নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-১৫

0
260

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কী ব্যাপার তুরাগ? তুই এভাবে আমাকে ডাকলি কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

তুরাগ কপালে হাত ঠেকিয়ে শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“তোর প্রথম স্ত্রীর নাম কি মুমতাহিনা ইসলাম সিরাত?”

মাহতাব সাতপাঁচ না ভেবে উত্তর দেয়,

“হ্যা, কেন কী হয়েছে?”

তুরাগ এক দৃষ্টে মাহতাবের দিয়ে চেয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর পুনরায় প্রশ্ন করে,

“সিরাত থাকতে তুই দ্বিতীয় বিয়ে কীভাবে করলি? ওই মেয়ে এখনো তোকে বাঁচিয়ে রেখেছে?”

“এসব কী বলছিস তুই? বাঁচিয়ে রাখবে না কেন? আর এক মিনিট, তুই কি কোনোভাবে সিরাতকে চিনিস?”

“শুধু সিরাতকে নয়, ওর পুরো বন্ধুমহলকে চিনি। খুব ভালো করেই চিনি।”

“কীভাবে চিনিস?”

তুরাগ কোনো উত্তর দেয় না। তার চোখমুখ অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে। মাহতাব বন্ধুর এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে,

“এই কী হয়েছে তোর? পুরো বিষয়টা পরিষ্কার করে বল তো আমাকে।”

লম্বা শ্বাস নিয়ে তুরাগ বলে,

“তখন আমি অনার্স শেষ করে সবেমাত্র চাকরি করা শুরু করেছি। ভালো পড়াশোনার জন্য সবার পছন্দের ছিলাম। অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে আমি মাওয়ার প্রেমে পড়ি। ওর পুরো নাম তাসফিয়া তাবাসসুম মাওয়া। আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতাম। সেখানে মাওয়া কোচিং করত। পরিচয়ের সূচনা সেখান থেকেই হয়েছিল। ওর চঞ্চল স্বভাব, কথা বলার ধরণ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছি। এক সময় অনেক সাহস করে ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিই। প্রথমে মাওয়া রাজি হয়নি। প্রায় মাস তিনেক পর আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল মাওয়া। সেই থেকে প্রেমের শুরু। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল। প্রায় সাত মাস ভালোভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর!”

থেমে যায় তুরাগ। মাহতাব কৌতুহলী কণ্ঠে বলে,

“তারপর?”

“সাত মাস পর থেকে আমার আর ওকে ভালো লাগত না। আমি ওর সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে আরেকজন মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ি। ওই মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক অবধি তৈরি হয়েছিল আমার। এসবের কিছুই মাওয়া জানত না। বেশ কিছুদিন আমি দুইটা সম্পর্ক সমানতালে চালিয়ে যাই। কিন্তু এসব বিষয় বেশিদিন গোপন থাকেনি। একদিন উর্মি আমাদের একসাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে মাওয়া এবং ওর বন্ধুমহলের সবার কাছে এই খবর পৌঁছে যায়।”

“ভাই তুই মেয়েটাকে ঠকালি কেন?”

“বললাম না? মাওয়ার প্রতি আর কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না আমার।”

“আচ্ছা তারপর কী হলো?”

“আমার এখনো মনে আছে দিনটা ছিল বুধবার। সন্ধ্যাবেলা আমি আমাদের আড্ডার জায়গায় বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কোথা থেকে যেন সিরাত এসে কোনোকিছু না বলেই আমাকে একের পর এক থা*প্পর দিতে শুরু করে। থা*প্পড়ের জোর এত বেশি ছিল যে আমার ঠোঁট কেটে র*ক্ত বের হচ্ছিল। আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সিরাতকে থামিয়ে প্রশ্ন করি, আমাকে এভাবে আঘাত করার কারণ কী? তখন পাশ থেকে মাওয়া উত্তর দেয়, আমাকে ঠকানোর কি খুব দরকার ছিল তুরাগ? মাওয়ার কথা শুনে আমি ঘাবড়ে যাই। বুঝে গিয়েছিলাম মাওয়া সব জেনে গিয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। চারপাশে প্রচুর মানুষ জমে যায়। আমি সেদিন সিরাতের হিং*স্র রূপ দেখেছিলাম। দেখেছিলাম বন্ধুমহলের এক অন্য রূপ। জানিস? আমি আজও সেই দিনটা ভুলতে পারিনি। আমার সাথে সেদিন যা হয়েছে তার জন্য আজও ভুগছি আমি। আমার পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গিয়েছে ওদের জন্য।”

“কী হয়েছিল সেদিন? আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বল।”

“ওই ঘটনার সবটুকু এখনো ভিডিয়ো আকারে আমার কাছে আছে। ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল তখন প্রচুর বাজেভাবে। দেখবি তুই?”

মাহতাব কোনোকিছু না ভেবেই উত্তর দেয়,

“হ্যা দেখব আমি।”

“তাহলে আমার বাড়িতে চল।”

“আচ্ছা।”

তুরাগ মাহতাবকে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অন্যদিকে সিরাত এসেছে মাওয়ার সাথে দেখা করতে।

“মাওয়া চুপ করে থাকবি না। সেদিনের পর কী হয়েছিল? বল আমায়।”

মাওয়া নাক টেনে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে,

“তুরাগের সাথে ঝামেলার পর বাবা আমার বিয়ে দিতে চায়। পাত্র ঠিক হয়ে গিয়েছিল সেটা তোরা জানিস। বিয়ের জন্য কুষ্টিয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই আমরা। বাবা খুব কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল যেন তোদের সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ না রাখি আমি। বাধ্য হয়ে কাউকে কিচ্ছু জানাতে পারিনি। কিন্তু বিয়েটা আমি মন থেকে মানতে পারছিলাম না। বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়ে, অনুরোধ করে আমি বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য রাজি করাই। সেখানেও তারা শর্ত দেয়, ভালোভাবে পড়াশোনা করে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলে আমাকে আর মেয়ে হিসেবে মানবে না। এমনিতেই আমার জন্য তাদের অনেক সম্মানহানি হয়েছে। আমি সব মেনে নিয়ে চলে যাই বাংলাদেশ ছেড়ে। এরপর টানা পাঁচ বছর বলা যায় বন্দী জীবন কাটিয়েছি আমি।”

কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই মাওয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে আর পারছে না কষ্টগুলো নিজের মধ্যে চেপে রাখতে। দীর্ঘ পাঁচটি বছর নিজের সাথে লড়াই করে আজ সে ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত!

মাওয়াকে জড়িয়ে ধরে সিরাত বলে,

“আঙ্কেলকে হাজার বার বুঝিয়েও আমি তোর আর অভির সম্পর্কের কথা আগাতে পারিনি। আমি চেয়েছিলাম আঙ্কেলকে আগে রাজি করাতে। তারপর তোকে বলতে চেয়েছিলাম, অভি তোকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আমি এসব কিছুই করতে পারিনি। তারপর আমি নিরুপায় হয়ে অভিকে বোঝাই, তোকে যেন ভুলে যায়। তোদের সম্পর্ক হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলস্বরূপ অভি ভেবে নেয় আমি হয়তো নিজেই চাইনি, তোদের মাঝে সম্পর্ক হোক। এভাবে দিনের পর দিন ভুল বুঝে অভি দূরে সরে গেল আমার থেকে। আর এরপরের গল্পটা তোদের সবারই জানা।”

“আমার জীবন তো নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তুই হটকারিতায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি যার জন্য নিজের সাথে সাথে তোর মেয়ের জীবনও এখন ঝুঁকির মুখে।”

“আমি মা হয়ে কখনোই চাইব না যে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক!”

“আচ্ছা সিরাত তোর মাহতাবকে বিয়ে করার কারণ কী ছিল?”

“আমি পরিবারের পছন্দে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। মাহতাবের বাবা আমাকে আগে থেকেই চিনত। সেই সুবাদে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমার পরিবারের সবাই রাজি হয়ে যায়। আর আমারও মাহতাবের সাথে কথা বলে ওকে ভালো লেগে যায়। তাই এত না ভেবে বিয়েটা করে ফেলি।”

“এখন কী করতে চাইছিস তুই?”

“আমার কথা বাদ দে। তুই বল এভাবে আর কতদিন চলবে? জীবনটা কি এভাবেই কাটিয়ে দিবি? বিয়ের কথা ভাববি না?”

মাওয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“আর বিয়ে!”

“অভিকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না মাওয়া?”

মাওয়া সিরাতের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে। অতঃপর কিছু না বলে সিরাতের কাছ থেকে উঠে চলে যায়। সিরাত বসে থেকে এক নজরে মাওয়ার চলে যাওয়া দেখে। কিন্তু হাজার চেয়েও আটকাতে পারে না তার চলে যাওয়াকে।

“আমরা প্রত্যেকে আমাদের জীবনে এমন অনেক ভুল করি যার খেসারত জীবনের শেষ সময় অবধি দিতে হয়। জীবনের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত যদি ভেবেচিন্তে তারপর নিতাম তাহলে হয়তো বর্তমানে এসে অতীতের জন্য আমাদের আফসোস করতে হতো না। আমরা পেতাম একটা সুন্দর জীবন। আমরা পেতাম একটা সুন্দর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ!”

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে