প্রণয়ের রংধনু পর্ব-১৮+১৯

0
357

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ১৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যা ফারিশের থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলে, ফারিশ আরো শক্ত করে চেপে ধরে অনন্যার হাত। অনন্যা ক্ষিপ্ত গলায় শুধায়, ‘ কি করছেন কি? ছাড়ুন বলছি। এইসব কথা বলার মানে কী এখন? ‘
‘ আমি কেন বলছি আপনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন মিস অনন্যা। আপনি নিজেও খুব ভালো করে জানেন, যার স্মৃতির চিহ্ন আপনি দিনের পর দিন বয়ে বেড়াচ্ছেন সে কিন্তু সামান্য একটা ভিডিও ক্লিপ দেখেই, আমার মতো অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে, নিজের ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করেছে। অত:পর দীর্ঘদিনের ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটিয়ে, আপনাকে ভরা বিয়ের আসরে একা করে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এইসব রিডিকিউলাস লাভ অন্তত আমি ভালোবাসা বলে গণ্য করি না। যেখানে বিশ্বাসটুকুই নেই, সেখানে ভালোবাসার কোন স্হান নেই।’

ফারিশের কথা শুনে,অনন্যা থেমে যায়। ফারিশ বেসিন থেকে আংটি টা উঠিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়, সেই আংটিটা সোজা বাগানের সুইমিংপুলে গিয়ে পরে। অনন্যার আখিজোড়ায় জল চলে এলো। হ্যা! তাকে অভি অবিশ্বাস করে গিয়েছে দিনের পর দিন! কিন্তু তাই বলে অভির ভালোবাসাও মিথ্যে হয়ে গেলো? মানতে নারাজ অনন্যা। অনন্যা গলা উচিয়ে ফারিশকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ বিশ্বাস ভালোবাসার একটি বিরাট বড় অংশ! হ্যা,অবিশ্বাস করেছে সে আমাকে, কিন্তু তাই বলে তার ভালোবাসা সম্পূর্ন মিথ্যে হয়ে যায় না, আর আপনি কী বা বুঝেন ভালোবাসা নিয়ে? আপনার নিজের তো কোন হার্ট নেই, হার্টলোস লোক! সে নাকি আমাকে ভালোবাসা নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে। ‘

ফারিশ অনন্যার কথা শুনে প্রথমবারের মতো কোনধরনের চিৎকার চেচামেচি কিংবা রাগারাগি করলো না। অনন্যা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে সমানতালে। তার হাতের যন্ত্রনার জন্যে নয়, অভির দেওয়া আংটিটার জন্যে আজ সে কাঁদছে। অভির দেওয়া শেষ ভালোবাসার স্মৃতিটুকুও আজ নি:শেষ করে দিলো, ফারিশ নামক পাষাণ লোকটা।ফারিশ শান্ত ভাবে পাশে থাকা সোফায় বসে, পায়ের উপর পা রাখলো। অত:পর উপরে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাঁকিয়ে, গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বললো,

‘ ইউ নো না? অন্য কাউকে কৈফিয়ত দেওয়া, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ, বাট আজকে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে, বিশ্বাস ভালোবাসার বিরাট বড় অংশ নয় বরং বিশ্বাসই ভালোবাসা! ভালোবাসাই বিশ্বাস। শুধুমাত্র একটা অবিশ্বাসের জন্যে একটা সুখী পরিবার নিমিষেই শেষ! ভালোবাসা তো কম ছিলো না সেখানে কিন্তু তবুও আজ সেই পরিবারের কোন অস্তিত্ব নেই, শুধুমাত্র বিশ্বাসে ফাটল ধরেছিলো বলে, আর কি যেন বলছিলেন? হার্টলেস! রাইট! আম আ হার্টলেস! ‘

কথাগুলো বলতে বলতে সোফা থেকে উঠে ফারিশ একেবারেই অনন্যার সামনে চলে আসে, যার ফলে কিছুটা ঘাবড়ে যায় অনন্যা। ফারিশ অনন্যার কানে ফিসফিস করে বলে উঠে, ‘ এই অবিশ্বাস নামক জিনিসটাই আজ আমায় হার্টলেসে পরিণত করেছে, মিস অনন্যা। হ্যা, আমি বড্ড বাজে লোক! যে শুধু মানুষকে হার্ট করতে পারে। ‘

কথাটি বলেই দূরে সরে গিয়ে, রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো ফারিশ। অপরদিকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা। আজ ফারিশের প্রতিটা কথার মধ্যে এক অদ্ভুদ ব্যাথা, আর্তনাদ লুকিয়ে ছিলো। অনেক কথা ছিলো যা লোকটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনি অনন্যাকে। কোন পরিবারের কথা বলছিলো ফারিশ তাকে? যেই পরিবারটা শুধুমাত্র একটা অবিশ্বাসকে ঘিড়ে নিমিষেই ধবংশ হয়ে গিয়েছিলো! অনন্যার মনে হচ্ছে অতীতের কোন এক ভয়ংকর ঘটনার জন্যে তার আজ এমন পরিনতি! তাই তাকে সর্বপ্রথম ফারিশের অতীত সম্পর্কে জানতে হবে। অনন্যা জানে এই বাড়ির কোন লোক, তাকে সহজে সবকিছু বলবে না, তাকে কৈশলে সবকিছু জানতে হবে।

_____________________

শিফালি জুঁইকে ফোন করে যাচ্ছে অনেকক্ষন যাবৎ, কিন্তু জুঁইকে সে পাচ্ছে না। শিফালিকে হতাশ করে বারংবার অপাশ থেকে মিষ্টি সুরে একজন মহিলার জবাব আসে, ‘ আপনি যেই নাম্বারে ফোন করেছেন, তা এই মুহুর্তে ব্যস্ত আছে। দয়া করে, কিছুক্ষন পর আবার কল করুন, ধন্যবাদ। ‘

শিফালি মন আজকে ভিষন খারাপ। তার বিয়ে ভাঙ্গতে বসেছে, তার বয়ফ্রেন্ড তার সাথে প্রতারণা করে, অন্য নারীকে বিয়ে করবে বলে, সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছে। এইসব বিষয়ের জন্যে আজ তার অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে অনন্যার প্রতি। অনন্যার বিয়ে ভাঙ্গতে সেদিন নিজের পার্টিতে সে জুঁইকে সাহায্য করেছিলো, তার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকাও সে পেয়েছিলো। নিজের বন্ধুর প্রতি অবিচারের শাস্তিই আজ সে প্রতিক্ষনে ক্ষনে সে পাচ্ছে, সে ঠিক করেছে জুঁইয়ের সাথে কথা বলে, অভিকে সবকিছু বলে দিবে, কিন্তু জুঁইয়ের সাথে সে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না। তার ভাবনার মাঝেই, জুঁইয়ের ফোন আসে। সে কিচ্ছুক্ষন ভেবে তৎক্ষনাৎ ফোন রিসিভ করে। অপাশ থেকে জুঁই বিরক্তি গলায় প্রশ্ন করে, ‘ এতোবার ফোন করছিস কেন? সমস্যা কী তোর?’

‘ আমি আসলে..জুঁই। ভাবছিলাম যে, আমরা সবাই অনেক অপরাধ করেছি অনন্যার সাথে। অনন্যা তো নির্দোশ! আমার মনে হয়, অভিকে আমার সবকিছু বলে দেয়া উচিৎ। ‘

সঙ্গে সঙ্গে জুঁই শাসিয়ে বলে উঠে, ‘ চুপ, একদম চুপ!
এতো বেশি ভাবতে কে বলেছে তোকে? আরো টাকা লাগলে বল, কিন্তু এইসব জ্ঞান ফ্যানের কথা আমাকে বলিস না। একটা কথা ভালো করে মাথায় রাখ, আমি চাই না ফারিশের কোনরকম অসুবিধা হোক। এইসব কথা যেনো আমি দ্বিতীয়বার না শুনি। নাহলে তুই জানিস, আমি ঠিক কতটা খারাপ। বন্ধু বলে ছাড় পাবি না তুই। অভি যেনো কিছু না জানতে পারে। ‘

শেফালি ফোনটা রেখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে ভেবে উঠতে পারছে না, এই মুহুর্তে তার কি করা উচিৎ! নিসংদেহে জুঁই একজন ভয়ংকর মেয়ে! সে যা বলবে তাই করবে।

_______________

অনন্যা নিজের রুম থেকে বেড়িয়েই, আরশের মুখোমুখি হয়। আরশ অনন্যা দেখেই বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠে বলে, ‘ মিস…হু! কি নাম যেনো? আচ্ছা যাই হোক, তা আপনার সার্ভিস কেমন চলছে? ফারিশ খানকে খুশি করতে পারছেন ঠিক মতো? ‘

আরশের বলা পুনরায় এমন কুৎসিত কথাতে, অনন্যা নিজের গাঁয়ের ওড়না ঠিক করে কঠোর গলায় জবাব দেয়, ‘ গালের থা/প্পড়ের কথা কি ভুলে গিয়েছেন? ‘

অনন্যার কথা শুনে, রাগে নিজের গালে হাত রাখে আরশ। আরশ কিছুটা এগিয়ে, অনন্যাকে শাসিয়ে বলে উঠে, ‘ আরশ খানের নজর যার উপর একবার পরে, তাকে সে একদিনের জন্যে হলেও নিজের বিছানায় এনে ফেলে। সেখানের তোমার মতো মেয়েকে তো…..’

আরশ হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিলো, কিন্তু পিছন থেকে ফারিশ এসে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

‘ এখানে কি হচ্ছে? ‘

ফারিশের কথা শুনে, আরশ থেমে যায়। দ্রুত দূরে সরে আসে। ফারিশকে দেখে স্বস্হির নি:শ্বাস ফেলে অনন্যা। ফারিশ আরশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ তুই এই মুহুর্তে! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’

আরশ মাথা নিচু করেই জবাব দিতে গিয়ে, আমতা আমতা করে জবাব দেয়, ‘ আসলে ভাই। আমি তো এখানে মানে…. ‘

ফারিশ পকেটে হাত রেখে, আরশের দিকে তাঁকিয়ে বাঁকা হেসে বলে, ‘ বাংলাতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে ইউ নো আরশ?অতি বাড় বেড়ো না, ঝরে পড়ে যাবে। ‘

ফারিশের কথা শুনে, আরশ এবং অনন্যা দুজনেই অবাক হয়! বিশেষ করে আরশের গলা ভয়ে শুকিয়ে আসে, তার মস্তিষ্কে একটা কথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে, ফারিশ কি কোন কিছু আন্দাজ করেছে? ‘

‘ ইউ নো না আরশ? বেশি কথা বলা, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

অনন্যা শুধু থ মে/রে ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে আছে।
আরশ কিছু না বলে বেড়িয়ে যায়। অপরদিকে, অনন্যা হয়তো ফারিশকে কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু ফারিশ গম্ভীর হয়ে বাইরের দিকে চলে যায়। ফারিশের পিছনে পিছনে অনন্যাও আসে। ফারিশ ড্রইংরুমে চলে আসে। সেখানে তার চাচা – চাচী এবং এনা বসে ছিলো। ফারিশ অফিসের উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলো কিন্তু হুট করে সেখানে জুঁই এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরে।

চলবে কী?।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-১৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
জুঁই সকলের সামনে এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরায়, অনন্যা ভ্রু কুচকে তাঁকায় জুঁইয়ের দিকে। রেশমি খান এবং এনাও কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। ফারিশ স্হীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখমুখ শক্ত! জুঁই ফারিশকে জড়িয়ে থেকেই ফিসফিস করে বললো, ‘ অফিস থেকে না হয় বিদায় করে দিয়েছো, কিন্তু? এই বাড়ি থেকে আমাকে কি করে বিদায় করবে তুমি ফারিশ? তুমি যতই আমাকে দূরে সরাতে চাইবে, আমি ততই তোমার কাছাকাছি চলে আসবো।’
ফারিশ কোনপ্রকার জবাব দিলো না। এমন পরিস্হিতিতে খালেদ খান কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার মা রুমা খান উপর থেকে নেমে গাম্ভীর্যের সাথে চেচিয়ে উঠে বললেন, ‘ এইসব কি হচ্ছে এখানে?’

রুমা খানের আওয়াজ শুনে, ফারিশ তৎক্ষনাৎ জুঁইকে একপ্রকার ঠেলে নিজের থেকে সরিয়ে ফেললো। জুঁই ধাক্কা সামলাতে না পেরে,নীচে পরে যেতে নিয়েছিলো কিন্তু আরশ এসে জুঁইকে ধরে ফেলে। জুঁইকে এইভাবে ধাক্কা দেওয়ায় আরশ কিছু বলতে চাইলে, জুঁই আরশকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে।জুঁই আরশকে আকড়ে ধরে কোনরকম জোড় করে হেসে বলে, ‘ আসলে অনেকদিন পর, সবাইকে দেখলাম তো! তাই আর কি এক্সাইটেডমেন্টে! যাই হোক, এনা ও আরশ তোরা আয়! লেটস গিভ মি হাগস! কতদিন পর তোদের দেখলাম। ‘

এনা ও আরশও একসাথে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে। আরশের থেকে বয়সে জুঁই ছোট হওয়ায়, আরশ জুঁইকে এনার মতোই ভালোবাসে, অপরদিকে এনাও বড় বোন হিসেবে জুঁইকে অনেক পছন্দ করে। জুঁই, এনা ও আরশের সাথে কুশল বিনিময় করে, রেশমি বেগমকে জড়িয়ে ধরে, ‘ খালা! কি অবস্হা তোমার?’

রেশমি বেগম উত্তর দিলেন না, তবে তাকে খুব দুশ্চিন্তিত লাগছে! ড্রইয়ং রুমে ৪টার মতো এসি! বাইরে আজ মেঘলা আবহাওয়া, তবুও সে ঘামছে! তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন, জুঁই মোটেও তাদের জন্যে আসেনি। ছোটবেলা থেকে সে ফারিশকে পছন্দ করে, সে একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছে ফারিশকে পাওয়ার জন্যে। নিশ্চই কোন পরিকল্পনা নিয়েই সে আজ এসেছে খান বাড়িতে কিন্তু তিনি ফারিশকেও ভালো করে চিনেন। একরোখা, জেদি টাইপ ছেলে। সে বেশকয়েকবারই জুঁই এবং ফারিশের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন প্রতিবারই তীব্রভাবে অপমানের সহিত সেই প্রস্তাব নাখোচ করেছে ফারিশ! বাড়িতে জুঁই চলে আসায় বেশ বড়সড় ঝামেলা হবে ভাবতেই মাথা ঘুড়াচ্ছে রেশমির! কিন্তু তার অজ্ঞান হলে চলবে না! নাহলে সবকিছু সামলাবে কে?

এতোকিছুর মাঝে সবেমাত্র ঘোর কাটলো অনন্যার! এতোক্ষন সে একটা বিরাট বড় ঘোরের মধ্যে ছিলো , জুঁই সম্পর্কে রেশমি খানের বোনের মেয়ে হয়! তার মানে ফারিশের সাথে তার আত্বীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সেদিন অভির সাথে জুঁইয়ের হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়ায়, প্রথম থেকেই অনন্যার সংদেহ হচ্ছিলো,সবকিছুর মধ্যে কোথাও না কোথাও জুঁইয়ের হাত রয়েছে। আজ সে পুরো নিশ্চিত, এতো বড় ষড়যন্ত্রে জুঁইয়েরও হাত রয়েছে। অনন্যার এখন মনে হচ্ছে সেদিনের ভিডিও হয়তো মিথ্যে না! সেদিন রাতের পুরো ঘটনা তার মনে নেই! এর পিছনে শেফালি এবং জুঁই সমানভাবে জড়িত! জুঁইকে সে ভালো করে চিনে, সে কিছুতেই সত্য কথা স্বীকার করবে না, অন্যদিকে বাকি রয়েছে শেফালি কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করবে কীভাবে অনন্যা? তার ফোনটাও তো ফারিশের কাছে জমা রয়েছে।

অনন্যা ভাবনার মাঝেই, জুঁইয়ের নজর গিয়ে পরে, অনন্যার উপর। অনন্যা দেখেই ইচ্ছে করেই, খানিক্টা হেসে প্রশ্ন করে , ‘ এই মেয়ে কে? আজ নতুন দেখলাম। নতুন সার্ভেন্ট নাকি?’

রেশমি খান হাল্কা হেসে বললেন, ‘ হ্যা! আমাদের বাড়ির কাজের লোক। ‘

‘ রেশমি খান একটা কথা আপনাকে কতবার বলতে হবে? মিস অনন্যা শুধুমাত্র আমার পার্সোনাল কাজের লোক! সব বিষয়ে আপনি কেন এতো ইন্টারফেয়ার করেন?’

ফারিশের প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো রেশমি খান। এনা এগিয়ে গিয়ে জুইকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ আপু! চলো তো উপরে।কতদিন পর, তোমায় দেখলাম। অনেক গল্প করা বাকি আছে। ‘

এনার কথার বিপরীতে, জুঁইও ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ সমস্যা নেই। এসেছি যখন, বেশ কয়েকদিন থেকে তবেই যাবো। ‘

ফারিশ আগের ন্যায় কোনপ্রকার উত্তর দেয় না কিন্তু বাঁকা হাসি দিয়ে নীচের দিকে তাঁকায়! তার মষ্তিষ্কে হয়তো এমন কিছু এসেছে তা ভয়ংকর! তবেই সে এতোটা শান্ত। তাদের কথার মাঝেই, আরশের ফোন আসে। অপাশ থেকে একটা মেয়ের নাম্বার দেখে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিয়ে, মেয়েটার নাম্বারে মেসেজ করে লিখে, ‘ তুমি রেডি থাকো বেবি! আমি জাস্ট কিছুক্ষনের মধ্যে হোটেল রুমে পৌঁছে যাচ্ছি। ‘

আরশ ফোনটা রেখে, জুঁই এবং এনার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে ছোটখাটো একটা পার্টি আছে, তোমরা যাও! আমি পার্টিটা শেষ করে, জলদি চলে আসবো। ‘

‘ ওকে ভাইয়া, কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। ‘

এনা কথাটি বলেই, জুঁইকে নিয়ে উপরে যেতে থাকলে, জুঁই খেয়াল করে অনন্যা ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে, কিন্তু তা সে একপ্রকার এড়িয়েই উপরে চলে গেলো। ফারিশও অফিসের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো কিন্তু পিছন থেকে খালেদ খান ড্রাইনিং টেবিলে বসে থেকে প্রশ্ন করে, ‘ ফারিশ শোনো একটু! আমাদের নেক্সট ক্লাইন্টকে হ্যান্ডেল করতে, ভাইকে দেশে আসতে বলবো ভাবছি। জাপানের ক্লাইন্ট তো! বেশ ঝামেলা করে এরা। ভাই আবার জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে উঠাবসা। তিনি সবকিছু ভালো করে হেন্ডেল করতে পারবে। তোমার কি মতামত? ‘

ফারিশ পিছনে না ঘুড়েই জবাব দিলো,’ মি: খালেদ খান, আপনার কি কোনভাবে আমার স্ট্রাটাজির উপর সংদেহ রয়েছে? থাকলে বলুন। এই অর্ডার থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে ফেলবো। ‘

‘ এইসব কি বলছো ফারিশ? তোমার উপর আমি কী করে সংদেহ করতে পারি? আসলে জাপানের পার্টি তো বুঝতেই পারছো! তার মধ্যে প্রায় ১০০কোটি টাকার অর্ডার, তাই আর কি…..

সম্পূর্ন কথা শেষ করতে পারলেন না খালেদ তার আগেই ফারিশ উচ্চগলায় বলে উঠে, ‘ আজকেই আমি সেই জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে বসে, অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। তার জন্যে রাশেদ খানকে, সদূর জাপান থেকে চলে আসতে হবেনা। তিনি যদি কোনভাবে আমার কাজে ইন্টারফেয়ার করে, তবে আমি নিজেকে বিসনেজ থেকে সরিয়ে ফেলবো। আমার লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিসিশন। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

ফারিশ কথাটি বলেই বেড়িয়ে যায়। খালেদ খান ও কথা বাড়ালেন না, তিনিও বেশ ভয় পান তার ভাইয়ের ছেলে। ছেলে যখন একবার সতর্ক করে দিয়েছে তখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করলে, ঝামেলা হবে বড়! ফারিশ ব্যাবসায়ী ছেলে বাবার মতো!এতো বছর ধরে সাফল্যের সাথে খান বাড়ির ব্যাবসা সামলাচ্ছে যদিও ফারিশ ডিগ্রি পেয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। কিন্তু ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রে সে তুখোর! তাইতো খান ইন্ড্রাস্টির এমডি সে। খালেদ খানের ধারণা, ফারিশ যখন বলে দিয়েছে তখন সে তাকে নিরাশ করবে না আজ। সে একাই এতো বড় অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। অপরদিকে এইসব দেখে রুমা খান হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিজের বাবার প্রতি ফারিশের এমন বিদ্বেষ দেখে, অনন্যা রুমা খানের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ দাদি! অনেক দিন ধরেই একটা কথা বার বার জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম। ‘

‘ কি কথা রে দিদিভাই?’

‘ এই বাড়িতে সবাই আছে, কিন্তু ফারিশ খানের বাবা-মা এই বাড়িতে থাকে না কেন? উনারা কি দুজনেই বিদেশে থাকে?’

অনন্যার এমন প্রশ্নে রুমা খানের মুখস্রী শুকনো হয়ে যায়। তিনি থমথমে গলায় জবাব দেয়, ‘ ফারিশ দাদুভাইয়ের যখন ৭বছর তখন তার মা মারা যায়। রোকেয়া মারা যাওয়ার ৮মাসের মাথায় ফারিশের কথা ভেবে, রাশেদ আরেকটা বিয়ে করে। কিন্তু সেই মাকে কিছুতেই মেনে নেয় না ফারিশ এবং সেই ঘরে বাচ্চা- কাচ্চা হওয়ার পরে, রাশেদের স্ত্রীও রাশেদকে নিয়ে বিদেশে চলে যায়, ছেলেটাকে একা করে। কতই বা বয়স ছিলো ছেলেটার? অতটুকু বয়সে বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে ফেলে সে। সৎ মা তো সৎ মা’ই হয়। এখন রাশেদ বউ, ছেলে- মেয়ে নিয়ে বিদেশেই থাকে। শীতের মধ্যে একবার করে তারা আসে শুধু এতটুকুই।’

রুমা খানের কথা অবাক হয়ে যায় অনন্যা! নিজের বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে ফারিশ। ছোট বয়স থেকেই বিষাক্ত দুনিয়াকে অনুভব করেছে সে, তাইতো তার মনে মায়া -দয়া জিনিসটা কম। অনন্যা প্রশ্ন করলো, ‘ আপনি তার বাবা কে, এতটুকু ছেলেকে রেখে, বিদেশে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন কেন দাদী?’

‘ সৎ মায়ের ছায়ায় বড় হওয়ার থেকে, তার থেকে দূরে থাকাই ভালো দিদিভাই। আমি তো দুনিয়াটি বুঝি রে দিদিভাই। তাই সেদিন রাশেদকে আটকায়নি, নাহলে আমার অনুমতি ব্যাতীত রাশেদ কখনোই যেতে পারতো না। আমি তো জানি ইশিকা ঠিক কেমন মানুষ! আমার নাতীকে সে কখনোই মমতা দিয়ে কাছে ডাকেনি। তার জন্যেই আজ বাবা- ছেলের মধ্যে এতোটা দূরুত্ব! ‘

বলেই আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন রুমা খান। অনন্যা নিজের রুমে এসে, নিজে নিজেই বলতে লাগলো, ‘ লোকটার হার্টলেস হওয়ার পিছনে কারণ আছে। ছোটবেলা থেকে বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে। বিয়ে করার পরও সংসার সুখ জুটলো না। বউটাও মারা গেলো। মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছে এখন। ‘

এইসব বলতে বলতে পরক্ষনে অনন্যা ভাবলো কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে তার বা তার ফ্যামেলির কি যোগসুত্র রয়েছে? যার কারণে এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে ফারিশ। ফারিশের করা কাজের কথা পুনরায় মস্তিষ্কে আসতেই, তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় অনন্যা! যত যাই হয়ে থাক। ফারিশ একজন নিকৃষ্ট মানব, তাকে নিয়ে মায়া করা বিরাট বড় অন্যায় বলে অনন্যার ধারণা। আজ তার প্রতিশোধের
নেশাতে, ভালোবাসা, পরিবার হারিয়ে শূন্য অনন্যা।

___________________

অফিস শেষে গাড়ি করে বাড়ির দিকে ফিরছিলো অভি, কিন্তু ঢাকা শহর বলে কথা! ঢাকা শহরে জ্যাম থাকবে না তা প্রত্যাশা করা সবথেকে বড় ভুল! আধাঘন্টা যাবত জ্যামে বসে আছে অভি। বিরক্ত হয়ে অভি গাড়ির মিউজিক অপশনে গিয়ে, একটি রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দেয়। মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেঁসে আসে, সেই পরিচিত গানটি….

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে’

গানটি শুনে অভির মনে পরে পুরনো কিছু স্মৃতি! প্রত্যেক শুক্রবার যখন সে অনন্যার সাথে দেখা করতে যেতো, তখন লাল পাড়ের মধ্যে তাতের সাদা শাড়ি পরতো অনন্যা। মুখস্রীতে থাকতো হাল্কা সাঁজের প্রলেপ! কপালে একখানা ছোট্ট কালো টিপ! লম্বা চুলে করা থাকতো খোপা। কি সুন্দর স্নিগ্ধ দেখাতো মেয়েটাকে। অভি তার কাছে গান শুনতে চাইলে, সে প্রথমেই বলতো, ‘ আগে বলো? বেলীফুলের গাজরা এনেছো? গাজরা না আনলে, নো সিনগিং! ‘

অভি তখন মুচকি হেসে গাজরা সামনে রাখতো অনন্যার। তা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিতো অনন্যা। অভি অনন্যার খোপায় গাজরা পরিয়ে দিতো এবং অনন্যা তার মিষ্টি গলায় গাইতো সেই রবীন্দ্রসংগীত..

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে ‘

সেই পুরনো দিনের কথা মনে পরতেই, অভি কি মনে করে যেনো গাড়ি থেকে চট করে নেমে গেলো। পাশে ছিলো ফুলের দোকান! সে দোকানে গিয়ে একটি গাজরা কিনে ফেললো। গাজরাটা কেন কিনলো সে জানেনা। তবে পরম ভালোবাসা নিয়ে সে গাজরাটির দিকে তাঁকিয়ে ছিলো।

________________

সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে এলো ফারিশ। অন্যদিনের তুলনায় আজ তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। কারণ আজ সে একাই এতো বড় অর্ডার কনর্ফাম করিয়েছে জাপানি ক্লাইন্টদের দিয়ে। ফারিশ উপরে গিয়েই, নিজের ফোন মানিব্যাগটা রেখে, চটজলদি ওয়াশরুমে চলে যায়। অনন্যা ফারিশের রুমে এসেছিলো কফি নিয়ে। ফারিশকে ওয়াশরুমে যেতে দেখে, সে চট করে ফারিশের ফেনটা হাতে নিয়ে নেয়। সকালে মিষ্টি যখন ফারিশের ফোনে গেম খেলছিলো, তখন ফারিশের ফোনের পার্সওয়ার্ড সে দেখেছিলো। এই বাড়িতে একজন সার্ভেন্ট এর কাছেও ফোন নেই, তার মধ্যে বাড়ির কেউই তাকে নিজের ফোন দিচ্ছিলো না, তাই বাধ্য হয়ে, ফারিশের ফোন থেকেই শেফালির নাম্বারে ডায়েল করে অনন্যা। সে জানে পাক্কা ২০ মিনিট এর আগে ওয়াশরুম থেকে বের হবেনা ফারিশ কিন্তু…..

শব্দসংখ্যা-১৬১৫
চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে