পাতা ঝরার দিনের কথা

0
1005

আমি বর্তমানে পৃথিবীর যে প্রান্তে অবস্থান করছি সেখানে আল্লাহর রহমতে সারাবছরই ভালো গরম পরে। না! শীতকাল বলতে তেমন কিছুনাই। মোটামোটি এই তিন ভাগে গোটা বছরের ঋতু পরিবর্তনকে ভাগ করা যায় –
ক. গরম কমে (একে বলে ড্রাই সিজন- হালকা শীত শীত ভাব হয় মনে হয় এই বুঝি শীত পড়বে! কিন্তু সেই শীত আর পড়ে না)
খ. গরম বাড়ে ( একে বলে ‘বিল্ড আপ’। অর্থাৎ এই সময়ে আপনাকে মূল গরমের সময়টার একটা ছোট নমুনা দেখানো হবে । সবাই এই সিজনে হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং মোটামুটি নিশ্চিত হয় এই বছরও শীত পড়বেনা)
গ. গরম অসহনীয় হয়/মাত্রা ছাড়িয়ে যায় (এই সময় আবার সবাই স্বপ্ন দেখা শুরু করে, আশায় বুক বাঁধে এই মনে করে যে এই গরম বেশিদিন থাকবে না! কারণ ড্রাই সিজন আসন্ন!)
তবে হ্যাঁ বৃষ্টি হয়। কঠিন বৃষ্টি! যাকে বলে একেবারে কুকুর বেড়াল বৃষ্টি। শহরটা সমুদ্রের খুব কাছে হওয়ায় সেই তুমুল বৃষ্টির সময় এক অতিপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাদর যেন ঘিরে থাকে এর চারপাশ ! আর হয় ঝড়। একেবারে সাইক্লোন ক্যটাগরি ঝড়!! সব মিলিয়ে বলা যায় ভীষণ wild weather! কিন্তু সারাবছরই এখানকার আকাশটা দেখারমত একটা ব্যপার বটে! এত রং- এত ভ্যেরিয়েশন – এত ভয়ংকর সুন্দর এখানকার আকাশ, যে প্রকৃতির ঔদ্ধত্ব অনেকটাই আপনি ক্ষমা করে দিতে বাধ্য।

এবার বলি কেন আমি ইনিয়ে বিনিয়ে এখানকার ওয়েদারের বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনা দিচ্ছি। আসলে ইয়ে …মানে… ব্যপারটা হল গিয়ে শুনলাম ঢাকায় ভীষণ শীত পড়েছে এবার। আসলে আমার মত যারা আজন্ম ঢাকাবাসী তাদের জন্য শীত কিন্তু একটা বিরাট ঘটনা। সারাবছর গরম আর লোডশেডিংএর অত্যাচারের পর শীতকালটাকে মনে হত অনেকদিনের না দেখা খামখেয়ালী কোন প্রিয় বন্ধু- যে কিনা অল্প দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে, আবার কাউকে কিছু না জানিয়েই দুম করে চলে যাবে!!

আজ সকালে মেসেঞ্জারে আমার এক আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন বর্তমানে ঢাকায় তীব্র শীত পড়ার প্রসঙ্গ আসে। তা সে ঢাকার শীত নিয়ে আমার মাতামাতি শুনে মহা বিরক্ত! আমাকে বলে “তুমি কখনো শীতের দেশে থাকো নাই তাই তুমি এমন কর! শীতের আসল চেহারা -আসল সৌন্দর্য্যই তুমি দেখো নাই। তাই অযথা ঢাকার মত বসবাসের অযোগ্য একটা শহরের শীত নিয়ে ইমোশনাল হোচ্ছ!” আমি খুব একটা তর্কে গেলাম না। তা কিছুটা ঠিকই বোধহয় বলেছে ও। ইমোশনই হবে হয়তো! শীত মানেই আমার কাছে হুড়মুড়িয়ে সামনে আসা অজস্র প্রিয় মুহূর্ত – নস্টালজিয়া – শৈশব …

ছোটবেলায় শীতকাল মানে ছিল পরীক্ষা শেষ – পড়ালেখায় সাময়িক ইস্তফা। শীত মানে ছিল শীত শীত গন্ধে লাল লেপের নীচ থেকে অলস চোখে সাদাটে সকাল দেখা! এই সময়টাতে আমার মধ্যবিত্ত বাড়ির খাটের নীচ থেকে গ্রাম থেকে আসা বস্তাবন্দী চালের গুড়ি আর নারকেল বের হত । কখনো চালের রুটি আবার কখনোবা খোলা পিঠার গন্ধে শহুরে সকালটার চেহারাই যেন পালটে যেত! ঝিম ধরা রহস্যময় দুপুরে ধার করা অজস্র গল্পের বইয়ের পাতা ওল্টানো (যেগুলো পরীক্ষার কারণে পড়া নিষেধ ছিল)। সেবাপ্রকাশণীর নিউজপ্রিন্টে ছাপা বই, জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন, হুমায়ূনের হিমু বা মিসির আলী, সুনীলের কাকাবাবু, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা বা প্রফেসর শঙ্কু কিছুই বাদ যেতনা! আর বিকেলে সোয়েটার পরে গলির মাথায় ব্যডমিন্টন খেলা! আহা!!!… আর পাড়ার পিকনিক?? কী আয়োজন- কী প্রস্তুতি তার !!

আমার ছোটবেলায় আরেকটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল ট্রেন-এ চড়ে আমার মেঝো খালার বাসায় মাইজদি বেড়াতে যাওয়া! কী আনন্দ- কী আনন্দ! উত্তেজনায় যাবার আগেরদিন ঘুমই আসতোনা। ভোরবেলা ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ‘উপকূল’ ট্রেনের সেই জার্নি – ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে কমলার খোসা ছাড়ানোর গন্ধ- জানালার পাশের সিট নিয়ে দুই ভাইবোনের ঝগড়া- মাঝখানে কোন নাম না জানা ষ্টেশনে “চা -গ্রাম চা – গ্রাম” ডাক… এসবই ছিল আমার শীতের অপরিহার্য অনুষঙ্গ !! আমার নিঃসন্তান খালা খালু আমাদের চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজনায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেন! দিঘির পাড়ে ছবির মত একতলা একটা হলুদ রঙের বাড়ির সামনে দু’হাত বাড়িয়ে ছলছল চোখে খালা হাঁটু গেড়ে বসে থাকতেন। তিনি বসে থাকতেন কারণ আমরা এত জোরে ঝাঁপ দিয়ে পড়তাম তার বুকে উনি জানতেন যে দাঁড়িয়ে থাকলে উনি নির্ঘাত পড়ে যাবেন! খালা খালুর ছোট্ট সাজানো সংসার কয়েকদিনের জন্য চূড়ান্ত ছন্নছাড়া দশা হয়ে যেত! এনিয়ে তাদেরকে মোটেও বিচলিত মনে হতনা!! দুই একটা সপ্তাহ কেটে যেত স্বপ্নের মত!!… .. আমি এখনো ঘুমের ঘোরে উপকূল ট্রেনের ‘শোভন’ লেখা একটা কম্পার্টমেন্ট দেখি। যেটা আর কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে যাবে। দেখি কম্পার্টমেন্টে ভেতরে একই রকম ডিজাইনের ফুলহাতা সোয়েটার পরা খুশিতে জ্বলজ্বল করা চোখের দুটি শিশু অনর্গল কথা বলছে।আর দেখি পাশে বসে থাকা তাদের মা কমলার কোয়া খুলে ওদের হাতে দিচ্ছেন আর অবিরল শিশু দুটিকে শাসন করার চেষ্টা করছেন যদিও তার কন্ঠে প্রশ্রয়ের সুর চোখে পরম তৃপ্তির হাসি!!…

অবশ্য শীত মানেই যে সবসময় নিরবচ্ছিন্ন সুখ ছিল তাও কিন্তু না! সাথে কিছু অত্যাচারও ছিল! এই সময়টায় আমাদের ছোটবেলায় শহরজুড়ে নানারকম প্রতিযোগিতা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। আমার উপস্থিতি যেখানে আমার মা শতভাগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করতো!! আমি ছিলাম মায়ের অতি বাধ্য সন্তান তাই মুখ গোমড়া করে হলেও সবখানে যেতাম আর মা যেভাবে যা করতে বলতো তাই করতাম। (এখন কিন্তু গান আর কবিতায় মুখর কুয়াশায় ঢাকা সেই বাংলা একডেমীর মাঠ, শিশু একাডেমী, চারুকলার প্রাঙ্গন- এগুলোই সবচেয়ে মিস করি!!)

গত কয়েকবছর অবশ্য শীত মানে আমার কাছে বিয়ের মৌসুম। কঠিন সাজগোজ করে (আমার ক্ষমতা অনুযায়ী যতটা সম্ভব!) বিয়ের নানারকম আয়োজনে অংশ নেয়া। অফিসে অপেক্ষাকৃত বেশি ফিটফাট হয়ে যাওয়া আর নানা রকম মিউসিকাল ফেস্ট এ রাত ভোর করা!! কিছুটা মেকানিক্যাল হলেও ঢাকার শীতের আবেদন আমার কাছে একটুও কমেনি! বরং যত বড় হয়েছি শীতের ভিন্ন ভিন্ন রূপ আবিষ্কার করেছি।
শীতের সময় শহরটার অদ্ভুত ভাবে পালটে যাওয়া দেখে আমার ভীষণ অবাক লাগে!! যেন দুরন্ত কোন কিশোরী হঠাৎ করে ভীষণ পরিণত হয়ে গেছে। যেন নিজের ঝাঁঝালো সৌন্দর্য একটা শান্ত শুভ্র কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছে…

আচ্ছা এই শীতেও নিশ্চয়ই ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে ধোঁয়া ওঠা চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা দেদারসে বিক্রি হচ্ছে! এবারও নিশ্চিত শীত আসার আগেভাগেই জোর করে শীত শীত ভাব আনতে আলমারিতে নেপথালিন দিয়ে তুলে রাখা হাতাকাটা সোয়েটার কিংবা ক্যাটক্যাটে রঙের মাফলার পরে কেউ কাজে বেরিয়েছে, আর একটু পর পর সবাইকে ” এইবারে যে কী সাংঘাতিক শীতটা পরবে দেখে নিয়েন” বলে নিজের সাজসজ্জাকে জাস্টিফাই করছে!!! বাড়িতে কিংবা অফিসে ফ্যান ছাড়া আর বন্ধ রাখা নিয়ে নিশ্চয়ই যুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছে দুই দলে (হা হা হা)!!

এরইমধ্যে অতি উৎসাহী চাচা মামা বা খালুরা পারিবারিক বনভোজনের প্রস্তুতি শুরুর করে দেয়ার কথা! জানি এবারও উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা শীতের রাতে ছাদের ওপর ইট দিয়ে বানানো চুলায় বার – বি – কিউর নামে মুরগির আধপোড়া ঠ্যাং হাতে নিয়ে সেলফি তুলছে! ফোক ফেস্ট বা ক্লাসিকাল ফেস্টএ দল বেঁধে ব্যপক আয়োজনে গিয়ে গান না শুনে চেক ইন দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে নেটওয়ার্ক খুঁজছে! আমার কিন্তু এসবের কোনটাই খারাপ লাগেনা। এইসব কিছুই আমি খুব আগ্রহ আর মুগ্ধতা নিয়ে দেখি। আমার বরাবর দেশের একটা ব্যপার খুব ভাল লাগে, সেটা হল আমরা অনেক ছোট ছোট বিষয়ে আনন্দ খুঁজে নিতে জানি। প্রকৃতির সাধারণ একটা পরিবর্তন – যা কিনা প্রতি বছর অবশ্যম্ভাবী – তা নিয়েও আমাদের কত্ত আয়োজন!

আমার কেন যেন মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কোন বরফে ঢাকা শহরে সূর্যোদয় দেখার সময়ও শীতের কুয়াশায় মোড়া ইটকাঠের জঞ্জাল ঐ আগোছালো- চালচুলোহীন ঢাকার একটা ভোরের জন্য আমার ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস পরবে। আসলে ঢাকার শীতটাতো আমার কাছে কোন ঋতু না একটা মায়ার নাম!

#পাতা_ঝরার_দিনের_কথা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে