প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
2070

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_২৯
#তানজিলা_খাতুন_তানু

সেইদিন অতসী মায়ের হাত ধরে বেড়িয়ে যাবার পর কেটে যায় ৫টা বছর। এই ৫বছরে আকরাম খান একবারো ওদের খোঁজখবর নেয়নি। রুদ্র প্রায় সময়ে দেখা করতে আসত।

খাঁন ভিলা থেকে বের হয়ে অতসী আর ওর মা ওর মামার বাড়িতে আসে। মামার বাড়ির আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল ছিল তাই অতসীর কোনো অসুবিধা হয়নি তবে অতসী মাধ্যমিক দেবার পর থেকে টিউশনি পড়াতে শুরু করে। নিজের প্রয়োজন টুকু নিজে থেকে মেটাতে শুরু করে।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে অতসী মেডিকেল কলেজে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অতসীর বড্ড ইচ্ছা বড়ো ডাক্তার হবে, ড. অতসী খাঁন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। অতসীর নানু ওকে বড্ড ভালোবাসত, ওর মেডিকেল পড়ার খরচ তিনিই বহন করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু সেটা সবার আগেই উনি মা/রা যান। অতসী নানুর মৃ/ত্যুর দিন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে শুধুমাত্র একটা কথাই বলেছিল, “মা আবার আর ডাক্তারি পড়া হবে তো!”

নানু মা/রা যাবার পর কয়েকদিন পর থেকে থেকেই অতসীদের নিয়ে মামার বাড়িতে অসুবিধা শুরু হয়। অতসীর মামি ওর মামার সাথে প্রতিদিন ঝামেলা করতে থাকে।

– এতদিন অনেক সহ্য করেছি আর পারছি না। তোমার বোন আর ভাগ্নীকে আমার ঘর থেকে বিদায় করো।
– এইভাবে বলছো কেন, জানো তো দিদির জীবনে সমস্যা চলছে তাই এই বাড়িতে আছে।
– এই সমস্যা কোনোদিন মিটবে বলে আমার মনে হয় না। তুমি ওদের চলে যেতে বলো, নাহলে আমি এই সংসার ছেড়ে চলে যাবো।

অতসীর মামা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কি করবে কিছুই বুঝতে পারলেন না। একদিকে বোন আর একদিকে স্ত্রী, কোনটা বেছে নেবেন উনি।

অতসী এসেছিল মামার সাথে কথা বলতে। দরজায় দাঁড়িয়ে মামা মামির কথা শুনে অতসী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, সোজা মায়ের কাছে গিয়ে বলল…

– মা আমি আর এই বাড়িতে কিছুতেই থাকব না।
– কেন?
– কেন সেটা তুমি বুঝতে পারছো না মা। এই বাড়িতে কেউই চাই না আমরা এই বাড়িতে থাকি মা প্লিজ চলো আমরা অন্য জায়গায় চলে যায়।
– কিন্তু কোথায় যাবি মা।
– জানি না মা। তবে এই বাড়িতে থাকব না। তুমি কোনো চিন্তা করো না আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নেবো।

অতসীর মা চোখের পানি ফেলে বললেন..

– মারে আমাকে মাফ করে দিস। আমার আর রুহির জন্য তুই রাজরানির জীবন থেকে দাসীর মতো জীবন যাপন করছিস।
– মা মন খারাপ করো না। যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
– হুম।

অতসী মায়ের আড়ালে গিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। মায়ের সামনে নিজেকে শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে ওহ নিজেও ভেঙে পড়ছে, নানু মারা যাবার পর অতসী নিজেদের অবস্থানটা হারে হারে টের পাচ্ছে।

রাতে খাবার টেবিলে,

অতসীর মামাতো বোন টিয়া ওকে দেখে বলে উঠল,

– কিরে অতু তোর মেডিকেল এক্সামের রেজাল্ট কবে দেবে।

অতসী কোনো উত্তর না দিয়ে ওর মামির আর ওর মায়ের দিকে তাকালো। টিয়ার কথাটা শুনে অতসীর মামি খ্যাক খ্যাক করে উঠল,

– কিসের এক্সাম?
– অতু মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল তার রেজাল্টের কথাই জিজ্ঞেস করছি।

কথাটা শুনে অতসীর মামি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অতসীর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

– দ্যাখো দিদি এমনিতেই বাবা মারা যাবার পর থেকেই তোমার ভাইয়ের ব্যবসা ভালো চলছে না। তার উপরে টিয়ার পড়াশোনা, বিয়ের জন্য কিছু জমিয়ে রাখতে হচ্ছে এইরকম পরিস্থিতিতে অতসীর মেডিকেল কলেজে পড়ানোর খরচ চালানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

অতসীর মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে খাবার ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। অতসী স্বাভাবিক থাকল, যেন কিছুই হয়নি। অতসীর চুপচাপ থাকা টিয়াকে ভাবিয়ে তুলল। তবে সেও চুপ করূন থাকলো। অতসী খাবার টেবিল থেকে উঠে যেতেই টিয়া বলল,

– মা এইসব কি বললে তুমি! জানো না অতসীর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা কত। আর দাদুভাই তো অতসীর নামে টাকা,সম্পত্তি রেখে গেছেন সেইগুলোতে তো ওর মেডিকেল পড়ার হয়ে যাবে।
– চুপ একদম চুপ। এই কথাটা যদি কেউ জানে তাহলে সেইদিনই এই বাড়িতে তোর শেষ দিন হবে। তোর পড়াশোনা, খাওয়া সব আমি বন্ধ করে দেব।

টিয়া চুপ করে গেল। মায়ের জেদ সম্পর্কে ভালোই জানে ওহ, এখন যদি মায়ের বিরুদ্ধে যায় তাহলে মা কি কি করবে সেটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে ও।

টিয়া অতসীর কাছে যেতে, অতসী ওকে কিছু বলতে না দিয়ে বলল,

– টিয়াদি প্লিজ আমাকে শান্তনা দিয়ো না। যার বাবাই তাকে দেখে না, তাকে অন্য কেউ দেখবে এটা আশা করা খুব বোকামী। বাদ দাও এইসব, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

অতসী ওর নানুর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। নানুর বিছানা, জিনিসপত্রগুলো স্পর্শ করে দেখতে থাকে। নানুর পাঞ্জাবি নিজের বুকে চেপে ধরে অতসী তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,

– জানো নানু তুমি চলে যাবার পরেই না সবাই স্বার্থপর হয়ে গেছে, মামি শুধু নিজের স্বার্থটাই বুঝছে। আমি আর মা যে তার কাছে বড্ড ভারি হয়ে গেছি। আমার মেডিকেল পড়া বন্ধ করার জন্য কি সুন্দর একটা বাহানা দিলো, মামার ব্যবসা নাকি আগের মতো চলছে না! অথচ ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। আমি আর এইখানে থাকব না নানু, আমাকে মাফ করে দিও।

পরেরদিন, অতসী বাড়ি ভাড়া খুঁজতে লাগল। মাকে নিয়ে তাড়াতাড়িই এই বাড়ি থেকে চলে যাবে থাকবে না এইখানে।

অতসী অনেক খোঁজ করে একটা বাড়ি পেয়ে যায়। মাকে নিয়ে নতুন‌ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে বলে প্রস্তুতি নেয়। টিয়া অতসী কে জড়িয়ে ধরে, বারবার যেতে বারন করে। অতসী টিয়া আর মামার কথা না‌ শুনেই মাকে নিয়ে চলে যায়। নতুন বাড়িতে নতুন করে সবকিছু সাজিয়ে নেয়।

– মা এইখানে তো চলে আসলাম, কিন্তু এখন সংসার কিভাবে চালাবো।
– চিন্তা করো না মা, আমি সব ঠিক করে দেবো।

অতসী আশ্বাস দিলেও ওর মা শান্ত হতে পারল না। এইভাবেই কেটে যায় কয়েকদিন। অতসী টিউশনি পড়ানো বাড়িয়ে দিলো। জমানো টাকা দিয়ে সংসার মোটামুটি ভালোই চলে যাচ্ছে।

ওইদিকে..

রুদ্র ওর মা আর বোনকে দেখতে মামার বাড়িতে আসে। কিন্তু বাড়িতে ওদের কাউকে পাইনা। মামিকে জিজ্ঞেস করলেও মামি চুপ করে থাকে, তখন টিয়া বলে,

– মা মনি আর অতুকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
– কি?
– হ্যাঁ রুদ্রদা আমি অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি আমাকে মাফ করে দাও।
– বাড়ির ঠিকানা জানিস।
– হুমম।
– আচ্ছা আমাকে দে।

রুদ্র টিয়ার থেকে ঠিকানাটা নিয়ে চলে যায় মায়ের সাথে দেখা করতে। মায়ের কাছ সবকিছু শুনে রুদ্র বলে,

– মা এতকিছু হয়ে গেলে একবারো আমাকে বললে না।
– তোর বোনকে তো চিনিস।
– হুম।‌ আমি দেখছি।

রুদ্র বাড়ি ফিরে গিয়ে ওর বাবার সাথে মুখোমুখি হয়।

– বাবা কিছু কথা ছিলো।
– কি বলো।
– বাবা নানু চলে যাবার পর থেকে ওই বাড়িতে ঝামেলা শুরু হয়। আর এখন বোন আর মা ভাড়া বাড়িতে থাকে।

আকরাম খান চমকে উঠলেন। এইরকম কিছু হবে, সেটা কখনোই আশা করে নি।

– কি বলছো এইসব।
– হ্যাঁ ঠিক বলছি। বাবা প্লিজ এতগুলো বছর তো অনেক জেদ নিয়ে বসে থাকলে প্লিজ এইবার সবকিছু মিটিয়ে নাও না।

আকরাম খান চুপ করে রইলেন।

– বাবা প্লিজ।

আকরাম খান কিছুই না বলে স্থান ত্যাগ করলেন। রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

২দিন পর,

অতসী টিউশনি পড়িয়ে বাড়িতে এসে চমকে উঠল। তার ভাড়া বাড়িতে স্বয়ং আকরাম খাঁন উপস্থিত আছে। অতসী ওনাকে দেখেও না দেখার ভান করে ভেতরে ঢুকে গেলো।

– অতসী মা।

অতসী থমকে গেলো। একটা অদৃশ্য টান অতসী কে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য করল। আকরাম খান নিজের জেদ সরিয়ে রেখে অতসীর সামনে গিয়ে বললেন,

– কিরে কথা বলবি না আমার সাথে। একবার বাবা বলে জড়িয়ে ধরবি না। কিরে মা বুকে আয়।

অতসী নিজের জেদ ধরে রাখতে পারল না। আকরাম খানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অতসীর মায়ের চোখে সুখের পানি।

মান অভিমান পর্ব শেষ‌ হয়ে যাবার পর আকরাম খাঁন বললে,

– অতসী চল মা বাড়ি ফিরে চল।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে বাবার ভালোবাসা পাবার লোভে অতসী বাড়ি ফিরতে রাজি হয়ে যায়। খাঁন ভিলা আনন্দে মেতে উঠল, অতসী খুব খুশি এতদিন পর বাড়ি ফিরে গিয়ে। কিন্তু খুশি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। অতসীর জীবনে আবারো নতুন ঝড়ের আগমন ঘটল।

অতসী মেডিকেল কলেজের এক্সামের রেজাল্ট নিয়ে খুব খুশি ছিল। ভেবেছিল রাতে খাবার সময়ে সকলকে সারপ্রাইজ দেবে কিন্তু তার আগে ওর বাবা ওকে সারপ্রাইজ দিয়ে দেয়।

– আমার একটা কথা বলার আছে।
– বাবা আমিও একটা কথা বলতে চাই।
– ঠিকাছে আগে আমার কথাটা শুনে নাও তারপরে শুনব।

অতসী বাবার কথাতে রাজি হয়ে গিয়ে চুপ করে থাকে। আকরাম খাঁন সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– আমি অতসীর জন্য পাত্র ঠিক করেছি। আগামীকাল ওকে দেখতে আসবে, আমি চাই অতসী আমার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করুক।

অতসীর মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল।

– বাবা এইসব তুমি কী বলছ। আমি পড়তে চাই আমি কিছুতেই বিয়ে করব না।
– আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। এটাই আমার সিদ্ধান্ত।

আকরাম খাঁন চলে গেলেন। অতসী ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল,

– মা আমার মেডিকেল কলেজে চান্স হয়েছে প্লিজ তুমি বাবাকে বোঝাও না।
– আচ্ছা আমি দেখছি।

অতসীর মা ঘরের দিকে চলে গেলেন। অতসী কি মনে করে ওনার পেছনে গেলেন।

অতসীর মা স্বামীর সামনে গিয়ে বলল,
– বলছি মেয়েটার বড্ড শখ ডাক্তার হবে, ওকে পড়তে দাও না।
– মেয়ে মানুষের এত পড়াশোনা করে কাজ নেয়। আর তুমি ওর সাথে সাধ দিয়ো না দয়া করে।
– কিন্তু মেয়েটা তো‌ রাজি হচ্ছে না।
– প্রয়োজনে জোর করে করাও। এক মেয়ে তো আমার নাক ডুবিয়ে চলে গেছে এখন যদি তোমার ছোট মেয়েও ওই কাজ করে! আমি কোনো রিস্ক দিতে পারব না, এই বিয়ে হবে।
– কিন্তু
– কোনো কিন্তু নয়। আর একটা কথা কি জানো, এই বিয়েটা আমার জন্য আমাদের কোম্পানির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
– মানে?
– মিস্টার মল্লিকের ছেলের সাথে আমাদের অতসীর বিয়ে হলে আমাদের মাঝে বিজনেস বন্ডিংটা আরো স্ট্রং হবে। আর সব ডিল আমাদের সাথেই করবেন।

আকরাম খাঁন কথাটা শুনে অতসীর মা ও অতসী চমকে উঠল। অতসী কখনোই ভাবতে পারিনি ওর বাব ওকে ব্যবহার করবে এইভাবে। অতসী আর সহ্য করতে পারল না, ঘরের মধ্যে এসে বলল,

– তারমানে আমাদের এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনার এটাই কারন তাই তো।

অতসীকে এইখানে দেখে ওনারা দুজনেই চমকে উঠল। আকরাম খাঁন বুঝে গেছেন অতসী সব শুনে নিয়েছে তাই লুকিয়ে লাভ নেয় তাই বললেন,

– যেটা ভাববে সেটাই। বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে,নাহলে সারাজীবনের জন্য তুমি আমার মেয়ের পরিচয় হারাবে।

অতসীর মাথাতে আবারো জেদ চেপে গেল।

– লাগবে না আপনার পরিচয়।‌ আমি আপনার পরিচয় ছাড়াই দাঁড়িয়ে দেখব, প্রয়োজনে না খেতে পেয়ে মা/রা যাব তবুও আপনার জেদের কাছে মাথা নাড়ব না। আপনি আপনার এই রাজপ্রাসাদে একাই থাকুন, মা চলো।

অতসী ওর মায়ের হাত ধরে চলতে থাকলেও ওর মা একপাও নড়ল না। অতসী ওর‌ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

– মা কি হলো চলো।
– না আমি কোথাও যাবো না।

অতসী অবাক হয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। অতসী কিছু বলতে যাবে তার আগে ওর বাবা ওর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

– নিজের মেয়েকে বোঝাও। আর অতসী জেদ করে লাভ নেয় আশা করি নিজের ভালোটা তুমি বুঝবে।

অতসীর মা অতসী কে নিয়ে অন্যঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

– মা এইগুলো কি করছ। চলো আমি আর থাকব না এইখানে।
– না অতসী। একবার ভুল করে আমি ওর বাবার থেকে এই সংসার থেকে ৫বছর দূরে ছিলাম আবার সেই একই ভুল করতে পারব না।
– মা! (অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে)
– মা পাগলামী করিস না। রুহির কথাকা একবার চিন্তা কর।
– মা বাবাকে বোঝাও এত জেদ না করতে। একদিন দেখবে এই জেদটা ওনার থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আর আমি কখনোই ওনাকে ক্ষমা করব না কথাটা বলে দিও ওনাকে।

অতসী নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে দেয়। অতসীর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এইবার বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেলেন উনি, কোনো কিজূর বিনিময়েই আর নিজের সংসার ছাড়তে রাজি নন উনি।

রুদ্র অফিস থেকে ফিরে এসে চুপচাপ বাড়ি থেকে মাকে জিজ্ঞেস করে,

– মা কি হয়েছে এত চুপচাপ কেন? আর অতসীর রেজাল্ট কি হলো।

মা রুদ্রকে সবকিছু খুলে বলল। রুদ্র অবাক হয়ে বলল

– মা, বাবা আবারো একই ভুল করতে যাচ্ছে। আমাকে বাবার সাথে কথা বলতেই হবে।

রুদ্র ওর বাবার সাথে কথা বলতে গেল। সেইদিন কি রুদ্র পেরেছিল ওর বাবাকে বোঝাতে?

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩০
#তানজিলা_খাতুন_তানু

অতসী নিজের ভাবনার মাঝে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সেই খেয়াল নেয়। সকালে মিষ্টি রোদ ওর চোখে পড়াতে ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৬টা বাজে। অতসী আর আলসেমি না করে উঠে পড়ল। গোছগাছ করতে হবে,আজকেই সবাই ফিরে যাবে।

অতসী ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে দেখল কতকগুলো মুখ ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার এইরকম কান্ডে ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, নিলয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– কি হয়েছে এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– তুই ঠিক আছিস তো।
– কেন?
– না এমনি।

সকলেই আশা করেছিল কালকের ঘটনা অতসীর মনে একটা দাগ কাটব, হয়তো অতসী ভেঙে পড়বে কিন্তু সকলের ভাবনাকে ভুল বলে প্রমানিত করে অতসী স্ট্রং হয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের সামনে।

অতসী টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট খেতে লাগল। রুদ্রর অতসীর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

– বোন বাড়ি ফিরে চল।
– কার বাড়ি? কিসের বাড়ি দাদাভাই।
– আর কতদিন জেদ করে থাকবি ফিরে চল।

অতসী কিছু বললো না। অতসী কে নিঃশ্চুপ থাকতে দেখে নিলয় বলল,

– আমি রুদ্রের কাছে সবকিছু শুনেছি আমি জানি যেটা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি। তবুও তুই ফিরে যা প্লিজ।
– সবটা জেনেও এই কথাটা বলছো?

অতসী ভ্রু কুঁচকে নিলয়ের উদ্দেশ্য কথাটা বলল। নিলয় কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। জিনিয়া এতক্ষন চুপ করে বসে সবটা শুনছিল, এইবার মুখ খুলল,

– অতসী আমি জানি না তোর লাইফে ঠিক কি কি হয়েছিল যার জন্য তুই পরিবার থেকে আলাদা থাকিস,তবে অতীতের জন্য নিজের বর্তমান ভবিষ্যতটাকে নষ্ট করিস না।

জিনিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে অতসী চুপ করে উঠে চলে গেল। সকলেই হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুদ্র মনে মনে বলল,

– এই জেদটাই আমাদের পরিবারটাকে ছাড়খাড় করে দিলো।

২দিন পর,

রির্সোট থেকে ফিরে আসার পর অতসী দুইদিন নিজেকে ঘরবন্ধি করে রেখেছে। কলেজেও যায়নি আর না আরুকে পড়াতে গেছে। আরুকে দুইদিন অতসী পড়াতে আসছে না দেখে আদৃত মিতুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– অতসীর খবর কি? পড়াতে আসছে না কেন?
– জানি না
– ওহ।

আদৃত চলে যেতে যাবে তখনি মিতু পেছন ডাকল,

-দাভাই।
– কি বল।
– তোকে একটা কথা জানানোর ছিল।
– কি কথা।
– জানি কথাটা শুনে অনেকটা অবাক হবি, কিন্তু এটাই সত্যি।
– কি কথা।
– অতসী রুহি ভাবির বোন।

আদৃত চমকে উঠল। এইটা কখনোই আশা করেনি। আদৃত জানত রুহির বোন আছে তবে তাকে কখনোই দেখেনি, নামটাও শুনেছিল কিন্তু এতগুলো বছরে ভুলে গিয়েছে।

– তুই এইটা জানলি কিভাবে। আর অতসী যদি রুহির বোন হয় তাহলে ও টিউশনি পড়ায় আর ভাড়া বাড়িতে থাকে কেন?

জিনিয়ার বৌভাতের দিনের সবকিছু মিতু আদৃতকে খুলে বলল। সবটা শুনে আদৃত চমকে উঠল।

– এই আকরাম খাঁনের জেদের কারনে আজকে এতগুলো মানুষের জীবন এলোমেলো হয়ে আছে। কে জানে এখনো আগের মতোই জেদি আছে কিনা।
– দাভাই আমার মনে হয় ওনাদের মুখোমুখি হওয়া দরকার তোর। ওনাদের ও তো জানার অধিকার আছে যে ভাবি আর বেঁ/চে নেই।
– বাদ দে এইসব। তুই নিজের ঘরে যা।

মিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। আদৃত নিজের মনে বিরবির করে বলল,

– কিসের জন্য ওই মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াব আমি। ওনার কারনেই তো রুহি আজকে আমার কাছে নেই। ওই মানুষটাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না।

মিতু নিজের ঘরে গিয়ে পুরানো কথাগুলো ভাবতে থাকে। রুহির সাথে মিতুর সম্পর্ক ছিল বোনের মতো, বড্ড ভালোবাসত রুহিকে। যেদিন রুহির প্রেগন্যান্টের কথা শুনেছিল সেইদিন মিতুর লাফালাফি দেখে কে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছূ এলোমেলো হয়ে গেল।

বাড়িতে মিতু আর রুহি একাই ছিল। আদৃত ওর মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই রুহি যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠে। মিতু বড্ড ভয় পেয়ে যায়, তখন মিতু অনেকটাই ছোট এইসবের কিছুই বুঝত না। রুহির কান্না দেখে নিজেও কেঁদে দেয়।

– ভাবি কি হয়েছে তোমার, কাঁদছ কেন? ভাবি তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে ওহ ভাবি বলো।

রুহির অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মিতু উপায় না পেয়ে আদৃত কে ফোন করে সবটা বলে। কাছাকাছি থাকাতে আদৃত তাড়াতাড়ি এসে রুহিকে হসপিটালে ভর্তি করায়।

ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল,
– প্রেশেন্টের বাড়ি লোক কারা।
– আমি রুহির হাসবেন্ড। কি হয়েছে রুহি ঠিক আছে তো।
– প্রেশেন্টের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। পুরানো একটা চোটের কারনে ওনাকে আগেই বলা হয়েছিল বেবিটাকে না রাখতে। কিন্তু উনি শোনেননি এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করব তবে আপনারা যেকোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকুন। যা কিছূ হয়ে যেতে পারে।

ডাক্তার চলে গেল। আদৃত চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক চলাফেরা করতে লাগল।

২ঘন্টা পর।

ওটির আলো বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে ডাক্তার হতাশ মুখে বেরিয়ে আসেন। আদৃত ওনাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,

– ডক্টর রুহি ঠিক আছে তো।
– আই অ্যাম সরি মিষ্টার। প্রেশেন্টকে আমরা
বাঁ/চা/তে পারিনি তবে আপনার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।

একদিকে স্ত্রীয়ের মৃ/ত্যু আর অন্যদিকে ফুটফুটে মেয়ে। আদৃত আরুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করল। আরুশীই আদৃতের সবকিছু হয়ে উঠল। যতটুকু পারত মেয়েটাকে সময় দিত, মিতু আর মায়ের সহযোগীতায় একাই মেয়েটিকে এতটা বড়ো করে তুলেছে।

রুদ্র কাজে দুইদিন বাড়ি ফিরতে পারেনি। আজকে বাড়ি ফিরে রাতে মা আর স্ত্রীর সামনে বলে উঠল,

– বাবা আমার সাথে বোনের দেখা হয়েছিল।

রুদ্রের কথা শুনে সকলেই চমকে উঠল। রুদ্রের মা বললেন,

– তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে আসলি না কেন? কতদিন মেয়েটাকে দেখিনি।
– মা তোমার মনে‌ হয় বোন এত সহজে সবকিছু ভুলে আসবে।

রুদ্রের মা ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।

– মেয়েটার যে বড্ড আত্মসম্মান বোধ আর বাবার মতো প্রচন্ড জেদি হয়েছে। এতগুলো বছর আমাদের চোখের আড়ালে থেকে কিভাবে দিন কাটাচ্ছে কে জানে।

রুদ্র ওনাদের সবকিছু খুলে বললো। রুদ্রর মায়ের কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে গেল। সামিয়া ওনাকে শান্ত করে ঘরে দিয়ে আসলো। ফিরে এসে রুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

– অতসীকে কি কোনো ভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
– জানি না গো।‌ আমার আদরের দুইবোন আমার থেকে কত দূরে আমার নিজেকে ব্যর্থ মানুষ মনে হয়।‌ দাদা হয়েও বোনদের দেখে রাখতে পারিনি।

রুদ্রকে সামিয়া শান্তনা দিতে লাগল। রাতে আকরাম খাঁন ফিরে এসে দেখলেন ওনার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছে। এগিয়ে এসে মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এই ২বছরে অনেকটাই বদলে গেছেন উনি। অতসীর জেদ ওনাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে। কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে রুদ্রের মা চোখ খুলে তাকালেন।

স্ত্রীকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বলল,

– কি হয়েছে এখন শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ নাকি!

কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে বসলেন। তারপরে আনমনে বলে উঠলেন,

– তোমাদের জেদের কারনেই আমার দুই মেয়েই আমার থেকে দূরে। তবুও রুহি তো তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে আছে, কিন্তু আমার ছোট্ট অতসী!

ঢুকরে কেঁদে উঠলেন উনি। আকরাম খাঁনের চোখেও পানি চিকচিক করছে। অতসী এই বাড়ি ছাড়ার পর উনি বুঝেছিলেন কতটা ভুল উনি তবে তখন সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। রুদ্রর মা কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু স্বামীকে খুলে বললেন। সব শুনে আকরাম খাঁন নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল,

– আমার কারনেই আমার অতসী কে এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে।‌ আমিই অ/পরাধী। আমি একজন ব্যর্থ বাবা, ব্যর্থ স্বামী।

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৩১
#তানজিলা_খাতুন_তানু

পুরানো ক্ষ’তগুলো তাজা হয়ে উঠেছে অতসীর। চেয়েছিল নিজের অতীত আড়াল করে রাখবে কিন্তু সেটা হলো না। সকলের সামনে সেই চলে আসলো নিজের পরিচয়। অতসী নিজেকে কয়েকদিন সবকিছু থেকে সম্পূর্ণ দূরে রেখেছিল, আবারো আসতে আসতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে লাগল।

কলেজে ক্লাস করে বের হবে, তখনি শাহানা অতসীর পেছন ডেকে বলল,

– অতসী।

অতসী শাহানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

– আবার কিসের জন্য ডাকছ, আমি জানি তুমিই ওই মহিলাটিকে আমার বিরুদ্ধে সবকিছু বলেছিল। আচ্ছা বলো তো, আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি যার জন্য তুমি সেই প্রথম থেকে আমার পেছনে পড়ে আছো। প্লিজ এইসব ঝামেলা আমার সাথে করতে এসো না, আমার ভালো লাগে না এইসব।

অতসী কথাগুলো বলে চলে যায়। শাহানা অতসীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এখনো কি শাহানা শুধরে যাবে নাকি আবারো নতুন করে কোনো ঝামেলা করবে।

আদৃতের মা আদৃত কে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিল। ওনার মনে খুব ইচ্ছা ছিল অতসীকে নিজের বাড়ির বউ করার কিন্তু যখন সত্যিটা জানল, তখন তিনি দোটানায় পড়ে গেছে। কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।

অতসী বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে আসতেই দরজায় টোকা পড়ল। অতসী এগিয়ে দরজা খুলে দেখল বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।

– কাকাবাবু আপনি।
– উপরে এসো কথা আছে।

উনি চলে গেলেন। অতসী কিছু বুঝতে পারল না, তবুও ওনার কথা মতো উপরে গেল। গিয়ে চমকে উঠল।

– অতসী মা।

অতসীর মা, বাবা, রুদ্র আর একটা নতুন মুখ যাকে অতসী চেনে না তবে আন্দাজ ওটা ওর ভাবি‌। অতসী সকলের সামনে কি রিয়াকশন দেবে সেটা বুঝে উঠতে পারল না। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

– কাকাবাবু আপনি কিছু মনে না করলে আমি কি ওনাদের নিয়ে আমার ঘরে যেতে পারি।
– হ্যাঁ অবশ্যই।
– চলুন আপনারা।

অতসী ওনাদের নিয়ে চলে যেতেই বাড়িওয়ালার বউ বলল,

– ওনারা কে? আর ওনাদের সাথে অতসীর কি সম্পর্ক।
– অতসীর বাবা মা।
– কি?
– হুম।

বাড়িওয়ালার চোখে মুখে একরাশ বিস্ময়। অতসীর পরিবার ছিল সেটা ওনার অজানা ছিল।

অতসীর ঘরে প্রবেশ করে আকরাম খাঁন সহ সকলে চারিদিকে দেখতে লাগল। অতসীর মায়ের চোখের কোনে পানি জমা হয়ে উঠল। অতসী কে জড়িয়ে ধরতে যাবে তার আগেই অতসী বলে উঠল,

– আপনাদের কি বলার আছে বলুন। আমি কোনো ঝামেলা চায় না।

আকরাম খাঁন শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,

– বাড়ি ফিরে চলো অতসী।

আকরাম খানের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। বিদ্রুপ করে বলে উঠল,,
– কেন আমাকে দিয়ে আবার কি স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছেন আপনি।

আকরাম খাঁনের হৃদয়ে আঘাত করল কথাটা। করুন কন্ঠে বলে উঠলেন,

– মারে আমাকে মাফ করে দে। আর কোনো স্বার্থ নয়, তুই আমার মেয়ে সেই পরিচয়েই ফিরে যাবি। আর কেউ কোনো কিছু নিয়ে তোকে জোর করবে না, যেটা তোর মনে হবে সেটাই করবি।
– আমি এইখানেই ভালো আছি। আপনারা ফিরে যান।
– অতসী মা কেন জেদ করছিস আর কতদিন সবার থেকে দূরে থাকবি। (অতসীর মা)
– দূরে তো থাকতে চাইনি। কিন্তু আপনারা আমাকে দূরে যেতে বাধ্য করেছেন। হাসিখুশি দুষ্টুমিতে ভরা মেয়েটাকে গম্ভীর মানুষ হয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। যেদিন আপনাদের আমার পাশে প্রয়োজন ছিল সেইদিন আমি আপনাদের পাইনি আজকে কিসের জন্য এসেছেন আপনারা। ফিরে যান আপনারা।
– বোন প্লিজ ফিরে চল। কেউ ভালো নেয় আমরা,তুই প্লিজ ফিরে চল আমাদের সুখের সংসারটা আবার পরিপূর্ণ হয়ে যাক।
– তোমরা শুধু আমার কথাই ভাবছ আর দিদিভাইয়ের কথা একবারো ভাবছ না। সেও তো ৭টা বছর তোমাদের থেকে দূরে আছে কই তাকে তো ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছ না।

রুহির কথা শুনতেই আকরাম খাঁনের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

– ওই মেয়ের নাম আমার সাথে উচ্চারণ করবে না। ওর কারনেই আমার জীবনে এত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। নিজে তো পালিয়ে গেল আর তার সাথে আমার বাড়ির সুখ শান্তি সব নিয়ে গেল।
– দিদিভাই কিছু করিনি সবটাই আপনার জেদের ফল। আপনি যদি না এত জেদ করতেন তাহলে কখনোই এইসবের কিছুই হত না। আপনার পরিবার কখনোই ভেঙে যেত না।
– এইসব কথা বাদ দাও। ফিরে চলো আমাদের সাথে।
– না। বাড়ি থেকে যেদিন চলে এসেছিলাম সেইদিনই আমি বলেছিলাম ম/রে গেলেও আপনার পরিচয় আমার লাগবে না। জীবনে যখন ২টো বছর একা একা থাকতে পেরেছি ভবিষ্যতেও থাকতে পারব।
– এত জেদ কেন তোমার।
– আপনারই তো‌ রক্ত।

অতসী বিদ্রুপের কথা শুনে আকরাম খান চুপ করে গেলেন। অতসীর মা বলল,

– মা’রে আর কত বাবা মেয়ে রাগ করে থাকবি। এইদিকে আমরা তো‌ শেষ হয়ে যাচ্ছি।
– আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। আমার তো কারোর সম্পর্কে কিছু অভিযোগ নেয়, ফিরে যান আপনারা আমি ফিরব না।

বাধ্য হয়েই ওনারা চলে গেলেন। অতসী যে কতটা জেদি হয়ে উঠেছে সেটা ওনারা ভালো করেই বুঝে গেছেন। তাই ঝামেলা বাড়ালেন না। ওনারা চলে যেতেই অতসী বিছানায় শুয়ে পড়ল, চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কারোর আশ্রয়স্থলে প্রান খুলে কাঁদবে সেটাও তো ওর নেয়।

বিকালে অতসী আরুকে পড়াতে গেল। কিন্তু চুপচাপ আনমনা হয়ে বসে আছে। আরু পড়ে যাচ্ছে কিন্তু ওর সেইদিকে খেয়াল নেয়। আদৃত অতসীর সাথে কথা বলবে বলে উশখুশ করে চলেছে, কিন্তু অতসী কে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে কিছু বলতে পারল না। অতসী পড়ানো শেষ করে বের হতে যাবে তখনি আদৃত বলল,

– আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি চলো।

অতসী একটু অবাক হলো আদৃতের কথা শুনে। তবুও মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,

– ধন্যবাদ। আমি একাই চলে যেতে পারব।
– একটু দরকার ছিল তোমার সাথে, প্লিজ।

অতসী আর কিছু বলতে পারল না। আদৃত অতসীর সাথে নিজ থেকে অনেকদিন কথা বলেনি, এমনকি সামনাসামনিও হয়নি। তাই আর অতসী কিছু বলল না, যাবার জন্য রাজি হয়ে গেল।

আদৃত ওকে সামনে বসিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে নিতে বলে‌ গাড়ি স্টার্ট দিলো। অতসী এতটাই আনমনা হয়ে ছিল যে খেয়াল করেনি আদৃত ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। আদৃত পৌঁছে এসে ওকে নামতে বলল। অতসী সামনে তাকিয়ে এটা কোথায় সেটা বুঝতে পারল না। অতসী কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আদৃত বলল,

– বিশ্বাস করতে পারো আমাকে।

অতসী আর কিছূ বলল না। চুপচাপ নেমে দাঁড়াল। আদৃত ওকে নিয়ে একটা ব্রিজে নিয়ে আসলো।

– এইখানে নিয়ে আসলেন কেন?
– শান্ত পরিবেশ, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করো একটু।

আদৃতের কথা শুনে অতসী চোখ বন্ধ করে কয়েকটা বড়ো‌ বড়ো নিঃশ্বাস নিল। শীতল হাওয়া ওর শরীর স্পর্শ করতেই অতসী কেঁপে উঠল। চোখ খুলে সামনে শান্ত পরিবেশ, নদীর পানি, দূরে আলো দেখে নিমেষেই অতসীর মনটা ভালো হয়ে গেল। সামনের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল,

– আপনি এইখানে আমাকে আনলেন কেন?
– তোমার মনখারাপ ঠিক করতে।

অতসী কথাটা শুনে আদৃতের দিকে তাকাল। আদৃত সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, ওইদিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে‌ বলে উঠল,

– হুট করে আবারো তুমি ডাকছি বলে অবাক হচ্ছো তাই না।

অতসী মুখে কিছু না‌ বললেও কথাটা সত্যি। আদৃত যে হঠাৎ করে এইভাবে এইখানে নিয়ে আসবে, তুমি বলবে সেটা ভাবতে পারেনি। আর কেন করছে তার কারনটাও ওর অজানা।

– মিতু আমাকে সব বলেছে।
– কি।
– এই যে তুমি কার মেয়ে। কিন্তু অতসী বাড়ি ছেড়ে এইভাবে জীবন কাটানোর কারন কি?

এতগুলো দিন নিজের মধ্যে কষ্টগুলো চেপে রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অতসী। আজকে আদৃতের প্রশ্নের উত্তর দিতে মন চাইছে ওর। তাই আর চুপ করে না থেকে বলে উঠল,

– আমার বাবার জেদ।
– মানে?

অতসী আদৃত কে বলল। সবটা শুনে আদৃত স্বব্ধ হয়ে গেল।

– সরি অতসী।
– আপনি কেন সরি বলছেন!
– কারন কোথাও না কোথাও তোমার এই জীবনটার জন্য আমি কিছুটা হলেও দায়ী।
– মানে?
– আমি রুহির হাসবেন্ড।
– কিসব বলছেন আপনি।রুহি মানে আমার দিদিভাই!
– হ্যাঁ।

অতসীর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। পড়ে যেতে গেলে আদৃত ধরে নেয় ওকে।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে