” থামাতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব।

” অনেক রাত হয়েছে প্রিয়তা। ঘুমোবেন চলুন। অনেকটা জার্নি করেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়বেন এবার।

প্রিয়তা ঘাড় বাঁকায়। ঘুম আসছে না তার। প্রহরের দিকে না তাকিয়ে বলে,
” আব্বু আমাকে ভালোবাসে না। একটুও না। আব্বু আমাকে আরো কয়েকবার কাছে ডাকতে পারতো, আরো কয়েকবার আমার কাছে ক্ষমা চাইতে পারতো। কই, করলো না তো। সম্পত্তি নিয়ে কথা বলে গেল শুধু। আমার সম্পত্তির ভাগ চাই না। বিশ্বাস করুন আব্বুর টাকা-পয়সার প্রতি লোভ নেই আমার। কিন্তু আব্বু যদি একবার তার সম্পত্তির কিয়দংশ অংশ আমাকে দিতে চাইতো, একবার যদি বলতো প্রিয়তার দায়িত্ব আমি নিবো, তাতেই আমি খুশি হয়ে যেতাম। মনে করতাম আব্বু আমাকেও নিজের উত্তরাধিকারী ভাবছে। কোনো কিছুই চাইতাম না আমি। শুধু মুখ থেকে একবার শুনতাম। কিন্তু সেটা তো হলো না। আব্বুর চিন্তা শুধু আরহামকে ঘিরে। ওর ভবিষ্যত নিয়ে আব্বু ভাবছে। আমার নিজের দায় নিজেকেই নিতে হবে।

প্রহর কি বলবে ভেবে পায় না। বাবা-মেয়ের এই দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না সে। প্রিয়তাকে সান্ত্বনা দিতে বলে,

” দিলেও আপনি নিতেন না। হয়তো এটা ভেবেই দেয়নি। কিন্তু আপনার দিক থেকে আপনি ঠিক। উনি আপনাকে মানানোর চেষ্টা করতে পারতেন।

” আমি কি ভুল করেছি প্রহর? কেন আমার সাথেই এমন হয়?

” ভুলটা আপনার নয় প্রিয়তা, ভুল আমাদের এই সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আপনার আব্বু ঘরে অমন সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীতে বিমোহিত হয়েছেন। আপনার আম্মু এমন সুদর্শন, ধনী স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরপুরষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়েছেন। আপনাদের কথা উনাদের মাথায় আসেনি তখন। উনাদের এই অবৈধ সম্পর্কের মাঝে আপনাকে আর আরহামকে এমন ভাবে পিষে দেওয়া হয়েছে যে আপনারা চাইলেও মাঝ থেকে বের হতে পারছেন না। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার আব্বু-আম্মু অন্য সংসারে গিয়ে বেশ সুখে আছেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, কারো সুখ কেড়ে নিয়ে কেউ সুখী হয় না, হতে পারে না। আপনার আম্মু, আব্বুর মাঝে এক ফোঁটা কষ্ট হলেও আছে। এতদিনে হয়তো উনারা দুজনই আপনার ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন। উনারা একটা সময় ঠিকই নিজেদের কর্মফল পাবেন। আপনাকে অভিশাপ ও দিতে হবে না। প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিবে।

প্রিয়তা গা এলিয়ে দেয়। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। ঘাড়ে প্রিয়তার চুলের ছোঁয়া পায় প্রহর। মুচকি হাসে। প্রিয়তা প্রশান্তিতে চোখ বুজে নেয়। ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে,

” আপনার ঘাড়ে মাথা রাখলে এত শান্তি লাগে কেন প্রহর?

নিঃশব্দে হাসে প্রহর। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

” বুকে মাথা রাখুন প্রিয়, আরো সুখ পাবেন।

সময় গড়ায়। প্রহর তাড়া দেয় ঘরে ফেরার জন্য। এগারোটার দিকে প্রহর নিজের বাড়িতে প্রিয়তাকে নিয়ে ফিরেছে। প্রিয়তাকে দেখা মাত্র নাবিলা উত্তেজিত হয়ে চুমু খেয়েছেন প্রিয়তার ললাটে। আরহামকে উনি নিজের কাছে রেখেছেন। রান্না করেছিলেন কয়েক পদ। প্রিয়তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন। সবাইকে ঘুমোতে বলে নিজেও ঘুমিয়েছেন। কিন্তু প্রিয়তার আব্বুর চিন্তায় ঘুম আসে না। ছাদে আসে। ডেকে নেয় প্রহরকেও। দুজনে একসাথে আকাশ দেখে। এত রাত হওয়ায় প্রহর পাঠিয়ে দেয় প্রিয়তাকে। কাঁথা টেনে দেয় শরীরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

” ধৈর্য ধরুন প্রিয়তা। সুখ আসবেই। কান্নাকাটি করবেন না। ঘুমোনোর চেষ্টা করুন। আপনাকে এভাবে ভেঙে যাওয়া মানায় না। আপনাকে শক্ত হতে হবে। এ প্রিয়তাকে আমি ভালোবাসিনি। আমি ভালোবেসেছি এমন একটি মেয়েকে যে সংগ্রাম করতে জানে। আপনি এক উত্তপ্ত হরিদ্রাভ অনল প্রিয়তা। কখনো আলো দেন, উষ্ণতা দেন, কখনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্ম করেন সর্বাঙ্গ।

________

প্রিয়তার ঘুম ভাঙে বেশ বেলা করে। রাতে মাথা ব্যথায় এপাশ ওপাশ করে আরো পরে ঘুম ধরেছিল প্রিয়তার। সকালের সতেজ রোদ মুখে পড়ায় ঘুম ছুটে যায় তার। মিষ্টি হেসে বিছানা ছাড়ে। জানালার সম্মুখে দেওয়া পর্দা ভালো করে সরিয়ে দেয়। বাড়িটা আজ অন্যরকম লাগছে প্রিয়তার নিকট। আগে এ ফ্ল্যাটে ঢুকতে ভয় পেত প্রিয়তা। আর এখন? এখন এ ফ্ল্যাটের হাওয়াটাও দারুন লাগে। মাংসের গন্ধে বাড়িটা ম ম করছে। ওড়না জড়িয়ে বের হতেই দরজার আড়াল থেকে ভো জাতীয় শব্দ করল আরহাম। প্রিয়তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টায় সফল হলো। আচমকা সামনে এসে শব্দ করায় ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল প্রিয়তা। ঘটনা বুঝতে পেরে রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,

” এইসব কি ধরনের ফাইজলামো আরহাম? ভয় পেয়েছি না?

আরহাম খুশি হয় বোনকে ভয় দেখাতে পেরে। জোরে হাত তালি দিয়ে বলে,
” প্রহর ভাইয়া বলেছে তুমি নাকি ভয় পাও না। তাই টেস্ট করছি। আমার কোনো দোষ নেই।

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
” উনার কথা শুনো কেন? উনি এইসব বাজে বকেই। মানুষ মাত্রই ভয়। প্রত্যেকটা মানুষ ভীতু। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমরা সবাই ভিতু। কেউ পশুপাখিকে ভয় পায়, কেউ শব্দতে ভয় পায়, মানুষে ভয় পায়, আবার কিছু মানুষ ভালোবাসায় ও ভয় পায়। ভয় পাই না এটা যে বলে সে মিথ্যে বলে। ভয় সবার মাঝেই আছে। বুঝেছো?

আরহাম পুরোটা না বুঝেও মাথা নাড়ে। প্রিয়তা ড্রইংরুমে আসে। সেখানে কেউ নেই। ডাইনিংরুমে প্রবেশ করে প্রিয়তা। বড়সড় টেবিলটায় বসে আছে নিধি। এটা ওটা ঠিকঠাক করছে মিসেস নাবিলা। প্রিয়তাকে দেখে প্রফুল্ল হলো নিধি। দাঁত বের করে হাসল। এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে চেয়ারে বসাল। বলল,

” দেখো তোমার জন্য আজ কত আয়োজন। বসো বসো। আমি যে কতটা খুশি হয়েছি তুমি আসবে জেনে, বলে বোঝাতে পারবো না।

প্রিয়তা চারপাশ অবলোকন করে টেবিলে বসল। মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে দেখে হাসলেন। বললেন,

” তোমাকে আরো আগে ডাকতে চাইলাম। সক্কাল সক্কাল উঠে আমি রান্নাবান্না করে রেখেছি। ডাকতে যাবো অমনি প্রহর বললো তুমি অনেক রাত করে ঘুমিয়েছো। এখনই যেন না ডাকি। তাই চলে এলাম। ডাকলাম না।

প্রিয়তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। টলমল করে ওঠে চোখের কার্ণিশ। নাকের ডগা রক্তিম রঙ ধারণ করে। মিসেস নাবিলা হাত ধুয়ে বিরিয়ানির প্লেট থেকে খাবার তুলে দেয় প্রিয়তার মুখে। মনে মনে প্রিয়তা বলে,

” এত সুখ আমার সইবে আদৌ?

প্রহর আসে টেবিলে। প্রহরের পরণে ছাই রঙা শার্ট। শার্টের হাতা ফোল্ড করা। অগোছালো চুলগুলো চোখের সামনে এসে হানা দিচ্ছে। প্রিয়তাকে দেখে গাঢ় হাসল প্রহর। প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলে,

” শুভ সকাল।

প্রিয়তা হেসে ফেলে ফিক করে। ঝলমলিয়ে ওঠে মুখশ্রী। বলে,

” এখনো সকাল? দেখুন দুপুর হয়ে গেছে।

নিধি হেসে ফেলে প্রিয়তার কথায়। বলে,

” ভাইয়া দেখি দিন-দুনিয়া ভুলে গিয়েছে। সকালে উঠে আবার গিয়েছিল ঘুমোতে। আপুর চিন্তায় আজকাল রাতে ঘুম হচ্ছে না ভাইয়ার। কি ঠিক বলছি তো?

প্রহর হাসে। উত্তর দেয়,
” রাতে ঘুম আসেনি। ফোন চেপেছি। সকালের দিকে একটু ঘুম হলো। তবে তোর কথা পুরোটা মিথ্যে নয়।

প্রহর আড়চোখে প্রিয়তার দিকে চায়। নজর সরে না প্রিয়তার থেকে। প্রিয়তা বুঝতে পারে প্রিয় পুরুষের গভীর চাহনি। অসস্তিতে আটশাট হয়ে বসে থাকে। নিধি খেতে খেতে প্রিয়তাকে বলে,

” আমার ভাইয়াকে কবে বিয়ে করবে প্রিয়া আপু?

প্রিয়তা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। এক ঝলক প্রহরের দিকে তাকিয়ে চোখ সরায়। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠে। বিয়ে শব্দটা শুনে কম্পিত হয় প্রিয়তার বেখেয়ালি মন। চিবুকে মাথা ঠেকে। নিধি হেসে ফেলে প্রিয়তাকে লজ্জা পেতে দেখে। প্রহর খাবার চিবুতে চিবোতে বলে,

” উনাকে রাজি কর। আজই বিয়ে করবো।

প্রিয়তা দ্রুত মাথা উঁচু করে। বিস্ময় চেপে ধরে চোখেমুখে। শৈথিল্যময় কণ্ঠে বলে,

” বিয়ে করবো বললেই কি বিয়ে করা যায়?

ব্যস। খাওয়া বন্ধ হলো প্রহরের। হাসিখুশি মুখটা নিমেষেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল ছেলেটার। গম্ভীর হলো মুহুর্তেই। কণ্ঠ ধারাল হলো বেশ। মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে বলল,

” আমি আজ রাতেই বিয়ে করবো মা। আয়োজনের কোনো দরকার নেই। এই মেয়ের ডিসিশন একটু পর পর বদলায়। আমি রিস্ক নিব না।

পুনরায় নিধির উদ্দেশ্যে বলল,
” তুই শপিং শুরু করে দে বোনু। আজ এই বাড়িতে আমার আর প্রিয়তার বিয়ে হবে ইন শা আল্লাহ্।

চলে যায় প্রহর। প্রিয়তা হকচকিয়ে ওঠে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

” কিন্তু এখনই কিভাবে?

মিসেস নাবিলা খুশিমনে বলেন,
” তুমি শুধু সেজেগুজে কবুল বলবে। বাকিটা আমরা দেখে নিবো। আমার ছেলের সংসার আজ আমি সাজিয়ে দিবো।

______

গাড়ির ফ্রন্ট সিটে প্রহরের পাশেই প্রিয়তা বসে আছে। পরণে মিষ্টি রঙের থ্রিপিস আর মাথায় হিজাব। লিপবামের কারণে তৈলাক্ত লাগছে ঠোঁট। আরহাম আসাতে চেয়েছিল। মিসেস নাবিলা ছেলেটাকে আসতে দিলেন না। বিকেলে নাকি আলাদা করে আরহামকে নিয়ে মার্কেটে যাবেন উনি। প্রহর আর কথা বলেনি প্রিয়তার সাথে। মিসেস নাবিলা দুজনকে পাঠিয়েছেন বিয়ের কেনাকাটা করতে। শপিং করেই ইহানের বাসায় যাওয়ার প্ল্যান আছে প্রহরের। পাশে বসে থাকা নির্বাক, নিশ্চুপ রমণীর প্রতি অভিমান জমেছে বেশ। কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে না প্রহর। প্রিয়তার প্রিয় পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে হয়। হাঁসফাঁস করে কিছুক্ষণ। কাছু বলতে চেয়েও চুপ থাকে। নিচু কন্ঠে প্রশ্ন করে,

” আপনার কোন রঙ পছন্দ?

প্রহর ড্রাইভিং করতে করতে প্রিয়তার দিকে তাকায় গভীর ভাবে। নজর সরে গেলেও মুখ থেকে কথা বের হয় না। প্রিয়তা পড়ে বেকায়দায়। সহ্য হয় না প্রহরের এমন অভিমানী মুখ। পুনরায় বলে ওঠে,

” কোন মার্কেটে যাচ্ছি আমরা?

প্রত্যুত্তর করে না প্রহর। নিরাশ হয় প্রিয়তা। মন খারাপ হয় প্রচণ্ড। বড় বাজারে আসে তারা। নেমে পরে প্রহর। সম্মুখে এগিয়ে যায় দ্রুত গতিতে। প্রিয়তাও পিছু হাঁটে। নত মুখে প্রহরের পা অনুসরণ করে শুধু। কিছুক্ষণ বাদে পা থামায় প্রহর। প্রিয়তার গতি কমে না ঠিক সময়ে। ততক্ষণাৎ ধাক্কা খায় প্রহরের পিঠের সাথে। প্রিয়তার নাক বরাবর মেরুদণ্ড ঠেকে প্রহরের। ব্যথা পায় প্রিয়তা। নাক ডলে। প্রহর কতটকু লম্বা? ধারণা করে প্রিয়তা। সে পাঁচ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। প্রহর তার থেকে কম করে ছয়- সাত ইঞ্চি লম্বা। স্বাস্থ্যবান, প্রশস্ত শরীরের অতি নিকটে এলে প্রহরের চিবুক নজরে আসে প্রিয়তার। প্রহর প্রিয়তার দিকে ফিরে। ভ্রু বাঁকায়। গম্ভীর স্বরে বলে,

” কিভাবে হাঁটছেন? ধাক্কা খান কিভাবে?

প্রিয়তা মিইয়ে যায়। লোকটা এমন কেন? একটু ভালো করে কথা বললে কি হয়? মিনমিনে স্বরে সে বলে,

” আপনাকে অনুসরণ করেই চলছি। আপনিই বা মাঝ পথে থেমে গেলেন কেন?

প্রহর বড় শ্বাস ফেলে। সংগ্রামী, পরিপক্ক,কঠোর মেয়েটা তার নিকটে এলেই কেমন বাচ্চা হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে ইগো। প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য পেতে নত করে মাথা। ভালো লাগে প্রহরের। মনে মনে হাসে সে। কণ্ঠ দমে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

” ব্যথা পেয়েছেন?

প্রিয়তা পিটপিট করে তাকায় প্রহরের দিকে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,

” পেয়েছি। এমন স্থানে ব্যথা পেয়েছি যে চাইলেও আপনাকে দেখাতে পারবো না।

প্রহরের ললাটে ভাঁজ পড়ে। চিন্তা বাড়ে। গাম্ভীর্য তলিয়ে যায় যত্নের কাছে। প্রিয়তার এক বাহু ধরে প্রহর। চিন্তিত স্বরে বলে,

” কোথায় ব্যথা পেয়েছেন? আমায় দেখাবেন না কেন? বেশ, ঠিক আছে। আমাকে বলতে হবে না। সামনের হসপিটালে মহিলা ডক্টর আছে। চলুন এক্ষুণি।

প্রিয়তা হেসে ফেলে শব্দ করে। হাসতে হাসতে পানি জমে চোখে। প্রহর ছোট ছোট করে ফেলে চোখ। প্রিয়তার হাসি থামে। দম নিয়ে বলে,

” সবসময় উল্টো বুঝেন কেন? আপনি কথা বলছেন না আমার সাথে তাইতো আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে। বুকের ব্যথা কি দেখানো যায়? এই ব্যথা সেই ব্যথা না।

ব্যস রাগ কমে প্রহরের। আলতো চড় মারে প্রিয়তার মাথায়। হাতে হাত গুঁজে সামনে এগোয়। অনেকগুলো দোকান ঘুরে লেহেঙ্গা দেখে প্রিয়তা। পছন্দ হয় না কোনোটাই। শেষে শাড়ি কিনতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। জ্ঞান হবার পর থেকে এ পর্যন্ত কখনো শাড়ি পড়েনি সে। ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়তো আগে। বাড়ি ছেড়ে আসার পর ওয়েস্টার্ন শব্দটি উচ্চারণও করে না সে। প্রহর একটি গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি বেছে দিল। সাথে ম্যাচিং করে লিপস্টিক থেকে শুরু করে সবই কিনল। বাড়ি ফেরার পথে ফোন এলো প্রহরের। ফোনের স্ক্রিনে দীপার নম্বর ভেসে ওঠায় চমকাল প্রহর। ধীরেসুস্থে ধরল কলটা। বলল,

” হ্যালো।

ওপাশ থেকে দীপা কিছু বলে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড বাদে কল কাটে প্রহর। থমকে যায় চলাফেরা। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,

” কে ফোন দিয়েছিল?

প্রহর সময় নিয়ে বলে,
” দীপা খন্দকার। আপনার সৎ মা।

প্রিয়তা অবাক হয়। আব্বুকে নিয়ে চিন্তাও হয় খানিক। বলে,
” কি বললেন উনি?

” আপনার আব্বু মারা গেছেন প্রিয়তা।

প্রিয়তা থমকায়। থমকে যায় প্রিয়তার জগত। যন্ত্রণা শুরু হয় বুকে। হৃদস্পন্দন থামে। কম্পিত হয় মোলায়েম দেহ। চোখের পাতা এক হয় না প্রিয়তার। বাকরুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখে পানি জমে। জড়তা কাজ করে কণ্ঠে। কণ্ঠ পেঁচিয়ে আসে। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। সময় নিয়ে কম্পিত স্বরে থেমে থেমে বলে,

” আব্বু নেই?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৪ )

“মৃত্যু” এমন একটি শব্দ যা এক লহমায় বদলে দিতে পারে জীবনের বাঁক। আরিফ হোসাইনের মৃত্যুতে প্রিয়তার জীবনের বাঁক ওলটপালট হয়নি। কারন প্রিয়তা নিজের জীবনের সকল পথ নিজেই বেছে নিয়েছিল। তাই বুঝি হাউমাউ করে কাঁদছে না মেয়েটা। বাবার মৃত্যুতে কি শোকাহত হয়নি প্রিয়তা? জানতে চায় আশপাশের লোকজন। সে যে শোকে পাথর হয়েছে এ কথা কাকে বোঝাবে?

হাসপাতাল থেকে লাশ আনা হয়েছে আরিফের বাড়িতে। বাড়ির বাইরের বারান্দায় নামানো হয়েছে লাশ। জনসমাগমে ভরতি এই স্থানে প্রিয়তা এক জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। কপোল বেয়ে রয়েছে নোনা পানির চিহ্ন। চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে প্রিয়তার। মাথা ব্যথায় উশখুশ করছে সে। দীপা কেঁদে চলেছে স্বামীর পাশে বসে। হাউমাউ করে কান্না করছে মহিলা। প্রিয়তাকে এভাবে কাঁদতে না দেখে কিছু মানুষ গুঞ্জন তুলছে। মেয়ে কি তবে বাবাকে ভালোবাসে না? বাবা যতই খারাপ হোক, মেয়ের তো উচিত বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করা। প্রিয়তা করছে না কেন? প্রিয়তা সব শোনে। তবুও মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। আরহাম মৃত্যু শব্দটা বুঝে। প্রচণ্ড কাঁদছে ছেলেটা। মিসেস নাবিলা বারংবার চেষ্টা করেও আরহামকে থামাতে পারছেন না। প্রিয়তাও ভাইয়ের কাছে ঘেঁষছে না। কাঁদুক ছেলেটা। বাবার মৃত্যুতে কাঁদুক। প্রহর আশপাশে কোনো কারণ ছাড়াই নজর বুলায়। এগিয়ে আসে লাশের দিকে। সাদা কাফনে জড়িয়ে রাখা লাশটা কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে। প্রহরের ভয় নেই। লাশ দেখার ইচ্ছে জাগে তার। নরম স্বরে বলে,

” আমি শেষবার আঙ্কেলকে দেখতে চাই।

দীপার কান্না থামে। ঘনঘন পলক ফেলে মহিলা। চাহনি দৃঢ় হয় তার। চোখ ফিরিয়ে বলে,

” মৃত মানুষকে আর কি দেখবে? কবরের ব্যবস্থা করো গিয়ে। কোনো দায়িত্ববোধ নেই দেখছি। সরো সরো।

প্রহর সরে না। বসে পরে লাশের পাশে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই হাতের আঙুল দ্বারা সরিয়ে দেয় সাদা কাপড়। কয়েক সেকেণ্ড যেতে না যেতেই দীপা রেগে আবারো মুখ ঢেকে দেয় আরিফের। রাগী স্বরে বলে,
” বললাম না কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে? কতক্ষণ লাশ এখানে থাকবে? যাও এখান থেকে। তোমাদের ডাকাই আমার ভুল হয়েছে।

প্রহর উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তার পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়তাকে লাশের কাছে আসতে না দেখে সুযোগ পেয়ে যায় দীপা। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
” বাপ মরে গেছে খুশি হয়েছো তো? খুব খুশি তাই না? সম্পত্তি সব পেয়ে গেছো। বাপকে আর কি দরকার?

প্রিয়তা এসব কথায় পাত্তা দেয় না। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে এগোয় বাবার লাশের সামনে। প্রিয়তার চোখের পানি ঘাসে পরে। শুষ্ক লাগে চেহারা প্রিয়তার চেহারা। এলোমেলো অগছালো মেয়েটা বাবার লাশের পাশে বসে। চেঁচামেচি করে না প্রিয়তা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরিফের মুখে হাত বুলায়। নির্মল, শান্ত অথচ গভীর কণ্ঠে বলে,

” তুমি উঠবে না আব্বু? আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। এবার প্লিজ উঠো। আমি চাইতাম তুমি অনুতপ্ত হও, নিজের ভুল বুঝতে পারো। বিশ্বাস করো কখনোই চাইনি তুমি এভাবে চলে যাও। কখনোই চাইনি তোমার কষ্ট হোক। এতদিন তবুও মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে তোমরা আছো, পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে বেশ সুখেই আছো। কিন্তু এখন? এখন নিজেকে কি বলে বোঝাবো? উঠো না।

উঠে না আরিফ, নড়েচড়ে না। শ্বাস না নেওয়া আরিফ মেঝেতে লুটিয়েই থাকে। প্রিয়তার হুঁশ ফিরে। বাবাকে উঠতে না দেখে উত্তেজিত হয় তার কায়া। বেশ সজোরে ঝাঁকায় মৃত শরীরটাকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

” এই আব্বু। উঠো। বলেছি তো আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি কান ধরছি। উঠো তুমি। আল্লাহ্, এমন মজা করে না আব্বু। দেখো সবাই কষ্ট পাচ্ছে।

প্রিয়তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। কপোল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে। রক্তিম হয় চোখ আর নাক। নাক টানে প্রিয়তা। হু হু করে কেঁদে উঠে। বাবার শীতল শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে। কান্না করে খুব। বিরামহীন অশ্রুতে টইটম্বুর হয় চোখ। ফুঁপিয়ে ওঠে প্রিয়তা। ভুলে যায় দিক্বিদিক। চেঁচিয়ে দীপার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

” আব্বু আপনাকে বিয়ে করেছিল সুখে থাকার আশায়। কেমন সুখ দিলেন আপনি? পাশে থাকতে পারেন নি? এত টেনশন করতে দিলেন কেন? কেন আব্বুকে প্রাণ হারাতে হলো হ্যাঁ?

দীপাও চেঁচিয়ে উঠে সমান তালে। বলে,
” বাপ তো মানো না ওরে। তোমার কথার ঝাঁঝেই মানুষটা চলে গেছে। বাবার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও তো জানো না। কোনোদিন খোঁজ ও তো নাও নাই। এখন আব্বু আব্বু কইরা ঢং দেখাও? দেখাও যে বাপরে ভালোবাসো?

প্রিয়তা অধিক শোকে পাথর হয়। কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলে চোখ। মাথা ব্যথায় কুঁচকে উঠে ললাট। ভেতরের যন্ত্রণা কাবু করে প্রিয়তাকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে প্রিয়তা। ছটফট করে। প্রহর এগিয়ে আসে নিকটে। প্রিয়তাকে আগলে ধরে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,

” কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তা? থামুন এবার।

প্রিয়তা থামে না। কেঁদে চলে। মস্তিষ্ক অগোছালো হয় প্রিয়তার। তাল হারিয়ে ফেলে। সবকিছু ঘোলাটে লাগে। পড়ে যেতে নেয় প্রিয়তা। চোখ বুজে আসে। ক্লান্ত স্বরে বলে,
” আমার শ্বা..শ্বাস নিতে ক..কষ্ট হচ্ছে প্রহর। দম বে..বেরিয়ে যাচ্ছে। বাঁচবো না বোধহয়। বাঁচবো না।

জ্ঞান হারায় প্রিয়তা। প্রহরের বুকে মাথা রেখে ঢলে পরে। আগলে নেয় প্রহর। নরম শরীরটাকে চেপে ধরে বক্ষে। ইহানকে কল করে। রাতে ঘুমোনোর পূর্বে এখানে আসার খবরটা ইহানকে জানিয়েছিল প্রহর। বলেছিল শপিং করেই ইহানের বাসায় যাবে। কিন্তু এখন যাওয়ার উপায় নেই। ফোন দিয়ে প্রহর বলল, ” প্রিয়তার আব্বু মারা গেছেন। প্রিয়তা অসুস্থ হয়ে পরেছেন। বিয়ে ক্যানসেল। এখানে গণ্ডগোল আছে বুঝলি? লাশ ভালো মতো দেখে নিবি। আমার সব ঠিকঠাক লাগছে না। প্রিয়তাদের বাড়িতে আয়। আমি প্রিয়তাকে নিয়ে আমার বাড়ি ফিরছি।

_______

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তানিয়াকে বিছানায় পায়নি ইহান। সারা বাড়ি খুঁজেও তানিয়ার অস্তিত্ব মেলেনি। ইলমা বেগম ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছেন। তানিয়া কোথায় গেছে তা তিনি জানেন না। ইহান নিজ ঘরেই তানিয়ার বস্ত্র খোঁজে। সবই ঠিক আছে। এর মানে পোশাকাসাক নেয়নি। ইহান পুরো ঘরে নজর বুলায়। টেবিলের উপরে সাদা রঙের কাগজ পায়। সেখানে লেখা ছিল,

অপ্রিয় স্বামী,

বাবার কাছে ফিরে যাচ্ছি। আপনার মতো গোমড়ামুখো, অতি গম্ভীর, জেদি মানুষের সাথে সংসার করা আর পুতুলের সাথে খেলা করা একই কথা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আপনার ওই কোঁকড়ানো চুলগুলো ধরে নায়কদের মতো দশ ফিট দূরে ফেলে দিতে। অনুভূতিহীন মানুষের সাথে কি আর সংসার করা যায়? বাসায় এসে জোর করে কোলে তুলে না নিয়ে গেলে আর কখনোই ও বাড়ি ফিরবো না।

ইতি,
আপনার অবাধ্যগত বউ।

সকালের ঘটনা ভেবেই গম্ভীর হয় ইহান। প্রিয়তাদের বাড়ি যাবে এখন। সাথে মেয়েটা গেলে ভালো হয়। গণ্ডগোল থাকলে সাথে একজন দক্ষ লেডি পুলিশ নিলে কাজ সহজ হয়। ফোন করবে কি করবে না ভাবে ইহান। ইগোটাকে সরিয়ে কল করতে খুব মানে লাগে ইহানের। তবুও কাজের স্বার্থে ফোন করে ইহান। ফোন খানিকক্ষণ বাদে উঠায় তানিয়া। গম্ভীর স্বরে বলে,

” হ্যালো।

ইহানের মাঝে জড়তা কাজ করে। সর্বদা গম্ভীর থাকে সে। অনুভূতি প্রকাশ করতে দ্বিধায় পরে সবসময়। তানিয়াকে আসতে বলতে ভিষণ অসস্তি লাগে ইহানের। বললে নিশ্চয়ই তানিয়া হাসবে। কৌতুক স্বরে বলবে , ” কি? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলেন না তাই তো? তাহলে বলুন আমাকে ভালোবাসেন”।

গাম্ভীর্য বজায় রেখে ইহান বলে,
” প্রিয়তাদের বাসায় যেতে হবে। রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি এসো।

” কেন? প্রিয়তার বাসায় কি কাজ?

” প্রহর আর প্রিয়তা এখানে ফিরেছে। আজ ওদের বিয়েও হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরেই প্রিয়তার বাবা মারা গেছে। প্রহর বললো ওখানে কিছু গণ্ডগোল আছে। মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাই যেতে হবে।

তানিয়ার যেতে ইচ্ছে হয়। প্রিয়তা আর প্রহরকে একত্রে দেখার ইচ্ছে জাগে। অভিমান ভুলে শান্ত কণ্ঠে বলে,

” প্রিয়তার বাসায় দেখা হবে। আসছি।

_______

প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে। আধশোয়া অবস্থায় বসেছে বিছানায়। মাথাটায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে প্রিয়তার। সময়টা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয় সে। সন্ধ্যে হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় ছ টা উনত্রিশ বাজে। একটু শীত শীত লাগছে প্রিয়তার। ললাটে ভেজা কাপড়ের অস্তিত্ব টের পায়। জ্বর এসেছে তার? জলপট্টি দিয়েছে কেউ। চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকায় প্রিয়তা। মনে পরে মাঝ দুপুরের ঘটনা। সাথে সাথেই প্রিয়তা শব্দ করে কেঁদে ওঠে। শব্দের দাপটে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরে প্রহর। প্রিয়তার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সযত্নে। প্রিয়তার কান্নাকাটিতে বিচলিত না প্রহর। এটা যেন হবারই ছিল। শান্ত কণ্ঠে বলে,
” আবার কাঁদছেন?

প্রিয়তা ফুঁপিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় কাবু হয়ে থাকে। ঘনঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। আকাশ সম ব্যথায় নেতিয়ে থাকে। কম্পিত কণ্ঠে বলে,

” আমার জীবনে কান্না ব্যতিত আর কি আছে হুহ? ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্না করা ছাড়া আর কি পারি আমি? আমার কারণেই আব্বু চলে গেছে। আমি একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। একটু ভালো ব্যবহার চেয়েছিল আব্বু। আমি দিতে পারিনি।

” আপনি দোষী নন প্রিয়তা। আপনি আপনার দিক থেকে ঠিক। উনি দোষ করেছেন, যার ফলস্বরূপ আপনি দুরত্ব বাড়িয়েছেন। আপনি তো কখনো চাননি আঙ্কেল চলে যাক দুনিয়া ছেড়ে। কখনো অভিশাপ দেননি। এটা উনার ভাগ্যে ছিল প্রিয়তা। আল্লাহ্ ব্যতিত কেউ ভাগ্য বদলাতে পারে না। তাই এত অনুশোচনা করবেন না।

” আব্বু কি আমাকে ক্ষমা করবে?

প্রহর কিছু বলে না। চুপ থাকে। পাশে বসে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সময় গড়ায়। সন্ধ্যে সাতটা বাজে। প্রিয়তার কান্নার পরিমাণ কমে। চুপ হয়ে যায়। নির্বাক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে। প্রহরের দিকে তাকিয়ে প্রাণহীন কণ্ঠে বলে,

” লাশ কোথায়?

” উনার দাফন শেষ হয়েছে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। দীপা আন্টি দেরি করতে চাননি।

আবার ও নিস্তব্ধ হয় ঘরটি। ছুটে আসে আরহাম। প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট বুকে। ছেলেটার চোখে পানি। প্রিয়তাকে জেগে উঠতে দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

” আপু তোমার খুব জ্বর। কত্তক্ষণ ঘুমোলে তুমি। আব্বুকে শুইয়ে দেওয়া হলো তুমি দেখলে না।

গভীর নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায় প্রিয়তা। আরহামের জীবনে ওর বাবা-মায়ের ভূমিকা এত ঠুনকো কেন? আরিফ হোসাইন চলে গেল। রেখে গেল নিষ্পাপ এক ছেলেকে। এই ছেলেটার বাবার নামের পাশে মরহুম শব্দটি উচ্চারিত হবে। এতিম বলে সম্বোধন করবে ছেলেটাকে। না মেনে নিতে পারে না প্রিয়তা। চেষ্টা করবে ভাইকে সর্বোচ্চ সুখী রাখার। জড়িয়ে নেয় আরহামকে। বলে,

” তুমি তো দেখেছো।

” হ্যাঁ। আব্বুকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা হলো জানো? আব্বু শব্দ করলো না। আব্বু তো মরে গেছে তাইনা?

কেঁদে ফেলে আরহাম। প্রিয়তা বলে,

” নিধি আপুর কাছে যাও আরহাম। তোমার প্রহর ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

চোখ মুছে চলে যায় আরহাম। প্রিয়তা উঠে বসে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে প্রহরকে। ঠোঁটের কোণে মৃদ্যু হাসি ফোঁটে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

” আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তাইনা?

প্রহর মুচকি হাসে। বলে,

” হুহ্। ছিলো।

প্রিয়তা চুপ থাকে। লজ্জায় মাথা নত করে বলে,

” আমি চাই আজই বিয়েটা হোক।

” আপনি আগে সুস্থ হন প্রিয়তা। এসব পরে ভাবা যাবে।

” উঁহু। আজই বিয়ে হবে। আমি ঠিক আছি।

অবাক হয় প্রহর। প্রিয়তার এহেন কথায় বিস্ময় চেপে ধরে তাকে। অবিশ্বাসের সাথে অস্ফুটে বলে,

” প্রিয়তা।

সম্মোহনী চোখে তাকায় প্রিয়তা। লজ্জায় রক্তিম হয় মুখ। হৃদস্পন্দন থামে। নত মুখে বলে,
” আপনাকে ভিষণ প্রয়োজন আমার প্রহর। আপনার বুকে মাথা রেখে নির্ঘুম রাত্রি পাড়ি দিতে চাই। আপনার দেহে আবৃত থাকতে চাই বৈধ ভাবে। চুমু খেতে চাই আপনার প্রশস্ত বুকে। আমার সুখ চাই প্রহর। এই দুঃখের সাগরে আপনিই একমাত্র সুখের দিশা। আপনি কাছে থাকলে আমার সুখ সুখ লাগে। পুরো পৃথিবীকে অনবদ্য লাগে।

প্রহর খুশিতে আত্মহারা হয়। বোঝাতে পারে না অনুভূতি। গাঢ় হাসি ফুটে উঠে চোখে। দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হয় প্রহরের। রম্যতার কণ্ঠে বলে,

” আপনি খুব দুষ্টু হয়ে গিয়েছেন প্রিয়তা। এত দুষ্টু না হলেও চলতো।

একই ভাবে হাসে প্রিয়তা। ফিসফিস করে বলে,

” শারিরীক নয়, মানসিক সুখের জন্য হলেও আপনাকে আমার চাই। ভিষণ ভাবে চাই।

________

রাত হয়েছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে চাঁদ। ইহান, তানিয়া, প্রহরের বাড়ির মানুষ জন, প্রিয়তা আর আরহাম ব্যতিত বাড়িটায় আর কেউ নেই। কাজী এসেছে মাত্র। বয়স্ক লোকটার পরণে ধবধবে সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। বড় বড় দাঁড়ি রেখেছেন। মাথায় টুপি পড়ে বসে আছেন বারান্দায়। বিদ্যুত চমকাচ্ছে। অন্ধকার আকাশে বাজ পড়ার কারণে ঝলমল আকাশ করে উঠছে মাঝে মাঝে। কাজী তাড়া দিলেন। প্রিয়তাকে সাজিয়ে আনা হলো বারান্দায়। মেয়েটার পরণে গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি। কোনোরকম প্রসাধনী নেই মুখে। গলায় সোনার চেইন আর কানে দুল। চোখের নিচে গাঢ় কাজল দিয়েছে প্রিয়তা। চুলের খোঁপা আগলা রয়েছে। ফোলা ফোলা চোখমুখে বারান্দায় আসে প্রিয়তা। মাথার ঘোমটা টেনে আনে ললাটে। নত মুখে বসে সোফায়। খানিকক্ষণ বাদে প্রহরকে আনা হয় বারান্দায়। প্রিয়তা তাকায় না সেদিকে। প্রহরের নজর পরে প্রিয়তার নত মুখে। মুচকি হাসে ছেলেটা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রহর। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় হৃদয়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার পানে। নজর সরে না এক রত্তি। কাজী দোয়া-দুরূদ পড়েন। খানিকক্ষণ বাদে কবুল বলার জন্য অনুরোধ করেন। প্রহর সময় নেয় না। পরপর তিনবার কবুল বলে সাইন করে কাগজে। প্রিয়তাকে কবুল বলতে বলায় কাঁপে না প্রিয়তার কণ্ঠ। বেশি সময় নেয় না। কবুল বলে বেশ অনায়াসে। সাইন করে কাগজে। সকলেই উচ্চস্বরে “আলহামদুলিল্লাহ্” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। কাজী যেতেই প্রহর দ্রুত পাশে এসে বসে প্রিয়তার। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ রেখে নিচু কণ্ঠে বলে,
” প্রিয়তমা, আমার সব সুখ আপনার হোক। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত হোক প্রহরময়।

প্রিয়তা লাজুক হাসে। নত মুখ আরো নত হয়ে আসে। লজ্জায় মূর্ছা যায় মেয়েটা। হাঁসফাঁস করে। ইশশ প্রিয় মানুষের কণ্ঠে এত মাদকতা কেন?

_____

বৃষ্টি পড়ছে। ঝমঝম বর্ষণের শব্দ ঝংকার তুলছে। প্রহরদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় এসেছে। খেয়েদেয়ে মিষ্টি মুখ করে বাইরে বেরিয়েছে ইহান আর তানিয়া। একই সময়ে বেরিয়েছে বলে বিরক্ত হলো তানিয়া। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট। গাড়িঘোড়া নেই তেমন। ছাতার নিচে থেকেও ভিজে যাচ্ছে তানিয়া। পায়ের নিচের শাড়ির অংশ ভিজে একাকার। বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। ইহান গাড়িতে ওঠে। গাড়ি স্টার্ট দেয় না। বসেই থাকে গম্ভীর ভাবে। বেশিক্ষণ থাকতে পারে না চুপচাপ। উচ্চস্বরে বলে,

” উঠে বসো তানিয়া।

তানিয়া ছাতা সহ এগিয়ে আসে গাড়ির জানালার কাছে। গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষটার উদ্দেশ্যে বলে,

” আপনার সাথে যাবো না। ফ্লার্ট করতে চাইছেন? আমি কিন্তু বিবাহিত।

ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটুকু বলে তানিয়া। তানিয়ার এমন অহেতুক কথাবার্তায় বিরক্ত হয় ইহান। ললাটে ভাঁজ পরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” বাজে বকো না। উঠে বসো। বাড়ি চলো। আম্মা তোমার অপেক্ষায় আছে।

” আন্টিকে বলে দিবেন, তার অমন জেদি ছেলের সাথে আমি সংসার করতে পারবো না।

” আমার জেদ তুমি দেখোইনি তানি। রাগ বাড়িয়ো না।

তানিয়া শোনে না। এক হাতে ছাতা ধরে অপর হাতে শাড়ির কুঁচি গুলো উঁচু করে ধরে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সম্মুখে। বৃষ্টির বেগ বাড়ে। ইহান নামে গাড়ি থেকে। ছাতা নিয়ে হেঁটে চলে তানিয়ার পিছু পিছু। তানিয়া তা দেখে হাসে। হাঁটার গতি বদলে দৌড়ায় তানিয়া। রাস্তায় জমে থাকা পানির তোয়াক্কা করে না। ছুটে চলে নিজের মতো। ছাতাটাও ছুঁড়ে মারে। তানিয়ার দৌড় দেখে ইহান ও দৌড়ায়। ফাঁকা পাকা রাস্তায় দুজন মানব মানবী দৌড়াতে থাকে নিজের খেয়ালে। সপসপ শব্দ করে পানি ছিটে যায় সবখানে। ধরা পরে তানিয়া। তানিয়ার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে ইহান। থামে তানিয়া। ইহানের নিকটে আসে। ইহানের হাতে থাকা বন্ধ ছাতাটা ফেলে দেয়। বাতাসে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পরে ছাতা। খিলখিলিয়ে হাসে তানিয়া। বলে,

” আপনাকে এভাবে দৌড়াতে দেখতে দারুন লেগেছে। পুরোই সিনেমা।

ইহানের রাগ বাড়ে। শাড়ির আঁচল টেনে ধরে শক্তি দিয়ে। গাড়ির দিকে ফিরে যেতে চায়। রাগী কণ্ঠে বলে,

” খুব অবাধ্য হচ্ছো তানিয়া। এত অহেতুক বকবক করা আমার পছন্দ নয়।

” আমাকে তো পছন্দ।

থতমত খায় ইহান। চোখ নামায়। দুজনেই ভিজে গেছে। কাপড় থেকে পানি পরছে এক নাগাড়ে। ইহানের কোঁকড়া চুল ভিজে একাকার। তানিয়ার চুল থেকে পানি পড়ছে। তানিয়া ইহানের পাশে পাশে হাঁটে। পুনরায় বলে,
” বলুন। আমাকে পছন্দ নয়?

” তোমাকে আমি ঠিক কতটা পছন্দ করি তা তুমি কখনো বুঝতে পারবে না। অপ্রকাশিত ভালোবাসা সবচেয়ে সুন্দর।

” কিন্তু আপনাকে প্রকাশ করতে হবে। নইলে আমি ফিরবো না।

একটি অটো আসে। ততক্ষণাৎ অটোটাকে থামায় তানিয়া। উঠে বসে অটোতে। চলতে থাকে অটো। ইহান দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। তানিয়া অটো উধাও হবার পৃর্বে চেঁচিয়ে বলে,

” চিঠিতে যা লেখা ছিল তা না করলে কখনোই আপনার বাড়িতে ফিরবো না। আপনি যদি জেদি হন তো আমিও আপনার বউ। সবসময় এক কাঠি উপরে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে