নয়নাভিরাম পর্ব-০৭

0
951

#নয়নাভিরাম (পর্ব-৭)

♡আরশিয়া জান্নাত

আকাশটা ঋতুর রাণীর আগমনে যেন একটু বেশিই আনন্দিত হয়। সাদা তুলোর মতোন মেঘ বুকে নিয়ে ছড়ায় অপার সৌন্দর্য। শরৎ মানেই বোধহয় নীল সাদার ছড়াছড়ি। নদীর কোল ঘেঁষে সাদা কাশবন আর আকাশে সাদা মেঘ!
হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে আমাদের গন্তব্য। এই গন্তব্যে আমার একমাত্র সঙ্গী আরশান আহমেদ!
অনেক ধরেই ভাবছিলাম সেই জায়গাটায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা, যান্ত্রিক শহুরে জীবনে থেকে থেকে তাঁর মন প্রাণ কেমন মিইয়ে গেছে। (আমার মন অবশ্য কখনওই মিইয়ে যায় না। আমি সবসময় প্রাণবন্ত আর সজীব,হিহি )
তার উপর ছ্যাঁকা খেয়ে আধমরা হয়ে আছে। এমন মানুষকে আগের ফ্লোতে আনতে এইটুকু সাহায্য মিমি করতেই পারে।
–আপনার কি ভয় করছে মিঃ?
–আমাকে বলছেন?
–হ্যাঁ আর কাকে বলবো?
–আমার কেন ভয় করবে?
— এই যে আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। এমনও তো হতে পারে আমি আপনাকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছি? আপনি তো জায়গাটা চেনেন না তার উপর আমার গাড়িতেই যাচ্ছেন। অনেক কিছুই তো ঘটতে পারে!
আরশান হোহো করে হেসে বললো, মিস মিমি আপনি কি জানেন মাঝেমধ্যে আপনি উল্টো রোল প্লে করেন? এই প্রশ্নগুলো আমার করা উচিত ছিল,
–আপনি আমায় কিডন্যাপ করবেন না। করে বিশেষ লাভ হবেনা,
–কেন কেন লাভ হবে না কেন?
— কি পণ চাইবেন? টাকা নাকি প্রপার্টিজ? এসব কিছুই তো চাই না আপনার। তাহলে লাভ কোথায়?
— ভেবে বলছেন?
–হুম অবশ্যই।
–মেয়ে হয়ে এতো কনফিডেন্ট? জানেন তো মেয়েদের কত রিস্ক?
— হুরর আপনি ওরকম নাকি! এইটুকু ভরসাযোগ্য না হলে নিশ্চয়ই আপনাকে সঙ্গে নিয়ে আসতাম না।
–আপনি আমায় ভরসা করেন?
— হ্যাঁ করবো না কেন?
–এমনো তো হতে পারে আমি খুব খারাপ। যতোটুকু চেনেন বা জানেন তার সবটা সঠিক নয়।

আমি তাঁর চোখে চোখ রেখে বললাম, যদি ধরেও নিই আমার মানুষ চেনার ক্ষমতা নেই তবুও বলবো আপনার ক্ষেত্রে আমার ধারণা এক বিন্দুও ভুল হয় নি। ইনফ্যাক্ট আপনাকে আমি যতোটুকু ভরসা করি তাঁর চেয়েও অনেক গুণ বেশি আপনি ডিজার্ভ করেন।

“এতো ভরসা করবেন না মিস মিমি! আমার ভয় হয় সেটা রক্ষা করতে পারবো কি না,,,,”

“ভয় পেতে থাকুন। আমার কি?”

তারপর জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করলাম। ভীতু লোক একটা এমন কথার পিঠে কি বলতে হয় তাও জানেন না।

“শান্তির পরশ” ইনস্টিটিউট এর সামনে আমাদের গাড়ি থামলো। ড্রাইভার চাচার সাহায্যে গাড়ি থেকে চকলেট বক্স আর খেলনা নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এক ঝাঁক জান্নাতী পাখি আমায় ঘিরে ধরলো।
এবার অনেকদিন পর আসায় তাঁদের সকলের উচ্ছাস অনেক বেশি। সবাইকে চকলেট আর খেলনা দিতে দিতে কুশল বিনিময় করে নিচ্ছি পেছনে তাকিয়ে দেখি আরশান দূর থেকে বোকার মতো চেয়ে আছে। আমি তাঁকে ইশারা করলাম এদিকে আসতে। সে আসতেই তাঁকে বললাম, হাবলুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে হেল্প করুন না!

সবাইকে সবকিছু দেওয়ার পর সিড়িতে বসতেই হুইলচেয়ারের আওয়াজ তুলে মুনা এসে বললো, আমার চকলেট কোথায় আমার কথা কি ভুলে গেছে কেউ?
আমি উঠে গিয়ে তাঁর সামনে হাঁটুভাজ করে বসে বললাম, আপনার কথা ভুলে যাবে এমন গোস্তাখী করার সাহস আছে নাকি কারো রাজকুমারী সাহেবা?
মুনা চেহারার গাম্ভীর্য ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করে বললো, এখন এসব বলে তো কাজ হবেনা। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করুন।
আমি চকলেট আর তাঁর প্রিয় ডেইজি ফুলের তোড়া দিয়ে বললাম,এই যে দেখুন আপনার প্রিয় ফুল আর চকলেট!
মুনা তাঁর বিশ্ববিখ্যাত হাসি দিয়ে গলা জড়িয়ে বললো, এতোদিন আসো নি কেন মিমিপু? কত মিস করেছি জানো?
–অনেক বিজি ছিলাম যে ময়না। আপুর বিয়ে পরীক্ষার চাপ সব মিলিয়ে পাহাড় সমান ভার! সেই ভারে আমি নুইয়ে গেছিলাম দেখো এখনো কেমন কুঁজোবুড়ির মতো হাঁটছি।(অভিনয় করে দেখালাম)
মুনাসহ সব বাচ্চারা হাসতে লাগলো।
মুনা ইশারা দিয়ে কাছে ডেকে বলল,উনি কে?

আমি ফিসফিস করে বললাম, ট্রয় রাজ্যের রাজকুমার! তোমার সঙ্গে দেখা করতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে এসেছে। অভ্যর্থনা জানাবে না??
এই যে রাজকুমার সাহেব এদিকে আসুন।আমাদের রাজকন্যা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

আরশান এসে বসতেই মুনা বললো, আপনি দেখতে আসলেই রাজকুমারের মতো! এতো সুন্দর ছেলে আমি আগে দেখিনি। আপনি বুঝি মিমি আপুর রাজকুমার?
আরশান হাসি দিয়ে মুনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, মুখে কিছুই বলতে পারলো না।
সবার সঙ্গে হৈ চৈ শেষে আরশানকে সেই এরিয়াটা ঘুরে দেখালাম। খুব সুন্দর সবুজ উদ্যানের পাশেই বিশাল বড় দীঘি। ঘাটে পা ভিজিয়ে বসে বললাম, জীবনটা কেমন?

আরশান নিঃশব্দে অপরপাশে বসলো। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ঘোরে আছে। তাঁর অনুভূতি আমি ঠিক বুঝতে পারছি। দাদাজান যখন প্রথমবার আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল আমি অন্য ভুবনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন থেকে জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেছে।

“সুস্থতা অনেক বড় একটা নেওয়ামত তাই না? আমরা একটু কষ্ট পেলেই ভাবি সৃষ্টিকর্তা বুঝি কেবল আমাকেই কষ্ট দিচ্ছেন। সব পরীক্ষা আমাকেই দিতে হচ্ছে। উনিশ থেকে বিশ হলেই ভেবে বসি জীবনটাই বৃথা! আমার কিছু নেই, আমার অনেক দুঃখ আরো কত কি ভাবনা! ওদেরকে দেখুন ওরা কেউ কিন্তু স্বাভাবিক না। ওরা তবুও জীবনটাকে সাজানোর স্বপ্ন দেখছে। হাসছে গাইছে খেলা করছে দিন শেষে আল্লাহকে কৃতজ্ঞতায় স্মরণ ও করছে। সমাজ এদের দেখে এড়িয়ে যায়,বাবা-মা নানা বিপাকে পড়ে। যদিও এখন অনেকটা বদলেছে তাও তো বিড়ম্বনা তো আছেই। এরা যদি এতো কিছুর পরো ভালোভাবে বাঁচতে পারে আমরা কেন সব পেয়েও হাসিমুখে বাঁচতে পারবো না? জানেন আমার যখনই ডিপ্রেশন হয় আমি এখানে চলে আসি। নতুনভাবে সব শুরু করার উদ্দীপনা পাই।”

“আপনার ডিপ্রেশন হয় মিস মিমি?”

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমাদের জেনারেশনটাই এমন কেউ ডিপ্রেশন ছাড়া নেই! পার্থক্য এই কেউ গা ঝেড়ে এড়িয়ে যায় আর কেউ পুষে রেখে থেমে যায়। choice is yours…

_____________

এতো বড় একটা বক্স হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যে কতটা অস্বস্তিকর তা কি আমার ফ্রেন্ডরা জানে না! এই হলো বন্ধুত্ব? দুই দিন আগে থেকে বলে রেখেছি এবার আমার দাদা-দাদীর পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী গ্র্যান্ড করে সেলিব্রেট করবো। কাউকে না জানিয়ে এই আয়োজন করছি তাই ওরা যেন হেল্প করে। কিন্তু বলে লাভ হলো কি সেই তো আমাকেই একা একা সব করতে হচ্ছে।ডেকোরেশন এর আইটেম কিনতে এসেছি সেই কখন ভেবেছি এর মধ্যে কেউ না কেউ এসেই যাবে কিন্তু কারো খবর নাই। ফোন নিয়ে কল করে সামনে এগোতেই একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে চেঁচিয়ে বললাম, আরেহ মিয়া আন্ধা নাকি চোখে দেখবার পান না?

সে চমকিত গলায় বললো, আরেহ ম্যাডাম আপনি! কি সৌভাগ্য আমার আপনার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল!

আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি সে আর কেউ না ঐ মেহবুব শালা!

“এতো বড় বক্স হাতে নিয়ে অযথা কেন কষ্ট করছেন। দিন দিন আমি এগিয়ে দিচ্ছি, ”

“না না ঠিক আছে। ধন্যবাদ”

” আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন? আসলে আমি ফোন স্ক্রল করে এগুচ্ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। আমি খুবই দুঃখিত।”

“সমস্যা নাই ঠিক আছে। আচ্ছা আমি যাই আমার অনেক কাজ আছে”

” একটু ওয়েট। আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আর কনট্যাক্ট করার তো কোনো ওয়ে-ই পাচ্ছি না। ফেসবুক আইডি টা অন্তত দিতে পারতেন!”

আমি রাগ কন্ট্রোল করে বললাম, আসলে ভাইয়া লাস্ট মান্থে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এই যে জিনিসপত্র দেখছেন এগুলো আমার হাজবেন্ডকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিনেছি। আজ তাঁর বার্থডে তো, নাহয় সে-ই আসতো আমার সঙ্গে। তিনি আবার আমায় একা ছাড়তেই চান না। তো এখন আর নাম ঠিকানা বা অন্য কিছু জেনে কি করবেন বলুন? তারচেয়ে বরং অন্যদিকে মনোনিবেশ করুন, গুড লাক। আর হ্যাঁ দোআ করবেন আমাদের জন্য কেমন?

তারপর আমি একপ্রকার পালিয়ে এলাম ওখান থেকে। যাক বাবা এবার নিশ্চিত তাঁর পিছু ছুটেছে।

নীলা– শোন দোস্ত কেকের দায়িত্ব তুই নিস না। ঐটা আমার উপর ছাইড়া দে। তুই বরং ডেকোরেশনে মন দে।
ছোটন– না না তোরে ডেকোরেশনেও আসতে হবে না এইটা আমি আর ইলহাম ম্যানেজ করতেছি। তুই বরং অন্য কিছুতে মন দে।

আমি রাগে লাল হয়ে বললাম, তোরা আমারে ভাবোস টা কি আমি সব ধ্বংস করি!

ওরা সবাই চিৎকার করে বলে উঠলো, আমরা শুধু এটা ভাবি না বরং বিশ্বাস করি

আমারে কেউ ভালোবাসেনা,হুহ!!!

_______________

দাদীজানকে সাজাবো এমন প্ল্যান করে তাঁর রুমে যাচ্ছি তখন দেখি দাদীজান মুখ চেপে কাঁদছেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই এভাবে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছেন। আমি দরজা আটকে তাঁর সামনে বসে বললাম, কি হয়েছে দাদীজান এভাবে কাঁদছো কেন?
তিনি কোনো কথাই বলছেন না। বহুবার জিজ্ঞাসা করার পরও কোনো উত্তর না পেয়ে আমি বললাম,তুমি যদি না বলো আমি চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দেবো।
দাদীজান কান্না আটকে বললো, বুবুন আমি এতো বছর সংসার করছি ভুল ভাবনায় ডুইবা। আমি ভাবতাম তোর দাদা আমারে ভালোবাসে। কিন্তু আইজ বুঝলাম তাইনে আমারে না অন্য জনরে ভালোবাসতো।
–আরেহ ধুরর এসব ভেবে কান্না করতেছো খালি খালি। দাদাজান তোমারেই ভালোবাসে, আর কাউরে ভালোবাসার সময় কই হু?
— তুই দেখ এই মাইয়ার ছবি তাইনে এখনো যত্ন কইরা রাখছে। একবার ভাবছি বাক্সটা খুইলা দেখমু, কিন্তু মনে হইলো যদি আরো গোপন তথ্য পাই এই ডরে আর ধরিনাই। বুবুন রে নারীজাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ হইছে স্বামী। এই স্বামীর ভালোবাসার ভাগ কাউরে দেওন যায় না। অথচ আমারডা তো অনেক আগেই ভাগ হইয়া আছিল।

“দাদীজান, মানুষের জীবনে অতীত থাকা কি খুব অন্যায়? ধরলাম তোমার কথাই সত্যি দাদাজান অন্য একজনকে ভালোবাসতো কিংবা তাঁকে ভুলতে পারেনাই। কিন্তু তাই বলে তোমাকে কি এক বিন্দুও অবহেলা করেছে নাকি আজ পর্যন্ত তোমার মনে হয়েছে উনি তোমাকে কম ভালোবেসেছে? তাহলে আজ এতো বছর পর কেন এসব ঘেঁটে কষ্ট পাচ্ছ?”

“এক বুন্দা লেবুর রস পড়লে এক হাঁড়ি দুধ ফাইটা যায়। এখন তো লাগতাছে তাইনে আজীবন অভিনয় কইরা গেছে। অন্তর থেইকা ভালোবাসেন নাই। যদি বাসতো তাইলে এসব আগলাইয়া রাখতো তুই ই ক?”

আমি নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আসলেই তো! তবে কি দাদাজান দায়িত্বে পড়েই অভিনয় করে গেছেন? কিন্তু তিনি তো বলেছেন তিনি দাদীজানকেই ভালোবাসেন, যদিও অতীত ভুলতে পারেন নি।
আচ্ছা তবে কি ছেলেরা কেবল দায়িত্বে বাঁধা পড়ে অভ্যাসেই এগিয়ে যায়, মন ঠিকই পড়ে থাকে আগের জনের কাছে? মিঃ আরশান ও বুঝি কখনোই পাস্ট ভুলে আমায় ভালোবাসবেন না? তাঁর প্রতি যে আমার সাগরসম প্রেম জমে আছে তাতেও বুঝি মন ভরবে না?

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে