নিয়তি (পর্ব-৬)

0
1208

নিয়তি (পর্ব-৬)

নাজিফার চিৎকার শুনে ইমাদ দরজা খুলতেই দেখে নাজিফা নিচে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, নাজিফার এই অবস্থা দেখে ইমাদের মিতুর মৃত্যু টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, মনে ভিতর ভয়েরা বাসা বাধতে লাগলো। ভাবতে লাগলো — এই মেয়েটি ও যদি মিতুর মতো মরে যায়!!”!
এদিকে নাজিফার চিৎকারের আওয়াজ শুনে সালেহা, নিতু ইমাদের ঘরের সামনে এসে দেখে নাজিফা মেঝেতে পড়ে রয়েছে।
ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
সালেহা বিস্মিত হয়ে, ইমাদকে জিজ্ঞাসা করলো—- কী হয়েছে ওর???
ইমাদ কোনো কথাই বললো না, ইমাদ নাজিফার হাতটাকে শক্ত ধরে বললো — এই যে শুনছেন? এই যে আপনাকে বলছি।
নাজিফার কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় ইমাদ ওকে কোলে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসে। অতঃপর বিছানার উপর শুইয়ে দেয়। নিতু তো নাজিফার এই অবস্থা দেখে ভয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সালেহা নাজিফার মাথার পাশে বসে কাঁদতে থাকে। এদিকে নওরীনের কানে নাজিফার চিৎকার যেতেই নওরীন ভয়ে কাঁপতে থাকে আর বলে— স্যরি আমি তোমাকে ব্যাথা দিতে চায়নি। নাবা পাশে কাঁদতে — কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে।
ইমাদ যেহুতো পেশায় একজন ডাক্তার তাই সে নিজেই নাজিফার ট্রিটমেন্ট করতে শুরু করলো। ডয়ার থেকে ফাস্টএইড বক্স টা বের করে তুলো দিয়ে নাজিফার কপালের রক্তগুলো মুছতে লাগলো, তারপর ব্যান্ডেজ করে দিলো। কাগজে কিছু ঔষধের নাম লিখে সালেহাকে দিয়ে বললো— মা তুমি এটা গিয়ে কদমকে দেও, ও যেনো এই ঔষধগুলো নিয়ে আসে।
সালেহ তখন ইমাদকে বললো — ও ঠিক হয়ে যাবে তো বাবা???
ইমাদ বলতে লাগলো —- আমি ওর কিছু হতে দিবেনা মা, আমি আর কোনো লাশ দেখতে পারবোনা।
সালেহা অদ্ভুত ভাবে ছেলের দিকে চেয়ে রইলো। আমার ছেলের এই নরম হৃদয়টা এতোদিন কোথায় ছিলো, নিজেকে পাষাণ পরিচয় দিয়ে, সোডিয়ামের আলোয় একা- একাই নিজের কষ্ট গুলোর সাথে নিজে বন্ধুত্ব করেছে, অথচ আমি মা হয়ে একবার ও বুঝতে পারলাম না।
— কী হলো মা, দাড়িয়ে আছো কেন?
যাও।
— হ্যা বাবা যাচ্ছি।


সালেহা চলে যাওয়ার পর ইমাদের চোখে জল টপটপ করতে লাগলো। কেন জানী বারবার মিতুর কথা মনে পড়ছে। এখন ও মনে আছে, এই ঘরের সামনে মিতু ও এভাবে পিছল খেয়ে পড়ে যায়।
রক্তাক্ত অবস্থায় ওকে নিয়ে আমি পাগলের মতো হসপিটালে যাই,
ডাক্তার ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার কিছুসময় পর আমাকে বললো— হয় মাকে বাঁচাতে পারবো, নয় বাচ্চাকে।
-কথাটি শুনার সাথে– সাথে, আমি কোনো কিছু না ভেবেই কোনো সংকোচ ছাড়াই বলে দেই — আমার বাচ্চাকে লাগবেনা ডাক্তার, আপনি প্লিজ আমার স্ত্রী কে বাঁচান।।
ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা


কিন্তু মিতু আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য ডাক্তারকে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়— ওর যা কিছু হোক কিন্তু এই বাচ্চার যেনো কোনো কিছু না হয়।
ডাক্তার বুঝে উঠতে পারলোনা সে কী করবে, কিন্তু ডাক্তার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে মিতুকে বাঁচাতে, কিন্তু ভাগ্যের লিখন কী আর বদলানো যায়, চলে গেলো সে আমাকে ছেড়ে এই বর্ষার এমন একটি দিনে।
এই ভেবে ইমাদ কষ্টে হাতের পাশের লাম্পট্য নিজের হাত দিয়ে জোরে বাড়ি দিতেই তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়,হাতটা কেটে রক্ত পড়তে থাকে,
কিন্তু ছেলেটি একটু বুঝতে পারলোনা সে একটি আঘাত পেয়েছে। কেননা মিতু চলে যাওয়ার আঘাতের কাছে এই আঘাত কিছুই না।ইমাদ অন্ধকারে নিচের দিকে মাথা নিচু করে নাজিফার পাশে বসে থাকে।

ঘন্টাখানিক পর নাজিফার জ্ঞান ফিরে , হালকা- হালকা চোখ খুলতেই দেখে ইমাদ পাশে বসে রয়েছে। বাহিরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, ঝিরঝির বাতাস বয়ে চলছে, পোকামাকড় অজানা শব্দ, বুনো মশকের গান,
আর ঘরে হালকা নিয়ন আলোয় নাজিফা দেখছে ইমাদের চোখের কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে, ওর রক্তাক্ত হাতটা,নাজিফার হাতের পাশে,
নাজিফা তা দেখে নিজের হাতটাকে ওর হাতের উপর রাখতেই ইমাদ মাথা উঁচু করে নাজিফার দিকে তাকিয়ে দেখে ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। মেয়েটি অসহায়ভাবে ইমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে, ইমাদ তখন চোখের জল গুলোকে মুছে নাজিফাকে বলে —– এতো বড় হয়েছেন অথচ এখন ও ঠিক হাঁটতে পারেনন না? পড়ছেন তো পড়েছেন আমার ঘরের সামনে এসে পড়তে হলো???আমার জীবনটা আর কত শেষ করবেন? আপনি ও কী আমাকে শান্তি দিবেন না?ছোটবেলায় বাবা- মা ভালো করে হাঁটতে শিখায় নি।
আপনারা মেয়ে মানুষের এই একটা সমস্যা, যখন- তখন পড়ে যান।
নাজিফা তখন ক্ষীণ কন্ঠে ইমাদকে বলে — কী করবো বলুন, মেয়ে মানুষ মানেই তো বিয়ে অবদি বাবা মানুষটা শক্ত করে হাতটা ধরে রাখা, বিয়ের পর প্রিয়মানুষটা শক্ত করে হাতটা ধরে রাখা। তাই তারা একা হাঁটতে গেলে হোচট খাবেই। আমার কপাল খারাপ তাই প্রিয় কোনো মানুষ নেই যে হোচট খেলে হাতটা শক্ত ধরবে।
নাজিফার কথায় ইমাদ আমতাআমতা করে বললো — কিছু পারেন না পারেন, বেশ কথা বলতে পারেন। আপনার যদি এখন কিছু একটা হয়ে যেতে?
— তাতে আপনার কী?
— আ,আমার আবার কী, একজন মানুষ হিসেবে ও তো কষ্ট লাগতো।



এমন সময় সালেহা ঘরে ঢুকে পড়লো ঔষুধ নিয়ে, ঘর অন্ধকার দেখে সালেহা বলতে লাগলো — কীরে ইমাদ এমন ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?????
এই বলে ঘরে আলো জ্বালাতেই ওনার চোখ পড়ে ইমাদের রক্তাক্ত হাতের দিকে। সালেহা তখন চিৎকার দিয়ে বলে — ওমা তোর হাতের এই অবস্থা কেন???
নাজিফা তখন ইমাদের হাতের দিকে চেয়ে এমন অবস্থা দেখে উঠে বসতে চাইলে — ইমাদ বলে — চুপ করে শুয়ে থাকুন একদম উঠার চেষ্টা করবেন না।
ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
— কিন্তু আপনার হাতের এই অবস্থা কীভাবে???
—- সেটার কৈফিয়ত কী আপনাকে দিতে হবে???
সালেহা তখন বললো — কিন্তু আমাকে তো দিতে হবে।
এই অবস্থা কেন করলি???
— মা তুমি কী এখন এসব জানবে নাকি আমার হাতটাকে ব্যান্ডেজ করবে???
— হ্যা তো নিজে কেটে এখন আমাকে ব্যান্ডেজ করতে বলছে।
এই বলে সালেহা কাঁদতে — কাঁদতে ওর হাতটা ব্যান্ডেজ করলো। এই মা দের এই একটা সমস্যা সন্তানের সামান্যা কিছু হলেই শুধু কান্নাকাটি।
— আচ্ছা মা আমার কী এমন হয়েছে যে তুমি এতো কান্নাকাটি করছো???
— চুপ কর একদম কথা বলবিনা।
এই নে ঔষধ গুলো। একটা পিছল খেয়ে পড়ে আছে, আরেকটা হাত কেটে কাহিনী শুরু করছে , পাগল হয়ে গেছিস তোরা দুজন, আমায় না কাঁদিয়ে ছাড়বিনা।
এই বলে সালেহা চলে গেলো।



সালেহা চলে যেতেই ইমাদ নাজিফাকে বললো — এই সব কিছুর জন্য আপনি দায়ী?
—- যাক বাবা আমি আবার কী করলাম??
— আপনাকে কেউ বলেছে আমার ঘরের সামনে এসে পড়তে??
— আমি কী আর ইচ্ছে করে পড়েছি???
ইমাদ তখন নাজিফাকে ধমক দিয়ে বললো — চুপ থাকুন, আমি একজন ডাক্তার অতএব আমি যা বলবো আপনাকে চুপচাপ শুনতে হবে, একটা কথা ও মাটিতে পড়তে দেয়না।
—- আচ্ছা মাটিতে কথা আবার পড়ে কী করে????
—- আবার!!!
—- ওকে আর কথা বলবোনা, এই হলাম চুপ।
হ্যা চুপ করে থাকুন। মা তো রাগ করেছে এখন আর এই ঘরের সামনে ও আসবেনা। তাই আমাকেই আপনার জন্য খাবার আনতে নিচে যেতে হবে, যতসব।
—–Excuse me,একটা কথা ছিলো।
— আবার, আপনার কানে কী কথা যায়না।
— এই কথাটা বলার পর আমি আর কথা বলবো না।
— সত্যি।
— হুম।
— বলুন, তাহলে শুনি।
— আসলে আমি এখন কেন খাবার খাবো?
— কারন আপনাকে ঔষধ খাওয়ানো হবে তাই।আর কিছু?
— না।
— তাহলে চুপচাপ থাকুন, আর যদি কথা বলেছেন কিংবা মুখ খুলছেন তো……
এনিওয়ে আমি নিচ থেকে আসছি।


কিছুক্ষণ পর ইমাদ খাবার নিয়ে উপরে এসে নাজিফার পাশে বসতে গিয়ে নাজিফাকে বলতে লাগলো—- আচ্ছা আমার ঘরের সামনে তেল, কলার খোসা এগুলো আবার আসলো কোথা থেকে? সাথে পায়েস, পানির গ্লাস, বাটি পড়ে আছে সে তো বুঝলাম আপনি এনেছেন, কিন্তু কলা না কলার খোসাতো আপনি আনেন নি সেটা কোথা থেকে আসলো? আমি ও তো এখন পিছল খেয়ে পড়তে গিয়েছিলাম, পরে বুয়াকে বলে আসলাম এগুলো পরিষ্কার করতে।
এই বলে ইমাদ চুপ হয়ে গেলে, একটু রেগে নাজিফার কাছে গিয়ে বলতে লাগলো — আপনি কী আমাকে পাগল ভেবেছেন?
নাজিফা মাথা নেড়ে বললো — না।
— আজিব তো আপনি! এই আপনি কী বোবা।
— হ্যা ( মাথা নেড়ে)
— মানি! এইতো দিব্যি কথা বলছিলেন, আর এখন বোবা হয়ে গেলেন।
নাজিফা তখন ইমাদকে ইশারা দিয়ে বললো — আপনি তো আমাকে চুপ থাকতে বলেছেন?
ইমাদ তখন নাজিফার দিকে দুহাত তুলে বলতে লাগলো আমার ভুল হয়ে গেছে, দয়া করে আমায় মাফ করুন আর এই খাবার আর ঔষধ খেয়ে আমায় উদ্ধার করুন।
( চলবে)
লিখা — আসমা আক্তার পিংকি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে