পুতুল বিয়ে পর্ব-০৭

0
976

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মিতুলের দ্বিতীয় বিয়ে টিকলো না। মানুষ বলে না যে প্রতারক নিজেও অন্যের কাছে একদিন প্রতারিত হয়।মিতুলও হলো। পিয়ার সাথে ওর বিয়ের তিনমাস পেরুতেই মিতুল জানতে পারলো পিয়া অন্য একটি ছেলের সাথে কথা বলে।ওর একটা আলাদা প্রেমের সম্পর্ক আছে। মিতুল ভেবেছিল ওর কাছ থেকে দ্রুত সড়ে আসবে। কিন্তু ওর আর নিজ থেকে সড়ে আসতে হলো না। পিয়া নিজেই একদিন বাড়ি ছেড়ে ওই ছেলের সাথে পালালো। পিয়া আর কোনদিন ওর জীবনে ফিরে এলো না!

মিতুল এবার ভেঙে পড়লো। খুব খুব ভেঙে পড়লো।সে এখন চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকে। ঠিকমতো খায় না দায় না।মন খারাপ করে বসে থাকে। সেদিন সন্ধ্যার পর আমার কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।বেশ অনুতাপের গলায় বললো,’তোমায় আমি কষ্ট দিয়েছি অনেক। আল্লাহ তাই আমায় এর শাস্তি দিয়েছেন! তুমি আমায় আর বদ দোয়া দিও না। এখন থেকে আমি তোমার।তোমায় ছেড়ে আর কোথাও যাবো না!’
ওর কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম।মিতুলকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’তোমার জন্য কখনোই আমি বদ দোয়া করি না। তোমার অমঙ্গল কামনা করার আগে যেন আমার নিজের অমঙ্গল হয়!’
মিতুল শুনে ভীষণ খুশি হলো।আমায় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতে খেতে সে বললো,’আমার লক্ষ্মী বউ। তুমি ভীষণ ভীষণ ভালো!’
তারপর থেকে আমার ভালো সময় কাটতে লাগল। মিতুল রোজ নিয়ম করে আমার কাছে আসতো।আদর করতো। ভালোবেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো।আমি তখন ভেবেছিলাম এই আমার সুখের দিন এসে গেছে। এখন আর কোন চিন্তা নেই!
কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মিতুল যেন কেমন হয়ে গেছে। এখন আর বাড়িতে তেমন থাকে না। আমার কাছে ঘেঁষে না খুব একটা।টেনেও তাকে কাছে আনা যায় না!বলে ভালো লাগছে না।ক্লান্ত!
আমার তখন সন্দেহ হয়। তাই খোঁজ খবর নিতে শুরু করি। এবং খোঁজ খবর নিয়ে দেখি আমার সন্দেহ মিথ্যে নয়।যা ভেবেছি তার চেয়ে বেশিই সত্য।
মিতুল এখন খারাপ মেয়েদের কাছে যায়। ওখানেই রাত কাটায়।
আমার মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।কী করবো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না! ওদিকে মার কথার খেলাপ করেছি দুই দুইবার। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না তার কাছে।মা সহজে মেনে নিবে না। তাছাড়া মামারা মাকে খুব বকেছে।বলেছে,তোর নষ্ট মেয়ে যদি এই বাড়িতে আবার ফিরে তবে তোদের সবগুলোরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো!
আমি আর এখন আমার পায়ের নিচে কোন মাটি দেখি না। উপায়হীন হয়ে শুধু ভাবি। ভেবে আর কোন কূল পাই না!
হ্যা আপনি এখন বলতেই পারেন, এই জমানায় এসে এমন কথা বললে চলে? চাকরি বাকরির অভাব আছে নাকি দেশে?
কিন্তু মঞ্জুরও তো অভাব নাই এই দেশে!এই অতি আধুনিক জমানায় এসেও কিন্তু এই দেশ মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয়। এখনও এ দেশের হাজার হাজার মেয়ে পুরুষের অত্যাচারের শিকার।নারীরাও নারীদের ধাবিয়ে রাখছে।রোজ শত শত ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে লজ্জা এবং ভয়ের ছায়ায়।কেউ মুখ খুলছে না। শুধু লেখক তার গল্পে,নাট্যকার তার নাটকে কিম্বা রাজনৈতিক বড় নেতারা তাদের বক্তৃতায় বড় বড় গলায় বলছে,নারী স্বাধীনতার কথা।নারীরা নাকি পুরোপুরি স্বাধীন। কিন্তু সত্য হলো এটাই যে নারীরা এখনও স্বাধীন নয়। নারীদের অধিকাংশই এখনও পুরুষের কতৃত্ব দীন। নিজের ইচ্ছায় যে তারা কিছু করবে তা গোটা কতক পরিবার ছাড়া অন্য কোথাও পারছে না!
আমি কাঁদি। অসহায়ের মতো।আর চারদিকে দেখি ঘন কালো অন্ধকার। এইসব অন্ধকার এসে আমায় চারিধার থেকে ঘিরে ফেলেছে। জড়িয়ে ধরেছে স্বর্ণলতার মতো।দিনদিন আমি ভেঙে পড়তে থাকি।মনে হয় মৃত্যু আমার খুব কাছে এসে গেছে।
শাশুড়ি মার কাছে এসব কথা নিয়ে ঘেঁষা যায় না। তিনি বলেন,’তুমি কী মাইয়া মানুষ না? আমার তো সন্দেহ হয়। মাইয়া মানুষ হলে স্বামীরে সন্তুষ্ট করতে পারো না কিসের জন্য?যদি সন্তুষ্ট করতেই পারতা তাইলে তো আর সে বাইরে বাইরে ঘুরতো না!অন্য নারীর কাছে যাইতো না!’
কী জঘন্য মহিলা একটা!কী বিশ্রী তার কথাগুলো! আচ্ছা আপনিই বলুন, আমাদের নারীরাই কী নারীদের পায়ের তলায় পিষে রাখছে না? তবে শুধু পুরুষকে দোষ দিবো কেন? আমার তো মনে হয় মিতুলের চেয়েও তার মা বড় অপরাধী!যদি দেশের প্রতিটা মা এমন হতো!যদি তার ছেলে কোন নারীকে অসম্মান করলে নিজের মা তার সেই অপরাধী ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ না দিয়ে নিজ হাতে খুন করতো, অপরাধের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দিতো তবে পৃথিবী আরো অনেক আগেই শুদ্ধ হয়ে যেতো। বাতাসে বাতাসে পুরুষ আর নারীর মিষ্টি কথার সুঘ্রাণ ছড়াতো! পৃথিবীর প্রতিটি ঘর হতো ছোট ছোট স্বর্গ!

কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে মিতুলের বড় চাচীর কাছে সব খুলে বলি।তার বড় চাচী তখন বলেন,’সন্তান নেও। সন্তান নিলে দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে। আগে তোমার জায়গা পাকা করো মা।ঘরে শিখড় গাঁথুনি দেও। তারপর যা ইচ্ছা তাই করতে পারবা!’
বড় চাচীর কথাটা আমার মনে ধরে।আমি চিন্তা করি, বিয়ের যেহেতু দু- তিন বছর হয়েছে এবার তবে সন্তান নেয়া যায়। সন্তান হলে সন্তানের মায়ায় হলেও মিতুল ঘরমুখো হবে।
কিন্তু সন্তান নেয়াটা খুব কঠিন। মিতুল চাইতোই না আমরা এখন সন্তান নেই। ওর কাছে বলতেই ও রেগে যায়।বলে,’আরো চার পাঁচ বছর পর সন্তান নেয়া নেয়ি। এখন সময় হয়নি।’
আমি বলি,’সময় হয়নি কেন?আমি তো আর চাকরি বাকরি করছি না কোন!’
মিতুল বলে,’সন্তান নিলে তুমি বুড়ি হয়ে যাবে।বুড়ি বউ নিয়ে আমি সংসার করবো না!’
আমি তখন বলি,’এখনও কী তুমি আমার সাথে সংসার করো? তুমি তো থাকো পাড়ায় পাড়ায়!’
মিতুল তখন আমায় হুমকি দেয়।বলে,’এইসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ঘরে আমি ফিরবোই না!’
আমি তখন চুপ হয়ে যায় একেবারে।আর কথা বলি না ভয়ে। কীভাবে কথা বলবো?ওর সাথে যাই বলতে যাবো তাই তো ওর কাছে ভুল হিসেবে গণ্য হবে!সে ভয় দেখাবে আমায়। ছেড়ে যাওয়ার ভয়!
বড় চাচীর সাথে আবার দেখা করি।বলি,’চাচী,সে তো শুনতেই পারে সন্তান নেয়ার কথা।সে বলে আরো চার পাঁচ বছর পর সন্তান নিতে। এখনও নাকি আমার সময় হয়নি!’
বড় চাচী তখন বলে,’তুমি হইলা বড় বেকুব মাইয়া।জগতে তোমার মতন যতো বেকুব মাইয়া আছে এদের কপালে শান্তি জিনিসটা নাই!ডান বাম কিছুই বুঝো না। একটা কথা শুনো, তোমার মঙ্গলের জন্য তোমায় একাই লড়তে হইবো।সে সন্তান নিতে না চাইলে না নিক। সন্তান তো আর তার পেটে থাকবে না। সন্তান থাকবে তোমার পেটে। শুরুতে গোপন রাখবা সবকিছু।পরে প্রকাশ হওয়ার সময় হলে তো এমনিতেই সব প্রকাশ হবে।’
আমি ভয়ে ভয়ে বলি,’তখন ও সবকিছু জেনে যদি সমস্যা করে?’
বড় চাচী হাসেন।বলেন,’কিছুই হইবো না। একটু রাগা গোস্বা হইবো। তারপর সব ঠিক হইয়া যাইবো। ঔরসের সন্তানের মহব্বত বড় মুহব্বত বুঝলা!’
আমি বলি,’ঠিক আছে।আমি ওকে না জানিয়েই সন্তান নিবো।’

মিতুল পৃথিবীর বিখ্যাত চতুরদের একজন! সেদিন রাতে যখন ওর কাছে বলেছিলাম আমরা সন্তান নিবো এরপর থেকেই সে স্বতর্ক হয়ে যায়। আমার কাছে কম আসে।আসলেও স্বতর্ক থাকে। নিজের হাতে পিল খাইয়ে দেয়। এতো কিছুর পরেও একদিন ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে কনসিভ করে ফেলি আমি।আর ধরে নেয় আমার পেটের সন্তানই আমার ভাগ্য। আমার সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল ভবিষ্যত।সে জন্ম নিয়ে আমায় নতুন করে গড়বে।তার পিতাকে ঘরমুখো করবে।আর আমাদের সমস্যাপূর্ণ, ভালোবাসাহীন ঘরটা তখন ভরিয়ে তুলবে ভালোবাসাময়। আমার দুর্দিন তখন আর থাকবে না।আমি আমার সন্তান আর স্বামী নিয়ে হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখিদের একজন!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে