প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০৯ সিজন ০২

0
791

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব ০৯
#তাহরীমা

তাহু একনাগাড়ে কেঁদে ই যাচ্ছে।আদ্র ধরে তাহুকে সোজা করায়।আদ্র ছেলেমানুষ হওয়ায় সে ও তাহুর মত কাদতে পারছেনা।কিন্তু কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।

আদ্র ফোন করে মা কে খবর দেয়।আদ্র এমন খবর দিবে এটা উনি কল্পণা ই করেননি।

আকাশ রুম থেকে বের।তাহুর কান্না দেখে সে ঘাবড়ে।রুমে গিয়ে বাবার নিথর দেহ দেখে বুক ধক করে উঠে।হাজারহোক সে ও বাবার সন্তান তো।চোখ ছলছল করে উঠে।

সন্তান গুলো বাবা মা বেচে থাকতে হুশ রাখেনা চলে গেলে খারাপ লাগে তাদের,তারপর কয়েকদিন কাদে।তারপর ভুলে যায় এটাই দুনিয়ার নিয়ম।

আদ্রর মা,আলো তড়িঘড়ি করে বাসায় আসে।আলো আদ্রর বাবার মাথার কাছে বসে কেঁদে কেঁদে বলে,
–“এভাবে কেন চলে গেলে আব্বু?একবার ও বলে গেলে না?”

তাহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।রুমে আয়াত কাঁদছে তাহু আয়াতের কাছে যায়।আদ্রর মা ও স্বামীর জন্য কেঁদে উঠেন।হাজারহোক স্বামীকে ভালবাসতেন।

তাহুর চাচিকে ও আদ্র কল করে জানায়।তিনি ও আসেন।আদ্র দাফনের ব্যবস্থা করে।তাহু একদম চুপচাপ হয়ে যায়।
.
.
দাফন শেষে সবাই যে যার মত বসে থাকে।তাহু রান্নাবান্না সেড়ে সবাইকে খেতে বলে।কিন্তু কেউ খায়না।

আদ্রর মা ও চুপচাপ বসে ছিল।তাহু গিয়ে বলে,
–“আম্মু আপনি অন্তত খাবার খেয়ে নিন।না খেলে শরীর খারাপ করবে।আমরা অন্তত আপনাকে হারাতে চাইনা।”

আদ্রর মা তাহুকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বলে,
–“আধিখ্যেতা দেখাবি না।অলুক্ষনে মেয়ে যেদিন থেকে এ বাড়িতে এসেছিস সেদিন থেকে কিছুই ভাল হচ্ছে না।আমার ছেলেটাও বদলে গেলো।আমার ছোট ছেলে আলাদা থাকতে চায়।আর আজ আমার স্বামী চলে গেলো।সব দোষ তোর?”

তাহু ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।টেবিলে আদ্র বসে ছিলো।তাহু আদ্রর দিকে তাকায় কিন্তু আদ্র কিছুই বলছে না।আদ্রর এমন ব্যবহারে,আদ্রর বদলে যাওয়া কিছুতেই তাহু মেনে নিতে পারছেনা।

এদিকে আদ্র মনে মনে বলছে।
–“হায়রে বউ!একবার হলেও প্রতিবাদ করে বলো আমার দোষ নেই।একবার হলেও শক্ত হয়ে দেখাও।আমি তোমাকে ভালবাসি আর ভালবাসব সারাজীবন।আমি বদলে যায়নি।প্লিজ তাহু প্রতিবাদ করো?”

কিন্তু তাহু আদ্রর দিকে তাকিয়ে থেকে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো।তারপর রুমে চলে গেলো।তাহুর যাওয়ার পানে আদ্র তাকিয়ে থাকলো।
______

মেঘা শশুড় কে দেখতে এসেছিল বাবা মা কে নিয়ে।আবারো দাফন শেষে চলে গেলো।আকাশ অনেক বলেছে এ বাড়িতে থাকতে কিন্তু মেঘা সবাইকে সাথে নিয়ে থাকতে রাজি না।

কিছুদিন পর আদ্র তাহুকে পড়তে বলে।এ কয়েকদিন একটু ও বই হাতে নেয়নি।এমন হলে কি চান্স পাবে?
কিন্তু তাহুর কিছুতেই পড়ায় মন বসে না।আদ্র তাকে ভালবেসে পড়তে বলে না।ধমক দিয়ে কথা বলে।তাহুর আরো মন খারাপ হয়।

রাতে টেবিলে তাহু চুপ করে বসে থাকে,আদ্র তাহুকে খেয়াল করছে অনেক্ষন ধরে।
–“কি হলো?পড়তে বলছি না?”
–“আগে হাসিমুখে বলুন কথাটা।”
–“তাহু!এ বয়সে মাইর খাওয়ার চেষ্টা করো না।”
–“কেন অবহেলা করছেন এত?আমার যে কষ্ট হচ্ছে।”

আদ্র চুপ করে থাকে।তারপর বলে,
–“ঠিক আছে পড়ার যখন আর ইচ্ছে হচ্ছে না আমি ও আর বলে কি করবো?”

আদ্র ঘুমাতে চলে যায়।তাহুর আজ নিজেকে খুব ই অসহায় লাগছে।
রাতে তাহু তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে।আদ্র যেন তাকে আগের মত ভালবাসে।সব যেন ঠিক হিয়ে যায় এটাই তার কামনা।

_____

পরের দিন সকালে তাহু চা বানায়।আকাশ আদ্র আসে।বাবার সীট টা দেখে তিনজনেরি মন খারাপ হয়ে আসে।আকাশের অপরাধবোধ জাগে।বাবার কাছ থেকে ক্ষমাটা নেয়ার সুযোগ হলো না।

তারপর আদ্র আকাশ চলে যায়।আদ্রর মা রুম থেকে আসেনা।তাহু নাস্তা চা নিয়ে শাশুড়ির রুমে যায়।
–“আম্মু?”
–“তুই এখানে কেন?তোর মুখ ই আমি দেখতে চায়না।যা এখান থেকে?”

তাহু চুপচাপ চলে আসে।
___________

আদ্র দুইদিনের জন্য বিদেশে যাবে।তাহুর মন আরো খারাপ হয়।তাহুর মন খারাপ দেখে আদ্র বলে,
–আল্লাহ চাইলে শীঘ্রই ফিরবো।মাত্র দুইদিনের ব্যপার।মন খারাপের কোনো কারণ নেই।

তাহু দৌড়ে গিয়ে আদ্রকে জড়িয়ে ধরে।আদ্র মুচকি হাসে।কপালে চুমু দিয়ে ছেলেকে কিছুক্ষণ আদর করে বের হয়ে যায়।


যাওয়ার পরে কল করে জানায় ঠিকঠাক সে পৌছেছে।তাহু সস্থির নিঃশ্বাস নেয়।
______

দুপুরের রান্না করছিল তাহু।আকাশ কল করে জানায় তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল রুমে আছে।যে কারোর দিয়ে যেন আর্জেন্ট পাঠায়।

কিন্তু তাহু এত খুঁজে ও ফাইল নেয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পায়না।
আকাশ কলের উপর কল করে,
–“ভাইয়া কাউকে পাচ্ছি না আমি।”
–“কিন্তু আমি ও আসতে পারছি না।তুমি কি নিয়ে আসতে পারবে?”
–“কিন্তু আয়াত আছে আম্মু আছে এভাবে যেতে দিবে?”
–“আমি আম্মুকে কল করে বলছি।”

আদ্রর মা এসে বলে,
–“আয়াতকে আমি দেখে রাখবো।তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।”

তাহু আকাশের রুমে গিয়ে ফাইল নিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে।আকাশ যে কোম্পানিতে কাজ করে ওখানে যায়।
ওখানের এক কলিগ জানায় আকাশ কি একটা দরকারে বের হয়েছে কিছুক্ষণ এর জন্য,তাহু যেন অপেক্ষা করে।তাহু কিছুক্ষণ বসে ছিলো।
.
হঠাৎ লোকজনের আওয়াজ ভেসে উঠে।
‘আগুন লেগেছে,আগুন লেগেছে।’
_____________

আগুন বাড়তে থাকে ক্রমশ।কোম্পানির লোক গুলো এদিক সেদিক ছুটে।কেউ কেউ উঁচু থেকে লাফ দেয়।

আকাশ বাইরে থেকে ভিতরে যেতেই আগুন দেখতে পায়।লোকজন বলাবলি করছে সিলিন্ডার গ্যাস থেকে আগুন লেগেছে।কিভাবে লেগেছে কেউ জানেনা।

ফায়ার সার্ভিসকে কল করা হয়।আকাশের তাহুর কথা মাথা আসতেই ওর ফোনে কল দেয়।রিং কিছুক্ষণ হওয়ার পর মায়ের কন্ঠ ভেসে উঠে।
–“আম্মু তাহু কই?”
–“তাহু ফোন ফেলে গেছে।”
–“অহ শীট।”
–“কি হয়েছে?”
–“এখানে আগুন লেগেছে।তাহুর সাথে আমার মিট হয়নি।”
–“কিহ?তুই ঠিক আছিস?’
–“হ্যা আমি বাইরে আছি।ঠিক আছি।”

আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিভানোর চেষ্টা করছে।আদ্র ফোন নিয়ে ই বসেছিলো।ইউটিউবে সদ্য পাওয়া খবরে তার চোখ আটকে যায়।হ্যা বাংলাদেশের খবর।এটা তো আকাশের কোম্পানি।আকাশ ঠিক আছে তো?

নানান চিন্তায় আদ্র দ্রুত আকাশকে কল করে।আকাশ রিসিভ করে।
–“তুই ঠিক আছিস ভাই?”
–“আমি ঠিক আছি কিন্তু তাহু।”
–“তাহু মানে?”
আকাশ সব খুলে বলে।মুহুর্তে আদ্রর মুখের ভাষা স্তব্ধ হয়ে যায়।
–“আমি আজই বাংলাদেশে আসবো।”

প্রায় দুই ঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।চারদিকে আহাজারি আর পুড়ার গন্ধ।কিছু লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।আকাশ এদিক সেদিক ছুটছে তাহুর মতো কাউকে যদি দেখে।লাশ বের করছে খুঁজতে সময় লাগবে।আকাশের হাত পা তড়তড় করে কাঁপছে।
________
আদ্র বিমানে বসে আকাশকে কল দেয়।
–“শুন ভাই তাহুর কিছু হবেনা তাইনা?”

আকাশ চুপ।তারপরে আবার বলে,
–“তাহুকে কিভাবে চিনবো বুঝছি না।আমি জানিনা তাহু ছিল কিনা।তবুও আমাদের ত ওকে খুঁজতে হবে।”
আদ্র বলে,
–“তাহুর গলায় আমার আর তাহুর নামে চেইন আছে।”

আকাশ কল কেটে দেয়।লাশ আনা হচ্ছে।
যার যার স্বজনরা আহাজারি করে লাশ নিয়ে যাচ্ছে।কিছু লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছে।কিছু লাশ একদম ই চেনা যাচ্ছে না।
আকাশ সব মেয়ে লাশগুলোর গলার দিকে তাকায়।হঠাৎ একটা লাশের দিকে আকাশের চোখ গেলো।লাশটা প্রায় পুড়ে গেছে।তবে গলার চেইনটা দেখা যাচ্ছে।চেইনটা ও পুড়ে ভস্ম হয়েছে,গলায় লেগে গেছে।আকাশ গিয়ে লকেট টা চেক করে।লকেট টাও ভস্ম হয়ে দলা হয়েছে,তাও হাল্কা হাল্কা দেখা যাচ্ছে।আকাশ অনেক্ষন নিখুঁত ভাবে তাকিয়ে খেয়াল করে নামটা ‘আদ্র তাহু’।

ব্যাস আকাশ বুঝে এটা তাহুর লাশ।আকাশের ও আজ কান্না বাধ মানছেনা।ভাই কিভাবে সহ্য করবে?আকাশ কান্না করে ফেলে।
–“তাহু আমি দায়ী সবকিছুর জন্য।আমার জন্য আজ তোমাকে মরতে হলো।”
___________
লাশ বাসায় আনা হয়।আদ্রকে এখনো আকাশ কিছুই জানায়নি।আদ্র আসলেই দাফন হবে।
তাহুর চাচি এসে সেই তাহুর মাথার কাছে চুপচাপ বসে রয়েছে।আলো আয়াত আহিতাকে সামলাচ্ছে,সেও কাঁদছে।আদ্রর মা এমন হবে কখনো ভাবেনি।তার ও খারাপ লাগছে।


বাসার দুয়ারে পা রাখতেই আদ্র জানে তার বউ আর নেই।সে ছুটে যায়।কিন্তু মুখ দেখা যায় না পুড়ে ছাই।আদ্র লাশের পাশে বসে।ফুফিয়ে কাদে,

–“তাহু।এই তাহু আমি ত তোমাকে আগলে রাখব বলেছিলাম।আমি ত ভালবেসে ছিলাম তাও কেন চলে গেলে।সত্যি কি ভালবাসলে বউ মরে যায়?”
আদ্র আবারো বলে,
–“আমি কি নিয়ে বাঁচব তাহু?তোমরা সবাই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার প্লেন কেন করছো বলো?আমি অবহেলা করেছি বলেই অভিমান করেছো?আমি তো তোমাকে…..
এভাবে চলে যাওয়ার কথা ছিল না তাহু।কে আমার সাথে অভিমান করবে।কে আমার উপর ভরসা করবে।আর তোমার স্বপ্নগুলো সব তো অপূর্ণ থেকে গেলো।এভাবে অপ্রাপ্তি নিয়ে তুমি চলে যেতে পারো না তাহু।আমার তোমাকে প্রয়োজন।তুমি ছাড়া আমার চলবে না।কেন এভাবে শাস্তি দিলে তাহু?কেন?

উপস্থিত সকলের চোখে পানি।এমন হৃদয়বিধারক পরিস্থিতি দেখলে যে কারোর ই কান্না পাবে এটাই স্বাভাবিক।

আদ্র আর কিছুই বলল না চুপ করে বসে থাকলো।আদ্রর মা আদ্রর কাধে হাত রাখতেই আদ্র ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“তুমি খুশি তো আম্মু?আমার তাহু চলে গেলো।এবার তো সুখী হবে?”

আদ্রর মায়ের কথা বলার ভাষা নেই…….
তাহু ঠিকই বলেছিল সেদিন,
‘বেশি ভালবাসা দিলে বউ মরে যায়’

চলবে…………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে