প্রাপ্তির শহরে পর্ব-১০ সিজন ০২

0
763

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-১০
#তাহরীমা

দাফন শেষে আদ্র কবরের পাড়ে বসে থাকে।তাকে টেনে ও তোলা যাচ্ছেনা।আকাশ আর কিছু প্রতিবেশি অনেকেই চেষ্টা করছে।কিন্তু সে ঠায় বসে আছে।কিছুক্ষণ পর পর ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে।
আকাশের ও খুব খারাপ লাগছে তাহুর জন্য।প্রতিবেশিরা আয়াতের কথা বলে অনেক বুঝালো।তারপর আদ্র নিজেই উঠে দাড়ালো।
.
আদ্রর বাসায় আসতে একদম ই মন চাইছে না।তাহুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ বাসায়।মেয়েটার অসহায় চাহনি টা ইস কি মোহময়।এই তো দুইদিন আগেই অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকত তার দিকে।যে আদ্রকে ছাড়া সে চলতে পারতো না।আদ্র বিদেশ গেলে একা থাকতে হবে বলে কেঁদে ফেলত।সেই মেয়ে অন্ধকার ঘরে নিশ্চিন্তে ছেলে স্বামী ছেড়ে শুয়ে আছে।আদ্র কিভাবে সামলাবে নিজেকে?
.
আয়াত সে কখন থেকে তাহুকে দেখতে না পেয়ে কাঁদছে।আদ্র আসার সাথে সাথে সে আদ্রর কোলে গিয়ে শান্ত হয়ে যায়।আদ্র এবার ছেলেকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।

আদ্রর মা অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।

মেঘা এ বাড়িতে ফিরে এসেছে।যেহেতু তাহু মারা গেছে।এখন পুরা বাড়ির রাজত্ব তার ই।মেঘাকে ফিরতে দেখে আকাশ ও খুব খুশি হয়।
.
.
দুইদিন কেটে যায়।আদ্র ঠিক মত খাবার খায়না।রান্নাবান্না সব আদ্রর মা ই করছে।এ কয়েকদিনে একটা কাজের মহিলা ও জোগাড় হয়নি আর না মেঘা কাজে সাহায্য করছে।

আলো কয়েকদিন নিজের বাসায় যায়নি আয়াতের জন্য থেকে গেছে।আহিতা আয়াত একসাথে বড় হয়।

মাকে আলো টুকটাক সাহায্য করে।কিন্তু আদ্রর মা এ বয়সে কাজ করতে একদম ই হাপিয়ে যাচ্ছেন।কোথাও গিয়ে একটু হলেও তাহুর চিন্তা মাথায় আসে।
________

সকালে কেউ ই চা বানায় না আর।আদ্র ভোরে উঠে মসজিদে যায়।কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবে।আর চোখের জল ফেলে।

এদিকে আলো আয়াত আর আহিতাকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে।আলোর হাসবেন্ড উঠে বাইরে হাটা দেয়।অন্তত দোকানে গিয়ে হলেও চা টা পান করতেই হবে।

আদ্রর মা উঠেন।আজকে শরীর একদম ভাল লাগছেনা।তাই আবারো শুয়ে পড়ে।

মেঘা স্কুলের উদ্দেশ্য রওনা হবে।উঠে দেখে কেউ চা বানায় নি।মেঘা নিজের জন্য এক কাপ বানায়।তারপর বিস্কুট দিয়ে খেয়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।

আলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়।আয়াত আহিতার কপালে চুমু দিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্য যায়।তারপর সবার জন্য চা বানায়।মা কে ডাকতে যায়।
–“আম্মু চা বানিয়েছি”।
–“পরে খাব।”
আলো আর জোর করেনি।
আকাশ উঠে চুপচাপ টেবিলে বসে।আলো চা এগিয়ে দেয়।তারপর খেয়ে চলে যায়।
.
.
আদ্র বাসার উদ্দেশ্য হাটা দেয়।আদ্রকে দরজার সামনে দেখে আলো এগিয়ে যায়।
–“আসো ভাইয়া কিছু খাবে?”

আদ্র আলোর দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে থাকে।আলোর ও খুব কষ্ট হচ্ছে।মৃত্যু স্বাভাবিক।সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে মানুষ চলে যায় আফসোস।
–“এমন করোনা ভাইয়া।আয়াতের জন্য হলেও তোমাকে শক্ত হতে হবে।”

আদ্র চুপচাপ টেবিলে বসে।তারপর ব্রেকফাস্ট করে আয়াতকে দেখতে যায়।ঘুমন্ত আয়াতকে কোলে নিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠে।আলো দূর থেকে ভাইকে দেখছে।ছেলেরা এমন কেমনে কাদে?এত ভালবাসা কেন?
__________

আলো আজ চলে যাবে।কয়েকদিন তো থাকলো তার ও তো সংসার আছে।যে কদিন ছিল রান্নাবান্না সব আলো ই করেছিল।মেঘা নিজে নিজের গুলা খেয়ে রুমে চলে যেত।

আলো আদ্রর রুমে যায়।
–“কিছু বলবি?”
–“আমি চাচ্ছি আয়াত ও আমাদের সাথে থাকুক।”
–“কেন?”
–“তাহু নেই।মা ছাড়া একজন বাচ্চার বিষয় অন্যকেউ বুঝবে না।”
–“মা নেই কিন্তু ওর বাবা ও কি নেই?যতদিন আমি আছি আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে।ওকে হলেও অন্তত আমি চোখের আড়াল করবো না।”

আলো আর কিছুই বলল না।আহিতাকে নিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

দুপুরের দিকে আদ্রর মায়ের শরীর আরো খারাপ হতে লাগলো।জ্বর এসেছে মনে হয়।নিজে নিজে ভাত ত দূর পানি ও খেতে মন চাইছে না।দুপুরের ভাত ও তিনি খান নি।আর আদ্র ও খায়নি।কে রাখবে কারোর খাওয়ার হিসেব?

আদ্রর মা অনেক কষ্টে টেবিলে গিয়ে বসে।আর মেঘাকে ডাক দেয়।মেঘা রুম থেকে আসে,
–“কিছু বলবেন?”
–“আমার জন্য অল্প করে ভাত পানি নিয়ে আসো?”

মেঘার চোয়াল শক্ত করে বলে,
–“আমাকে দেখে কি কাজের মেয়ে মনে হয়?”

আদ্রর মা অসহায় চোখে তাকায়।যেমন টা তাহু তাকাতো।
–“আপনার বড়বউ পুরাতন হয়েও তেমন কাজ করত না আর আমার এখনো নতুনের গন্ধ যায়নি অমনি অর্ডার করছেন?”

আদ্রর মায়ের মনে পড়ে এ কথাটা তিনি ই একদিন বলেছিলেন।
–“সামান্য ভাত আনতে বলেছি বলে এত কথা শুনাচ্ছো?”
–“শুনাচ্ছি এ জন্য যে আমি আপনার বড় বউয়ের মতো কাজের মেয়ে নই।আমার স্টেটাস আছে।তাছাড়া আপনার কি হাত নেই?নিজে নিয়ে খান।”

মেঘা চলে যায়।অনেকদিন পর আদ্রর মায়ের চোখে পানি।তিনি ওখানেই কিছুক্ষণ বসে থাকেন।তারপর কিছু না খেয়ে ই শুয়ে পড়েন আবার।
_________

মেঘা নিজেদের জন্য খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করে।আকাশ এতে কিছুই বলেনা।কিছু বললে মেঘা আলাদা থাকার ভয় দেখায়,আকাশ মেঘাকে হারাতে চায়না।

আদ্র আয়াতকে ঘুম পাড়িয়ে বাইরে গেলে আয়াত জেগে যায়।ও এখন একটু একটু হাটতে পারে।
আয়াত বিছানা থেকে নেমে হেটে আসে।তাহুকে খুঁজে কিন্তু কোথাও পায়না।তারপর আলোকে খুঁজে আলো ও নেই।এদিক সেদিক হাটে।কাউকে দেখেনা তার খুব কান্না পাচ্ছে।

মেঘাকে রুম থেকে বের হতে দেখে হাসে।মেঘার সামনে গিয়ে হাত দুইটা মেলে ধরে মানে সে কোলে উঠবে।
কিন্তু মেঘার আয়াতকে ও পছন্দ না।সে আবার রুমে চলে গেলো।আয়াত ঠোট টেনে কান্না ধরলো।

আয়াতের কান্নার আওয়াজ শুনে আদ্রর মা শুয়া থেকে উঠে।তারপর আস্তে আস্তে এসে আয়াতকে কোলে নিয়ে যায়।আয়াত কে পাশে বসিয়ে
আদ্রর মা কষ্ট করে ভাত তরকারি রাধে।

তারপর আয়াতকে নিয়ে খাওয়ায়।আয়াত তাহুর মতো ই শান্ত হয়েছে।আয়াতের চেহারা দেখতে আদ্রর মার কেমন যেন লাগে।এই প্রথম মনে হচ্ছে কোথাও যেন কি শূন্যতা।গভীর শূন্যতা।ভালবাসার শূন্যতা।তাহু ও এমন বয়সে একদিন বাবা মাকে হারিয়ে ছিল।সেই মেয়ের মন কতই না ছোট ছিল।অথচ মা বলে ডাকার পর ও কখনো সেই মেয়েকে ভালবাসা হয়নি।
________________

আকাশ অন্যখানে জব নেয়।জব থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আসলে মেঘাকে না বলে নিজেই ভাত নিয়ে খায়।
তারপর রুমে ডুকলে দেখে মেঘা ফোন ইউজ করছে।আকাশকে দেখে জড়িয়ে ধরে।
–“কি হলো?এত ভালবাসা?”
–“একটা কথা বলার ছিলো?”
–“কি কথা?”
–“তোমার মা কে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসো।আর তোমার ভাই তার ছেলেকে নিয়ে কি করবে সে জানে।কিন্তু আমি তোমার মায়ের সেবা করতে পারব না।জানোই ত আমার এসব পছন্দ না।”

আকাশ চুপ করে থাকে।তার মানে নিরবতায় হ্যা?মেঘা আকাশকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
_________
আদ্র এ কয়েকদিন খেয়াল করেছে মেঘা কাজ করেনা।মা ই সব করছে।আদ্র রুমে গিয়ে দেখে আদ্রর মা আয়াতের সাথে আছে।আদ্র হাসার চেষ্টা করে।
–“ঘুম থেকে উঠে গেছে?”

আদ্রর মা বলে,
–“তোর ছেলে সারাবাড়ি খুঁজে কাউকে না পেয়ে কেঁদে ফেলেছিল আমি খাইয়ে দিয়েছি।”

আদ্র বলে,
–“আম্মু রান্নাগুলা তুমি করো কেন?তোমার আদরের বউমা কে করতে বলো না কেন?”

আদ্রর মা চুপ করে থাকেন।
–“ইসস আমার তাহুকে তুমি সেদিন যা নয় তাই বললে।আজ কেন তোমার বউমা কাজ করছেনা?”

আদ্রর মা এবার কেঁদে ফেলেন
–“চুপ কর।”
–“কেন চুপ থাকবো?তুমি মেয়েটাকে কেন ভালবাসতে পারলে না?যেদিন বলেছিলাম আমার মা কে মায়ের মতো ভালবেসো সেদিনের পর থেকে তোমাকে ভালবেসে গেছে।বিনিময়ে পেয়েছে কষ্ট।”

আদ্রর মা চুপ।
–“আমার কত কষ্ট হতো জানো।তুমি যেমন আমার মা তোমাকে ভালবাসার অধিকার আছে।তেমনি ও আমার বউ,সবার ই ভালবাসার প্রাপ্য ছিলো।আলমারির সব শাড়ি এখন তোমার, যাও নিয়ে নাও সব।”

আদ্রর মা এবার হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
–“আমার তাহু কে খুব মনে পড়ছে।আমি অনেক বড় ভুল করেছি।অন্যায় করেছি।”

আদ্র হাল্কা হাসে।
–“মানুষকে ভালবাসা আর সম্মান দেয়া উচিৎ বেচে থাকতে, মরে গেলে আর ভালবেসে কি আর হবে?”

আদ্র আয়াত কে কোলে নেয়।আর কপালে চুমু দেয়।আদ্রর মা চোখের জল মুছে বলে,
–“আয় খেতে আয়?”

আদ্র বলে,
–“কাজের মহিলা ঠিক করেছি একটা।সব অই মহিলা ই করবে।এ বয়সে আমি চাইনা তুমি কাজ করো।”

আদ্রর মা চুপচাপ চলে আসেন।আদ্র আয়াতকে চেয়ারের অপরপাশে বসিয়ে রাখে।আদ্রর মা আদ্রকে খেতে দেয়।আদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিরবে কাঁদেন।ছেলেটার মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে।তার পরিপূর্ণ সংসার টা ভেঙ্গে গেলো।
.
.
আদ্র রুমে আসতে ই আলো কল করে।পাশে বিছানায় আয়াতকে বসায়।আলো আদ্রকে আয়াতের ব্যপারে,সবাই কেমন আছে জানার জন্য কল দিয়েছিলো।
–“ভাইয়া কেমন আছো?”
–“আলহামদুলিল্লাহ,তুই?”
–“আমি ও আলহামদুলিল্লাহ।আম্মু কেমন আছে?বাড়ির সবাই?”
–“আম্মু একটু অসুস্থ।আর বাকিগুলা ভালই আছে।”

আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
–“আয়াত কোথায় ভিডিও কল দিই ওকে দেখবো?”

আলো ভিডিও কল দেয়।আয়াত আলোকে দেখে হাসে। কিন্তু আয়াত আঙ্গুল দিয়ে বারবার চেষ্টা করছে আলোর মুখটা ছোয়ার জন্য,কিন্তু আলোকে কিছুতেই ছুতে পারেনা।বারবার আলোর মুখ ধরতে চায় আর ব্যর্থ হয়।

আদ্র কিছুক্ষণ ছেলের কান্ড দেখলো।
আয়াত আবার মোবাইলে পা রাখার চেষ্টা করে।মানে পা রাখলে সে ডুকে যেতে পারবে এই ধারণা।কিন্তু তাও হয়না।আয়াত আদ্রর দিকে তাকায়।আদ্র হাসে।

আদ্র আলোকে বলে,
–“শোন ঘুম থেকে উঠলে আয়াত তাহুর জন্য কান্না করে।এখন থেকে ঘুম থেকে উঠলে তোকে কল দিবো তোকে দেখলে হলেও ও শান্ত হয়।জানিস ই তো ও তো অবুঝ।”
–“সমস্যা নেই ভাইয়া।কত বললাম আমার কাছে দিয়ে যাও।”
–“নাহ আমার ছেলে আমার কাছে থাক।”
আলো কল কেটে দেয়।

আদ্র গ্যালারি তে ডুকে তাহুর কিছু ছবি বের করে।অনেকদিন হলো ছবি তোলা হয়নি।
আদ্র দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
–“এই অভিমানী!এত অভিমান তোমার হ্যা?দুইদিন অবহেলা করে দূরে রেখেছিলাম সেটা দেখেছ আর সারাজীবন ভালবেসেছিলাম সেটা দেখোনি?তোমার বর কি তোমায় ভাল না বেসে পারে?আমি কখনো ই আমার তাহু কে ভুলব না।”

ফোন টা বুকে চেপে ধরে আদ্র আবারো বলে।
–“তুমি আজীবন থেকে যাবে আমার ভালবাসায়।আমার মনের গহীনে।আড়ালে আবডালে।”
_______

বিকেলে আদ্রর মায়ের গলা ব্যাথা করে হঠাৎ ই।নিজে গিয়ে গরম পানি করতে ইচ্ছে করছে না।মেঘা পাশ দিয়ে ই যেতে তাকে বলতেই সে বলে,
–“আপনি এক কাজ করুন বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান।সেখানে অনেক টা সেবা পাবেন।এভাবে আমাকে আর জ্বালাবেন না।”

আদ্রর মা চুপচাপ রুমে চলে আসে।কাজের জন্য হোক ভালবাসার জন্য হোক আজ সেই মেয়েকে ই তার মনে পড়ছে যাকে তিনি এতটুকুই পছন্দ করতেন না।আজ খুব করে মনে হচ্ছে তাহু যদি বেচে থাকত যতটুকু ঘৃণা করেছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালবাসত।খুব করে ইচ্ছে করছে যে অন্যায়গুলো করেছে তার জন্য ক্ষমা চাইতো।কিন্তু মানুষ বড়ই অদ্ভুত,
‘দাতঁ থাকতে দাতেঁর মর্যাদা দেয় না’

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে