নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২৯

0
100

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ঊনত্রিশ

রাত তখন বারোটা পয়তাল্লিশ মিনিট, মাসুদা দরজা খুলে বের হলো। সারা বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঘেরা, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সদর দরজার কাছে আসলো। পিছনে ফিরে সোফায় শুয়ে থাকা আকলিমাকে শেষবারের মতো দেখে বলল,” ঘুমাও আকলিমা! আজকের পর থেকে তোমার জেগে থাকার দিন শুরু হবে।”
পরদিন সকালবেলা বাশারের বাড়ির সামনে পুনরায় পুলিশ এসে উপস্থিত হলো। এবার বাশারের কোমরে দড়ি বেঁধে সকলের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আকলিমা বাকরূদ্ধ! যখন থেকে এসপির কাছে ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার কারণ শুনতে পেরেছে তখন থেকেই সটান হয়ে বসে আছে। এদিকে বাশার পুলিশদের হাতে পায়ে ধরে আকুতি মিনতি করছে তার দোষটা জানতে চাইছে কিন্তু কেউ তাকে কিছুই বলছে না। অবশেষে বাশারকে গাড়িতে উঠানো হলো। গাড়ি চলছে আপন গতিতে, বাশার ছটফট করছে, সে জানতে চাইছে তার দোষটা কোথায়? শেষে একজন অফিসার মুখ খুলল,” তোর বউ তোর নামে মামলা করছে, নারী নির্যাতন মামলা। একেবারে প্রমাণ সহ থানায় হাজির হইছে।”
বাশার মাথায় হাত রেখে অবাকের সুরে বলল,” মাসুদা!”

গতকাল রাতে মাসুদার করা ভিডিওর কথাও অফিসার বলল। বাশারের ভীষণ আফসোস হলো! এই মুহূর্তে হাতে কানা কড়ি ও নেই। মাসুদার সেই এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক পরিশোধ করেছিল কাঁকন নামক মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করে। টাকা পরিশোধ করে বাশার মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলো। কাঁকনের সাথে অনলাইনে বাশারের সম্পর্ক হয়েছিল, বোকা মেয়েটার থেকে বাশার প্রেমের ফাঁদে ফেলে ন্যুড ছবি ভিডিও সংগ্রহ করেছিল।সেই ভিডিওই বশারের কাজে লেগে গেলো, বাশারও বিপদমুক্ত হয়েছিল। কিন্তু আজ সে কী করবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে। বাশারকে থানায় নেয়া হলো। পরদিন সকালে গাজীপুর থেকে কাশিমপুর জেলে চালান করে দেয়া হলো।

বিকালে বাশারকে দেখতে মাসুদা এলো। বাশারের মর্মান্তিক অবস্থা দেখে মুখে তার ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো। বাশারের বিরুদ্ধে পাকাপোক্ত প্রমাণ আছে, সে চাইলেও নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। অনুমতি নিয়ে বাশারের সাথে দেখা করতে মাসুদা এলো। তাকে দেখে বাশার ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,” কতোদিন আমাকে আটকে রাখবি। একদিন তো ছাড়া পাবো! সেদিন তোর এমন অবস্থা করব যে, তুই নিজে নিজের মৃত্যু কামনা করবি।”

মাসুদা হাসলো, হাসতে হাসতে মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে কাঠিন্যরূপ প্রকাশ পেলো, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” কখনো শুনেছিস, ধর্ষণের শাস্তি মুক্তি মিলতে? অবশ্য বর্তমানে আমাদের দেশে হাজার হাজার ধ’র্ষ’ক খোলা পথে ঘুরছে। মনে করিস না, তুইও এভাবে ঘুরবি। আমি বেঁচে থাকতে ধ’র্ষ’কে’র শা’স্তি তোকে দিয়ই ছাড়বো।”

মাসুদার কথায় বাশার ভয় পেয়ে গেলো। ভয় তারাই পায় যারা অন্যায় করে! বাশারও কী তবে ধর্ষক কিন্তু কার? তরতর করে বাশার ঘামছে। শরীর একদম জবুথবু অবস্থা! কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো বাশার,” তুমি কে?”

মাসুদার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্যের আভাস পাওয়া গেলো,” হালিমার কথা মনে আছে? ইন্জিনিয়ারিং পড়ার সময় যাকে সরল পেলে দিনের পর দিন ব্যবহার করেছিস?”

বাশার শুঁকনো ঢোক গিলে নিলো। হালিমাকে সে কীভাবে ভুলবে? তার জীবনের প্রথম মেয়ে ছিলো হালিমা! যার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে বাশারের ছোঁয়া ছিলো। সমাজের ভাষ্যমতে বাশার প্রতিনিয়ত মেয়েটিকে ধ’র্ষ’ণ করতো। একজন মেয়ের কাছে তার সম্মানের থেকে মূল্যবান সম্পদ আর কিছুই নেই। মেয়ে যতোই সরল সোজা হোক না কেনো একদিন ঠিকই ছেলেকে উচিত জবাব দিবে! একজন মেয়ে তো আর এতো সহজে কোনো ছেলের কাছে ধরা দিবে না! হালিমা বাশারকে পাগলের মতো ভালোবাসতো কিন্তু বাশার! হালিমার দেহকে। ফলস্বরূপ হালিমাকে ভালবাসার দোহাই দিয়ে ব্যবহার করতো। একটা সময় হালিমা নাকচ করলো কিন্তু বাশার তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলো। হালিমার ভিডিও জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিবে বলে ভয় দেখাতো। হালিমা তার পায়ে পড়ে কতো কাঁদত! অনুনয় বিনয় করতো কিন্তু বাশার তা কানে নিতো না সে তার পাপকর্মে মনোযোগী থাকতো। একটা সময় হালিমা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো। ঠিকমতো ক্লাসে উপস্থিত হতো না, বাহিরেও বের হতো না। একদিন খবর এলো হালিমার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে। সেখানে স্পট ডেথ। বাশার খুব আফসোস করেছিল, মরে যাওয়ার জন্য নয় বরঞ্চ তার দেহ পিয়াসা মেটানোর মানুষ চলে গেলো বলে। হালিমার কথা ভাবতে ভাবতে বাশার মাসুদার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,” তুমি?”
” আমি হালিমার ছোট বোন। তোকে আমার ফাঁদে ফেলতে কী-ই না করেছি। নিজের চাচাদের ব্যবহার করে আমার রূপের জালে ফাঁসিয়েছি। তোর থেকে প্রমাণ উদ্ধার করার জন্য তোর বউ হয়েছি, মা’র খেয়েছি।”

” আমি কাউকে চিনি না, কোনো প্রমাণ নেই তোর কাছে তুই আমার কিছু করতে পারবি না।”

বাশারের কথায় মাসুদা বাঁকা হাসলো। ব্যঙ্গ স্বরে বলল,” প্রমাণ তো আমি নিজেই, আর কী চাস? আপার মৃত্যু এক্সিডেন্ট ছিলো না, পরিকল্পনা মোতাবেক মা’র্ডা’র ছিলো। আপা মৃত্যুর আগে ডায়েরিতে তোর সমস্ত পাপকর্মের কথা লেখে গেছে। আর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ তোর কম্পিউটার যেখানে আপার মতো হাজারো নারীদের সাথে করা কাজের প্রমাণ আছে। বর্তমানে সব এখন পুলিশের হাতে। তোর কী হবে রে, বাশার?”

বাশার দূরে সরে দাঁড়ালো। সময়ের ব্যবধানে সে এমন পর্যায়ে এসে দাড়াবে ভাবতে পারেনি। মাসুদা প্রশান্তি অনুভব করলো। ছলছল চোখে বলল,” আপা তো না জেনে পাপ করেছিল, শাস্তি তো পচ্ছেই। কিন্তু তুই অপরাধ করেও ঘুরে বেড়াচ্ছিস।”

সময় নিয়ে চুপ থেকে পুনরায় বলল,” ধ’র্ষ’কে’র শাস্তি একমাত্র মৃত্যু হওয়া উচিত।”

—————————-

হাসপাতালে ক্যান্টিনে তূর্যের সাথে একজন মেয়ে বসে আছে। তারা অপেক্ষা করছে নয়নার জন্য। নয়না ভাবনার বাসায় ছিলো, তূর্যের ইমারজেন্সি কল আসাতে তাড়াহুড়ো করে আসতে হলো তার। দূর থেকে তূর্যের সাথে অপরিচিত মেয়েকে বসে থাকতে দেখে মান হয় নয়নার। ভয় হয় এই ভেবে, যদি মেয়েটা তার কাছ থেকে তূর্যকে কেড়ে নিয়ে নেয়! নানান ভাবনার মাঝে নয়না তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। তূর্য হাসিমুখে নয়নার হাত ধরে পাশে বসিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলো,” মিস মাসুদা, মিট মাই লাভলী ওয়াইফ, নয়না তাবরেজ তূর্য।”

মাসুদা প্রসস্থ হাসলো। নয়নাকে দেখে বলল,” সত্যিই তুমি অপরূপ। তোমার বর এতোক্ষণ যা যা বলেছে একটাও মিথ্যা নয়।”

নয়না লজ্জা পেলো। তূর্য এবার নয়নাকে মাসুদার পরিচয় বলল,” নয়ন! ইনি হচ্ছে মাসুদা। তোমার শুভাকাঙ্খী।”

শুভাকাঙ্খী শব্দটা শুনে নয়না প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করলো। তূর্য তা দেখে একে একে নয়নাকে সবটা ঘটনা খুলে বলল। নয়নার চোখে পানি, আকস্মিক অপরিচিতা মাসুদাকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো। মাসুদা নিষ্প্রাণ হেসে বলল,” পৃথিবীতে নয়নার মতো নরম মেয়েদের জন্য মাসুদা আছে। তোমার সাথে করা প্রতিটা অন্যায়ের শাস্তি এবার বাশার পাবে।”

নয়নার মাসুদাকে ছেড়ে তূর্যের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লো,” তারমানে তুৃমিই উনাকে ঐ বাড়িতে পাঠিয়েছিলে?”

তূর্য বুকে হাত বেঁধে মুচকি হেসে বলল,” তোমার মতো আজই আমার সাথে এই অপরিচিতার প্রথম সাক্ষাৎ, নয়ন! আমি চেয়েছিলাম বাশারকে তিলে তিলে শাস্তি দিতে কিন্তু তারর পূর্বেই বাশারের কাল হয়ে মিস মাসুদা চলে আসে।”

নয়না চোখ মুছলো। গলার স্বর উঁচু করে বলল,” আমি বাশার ভাইয়ের শেষ পরিণতি স্ব চোক্ষে দেখতে চাই।”

তূর্য নয়নার কথায় সায় দিলো। মাসুদাকে বিদায় জানিয়ে নিজ গন্তব্যে ছুটলো।”

——————————-

কাশিমপুর জেলখানায় পরের সপ্তাহে তূর্য নয়নাকে নিয়ে আসলো। প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বাশারের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলো নয়নারা। বাশারকে প্রথমে দেখা মাত্রই নয়না চিৎকার করে উঠলো। বাশারকে সে চিনতেই পারছে না। সারা মুখে কালচে দাগ, হাত পায়ের অবস্থাও খারাপ। হাতের নখগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়েছে কিন্তু কেন? প্যান্টের অনেকটা অংশ ছেঁড়া বিধায় আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। নয়না মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাশার নয়নাকে দেখতে পেয়ে আকুতি মিনতি করা শুরু করলো,” আমাকে বাঁচিয়ে নে, নয়না! আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।”

নয়না তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,” ঐটা কী ভুল ছিলো, বাশার ভাই?”
” আমি পাপ করেছি বোন! আমাকে ক্ষমা করে দে।”

” আমি ক্ষমা করার কেউ না,বাশার ভাই। শুধু তোমাকে দেখে আফসোস হচ্ছে। না জানি তুমি নিজ হাতে কতো পরিবারকে শেষ করেছো। কাঁকনের সাথে করা কাজটাও তুমি করেছো তাই না! একজন মায়ের বদ দোয়ার প্রতিফল ভোগ না করে কীভাবে তুমি মুক্তির আশা করো।”

বাশার প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলল না। হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। তূর্য নয়নাকে ধরে দূরে সরিয়ে আনলো। বাশারের দিকে তাকিয়ে বলল,” পাপ বাপকেও ছাড়ে না, শালা সাহেব! মাসুদা তো তোকে জেলে ঢুকিয়েছে, আমি তোকে জেলের ভেতর পঁচে গলে ম’রা’র ব্যবস্থা করব।”

বাশার চিৎকার করতে লাগলো। পাগলের মতো নিজেকে আঘাত করতে লাগলো। এই নরকে থাকলে সে এমনিতেও পঁচে গলে ম’রে যাবে। নিজের পাপকর্মের কথা ভেবে আফসোস করলো।

নয়না যখন আকলিমার বাড়িতে পা রাখলো তখন বিকাল প্রায়। বাড়িতে প্রবেশ করে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এ বাড়ির প্রতিটা দেয়াল, আসবাবপত্র তার সাথে করা অন্যায়ের স্বাক্ষী। নয়নার আর্তনাদ শুনে হয়তো এরাও কাদতো। আকলিমাকে নয়না পেলো তার ঘরে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে কুঁকড়াচ্ছে। নয়না লাইট জ্বালিয়ে দিলো। আকলিমা নয়নাকে ফিরে আসতে দেখে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। আকলিমা বিছানায় শায়িত অবস্থায় পড়ে আছে। বাশার চলে যাওয়ার পর তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হতে নিলে পিছলে পড়ে যায়। ডান উরুর জয়েন্টে ব্যথা পায়! আশেপাশের ফার্মাসির ডাক্তার ধারণা করছে হাড় ভেঙ্গে গেছে কিন্তু আকলিমাকে কে নিয়ে যাবে? মাহবুব, রিহানের সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় পেলো না আকলিমা। নয়নকে দেখে সে বলল,” মা রে! তোর সাথে করা অন্যায়ের প্রতিফল ভোগ করছি। আমার এখন জীবনে কিছুই নেই। দাম্ভিকতা আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দে মা!”

নয়না ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করলো। সে কখনো তার শত্রুদেরও মৃত্যু কামনা করে না। সেখানে আকলিমা তো তার ফুফু ছিলো। নয়না আকলিমার পাশে বসলো। তূর্যের কথা উঠালো সে, ” আমার স্বামী একজন ডাক্তার। তোমার চিকিৎসা করার সামর্থ্য তার আছে। তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমার চিকিৎসা করাবো।শুধু একটাই অনুরোধ, এভাবে আর কোনো মেয়ের জীবন শেষ করে দিও না।”

আকলিমা হু হু করে কেঁদে উঠে। সত্যিই সে বড়ো অন্যায় করেছে যার শাস্তি সে পাচ্ছে।

চলবে………………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে