প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০৮ সিজন০২

0
802

#প্রাপ্তির শহরে সিজন০২
#পর্ব-০৮
#তাহরীমা

.
দেখতে দেখতে আয়াত বড় হয়।তাহুর সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা ও শেষ হয়।সংসার বাচ্চা সামলানো দিন এভাবেই চলে যাচ্ছে।

মেঘা কয়েকদিন ধরে আকাশকে বলছে যে,সে আলাদা বাসায় থাকতে চায়।এরকম একসাথে থাকা তার ভাল লাগছেনা।এদিকে আকাশ বলে,
–“এটা কখনো বাবা মা মানবে না।জব করতে চাইছো করছো।এতেই ভাল থাকো।”

মেঘা এ নিয়ে মন খারাপ করে থাকে।

তাহু ভোরে নামাজ পড়ে বাবুকে খাইয়ে চা,বানাতে যায়।আদ্রর বাবা প্রতিদিন সবার আগেই উঠে তাহুর চায়ের জন্য বসে থাকে।তাহু ও শশুড়কে চা দিয়ে এটা সেটা গল্প করে তারপর বাকিরা আসে।

আদ্রর বাবা চা পান করতে করতে দেখে আকাশ,আদ্র,আদ্রর মা ও চলে এসেছে।তাদের ও চা দেয়।কিছুক্ষণ পর মেঘা এসে বসে পড়ে।আদ্রর বাবা সব খেয়াল করেও চুপ থাকেন।

তাহু মেঘাকে চা এগিয়ে দিতেই হাত ফসকে কাপটা পড়ে যায়।আর চা গুলো ছিটকে মেঘার কাপড়ে পড়ে।
মেঘা চিল্লিয়ে উঠে,
–“কি করেছো তুমি?ইস আমার কত সুন্দর কাপড় টা।”

তাহু ভয় পেয়ে যায়।আর বলে উঠে,
–“সরি।”
–“সামান্য সরিতে আমার কাপড় ঠিক হয়ে যাবে?”

আকাশ এসে ব্যাপার টা সামলানোর চেষ্টা করে বলে,
–“থাক না ভুলবশত হয়ে গেছে।”
–“ভুল?ও ইচ্ছে করে এমন করেছে।ও একটা হিংসুটে মেয়ে।”

আদ্র এতক্ষন চুপ ছিল।কিন্তু এটা শুনে খুব রাগ হচ্ছে তার।আজ যদি মেঘা ছোট ভাইয়ের বউ না হতো থাপ্পড় দিয়ে দিতো।

আদ্রর বাবা বলে,
–“ভুল মানুষের হয়।এটা তাহু ইচ্ছে করে করেনি।”

তখন আদ্রর মা বলে,
–“ইচ্ছে করে না করলেও যেমন তেমন ফেলেছে তো।তাহু এসব পরিষ্কার করে দে?”

তাহু অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে।তারপর মেঘার কাপড় পরিষ্কার করতে নিলে আদ্র ধমক দেয় তাহুকে যাতে সেটা পরিষ্কার না করে।কিন্তু তাহু আদ্রর চোখের ভাষা বুঝেনি।তাহু সব নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করে দেয়।

এতে আদ্র আর তার বাবা দুজনেই এ দৃশ্য দেখে খুব কষ্ট পায়।তারা উঠে চলে যায়।

তাহু সব গুছিয়ে রুমে আসে।আদ্র তখন ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকে।

তাহু মন খারাপ করে ছাদে যায়।আর ভাবে, ‘এত ভালবেসে ও কেন শাশুড়ির মন জয় করা যায় না?কেন মেঘাকে যেভাবে ভালবাসে তাকে সেভাবে ভালবাসে না।তার তো কাজ করতে কষ্ট হয়না।কষ্ট হয় শাশুড়ির ব্যবহারে।’

পিছন থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আদ্রর বাবা।তাহু ঘুরে দাঁড়ায়,
–“আব্বু?”
–“এখানে কেন তুই?”
–“ভাল লাগছিল না তাই।”
–“তোর কপাল টা এমন কেন রে?তুই এত সহজ সরল কেন?একটু কি কঠোর হতে পারিস না?”

তাহু ফুফিয়ে কাদে,
–“আমাকে আম্মু একটু ও ভালবাসে না।আমি গরীবের মেয়ে বলে তাইনা?”
–“তুই গরীব হলেও তোর মনটা যে বড়লোকের।একদিন দেখবি তোর সব পাওয়া পূর্ণ হবে।আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে থাকবে।”

তাহু আদ্রর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাদে।বাবার কথা তাহুর মনে নেই।তবে এই বাবাকে পেয়ে সে ধন্য।

_______
সামনে মেডিকেল ভর্তি প্রিপারেশন।তাহুকে আদ্র একটা কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দেয়।তারপর যা যা পড়তে হবে সব বই এনে দেয়।আদ্রর মা বলে,
–“শেষমেশ তুই বউকে ডাক্তার বানাবি?”
–“আল্লাহ চাইলে অবশ্যই হবে।”

আদ্রর মা রাগ দেখিয়ে যায়।তাহুর এসব আর ভাল লাগছে না।

অইদিনের ঘটনার পর থেকে আদ্র তাহুর সাথে তেমন কথা বলেনা।

রাতে পড়তে বসলে আদ্র বলে,
–“বেশি রাত জেগে পড়তে হবেনা।”
এই বলে চলে যেতে নিলে তাহু বলে,
–“এভাবে কেন চুপচাপ হয়ে আছেন?আগের মত হাসিমুখে বলুন?আমি ডাক্তারি পড়তে চাইনা।”

আদ্র চলে যায় কিছুই বলেনা।তাহুর কান্না চলে আসে।
–“কেন অবহেলা করছেন এত।আমার ত সহ্য হয়না।”
______

তাহু সকালে চা করে দিলে আদ্র চুপচাপ খেয়ে চলে যায়।প্রতিদিন ত তাহুকে খেতে বলে এখন আর বলেনা।এইসব অবহেলা তাহু নিতে পারছেনা।

আদ্রর বাবা এসব খেয়াল করে।রুমে আদ্র বসে ছিল তখন আদ্রর বাবা ও যায়।
–“আব্বু আসো বসো?”

আদ্রর বাবা বিছানায় বসে।
–“তুই তাহুর সাথে কথা বলিস না?”
–“বলিতো।”
–“তাহলে মেয়েটার মন খারাপ কেন?”

আদ্র চুপ।
–“তুই ও তোর মায়ের মত ওকে অত্যাচার করতে চাইছিস?”

আদ্র এবার হাল্কা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
–“মেয়েটা কেন এত নরম মনের।কেন অন্যায় গুলো মেনে নেয়।তাহুর প্রতি আমার এই একটায় অভিযোগ।”

–“কিন্তু সবার অবহেলা একদিকে তোর অবহেলা একদিকে।মেয়েটা যে ভেঙ্গে পড়ছে।”

–“কয়েকদিন যাক।সে নিজ থেকে বুঝোক আমার রাগের কারণ।একটু শক্ত হোক।তারপর কথা বলবো।”

–“অবহেলা করিস না।মেয়েটা খুব ভাল রে।এজন্য বেশি কষ্ট পায়।”

আদ্র বলে,
–“আমি ওকে কষ্ট দিতে চায়না।তবে সে একটু প্রতিবাদী হোক এটাই চাই।”

_______

মেঘা আর আকাশ ঝগড়া করছে।ঝগড়ার মূল মেঘা একসাথে থাকবেনা।আর আকাশ যদি রাজি না হয় সে বাপের বাড়ি চলে যাবে।

অবশেষে আকাশ তার বাবা মাকে এটা বলে।আদ্রর বাবা তখন রেগে যায়,
–“তুই যখন যেটা বলেছিস সেটা শুনেছি।এখন আর এসব শুনতে চাইনা।আমি বেচে থাকতে এসব কখনো ই মেনে নিবো না।’

তখন আকাশ রেগে বলে,
–“তোমরা কি চাইছো আমার সংসার ভাঙ্গুক।মেঘা আজই বাপের বাড়ি চলে যাবে।”

আদ্রর বাবা বলে,
–“দেখেছো আদ্রর মা আকাশ আমার সাথে রেগে কথা বলছে।পড়ালেখা করে এই শিক্ষা পেয়েছে?”

আকাশ বলে,
–“তুমি আমাকে রাগতে বাধ্য করছো।ভালই ভালই মেনে নিলে ত হয়।তাছাড়া তোমার আদরের বউ মা ত থাকবেই।”

আদ্রর বাবা চুপ হয়ে যান।আদ্রর মা বলেন,
–“আমরা বেচে থাকতে অন্তত কেউ আলাদা হইস না।”

আকাশ রাগ দেখিয়ে ধুমধাম পা ফেলে ওখান থেকে চলে আসে।এসেই মেঘাকে এসব বলতেই সে আর কিছুই শুনতে চায়না।কাপড় গুছিয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়।

__

আলো কল করে মা বলে,
–“কয়েকদিনের জন্য আব্বু আর তুমি বেড়াতে এসো?”

আদ্রর বাবা রাজি হয়না।উনার মন ভালো নেই।এদিকে আদ্রর মায়ের আলোকে আর আহিতাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।কতদিন হলো এদের দেখেনা।তাই ঠিক হলো।আদ্রর মা একাই যাবে।আদ্রর মা আলোর বাসায় চলে যান।
.
.
রাতে আদ্রর বাবাকে তাহু জোর করে খাওয়ায়,উনি কিছুই খাবেন না বলেন।

তারপর সবার খাওয়াদাওয়া শেষে তাহু সব গুছিয়ে চলে যেতে নিলে খেয়াল করলো শশুড়ের রুমে লাইট অন।উনি কি এখনো ঘুমান নি?ঘুম আসছে না নাকি?

তাহু এগিয়ে যায়।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে আদ্রর বাবা কি যেন ভাবছে।
–“আব্বু ঘুমাবেন না?”

আদ্রর বাবা তাহুর দিকে তাকায়।
–“আয় ভিতরে।”
–“ঘুম আসছেনা?আমি কি ঘুম পাড়িয়ে দিবো?”
–“ঘুম আসবেনা।ভাবছি ছেলেমেয়ে গুলা এমন হয় কেন?”

তাহু চুপ
–“জানিস আমরা বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের কোলেপিঠে মানুষ করি,তাদের সব শখ চাওয়া পাওয়া পূরণ করে পড়ালেখা করে মানুষ করায়।কিন্তু আদৌ তারা মানুষ হয়?”

–“আব্বু এসব কেন বলছেন?”
–“আমরা ছোটবেলায় তাদের আগলে রাখি।আর ওরা বড় হয়ে আর আমাদের সাথে থাকতে চায়না।”

তাহু আকাশ আর মেঘার ব্যাপারটা জানেনা।তাই সে কিছুই বুঝছেনা।তারপর আদ্রর বাবা আকাশের কথা বলে।তিনি যে কতটা আঘাত পেয়েছেন বুঝা ই যাচ্ছে।

তাহু তখন আদ্রর বাবার হাত জোর করে বলে,
–“আমরা ত আছি নাকি।এক সন্তান আলাদা থাকলে আপনার আরেক সন্তান ত আছে নাকি?”
–“আদ্রকে যেভাবে বড় করেছি আকাশ ও ত সেভাবে আদর যত্ন দিয়ে বড় করেছি।তাহলে?”

তাহুর আর জবাব নেই।
–“আব্বু এসব নিয়ে ভাববেন না আর।শুয়ে পড়ুন।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
–“তুই একদম আমার মায়ের মতো।”

তাহুর চোখ ছলছল করে উঠে।

আদ্রর বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে।তাহু চলে আসে।আজকে ও আদ্র নিজে নিজে ঘুমিয়ে গেছে।আগে তার জন্য অপেক্ষা করত।জড়িয়ে ধরার বাহনা খুঁজত। আর এখন?তাহুর কান্না চলে আসে।ছেলের কপালে চুমু দিয়ে সে ও শুয়ে পড়ে।

________

প্রতিদিন কার মত তাহু চা বানাতে যায়।কিন্তু চা করার পর শশুড় রুম থেকে আসেনা।তাহু অবাক হয়।এত বেলা তো উনি ঘুমান না।প্রতিদিন নামাজ পড়ে ই উনি চায়ের জন্য বসে থাকেন।

তাহু আস্তে আস্তে চা নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।চায়ের কাপ পাশের টেবিলে রাখে।কালকে রাতে যেভাবে ঘুমিয়ে ছিল সেভাবেই আছেন।

তাহু আস্তে করে ডাকে।
–“আব্বু।আব্বু চা এনেছি।”
কিন্তু সাড়া নেই।এবার জোরে ডাকে,
–“আব্বু?আব্বু!

তাহু এবার ফুফিয়ে কেঁদে উঠে দৌড়ে আদ্রর কাছে যায়।

তাহুকে এভাবে দেখে আদ্র ভয় পেয়ে যায়।
–“কি হয়েছে তাহু?”
–“আব্বু কথা বলছে না।ঘুম থেকে এখনো উঠেন নি?”

আদ্র আতংকিত হয়ে বলে,
–“কিহ?”
আদ্র দৌড়ে রুম থেকে বের হয়।গিয়ে বাবার গায়ে হাত রাখে।শরীর কেমন শীতল।

আদ্র ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে।কাল তাহু ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার পর রাতে উনার ঘুম ভেঙ্গে যায়।আকাশ,আদ্রর মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি হার্ট এট্যাক করেন।

আদ্রকে বসে থাকতে দেখে তাহু কাপাহাতে আদ্রকে বলে,
–“কি হলো?আব্বু কথা বলছে না কেন?”

আদ্র তখন ঠোট নেড়ে বলে,
–“আব্বু আর নেই তাহু।”

তাহু গিয়ে শশুড় কে জড়িয়ে ধরে।এই কথাটা কিছুতেই তাহু বিশ্বাস করবেনা।তার এক বাবা ছোটবেলায় রেখে চলে গেছে আল্লাহর কাছে।আরেক বাবা পেয়ে সে তো ভালই ছিল সে ও যেতে পারেনা।নাহ এই বাবা তাকে ছেড়ে যেতে পারেনা,পারেনা।
এই কালকেই তো আব্বু কথা বললেন?আজকে এভাবে কেন ছেড়ে যাবে?কেন?

তাহু হু হু করে কেঁদে উঠে।

মৃত্যু শব্দটার কাছে প্রত্যেক সম্পর্ক অসহায়।নিঃশ্বাস ফুরিয়ে গেলে কেউ বেধে রাখতে পারেনা।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে