প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-১৫+১৬

0
517

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১৫
.
তরু নেমে গেলেও নুসরাত পুনরায় দরজার ফাঁক দিয়ে তাকায়।
নির্জন তখন পাঞ্জাবির গুটানো হাত পুনরায় গুটিয়ে সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে চলে এসেছে দরজার কাছে। নুসরাত প্রথমে চেয়েছিল দৌড়ে নেমে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো ধরা পড়ে যাবে৷ তাই সে উলটো ছাদেই যাচ্ছিলাম এরকম একটা ভাব করে দরজা খুলে ছাদে গেল।

নির্জন তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায়। ইতস্তত করে বলে, ‘আপনাকে তরুর সঙ্গে দেখেছিলাম। যদি কিছু মনে না করেন, জানতে পারি ওর কি হন আপনি?’

ছেলেটি নিজ থেকে পরিচিত হতে চাচ্ছে দেখে প্রচণ্ড ভালো লাগছে ওর। সে আগ্রহ নিয়েই বললো, ‘আমার নাম নুসরাত, তরুর মামাতো বোন। বিয়ে হচ্ছে আমার চাচাতো বোনের।’

‘ও তাহলে একটু কষ্ট করে তরুর আম্মুকে বলবেন নির্জন চলে গেছে ঢাকায়। ওর একটা জরুরি কল এসেছিল।’ বলেই সে হাঁটা শুরু করে দিল। নুসরাত ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বললো, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান।’

নির্জন পিছু ফিরে তাকায়।

– ‘বলুন।’

নুসরাত স্বভাবসুলভ মিথ্যে বলতে শুরু করলো। সে খুবই চিন্তিত চেহারায় বললো, ‘কি হয়েছে বলুন তো। তরু ছাদে এসেছিল। আমি সিঁড়ির ওইখানে দাঁড়িয়ে ছবিগুলো দেখছিলাম কেমন হলো। এরপর দেখি তরু কেঁদে কেঁদে নেমে গেল। ও তো সহজে কাঁদবার মেয়ে নয়। কি এমন করলেন যে বেচারি কাঁদছে বলুন তো।’

নির্জনের বুকটা কেমন করে উঠলো। তরু কাঁদছে? আশ্চর্য! কাঁদবে কেন? সে কি বেশি বলে ফেলেছে? ইতস্তত করে বললো, ‘কিযে বলেন, কি করবো আবার।’

– ‘কিন্তু আপনিই বা হুট করে চলে যাচ্ছেন কেন? কি এমন হয়েছে?’

নির্জন আমতা-আমতা করে বললো, ‘একটু রাগারাগি হয়েছে, তাই বলে কাঁদবে কেন বুঝলাম না।’

– ‘সেটাই তো, এখন হলের দিকে গিয়ে যদি কাঁদে সবাই দেখে কি বলবে। আচ্ছা যাইহোক, আপনি কি সত্যিই চলে যাচ্ছেন?’

নির্জন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। এখন চলে গেলে তরু বেচারি বিপদেই পড়বে। ওর আম্মু নিশ্চয় বুঝবেন ওর কারণেই এভাবে চলে গেছে সে। নুসরাতও বলবে। যেহেতু সে নতুন মেহমান। সবাই এটা সিরিয়াসলি নিবেন।
নির্জন ইতস্তত করে বললো, ‘আচ্ছা থাক, আপনি ওর আম্মুকে কিছু বলার দরকার নেই।’

– ‘আপনার না জরুরি কাজ?’

নির্জন আমতা-আমতা করে বললো, ‘দেখছি কি করা যায়। এভাবে হুট করে চলে যাওয়া হয়তো ঠিক হবে না।’

– ‘আচ্ছা আমি গিয়ে দেখি তরু কি করছে। আপনি কি কষ্ট করে বাইরে গিয়ে ওর জন্য আইসক্রিম আনতে পারবেন? যা গরম পড়েছে। তরু আইসক্রিম অনেক পছন্দ করে। আনলেই খুশি হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি’ বলে নির্জন সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। নুসরাত দাঁড়িয়ে থেকে কপালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে, ‘বাবা এদের মাঝে তো কিছু একটা হয়ে গেছে, তরু জিতছিস বোন জিতছিস’ বলে তাড়াতাড়ি সেও নেমে গেল। এসে দেখে তরু একটি চেয়ারে মুখভার করে বসে আছে। নুসরাত চারদিকে তাকিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ‘ঘটনা কি বলতো তরু, ওই ছেলেকে কি বলেছিস? সে রাগ করে ঢাকায় চলে যাচ্ছে।’

তরু অবাক হয়ে বললো, ‘কি? চলে যাচ্ছে মানে?’

– ‘হ্যাঁ, আমাকে বললো তরুর আম্মুকে বলবেন আমি চলে যাচ্ছি। যাই ফুপুকে বলে আসি।’

তরু ওর হাত খামচে ধরে বললো, ‘কু*ত্তি, তুই এই কথা গিয়ে বললে আম্মু আমার চুল সব ছিঁড়ে ফেলবে।’

– ‘তাহলে কি করবি? উনি তো সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে চলে যাচ্ছে।’

– ‘তুই মিথ্যুক, তোকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।’

নুসরাত ওর হাতে ধরে টেনে নিয়ে বললো, ‘দেখে যা, চলে যাচ্ছে কি-না।’

তরু উঠে এলো। বারান্দায় এসে রেলিঙ থেকে দাঁড়িয়ে দেখে নির্জন সত্যিই চলে যাচ্ছে৷ একেবারে সেন্টারের গেইটের কাছে চলে গেছে। তরু শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘এখন কি করবো বল তো।’

– ‘গিয়ে আঁটকে ফেল।’

– ‘শাড়ি পরনে, যেতে যেতেই কোনো গাড়িতে উঠে যাবে। আর পাগলের মতো ছুটলে মানুষ দেখে কি বলবে।’

– ‘তাহলে কল দে।’

‘ও হ্যাঁ, তাইতো’ বলেই তরু ফোন বের করে কল দিল নির্জনকে। একবার রিং হতেই রিসিভ করলো ওপাশ থেকে। তরু আশেপাশে তাকিয়ে, ফিসফিস করে বললো, ‘প্লিজ আমার কথা শুনুন, যেখানে আছেন দাঁড়ান প্লিজ। আমার কথা শুনুন আগে।’

– ‘হ্যাঁ, বলো কি হয়েছে।’

– ‘বলছি এসে, আপনি জাস্ট একটু দাঁড়ান।’

– ‘মানে কি, আমি তো এখন বাইরে এসেছি। ছাদে না।’

– ‘হ্যাঁ, সেখানেই থাকুন।’

– ‘বাইরে রোদ, আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো কতক্ষণ।’

– ‘আমি আসছি তো এখনই।’

– ‘ও আচ্ছা, আসুন।’

তরু ফোন রেখে নুসরাতকে একটা চুমু দিয়ে বললো, ‘আগে আমাকে বলে বাঁচিয়েছিস। আজ সবার বকা শুনতাম। তুই এখন ভেতরে যা। আমি আসছি। দুইজন নাই হয়ে গেলে খুঁজবে ওরা।’

– ‘আচ্ছা যা, কিন্তু আমার জন্য আইসক্রিম আনবি।’

– ‘আইসক্রিম কোথায় এখন পাব?’

– ‘রাস্তায় ওইপাশে দোকান আছে।’

‘ওকে যা আনবো’ বলে তরু তাড়াতাড়ি শাড়ির কুঁচি ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তারপর বর-কনের গাড়ির মাঝখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেল গেইটের কাছে। নির্জন সেখানে একটি ফুল গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে হলুদ ফুল। গাছে কিছু পাখি কিচির-মিচির করছে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে শাড়ি পরা অবস্থায় দ্রুত আসতে গিয়ে তরু ঘেমে একাকার, রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। নির্জন পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে কৌতূহল। তরু চারদিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘রাগ করার কথা আমি, আপনি উলটো রাগ করে চলে যাচ্ছেন কেন?’

নির্জন ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কীভাবে জানলে তুমি চলে যাচ্ছি?’

– ‘নুসরাত বলেছে।’

নির্জন কিছুটা হলেও ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তাই মুখের ভঙ্গি পালটে নিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছো, চলে যাচ্ছি আমি।’

– ‘দেখুন ঝামেলাটা বাড়াবেন না। সবাই আমাকে বকবে, আমার কথা শুনুন।’

নির্জন আশপাশে তাকিয়ে বললো, ‘এখানে সিনক্রিয়েট করবে না তরু। সবাই দেখবে।’

– ‘কিন্তু আমার কথা তো শুনুন।’

নির্জন বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আচ্ছা তোমার আরও কথা শুনানোর বাকি আছে তাহলে। চলো রাস্তার ওপাশে ফুলকলি দেখা যাচ্ছে। গিয়ে বসে শুনি।’

তরুর মনে পড়লো নুসরাত আইসক্রিমের কথা বলেছিল। সে মাথা নেড়ে বললো, ‘ঠিক আছে চলুন।’

কিন্তু নির্জনের কেমন কষ্ট হচ্ছে ওর অস্থিরতা দেখে, ঘেমে যাওয়া মুখ দেখে। তার ইচ্ছা করছে বলে দেবে, ‘আচ্ছা তুমি শান্ত হও, আমি যাব না, আস্তে-আস্তে আসো।’

সেটা সরাসরি না বলে বললো, ‘এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই, খেয়াল করে রাস্তা পার হও।’

তরু কিছু না বলে শাড়ির কুঁচি ধরে পিছু পিছু আসছে। বারবার তাকাচ্ছে সেন্টারের দোতলার দিকে। কেউ না আবার খেয়াল করে তাকে। রাস্তা পার হয়ে এসে ঢুকলো তারা ভেতরে। নির্জন তাকে টেবিলে গিয়ে বসতে বলে আইসক্রিম দিতে বললো। এসি ছাড়া থাকায় ভাবলো এখন একটু জ্বালানোই যায় তরুকে। গরম লাগবে না। ঠান্ডা পরিবেশ। সে সামনের চেয়ারে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ যা অপমান করার তাড়াতাড়ি করো। আমার ঢাকা ফিরে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তরু ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখুন, আপনি উলটো রাগ দেখাচ্ছেন। অথচ বাড়াবাড়ি আপনি করেছেন।’

– ‘কিরকম?’

– ‘আপনি সাজিদকে বলেছেন আমার বিয়ে। ফেইসবুকে এংরি রিয়েক্ট দিয়েছেন। আমি ছাদে গিয়ে এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম এগুলো। আর আপনি কত বাজেভাবে আমাকে কথা শুনিয়েছেন। কেউ এরকম বলে পোশাক নিয়ে? আমার অনেক লজ্জা লাগছিল তাই রেগে গিয়েছিলাম।’

– ‘আমি কি বেশি কিছু বলেছি আসলেই?’

– ‘তা নয়তো কি? আমি রাস্তার ছেলেদের পেট দেখিয়ে বেড়াচ্ছি এরকম অন্য কাউকে বললে কি করতো শুনি? আর আমি একটু রেগে গিয়ে কি বলেছি তাতেই আপনি চলে যাচ্ছেন।’

নির্জনের বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তরুর কথা শুনে। বেচারি কষ্ট পেয়েছে তাহলে। সে ইতস্তত করে বললো, ‘কিন্তু ম্যাডাম, আমিও যে আগে থেকেই রেগে ছিলাম।’

– ‘কেন?’

– ‘তুমি এসেই হাওয়া হয়ে গেলে। আমি একা একা বসে থেকেছি।’

– ‘বাজে কথা বলবেন না৷ আপনি দেখেছেন কাজিনরা আমাকে কীভাবে নিয়ে গেছে। ওইখানে নিয়েই মেহেদি দেওয়াই লাগিয়ে নিয়েছে। আমি আম্মুকে পাঠিয়েছি। আপনাকে নাশতা দিয়েছে কি-না, ঘুমানোর জন্য রুম দিতেও বলেছি। তাছাড়া রাতে মেহেদি হাতের ছবি দিলাম। আপনি রিপ্লাই দেননি। দিলে আমি কথা বলতাম।’

– ‘মেসেজে বলতে হবে কেন, আসা যায় না?’

– ‘এহ বিয়ে বাড়িতে বাইরের মানুষ ছিল অনেক। আমি কীভাবে যাব। আর তখন রাতও অনেক হয়ে গিয়েছিল।’

– ‘আচ্ছা তাহলে ভোরে আসা যেত না?’

– ‘আপনি জানেন আমি কয়টায় ঘুম থেকে উঠেছি? সবার বকা খেয়ে নয়টার পরে উঠেছি। উঠেই কনের গোসল হেনতেন৷ তখন সাজিদকে পাঠিয়েছি আপনি উঠেছেন কি-না দেখতে। আমাকে ওরা কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর গোসল করে নিজেই রেডি হতে গিয়ে অস্থির।’

– ‘তাই বলে এরকম।’

– ‘আপনি বেশি বেশি ভাবছেন। আপনাকে আমি সকালেও মেসেজ দেইনি বলুন? গোসল করে রেডি হতে বলেছি। আবার সেন্টারে এসে খুঁজছিলাম। কাজিন ছেলেদের জিজ্ঞেস করেছি খেয়েছেন কি-না। ওরা বলেছে খেয়েছেন আপনি। ছাদেও গিয়েছিলাম ভালোমন্দ কথা বলবো। কিন্তু আপনি মুড নষ্ট করে দিয়েছিলেন আজেবাজে কথা বলে..।’

নির্জন ওর টেবিলে রাখা হাতের উপর হাত রেখে বললো, ‘আচ্ছা এত অস্থির হতে হবে না। আমি যাব না।’

তরু ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হয়তো আরও কেয়ার নেয়া উচিত ছিল আমার। আমি তো আর বড়ো হয়ে যাইনি যে এতকিছু বুঝবো। তাছাড়া ছাদে এরকম না বললেও পারতাম, স্যরি।’

নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।’

– ‘এহ ছাদে কত শুনিয়েছেন।’

– ‘ওটা অন্য কারণে। কিন্তু সত্যিই সুন্দর লাগছে। এইযে মেহেদি দিয়েছো। তাও সুন্দর হইছে।’

– ‘থ্যাঙ্কিউ।’

বেয়ারা আইসক্রিম নিয়ে এলো। নির্জন হাতে নিয়ে তরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘একটা তুমি এখনই খেতে পারো। আরেকটা নুসরাতকে দিয়ো।’

তরু হাতে নিয়ে বললো, ‘আপনি কিছু খান।’

– ‘না ইচ্ছা করছে না।’

তরু মুচকি হেসে বললো, ‘আমার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে কিন্তু খেতে লজ্জা পাই।’

– ‘আচ্ছা আমি ড্রিংকস নিচ্ছি। তুমি নিজের মতো খাও।’

মাথা নাড়লো তরু। নির্জনকে ড্রিংকস এনে দিল ছেলেটি। তরু আইসক্রিম খেতে খেতে বললো, ‘প্রেম করবেন?’

নির্জন আঁতকে উঠে বললো, ‘মানে কি?’

– ‘মানে টানে কিছু না। একজন আপনাকে দেখে ফিদা হয়ে আছে।’

– ‘ও তাই না-কি? কে সে।’

– ‘বলবো?’

– ‘সমস্যা না থাকলে।’

– ‘নুসরাত।’

নির্জন অবাক হয়ে বললো, ‘তাই না-কি? ওই একটু দেখাতে? আর তোমাকেই বা কখন বললো।’

– ‘বাবা খুব নড়েচড়ে বসেছেন মনে হচ্ছে।’

নির্জন আরও আগ্রহ দেখিয়ে বললো, ‘তা একটু হয়েছি। বেশ মিষ্টি দেখতে ও।’

তরু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘তাহলে তো হলোই। প্রেম করেন। আমি ওকে জানিয়ে দেই আপনি রাজি।’

– ‘না আমারটা আমিই বুঝে নিব, তোমার জানানো লাগবে না।’

তরু মাথা নাড়লো। নির্জন ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে তরুর দিকে তাকায়। ওর গালগুলো কেমন গরমে লাল হয়ে আছে। একটু আগেও প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিল। যদি সত্যিই চলে যেত? ভাগ্যিস যায়নি। তরুর কষ্ট হয় এমন কিছুই হয়তো তার দ্বারা করা আর কখনও সম্ভব হবে না। তরু আইসক্রিম খেতে খেতে বললো, ‘আপনি দেখছি মেয়েদের মতো রাগ করেন।’

– ‘কেন মনে হলো?’

– ‘এইযে আমি আসিনি বলে রেগে বসে ছিলেন।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘তাছাড়া শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন এক আপু। তাড়াহুড়োয় এত ভাবিওনি। আর আমি একা তো এভাবে পরিনি। সবাই পরেছে।’

– ‘কিন্তু মনে হলো ছেলেরা শুধু তোমার দিকেই তাকিয়েছিল।’

– ‘তাই?’

– ‘হ্যাঁ, আর আমি অন্যকারও কিছু দেখা যাচ্ছে কি-না খেয়াল করিনি।’

ওর শেষের কথাগুলো তরুর কাছে ভীষণ নরম লাগলো। নির্জন কি ভেতরে ভেতরে তাহলে অনেক আবেগি মানুষ? তরুর তাই মনে হলো। সে মুচকি হেসে বললো, ‘শুধু আমাকেই দেখছিলেন বুঝি? কিন্তু কেন?’

নির্জন আচমকা এই প্রশ্নে কি বলবে প্রথমে ভেবে পেল না৷ আমতা-আমতা করে বললো, ‘এখানে তো কাউকে আমি চিনি না। তোমাকেই শুধু চিনি তাই।’

– ‘ও আচ্ছা ছেলেরা শুধু চেনা মেয়েদের দেখে। অচেনা মেয়েদের পেট দেখা গেলেও তাকায় না।’

– ‘তা তো অবশ্যই।’

তরু মুচকি হেসে বললো, ‘তা আমার দিকে যে অন্য ছেলেরা তাকিয়েছে ওরা কি আমাকে চেনে?’

নির্জন ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে সরাচ্ছিল না। কি বলবে ভাবছে সে। কিছু একটা তো বলতে হবে তার। ইতস্তত করে বললো, ‘চিনতেও পারে, তোমার পোস্টে কত রিয়েক্ট বাবা। সেলিব্রিটি লেখিকা।’

– ‘ও আচ্ছা, তাহলে কেউ সেল্ফি তুলতে এলো না যে?’

– ‘বাদ দাও তো এসব। কে কেন তাকালো তা দিয়ে কি হবে।’

– ‘হুম তা ঠিক।’

খানিক সময় পর তরু পুনরায় বললো, ‘আমি আসলে ছাদে বেশি রুড হয়ে গিয়েছিলাম তাই না? স্যরি, সত্যিই স্যরি। এমনভাবে বলেছিলেন লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আবার রাগও হচ্ছিল। তখন কি থেকে কি বলে চলে এসেছি।’

নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘কিছু কিছু মেয়েদের সঙ্গে রাগ করে থাকা মুশকিল। তুমিও তেমন।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হুম সাতখুন মাফ টাইপ চেহারা।’

– ‘আজকাল বড্ড ভুলভাল বকছেন।’

তরুর ফোন এলো তখনই। নুসরাত কল দিয়েছে। সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, ‘কিরে তুই আটকাতে গিয়ে, নিজেই চলে গেলি না-কি?’

– ‘আরে না আসছি।’

– ‘সবাই খুঁজছে তো, মালা বদল হচ্ছে। সবাই ছবি তুলছে।’

‘আচ্ছা আসছি’ বলেই তরু ফোন রেখেই নির্জনকে বললো, ‘যেতে হবে।’

– ‘আইসক্রিম অর্ধেক রয়ে গেছে।’

‘থাক, বকা শুনবো পরে, নুসরাতের ওটা নিয়ে যাচ্ছি। আপনি একটু পরেই বের হোন। ছবি তুলবেন আমাদের সঙ্গে।’ বলেই সে চলে গেল। চড়ুই পাখির মতো যেন মেয়েটি শুধু উড়াউড়ি করছে। নির্জন তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার দিকে। ও বের হয়ে যাওয়ার মিনিট খানেক পরই নির্জন বিল চুকিয়ে বের হয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে এলো সেন্টারে। বর কনেদের মিলিয়ে সবাই একে একে ছবি তুলছে। নির্জন নিরাপদ দুরত্বে থেকে তরুকেই দেখছে৷ এক সময় তরু আর নুসরাত গেল বর-কনের দুইপাশে। নির্জন মোবাইল বের করলো তখন। তরুর ছবি তোলার ইচ্ছা থেকেই। ঝটপট তুলে নিল কয়েকটি ছবি। তরু ছবি তুলে নাহেরা বেগমকে ফিসফিস করে বললো তার কথা। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘তুমি কোথায় বাবা। দেখাই পাচ্ছি না। খেয়েছো তো?’

– ‘হ্যাঁ।’

‘আসো আমরা ছবি তুলি’ বলে তাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন। তরুকেও ডাকলেন তিনি। কনের পাশে দাঁড়ালেন। তরু গেল নির্জনের পাশে। ছবি তোলার পর সে ভিড় দেখে একটু দূরে চলে এলো। বিয়ের সকল কাজ শেষে কনে বিদায় করে তারা বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা। অনেকে সেন্টার থেকে বিদায় নিয়েছেন। মেয়ে দু’জন আর একটি ছেলে কনের সঙ্গে চলে গেছে। বাড়িতে অনেকটাই মানুষ কমে গেছে। রাতে সবাই ফ্রি হওয়ার পর চা দেয়া হচ্ছে। তরু ট্রে-তে ওর আর নির্জনের চা নিয়ে উঠান পেরিয়ে গেল। এসে দরজায় নক দেয়ার আগে তরু জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে নির্জনের পরনে ট্রাউজার। খালি গা। সে ভেজা শরীরে বের হয়েছে বাথরুম থেকে। তরু তাকিয়ে রইল। ফরসা লোমশ বুক। মেদহীন পেট। সরে দাঁড়ানোর আগেই নির্জন দরজা খুলে বারান্দায় এসে ওকে দেখে বললো, ‘তুমি।’

– ‘হুম চা নিয়ে এলাম।’

নির্জন তোয়ালে মেলে দিয়ে আশেপাশে দেখে বললো,

– ‘এখন কেউ কিছু ভাববে না এলে যে?’

তরু কোনো জবাব না দিলে রুমে ঢুকে গেল। টি-টেবিলে ট্রে রেখে বসলো সোফায়। নির্জন ভেতরে এসে মেগি হাতা গেঞ্জি পরে বিছানায় বসার পর তরু চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘চা খেয়ে ঘরে চলুন। এখানে সব সময় একা থাকতে হবে না।’

– ‘একা থাকতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।’

– ‘এহ গতকাল একা কাটিয়েছেন বলে কি রিয়েক্ট না করলেন।’

নির্জন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, ‘জানি না রাগটা কেন হয়েছিল। একাকীত্বের জন্য, না-কি কাউকে দেখার জন্য।’

তরু কথাটি শুনেছে। ভেতরে ভেতরে সে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে৷ সরাসরি কেউ বুঝি এভাবে বলে? তরু না শোনার ভান করে উঠে হাঁটা ধরে বললো, ‘নুসরাতকে নিয়ে আসি।’

নির্জন হুট করে ওর হাতটা ধরে ফেললো, তার ঠোঁট চায়ের কাপে। চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ রেখে ওর দিকে তাকায়। বেগুনি রঙের মতো একটি পাতলা কামিজ পরনে। খোলা চুল। কি মিষ্টি লাগছে ওকে। সে হুট করে হাত ধরে যেন কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে গেল। হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘বসো না, ও আসবে একটু পর সমস্যা কি।’

তরু এসে সোফায় বসে নিজেও চায়ের কাপ নিল। নির্জন হুট করে বললো, ‘তরু।’

– ‘কি?’

– ‘তোমার রিলেশন আছে? মানে প্রেমিক-ট্রেমিক কিছু?’

তরু চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবছে আল্লাহ এরকম একটা পরিবেশে যেন কিছু না বলে বসে। বেরসিক পুরুষ মানুষ নিয়ে বিশ্বাস নেই। সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো, ‘প্রেমিক থাকা না থাকা দিয়ে আপনি কি করবেন শুনি?’

– ‘খুন করবো।’

তরু এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললো, ‘কাল ঘুরতে যাবেন?’

– ‘নুসরাত গেলে অবশ্যই।’

তরু এ কথায়ও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চায়ে চুমুক দিল। শুধু ভেতরে ভেতরে বললো, ‘কত বড়ো ফাজিল, আমার প্রেমিক থাকলে খুন করতে চায়, আবার নুসরাতকে ছাড়া বেড়াতে যাবে না। মদ না খেয়েই মাতাল হয়ে আছে মনে হচ্ছে।’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১৬
.
বেশি সময় তারা আর একা বসতে পারলো না। দরজায় এসে নক দিল নুসরাত। নির্জন উঠে গিয়ে খুলে দিতেই অর্থবহ হাসি মুখে এনে বললো, ‘এসে কি বিরিয়ানিতে এলাচি হলাম?’

– ‘কিযে বলেন, আসুন ভেতরে।’

নুসরাত গিয়ে তরুর পাশে বসে বললো,

– ‘আইসক্রিমের জন্য থ্যাংকস। তরু বলেছে আপনি দিয়েছেন।’

সরাসরি কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে নির্জনের অস্বস্তি লাগে। যদিও সভ্য পৃথিবীতেই এটা ভদ্রতা বলে স্বীকৃত। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘আপনাকে রেখে চা খাচ্ছি।’

– ‘আমি খেয়েই এসেছি। হঠাৎ তরুকে না পেয়ে ভাবলাম কোথায় গেল।’

– ‘ও আচ্ছা।’

তরু চায়ের কাপ রেখে বললো, ‘কাল আশেপাশে কোথাও বেড়াতে যাই চল।’

– ‘কোথায়?’

– ‘পাহাড়, চা বাগান এসবে আরকি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

নির্জন খানিকক্ষণ কিছু ভেবে বললো, ‘কাল কিন্তু আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে। আবার দিনে-দুপুরে রোদ থাকবে, বেড়ানো যাবে না।’

নুসরাত প্রতিবাদ করে বললো, ‘সেকি, এসেছেন থাকুন কয়েকদিন।’

– ‘না, কালই চলে যাব।’

তরু তখন বললো, ‘তবুও বেড়ানো যায় চাইলে।’

নুসরাত ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘কীভাবে?’

– ‘আমরা তিনজন আজ ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠবো। উঠে রেডি হয়ে বের হতে হতেই পাঁচটা হয়ে যাবে। তখন একেবারে ভোর। সতেজ নির্মল, পরিবেশ। যেহেতু পাহাড়, চা বাগান দেখবো তাই ভোরেই ভালো লাগবে। আর রোদ পুরোপুরি উঠতে উঠতে আমরা ফিরে আসবো।’

ওর আইডিয়া খুবই পছন্দ হলো নির্জনের।সে চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললো, ‘ডান, লেখিকার কথাই শেষ কথা।’

ফিক করে হাসলো নুসরাত। তরু তখন বললো, ‘ভালো বুদ্ধি দিয়েছি বলে মেনেছেন। সব কথাই কি এভাবে মানবেন?’

– ‘হ্যাঁ অবশ্যই।’

– ‘মনে থাকে যেন।’

– ‘থাকবে।’

নুসরাত তখন বললো, ‘ভোরে যেতে হলে এখনই ঘুমাতে হবে, আমি তাহলে যাই’ বলে সে ট্রে-তে কাপ তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। তরু ওর দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে উঠে গেল বসা থেকে। নির্জন তরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। তরু বাইরে এসেই নুসরাতের পিঠে কয়েকটি কিল দিয়ে বললো, ‘ঘুমাতে যাই বলে তুই এভাবে যে চলে এলি? আমি কি এই রুমেই ঘুমাবো?’

নুসরাত খিলখিল করে হাসতে গিয়ে ট্রে পড়ে গেল হাত থেকে। দু’জনই সঙ্গে সঙ্গে জিভে কামড় দিয়ে চুপ হয়ে গেল। নির্জন দরজার কাছে এসে বললো, ‘আমি কিছু টের পাইনি। কারণ কাপ ভাঙার আর আপনাদের হাসির শব্দ একইরকম।’

দু’জন ভাঙা কাপের টুকরোগুলো ট্রে-তে তুলে খিলখিল করে হেসে দৌড়ে যেন পালিয়ে গেল। তরুর নানির গলা শোনা গেল এই ঘর থেকেই, ‘কিরে এত খিলখিল করতাছো কেন? একটারে সবে বিয়া দিছি এদিকে তোরাও দেখি রসে ফাইট্টা পড়তাছস।’

নির্জন মুচকি হেসে দরজা ভেজিয়ে গিয়ে মোবাইল হাতে নিল। একটু পরেই তরুর মামা এলেন। এসে ভালো-মন্দ গল্প করলেন তার সঙ্গে। নুসরাত আগেই তাদের খাবার ব্যবস্থা করে নিল। দশটার দিকে তাকে ডেকে নিল খেতে। কিন্তু খেয়ে এসে নির্জনের ঘুম পাচ্ছিল না৷ কেমন যেন এক অস্থিরতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। বুক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চোখ যেন বিদ্রোহ করছে, সারাক্ষণ তরুকে সামনে দেখতে চায় সে। নির্জন বিয়ের ওই ছবিটা বের করলো। তরু বরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। খয়েরি রঙের শাড়ি। এক হাত সামনের দিকে এনে, অন্যহাতে কবজি ধরা। কি সুন্দর হাত। মোমের মতো মসৃণ। তুলতুলে দু’টো গাল। জোড়া ভ্রু। কি সুন্দর চুল। সে চোখ সরাতে পারছে না। জীবনে কখনও নিজের ভেতরের এমন দূর্বলতা টের পায়নি সে। বুঝতে পারছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে। কিছুই করার নেই। এই বিশ্বচরাচরের মালিক নিশ্চয়ই এই মেয়েটিকে তার ভাগ্যে লিখে দিয়েছে৷ নিশ্চয় দিয়েছে৷ না হলে এমন হচ্ছে কেন।

খেয়ে এসে তরু আর নুসরাত এক সঙ্গে ঘুমিয়েছে। নুসরাত কারও সঙ্গে চ্যাট করছে। তরু চেষ্টা করছে গল্প লেখার। অনেকদিন হলো কিছু লিখতে পারছে না। ছোট গল্প হলেও ফেইসবুকে দেয়ার ইচ্ছা। কিন্তু তরু লিখতে গিয়ে নায়কের জায়গায় শুধু একটি ছবিই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই মানুষটি হচ্ছে নির্জন। কানে সংগীতের মতো বাজছে,
”বাতাসে তোমার চুল উড়ার দৃশ্য থেকে সূর্যমুখী ক্ষেত সুন্দর নয় তরু।”
“একাকীত্বের জন্য না-কি কাউকে দেখতে না পেয়ে রিয়েক্ট করেছি জানি না…।”

তরু দীর্ঘসময় পর খেয়াল করলো মোবাইলের নোটে সে নির্জনের বলা নানান কথা লিখে ভরে ফেলেছে৷ মোবাইল লক করে বালিশের পাশে রেখে দিল। মনটা যেন কেমন করছে তরুর। পাশ ফিরে নুসরাতকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে শুয়ে রইল। চোখে ভাসছে গাড়িতে নির্জনের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে সে, নির্জন ঘুমিয়ে আছে তার কোলে। নির্জন বেখেয়ালে হাত ধরে ফেলেছে তার…। দৃশ্যগুলো ভাবতে ভাবতে তরুর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। নুসরাত মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে বললো, ‘কিরে কি হয়েছে?’

তরু জবাব দিল না। নুসরাত পুনরায় বললো, ‘মন খারাপ?’

– ‘কিছু না চুপ থাক।’

– ‘একটা কথা সত্য করে বলবি তরু?’

– ‘কি?’

– ‘নির্জন ভাইয়ের সঙ্গে কিছু আছে তোর তাই না?’

– ‘বাজে কথা বলবি না।’

– ‘না হলেও আমি শিওর প্রেমে পড়েছিস।’

– ‘হ্যাঁ প্রেমে পড়া তো সহজ।’

– ‘আমার সঙ্গে ঢং করবি না তরু। তোরা এক সঙ্গে ঢাকা থেকে এসেছিস। এর ভেতরেই তো প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাওয়ার কথা।’

– ‘গাড়িতে একদিন একসঙ্গে এলেই বুঝি প্রেম হয়ে যায়?’

– ‘হওয়ার হলে দেখলেই তো হয়ে যায়। তাছাড়া তোদের দেখলেই লাগে প্রেম হবে।’

– ‘বুঝি না, কেয়া ফুপুও এই কথা বলে। কেন দেখলেই মনে হবে? উনি কত লম্বা৷ আমি খাটো। উনি কত বড়লোকের ছেলে। মানে কোনদিক থেকে মনে হয়?’

– ‘কি জানি, কেন যেন মনে হয় তোদের প্রেম হবে অথবা হয়ে গেছে।’

– ‘যতসব আজাইরা চিন্তা।’

– ‘আজাইরা না, নির্জন ভাই তোর প্রেমে পড়েছে সেটাও আমি ১০০% শিওর।’

– ‘কীভাবে বুঝলি?’

– ‘সে থাক, যেভাবেই হোক বুঝেছি। তাই আমি সাহস করে সন্ধ্যায় ফাজলামোও করেছি। আর উনি খুশি হয়েছেন।’

– ‘তুই তো ছেলেদের মনোবিজ্ঞানী হয়েছিস৷ হাজারে-বিজারে প্রেম করেছিস বলে কি যে ভাবিস নিজেকে।’

নুসরাত চুপ হয়ে গেল। পুনরায় চ্যাটে মনযোগ দিল সে। দীর্ঘ সময় পর তরু ইতস্তত করে বললো, ‘একটা কথা বলি, তুই আবার অন্যদিকে নিবি না।’

– ‘বল।’

– ‘আয় দেখে আসি উনি কি করছে।’

নুসরাত মুচকি হেসে বললো, ‘বুঝি তো, সবই বুঝি। দেখতে ইচ্ছা করছে সেটা বল।’

– ‘কু*ত্তি, আগেই বলেছি অন্যদিকে নিবি না। উনার এখানে কেউ কি পরিচিত আছে না-কি? ঘুমালো কি-না, কিছু দরকার কি-না দেখতে হবে তো।’

নুসরাত ওড়না নিয়ে বললো, ‘তোর জন্য না হোক, বেচারা আইসক্রিম পাঠিয়েছিল। দুলাভাই হলেও কতকিছু দিবে। একটু না হয় এখন হেল্প করলাম।’

– ‘কিসব যা-তা বকছিস, চুপচাপ চল তো।’

দু’জন রুম থেকে বের হয়ে উঠানে এলো। চাঁদনী রাত। চাঁদের আলোয় উঠানে গ্রিলের ছায়া পড়েছে। জোনাক পোঁকাগুলো উড়াউড়ি করছে। নির্জনের রুমের দরজায় নক দিল নুসরাত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে দিল নির্জন। যেন অপেক্ষায়ই ছিল সে। তার পরনে আগের কালো ট্রাউজার, গায়ে মেগি হাতা গেঞ্জি।

– ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’

নুসরাত কিছু একটা ভেবে বললো, ‘একটা গেইম খেলবেন নির্জন ভাই। আপনি তো অনেক লম্বা, দেখি পারেন কি-না।’

– ‘বুঝিনি।’

– ‘আচ্ছা আমি বুঝিয়ে দেই। আপনি দরজার পাল্লা দু’টো দুইহাত ধরে মেলে সোজা দাঁড়ান।’

নির্জন তাই করলো। নুসরাত এবার তরুকে ধরে বললো, ‘তুই এদিকে আয়’ বলে সে একেবারে নির্জনের সামনে তরুকে দাঁড় করিয়ে বললো, ‘এবার আপনি ওকে টাচ না করে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করুন। সময় দুই মিনিট।’

তরু পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘এটা আবার কেমন খেলা?’

‘আরে এরকম খেলা আছে৷ লম্বা মানুষ ছাড়া পারে না। দেখি উনি কাজের লম্বা কি-না। তুই একেবারে সোজা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাক।’ বলে নুসরাত বারান্দায় গিয়ে বললো, ‘শুরু করুন।’

নির্জন দরজার পাল্লা বারবার বন্ধ করতে গিয়ে তার বুক তরুর নাকে কপালে লেগে যাচ্ছে। তরু মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও, সে অনুভূতি শূন্য নয়। নক্ষত্রের বুক তার যতবার এসে নাকে লাগছে। শিরশির করে উঠছে তরুর বুক। নিজের অজান্তেই যেন ইচ্ছাকৃত তার মাথা নির্জনের দিকে আরও বেশি চলে যাচ্ছে। ওর বুক, গলা একেবারে চোখের সামনে। দুই মিনিট অনেক সময়, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তরুর পুরো শরীর যেন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে অবশ হয়ে আসছে। চোখবন্ধ করে, শুকনো ঢোক গিলে তরু ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বলছে, ‘নুসরাত বোন, তুই আমাকে এ কেমন পরীক্ষায় ফেলেছিস। আমি যদি হঠাৎ এই লোমশ বুকে ঝাপিয়ে পড়ি? যদি জড়িয়ে ধরে ফেলি? যদি ওই গলায় মুখ লুকাই?’

নিজের অজান্তেই তরু এক পা পেছনে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল পলকে। দরজার সঙ্গে দুইহাত একত্র হওয়ায় তরুর দুইগালে নির্জনের দুই হাতের পেশি লেগে গেল। কেঁপে উঠলো তরু। চোখবুজে খামচে ধরলো নিজের ড্রেস। নির্জন নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তার ইচ্ছে করছে এখনই তরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। ইচ্ছা করছে তরুও। অথচ দুজনই নিজেকে সামলে রাখছে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরার অধিকারের অভাবে৷ দরজায় নক দিল নুসরাত। তরু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল নির্জনকে। তারপর দরজা খুলে দ্রুত বারান্দায় গিয়ে বললো, ‘নুসরাত চলে আয়, ঘুমাতে হবে।’
তারপর আর পিছু না ফিরেই উঠান পেরিয়ে দ্রুত ছুটে গেল সে। নুসরাত মোবাইল টিপতে টিপতে বললো, ‘গুড নাইট নির্জন ভাই৷ ঘুমান। সকালে দেখা হচ্ছে।’

নির্জন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললো, ‘ঘুম নষ্ট করিয়ে ঘুমাতে বলছিস বইন।’
তারপর দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে গা হেলিয়ে দিয়ে বড়ো বড়ো করে শ্বাস ছাড়লো৷

এলার্ম থাকায় সকালে ঘুম ভাঙলো তরুরই আগে। ডাক দিল নুসরাতকে। উঠে বসে বললো, ‘কল দে উনাকে। উঠে ফ্রেশ হোক।’

তরুর অকারণই কেমন যেন হুট করে লজ্জা লাগছে কল দিতে। তবুও কল দিল। দুইবার রিং হতেই রিসিভ করলো নির্জন। ঘুম ঘুম গলায় বললো, ‘হ্যালো।’

– ‘চারটা বাজে উঠোন।’

– ‘ঘুমোতেই তো একজন দেয়নি সারা রাত। এখন আবার উঠতে হবে।’

তরু লজ্জায় লাল হয়ে পিটপিট চোখে নুসরাতকে দেখে নিল। তারপর বললো, ‘ফ্রেশ হয়ে রেডি হোন।’

– ‘তোমার ঘুম ঘুম ভয়েজ অনেক মিষ্টি তো তরু৷ বিরিয়ানির মতো এক প্লেট ঘুম ঘুম ভয়েজ বিক্রি হলে ভালো হতো।’

তরুর ভেতরে ভেতরে কি যে ভালো লাগছে। লজ্জা হচ্ছে। যেন নুসরাত সবকিছু শুনে ফেলছে। ‘আচ্ছা রাখি’ বলে কেটে দিল কল। দুইজন হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পালটে রেডি হয়ে গেল নির্জনের রুমে। গিয়ে নক দিতেই খুলে দিল সে। কেডস, জিন্স আর লাল গেঞ্জিতে কি যে সুন্দর লাগছে ওকে। তরু চোরা চাহনিতে কেবল দেখলো। লাল গেঞ্জিতেও বুঝি ছেলেদের এত মানায়? আগে খেয়াল হয়নি কখনও তরুর। তিনজনই বের হয়ে এলো রাস্তায়। নুসরাত বললো, ‘এখন রিকশা পাব না, হেঁটে হেঁটেই যেতে হবে আমাদের।’

নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দোকানপাটও খুলতে দেরি আছে তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাহলে আমরা নাশতা পরে করে নিব।’

– ‘হুম।’

তরু চুপচাপ হাঁটছে। তিনজনই রাস্তা দিয়ে হেঁটে এলো একটা চা বাগানের কাছে। চারদিকে উচ্চতার চা গাছ গিয়ে যেন ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠেছে৷ অদ্ভুত সুন্দর, সবুজ দৃশ্য। নির্জন মোবাইল বের করে সেল্ফি ক্যামেরায় ছবি তুললো একটা। নুসরাত তাদের নিয়ে গেল একটা সরু রাস্তা দিয়ে। দুইপাশে চা গাছ। হেঁটে হেঁটে তারা একটি পাহাড়ে এসে উঠলো। এই জনপদ প্রায় জেগে উঠতে শুরু করেছে। পাখিরা ডাকছে। পাহাড়ের ওপর থেকে চারপাশে চা গাছ দেখতে দারুণ লাগছে। পাহাড়টি অনেক বড়ো। পাহাড়ের ওপরেই আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য টিলা। নুসরাত একটু দূরে চলে গেছে। তরুকে নীরব দেখে নির্জন ফিসফিস করে বললো, ‘আমাকে আর নুসরাতকে একটু একান্তে কথা বলতে দাও।’

তরু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি কি কর‍তে পারি?’

– ‘ওই টিলার পেছনে গিয়ে বসো।’

‘ওকে’ বলে তরু হন-হন করে হেঁটে চলে গেল। নুসরাত ‘হা’ করে তাকিয়ে নির্জনকে বললো, ‘ও কই যায়।’

নির্জন ঠোঁট উলটে বললো, ‘কি জানি, আচ্ছা আপনি এখানে বসুন আমি গিয়ে দেখি কি হয়েছে।’

নুসরাত মাথা নাড়লো। নির্জন আস্তে-আস্তে হেঁটে টিলার কাছে গিয়ে দেখে তরু বসে আছে সামনে তাকিয়ে৷ সেখান থেকেও চা বাগান দেখা যাচ্ছে। নির্জন ওর পাশে গিয়ে বসলো। তরু অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি আসলেন যে।’

– ‘একান্তে তো আমি শুধু একজনকেই চাই ম্যাডাম।’

তরু কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল উত্তরের দিকে। যেদিকে একটি কোকিল কুহু কুহু করে কোথাও উড়ে যাচ্ছে।

– ‘তাকাবে না এদিকে?’

তরু তাও কোনো জবাব দিল না৷ নির্জন গাঢ় আবেগমাখা গলায় বললো, ‘আমি তোমার হাতটা একটু ধরে বসতে পারি তরু? যে হাতের নখগুলো লম্বা।’

____চলবে……
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে