পদ্মফুল পর্ব-০১

0
1728

#পদ্মফুল – সূচনা পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

[১]
আমাদের প্রেমটা শুরু হয় যখন আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি আর সে পড়েন কলেজে। ছোটবেলার প্রেম যাকে বলে। প্রেমটা আমাদের বাঁধিয়ে রাখার ন্যায় ছিল। অতঃপর অনেক কষ্ট করে আমি তাকে আমার স্বামী হিসেবে পেয়েছিলাম। সে কষ্টের কথা ভাবলে আমার চোখ উপচে জল গড়ায়।
শুরু থেকে বলি তাহলে। সেদিন ছিল শনিবার। স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে মহসিন। বারবার ইতি-উতি উঁকিঝুঁকি করছে। যেন কাউকে খুঁজছে সে। সদা জানালার পাশে বসা আমি সেদিনও ক্লাসে জানালার পাশে বসলাম। হয়ত আমি অবচেতন মনে চাচ্ছিলাম সে আমায় খুঁজে বের করুক। ক্লাসে ইতিহাস পড়াচ্ছেন জবরুল স্যার। সেদিকে আমার বিন্দুমাত্র মন নেই। আমার চোখ যে এই ভয়ংকর কিশোর ছেলেটার পানে আটকে। হঠাৎ মহসিনের চোখ আমার দিকে এসে থেমে গেল। হকচকিয়ে গেলাম আমি। লুকিয়ে তাকে দেখেছি, ইশ ভাবতে লজ্জয় মাথা কা’টা যাচ্ছে। আমি চট করে আমার মুখ খাতা দিয়ে আড়াল করে দিলাম। আড়চোখে খাতা সরিয়ে একবার দেখেও নিলাম তাকে। সে আমার দিকে চেয়ে আছে। ঠোঁট টেনে মৃদু হাসছে। লজ্জায় আমি সেই যে খাতা দিয়ে মুখ আড়াল করলাম, আর তাকাবার জো রইল না। সে আমায় দেখে নিয়েছে। ইশ! ধরণী দ্বিধা হও। আমি মাটির ফাঁকে লজ্জিত মুখ নিয়ে ডুবে ম’রি।
ক্লাস শেষ হয়েছে সময় ধরে। সে হয়ত চলে গেছে। আমি খাতা সরালাম। না, সে নেই। ছোট্ট মনটা আমার খচখচ করে উঠল। সে চলে গেছে? আমায় না দেখে? মন খারাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। সদ্য ভালোবাসার নদীতে পা ভেজানো আমি এই মন খারাপের ধকল সহ্য করতে পারলাম না। চোখের কোণ ছলছল করে উঠল।
ঝটপট তাড়া দেখিয়ে খাতাপত্র ব্যাগে পুড়ে দৌঁড়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। গেইটের ফাঁক দিয়ে তাকে অহর্নিশ খুঁজে চললাম। না, সে সত্যি নেই।
দারোয়ান কাকা হঠাৎ ডাকলেন আমায়। চুলে বেনুনি হেলিয়ে দুলিয়ে আমি এগুলাম তার দিকে। দারোয়ান কাকা বললেন,
‘ মৌরি, তোমার চাচাতো ভাই এসেছিল তোমার খুঁজে। ‘
‘ কে এসেছিল? ‘
আমার বিস্ময় প্রশ্ন। দারোয়ান কাকা আবার বললেন,
‘ ওই যে চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে, মহসিন। বলল তোমার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। ‘
আমি শিউরে উঠলাম। অস্থির চিত্তে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কেন এসেছেন? ‘
‘ আমাকে জিজ্ঞেস করল তোমার ছুটি কয়টায়? আমি বললাম দুইটায়। সে শুনে চুপচাপ চলে গেল। ‘
‘ আর কিছু বলেছেন?
‘ না, আর কিছু বলেনি। ‘
আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। বললাম,
‘ আচ্ছা, কাকা। আমি বাড়ি যাচ্ছি। ‘
গেইট ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমি। বেহায়া চোখ ছুঁতে চাচ্ছে তাকে। অবলোকন করতে চাইছে তার চোখের ভেতর। আমি ব্যাগ খা’মচে ধরে বাড়ির পথে পা চালিয়ে গেলাম। তীক্ষ্ম চোখে তাকে খুঁজে চলার পরও যখন তাকে পেলাম না, আমার ছোট্ট মনটা ভেঙে খানখান হয়ে পড়ল। এই কেঁদে ফেলব যেন। ভালোবাসার য’ন্ত্রণা যে আমায় সঙ্গে করে বহুদূর নিয়ে যাবে, সেদিন তা বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে ভয়ে সেই পথে হয়ত কখনো পা বাড়াতাম না।
আমাদের বাড়ি যাবার পথে চেয়ারম্যান বাড়ির পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে এক ভাইয়ের বিশাল মুদি দোকান চোখে পড়ে। সেই দোকানে সদা সে এবং তার বন্ধু বান্ধব বসে থাকে। দোকানের এটা সেটা খায়। আমি সে পথ দিয়ে চললে চেয়ে থাকে আমার পানে। প্রথম প্রথম ভয়ে পা আটকে যেত আমার। আঁ’তকে উঠত গায়ের পশম। তবে এখন কেন যেন তা আর হয় না। তাকে দেখলে আগে যেমন ভ’য়ে শিউরে উঠতাম, এখন তেমনই লজ্জায় কেঁপে উঠি। সময় বদলেছে। আমার কেঁপে উঠার ধরন বদলেছে। আগে কাঁপতাম ভয়ে আর এখন লজ্জায়।

আমি চমকালাম। এই তো দোকানে এসে বসে আছে। বন্ধুদের সাথে প্রাণখুলে হাসছে। কলেজে যায় না নাকি? প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে এখানে থম করে বসে থাকে। আমি এদিক দিয়ে গেলে আমাকে দেখে। এ কেমন অত্যাচার!
আমি ব্যাগ খা’মচে ধরে পা চালালাম। ততক্ষণে যা অঘটন ঘটার ঘটে গেছে। সে পথ আটকে দাঁড়িয়েছে আমার। আমি এবার ভয়ংকর কাঁপতে লাগলাম। পূর্বে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। কোনো ছেলে আমাকে এমন তীব্রভাবে আমার মন ছুঁতে পারেনি। সেই প্রথম সাহস করেছে। সে আমাকে দেখে মৃদু হাসল। বলল,
‘ বাড়ি যাচ্ছো? ‘
আমি মৃদু মাথা দুলালাম। সে বলল,
‘ একটা চিঠি আছে। দিলে নিবে? ‘
কেন যেন মানা করতে পারলাম না। ছোট্ট কণ্ঠে বললাম,
‘ হু। ‘
সে হাসল। আমার মন সে হাসিতে জ’খম হয়ে গেল। চেয়ারম্যান বাড়ির সকল ছেলেরা সুন্দর। একবার তাদের বাড়িতে লুকিয়ে গিয়েছিলাম আমি। তার মা’কে দেখলাম। তিনি জোহরের নামাজ পড়ছেন। সে কি সুন্দর দেখতে। আমি আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। বয়স হয়েছে ত্রিশোর্ধ্ব। অথচ এখনো যেন যৌবনা, রূপবতী! তিনি সালাম ফিরিয়ে আমাকে দেখার আগেই চলে এসেছিলাম আমি।
সেও সুন্দর। আর ভীষন লম্বা। তাকে দেখার জন্যে আমাকে মাথা উঁচু করতে হয়। কলেজে পড়ে অথচ এই বয়সেও কেমন নজরকাড়া। স্টাইল করে সবসময় পার্টসার্ট করে থাকে।
আমি আড়চোখে তার দিকে চাইলাম। সে পকেট থেকে একটা চিঠি আমার দিকে এগিয়ে দিল। বলল,
‘ বাড়ি গিয়ে পড়বে, কেমন? যদি রাজি থাকো আমার নাম্বার দেওয়া আছে। ফোন করবে। আমি আজ সারারাত অপেক্ষা করব তোমার ফোনের জন্যে। ‘
নাম্বার দিয়েছে? হায় হায়! এতদূর এগিয়ে গিয়েছে সে? আমি হাত বাড়াতে চাইলাম। কিন্তু আমার হাত অত্যধিক কাপছে। হয়ত ভয়ে। তাকে ভয় পাচ্ছি আমি। এ কেমন মনের খেলা। একবার ভয় একবার লজ্জা। বিধাতা রক্ষা করো।
সে আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে নিজেই ব্যাগে চিঠিটা পুড়ে দিল। আমি আর একমুহূর্তে সেখানে দাঁড়ালাম না। দৌঁড়ে পালিয়ে এলাম। আসার পথে শুনতে পেলাম তার প্রাণ জ’খম করা সেই সুন্দর হাসি। ইশ, আমার দিল এত কাঁপছে কেন?
___________________________
রাতে সবার খাবার খাওয়া শেষ হলে আমি রান্নাঘর গুছিয়ে আমার রুমে এলাম। আমার ছোট বোন উর্মি ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। ঘুমে কাহিল। আমি বাতি নেভালাম। বাড়ির বাইরে আলো জ্বালানো। আমি জানালার কাছে বসে চিঠি খুললাম। তার লেখা! তার হাতের লেখা। ইশ, আমার কেমন যেন পেটে মো’চড় দিচ্ছে। আমি চিঠি পড়লাম। লেখা ছিল,
‘ মৌরি, তোমাকে আমি পছন্দ করি। স্কুলে যাওয়ার পথে তোমাকে দেখার জন্যে আমি দোকানের সামনে বসে থাকতাম। তুমি কি আমায় পছন্দ করো? আমাকে জানাবে। আমি বড্ড চিন্তায় আছি। যদি পছন্দ করে থাকো তাহলে নিচের নাম্বারে কল করবে। এটা আমার নাম্বার। আমি লুকিয়ে সিম আর ফোন কিনেছি।
নাম্বার… ০১৭********’ ‘
চিঠির লেখা এটুকুই। তবুও কি প্রেম প্রেম গন্ধ চিঠিতে। আমি চিঠিটা নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকলাম। আমার বোধ হল আমি হারিয়ে যাচ্ছি। তার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি যেন চিঠিতে। আমি কি করব? ভাই জানলে মে’রে ফেলবে আমাকে। প্রেম আর ছেলে ভাই দু চোখে দেখতে পারে না। বাড়ির বড় মেয়ে প্রেম করছে শুনলে ভাই পি’টিয়ে ফ্যা’নাফ্যা’না করে ফেলবে। কি করব? তাকে কি কল করব? আমি পড়ে গেলাম মহা চিন্তায়। চিন্তায় চিন্তায় সে রাত আর ঘুম হল না। সারারাত একবারও ফোন করলাম না তাকে। সে অপেক্ষা করছে, ভাবলে খারাপ লাগছে। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে তাকে ফোন করলে আরো কষ্ট দেয়া হবে তাকে। ফজরের আযানের একটু আগে আমার কি যে হল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, না আমি তাকে ফোন করব। যা হওয়ার হয়ে যাক। কপালে থাকলে মাই’র খাব। কি হবে? একটু মাই’র খেলে কিছু হয় না। সহ্য হয়ে যাবে।
এবার আরেক সমস্যা শুরু হল। এখন আমি ফোন কোথায় পাব? আমার কাছে ফোন নেই। বাড়িতে একমাত্র আব্বার কাছে ফোন আছে। আমি পা টিপেটিপে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আব্বার রুমে এসে দেখলাম তিনি ঘুমাচ্ছেন। তার বালিশের পাশে ফোন রাখা। আমি আস্তে করে ফোন হাতে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলাম সে রুম থেকে। নিজের রুমে এসে উর্মিকে দেখলাম। না, ও ঘুমাচ্ছে। এখন শত ডাকলেও উঠবে বলে মনে হচ্ছে না।
আমি তার নাম্বার মুখস্ত করলাম। নিমিষেই তার নাম্বার মুখস্ত করে ফেললাম আমি। ঠোঁট কা’মড়ে কিছুক্ষণ বড়বড় নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর তাকে কল করলাম আমি। আমার মনে হচ্ছে, আমি এখনি উত্তেজনায় জ্ঞান হারাব। তার সাথে প্রথম কথা! কেমন হবে ভাবলে আমার শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে