নন্দিত নরকে ২য় পর্ব

0
752

২য় পর্ব
#নন্দিত_নরকে – হুমায়ুন আহমেদ

কাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তারা দেখে সময় বলতে পারি। এখন প্রায় দুটো।
আমিও আকাশের দিকে তাকালাম। খুব পরিষ্কার আকাশ। ঝকঝকি করছে তারা।
কাকা বললেন, দেখেছিস কত তারা? খুব যখন তারা ওঠে, তখন দেশে দুৰ্ভিক্ষ হয় শুনেছি।
আমার শীত করছে। তবু বেশ লাগছে বসে থাকতে।
মাস্টার কাকাকে খুব ভালো লাগে আমার। অদ্ভুত মানুষ। বয়সে বাবার সমান। বিয়েটিয়ে করেন নি। দুই যুগের বেশি আমাদের সঙ্গে আছেন। কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই। বাইরের কেউ যদিও তা বুঝতে পারে না। বাইরের কেন, আমি নিজেই অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে বাবার আপন ভাই বলেই ভেবেছি। তিনি যে বাবার বন্ধু এবং শুধুমাত্র বন্ধু হয়েও আমাদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গেছেন, তা আচ করতে কষ্ট হয় বই কি। বাবার সঙ্গে মাস্টার কাকার পরিচয় হয় আনন্দমোহন কলেজে। অনেক দিন আগের কথা সে-সব। মার কাছ থেকে শোনা। সরাসরি তো আমরা বাবার কাছ থেকে কিছু জানতে পারতাম না। বাবা মা-কে যা বলতেন, তাই শোনাতেন। আমাদের। মাস্টার কাকাকে বাবা অত্যন্ত মেহের চোখে দেখতেন বলেই হয়তো খুঁটিনাটি সমস্তই বলেছেন মাকে।
খুব চুপচাপ ধরনের ছেলে ছিলেন মাস্টার কাকা। ক্লাসে জানালার পাশে একটি জায়গা বেছে নিয়ে সারাক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। তেমন চোখে পড়ার মতো ছেলে নয়। একটু কুজো, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে রয়েছে, শুকনো দড়ি-পাকান চেহারা। ক্লাসের সবাই ডাকত শকুন মামা বলে। তবু বাবা তাঁর প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সমস্ত ব্যাপারে তাঁর অদ্ভুত নির্লিপ্ততা আর অঙ্কে অস্বাভাবিক দখল দেখে। তাঁদের ভেতর প্রগাঢ় বন্ধুত্বও হয়েছিল অতি অল্প সময়ে। মাস্টার কাকা বলতেন, দুটি জিনিস আমি ভালোবাসি, প্রথমটি অঙ্ক, দ্বিতীয়টি এস্ট্রলজি। সেই অল্প বয়সেই মাস্টার কাকা নিখুঁত কোষ্টি তৈরি করতে শিখেছিলেন।
পরীক্ষার ঠিক আগে-আগে মাস্টার কাকাকে কলেজ ছেড়ে দিতে হল। তিনি একটি বিশেষ ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে— সময় খুব কম মেয়েই সায়েন্স পড়তে আসত আনন্দমোহনে। অ্যাডভোকেট রাধিকারঞ্জন চৌধুরীর মেয়ে আনিলা চৌধুরী ছিলেন সব কটি মেয়ের মধ্যে একটি বিশেষ ব্যতিক্রম।
খুব আকর্ষণীয় চেহারা ছিল, খুব ভালো গাইতে পারতেন, ছাত্রী হিসেবেও অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। কেউ সেধে বলতে এলে ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিতেন। হয়তো কিছুটা অহংকারী ছিলেন। তাঁকে জব্দ করার জন্যই ছেলেরা হঠাৎ করে আনিলা নাম পাল্টে শকুনি মামী বলে ডাকতে শুরু করল! শকুন মামা ও শকুনি মামী। এই নামে পদ্য লিখে বিলি করা হল। মাস্টার কাকা তাঁকে শকুন মামা ডাকায় কিছুই মনে করতেন না। কিন্তু এই ব্যাপারটিতে হকচাকিয়ে গেলেন। অসহ্য বোধ হওয়ায় অনিলা চৌধুরী আনন্দমোহন কলেজ ছেড়ে দেন। তার কিছুদিন পরই সপরিবারে তাঁরা কলকাতায় চলে যান স্থায়ীভাবে। অনিলার প্রতি হয়তো মাস্টার কাকার প্রগাঢ় দুর্বলতা জন্মেছিল। কারণ তিনিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কলেজ ছেড়ে দেন। এরপর আর বহুদিন তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় নি।
প্রায় ছ বছর পর বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা হল কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায়, বাবার নিজের বিয়েতে। বাবা চিনতে পারেন নি। মাস্টার কাকা বাবার হাত ধরে যখন বললেন, আমি শরীফ আকন্দ, চিনতে পারছি না? তখন চিনলেন। সময়ের আগেই বুড়িয়ে গেছেন। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, আরো কুজো হয়ে পড়েছেন। বাবা অবাক হয়ে বললেন, কী আশ্চৰ্য, আবার দেখা হবে ভাবি নি। এখানে কোথায় থাক তুমি?
তুমি যে-বাড়িতে বিয়ে করেছি, আমি সে-বাড়িতেই থাকি। বাচ্চাদের পড়াই।
বাবা বললেন, আসবে আমার সঙ্গে?
মাস্টার কাকা খুব আগ্রহের সঙ্গে রাজি হলেন। সেই থেকেই তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। বাবা স্কুলের মাস্টারি যোগাড় করে দিয়েছেন, তাঁর একার বেশ চলে যায় তাতে। তিনি জন্ম থেকেই আমাদের স্মৃতির সঙ্গে গাঁথা। ছোটবেলার কথা যা মনে পড়ে, তা হল–দুর বিছিয়ে বসে বসে পড়ছি। তাঁর ঘরে, রাবেয়াটা হৈচৈ করছে, মাস্টার কাকা পড়াতে পড়াতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলছেন, খোকা হাত মেলে ধরা আমার সামনে, দু হাত।
কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার অন্যমনস্কতা, বিড়বিড় করে কথা বলা। কান পাতলেই শোনা যায় বলছেন, সব ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত। বৃত্ত দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে কেউ যেতে পারবে না। আমি না, খোকা তুইও না।
বাবার সঙ্গে বিশেষ কথা হত না তাঁর। বাবা নিজে কম কথার মানুষ, মাস্টার কাকাও নির্লিপ্ত প্রকৃতির।
মাস্টার কাকাকে বাইরে থেকে শান্ত প্রকৃতির মনে হলেও তাঁর ভেতরে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ছিল। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন তিনি এস্ট্রলজি নিয়ে খবু মেতেছেন। কাজকর্মেও তাঁর মানসিক অস্থিরতার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। গভীর রাতে খড়ম পায়ে হেঁটে বেড়াতেন। খটখট শব্দ শুনে কত বার ঘুম ভেঙে গেছে, কত বার মাকে আঁকড়ে ধরেছি শুয়ে। মা বলেছেন, ভয় কি খোকা, ভয় কি? ও তোর মাস্টার কাকা।
বাবা তারি। গম্ভীর গলায় ডাকতেন, ও মাস্টার, মাস্টার, শরীফ মিয়া, ও শরীফ মিয়া।
খড়মের খটখটি শব্দটা থেমে যেত। মাস্টার কাকা বলতেন কি হয়েছে?
ছেলে ভয় পাচ্ছে, কী কর এত রাত্ৰে?
তারা দেখছিলাম। এত তারা আগে আর ওঠে নি। দেখবে?
পাগল! যাও, ঘুমাও গিয়ে।
যাই।
মাস্টার কাকা খড়ম পায়ে খটখট করে চলে যেতেন।
আমাদের সবার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর কাছে। আমি তাঁর প্রথম ছাত্র, তারপর মন্টু। পড়াশোনায় মন নেই বলে রাবেয়ার তো পড়াই হল না। রুনু এখন পড়ে তাঁর কাছে। বাড়িতে তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই তাঁর। থাকলেও যাবার উৎসাহ পান না। অবসর সময় কাটে এস্ট্রলজির বই পড়ে। অঙ্কের মাস্টার হিসেবে এস্ট্রলজি হয়তো ভালোই বোঝেন। মাঝে মাঝে তাঁর কাছ থেকে বই এনে পড়ি আমি। বিশ্বাস হয়তো করি না। কিন্তু পড়তে ভালো লাগে। আমি জেনেছি মীন রাশিতে আমার জন্ম। মীন রাশির লোক দার্শনিক আর ভাগ্যবান হয়। তাদের জীবন চমৎকার অভিজ্ঞতার জীবন। প্রচুর সুখ, সম্পদ, বৈভব। বেশ লাগে ভাবতে। কাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঐ যে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখছি না? ওর ডান দিকের ছোট্ট তারাটি হল কেতু। বড়ো মারাত্মক গ্রহ। আমার জন্মলগ্নে কেতুর দশা চলছিল!
জানি না, হয়তো জন্মলগ্নে কেতুর দশা থাকলেই আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়। গভীর রাতে অনিদ্ৰাতপ্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যনিয়ন্তা গ্রহগুলি পরখ করতে হয়। কাকাকে আমার ভালো লাগে। তার ভিতরে প্রচণ্ড জানিবার আগ্রহটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। সামান্য বেতনের সবটা দিয়ে এস্ট্রলজির বই কিনে আনেন। দেশবিদেশের কথা পড়েন। মাঝে মাঝে বেড়াতে যান অপরিচিত সব জায়গায়। কোথায় কোন জঙ্গলে পড়ে আছে ভাঙা মন্দির একটি, কোথায় বাদশা বাবরের আমলে তৈরী গেটের ধ্বংসাবশেষ। সামান্য স্কুলমাস্টারের পড়াশোনার গণ্ডি আর উৎসাহ এত বহুমুখী হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। তিনি মানুষ হিসেবে তত মিশুক নন। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টাটা বাড়াবাড়ি রকমের। কোনো দিন মায়ের সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে দেখি নি। খালি গায়ে ঘরোয়াভাবে ঘরে বসে রয়েছেন, এমনও নজরে আসে নি।
স্কুলে কাকা আমাদের ইতিহাস আর পাটীগণিত পড়াতেন। ইতিহাস আমার একটুও ভালো লাগত না। নিজের নাম হুঁমায়ুন বলেই বাদশা হুঁমায়ুনের প্রতি আমার বাড়াবাড়ি রকমের দরদ ছিল! অথচ আমাদের ইতিহাস বইয়ে ফলাও করেচ শেরশাহের সঙ্গে তাঁর পরাজয়ের কথা লেখা। শেরশাহ আবার এমনি লোক, যে গ্র্যাণ্ডটাঙ্ক রোড করিয়েছে, ঘোড়ার পিঠে ডাক চালু করিয়েছে। কিন্তু এত করেও ক্লাস সেতেনের একটি বাচ্চা ছেলের মন জয় করতে পারে নি। পরীক্ষার খাতায় তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে আমার বড়ো রকমের গ্লানি বোধ হত। সেই থেকেই সমস্ত ইতিহাঁসের ওপরই আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কাকা তা জানতেন। এক দিন আমায় বললেন, খোকা তোর প্রিয় বাদশা হুমায়ূনের কথা বলব তোকে, বিকেলে ঘরে আসিস।
সেই দিনটি আমার খুব মনে আছে। কাকা আধশোয়া হয়ে তাঁর বিছানায়, আমি পাশে বসে, রুনু আর মন্টু সেই ঘরে বসে-বসে লুড়ু খেলছে। কাকা বলে চলেছেন, হুঁমায়ুন সম্পর্কে কে এক জন ছোট্ট একটি বই লিখেছিলেন-হুমায়ূন নামা। বইটিতে হুঁমায়ুনকে তিনি বলেছেন দুভাগ্যের অসহায় বাদশা। কিন্তু এমন দুভাগ্যবান বাদশা হতে পারলে আমি বিশ্ববিজয়ী সিজার কিংবা মহাযোদ্ধা নেপোলিয়ানও হতে চাই না। যুদ্ধ বন্ধ রেখে চিতোরের রাণীর ডাকে তাঁর চিতোর অভিমুখে যাত্রা, ভিত্তিওয়ালাকে সিংহাসনে বসোনর পিছনে কৃতজ্ঞতার অপরূপ প্রকাশ। গান, বই আর ধর্মের প্রতি কি আকর্ষণ! আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। যেখানে আজান শুনে হুমায়ূন লাইব্রেরি থেকে দ্রুত নেমে আসছেন নামাজে সামিল হতে, নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মারা গেছেন, সে-জায়গায় আমার চোখ ছলছল করে উঠল। কাকা বললেন, বড়ো হৃদয়বান বাদশা, সত্যিকার কবি হৃদয় তাঁর। আমার মনে হল আমিই যেন সেই বাদশা। আর আমাকে বাদশা বানানর কৃতিত্বটা কাকার একার।
আজ এই আশ্বিনের মধ্যরাত্রি, কাকা বসে আছেন ঠাণ্ডা মেঝেতে। অল্প অল্প শীতের বাতাস বইছে। জোছনা ফিকে হয়ে এসেছে। এখনি হয়তো চাঁদ ড়ুবে চারদিক অন্ধকার হবে। আমার সেই পুরনো কথা মনে পড়ল। আমি ডাকলাম, কাকা, কাকা।
কি।
অনেক রাত হয়েছে, ঘুমুতে যান।
যাই।
কাকা মন্থর পায়ে চলে গেলেন। আমি এসে শুয়ে পড়লাম। রাবেয়া ঘুমের মধ্যেই চেঁচাল, আম্মি আম্মি।
আমার মনে পড়ল রাবেয়া এক দিন হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্র মাস। দারুণ গরম। কলেজ থেকে এসে শুনি রাবেয়া নেই। তার যাবার জায়গা সীমিত। অল্প কয়েকটি ঘরবাড়িতে ঘুরে বেড়ায় সে। দুপুরের খাবারের আগে আসে; খেয়েদেয়ে অল্প কিছুক্ষণের ঘুম। তারপর আবার বেরিয়ে পড়া। সেদিন সন্ধ্যা উৎরেছে, রাবেয়া আসে নি। মার কান্না প্ৰায় বিলাপে পৌচেছে। মন্টু দুপুর থেকেই খুজছে। বাবা হতবুদ্ধি। একটি অপ্রকৃতিস্থ সুন্দরী যুবতী মেয়ের হারিয়ে যাওয়াটা অনেক কারণে বেদনাদায়ক। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাকে কি আবার ফিরে পাওয়া যাবে? রুনু চুপচাপ শুয়ে আছে তার বিছানায়। তার দুঃখপ্রকাশের ভঙ্গিটা বড়ো নীরব। এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা রুনুর ছোট শরীরটা একটা অসহায়তারই প্রতীক। আমায় দেখে রুনু উঠে বসল। বলল, কি হবে দাদা?
তার চোখের কোণে চব্বিশ ঘণ্টাতেই কালি পড়েছে। আমি বললাম, পাওয়া যাবে রুনু, ভয় কি?
কিন্তু ও যে ঠিকানা জানে না। কেউ যদি ওকে খুঁজে পায়, ও কি কিছু বলতে পারবে?
সে কিছুই বলতে পারবে না। তার বড়ো বড়ো চোখে সে হয়তো অসহায়ের মতো তাকাবে। মেলায় হারিয়ে যাওয়া ছোট খুঁকির মতো শুধুই বলবে, আমি বাড়ি যাব। আমি বাড়ি যাব। সে বাড়ি যে কোথায়, তা তার জানা নেই।
রুনু আবার বলল, দাদা, ও যদি কোনো বাজে লোকের হাতে পড়ে?
রুনু বুঝতে শিখেছে। মেয়েদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয় ছেলেদেরও আগে। তারা তাদের কচি চোখেও পৃথিবীর নোংরামি দেখতে পায়। সে নোংরামির বড়ো শিকার তারাই। তাই প্রকৃতি তাদের কাছে অন্ধকারের খবর পাঠায় অনেক আগেই।
রাবেয়া ফিরে এল রাত আটটায়। সঙ্গে মাস্টার কাকা। বুকের উপর চেপে-বসা দুশ্চিন্তা নিমিষেই দূর হল। মাস্টার কাকা বললেন, ওকে আমি স্কুলের কাছে পাই, হারিয়ে গেছে তা আমি জানতাম না। এসব শোনার উৎসাহ আমার ছিল না। পাওয়া গেছে এই যথেষ্ট। স্কুলঘরের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, মাস্টার কাকাকে দেখে দৌড়ে রাস্তা পার হল, আরেকটু হলেই গাড়িাচাপা পড়ত। এ সবে এখন আর আমাদের উৎসাহ নেই। বাবা পরপর দু দিন রোজা রাখলেন।
খোকা, ও খোকা।
কি?
বাতি জ্বাল।
কেন?
আমার বাথরুম পেয়েছে।
বারেয়া মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। আমি বললাম, বাতি জ্বালাতে হবে না। আয়, বারান্দায় আলো আছে।
না, জ্বাল।
দেশলাই খুঁজে হ্যাঁরিকেন জ্বালালাম। দরজা খুলতেই ওঘর থেকে মা বললেন, কে? শেষরাতের দিকে মায়ের ঘুম পাতলা হয়ে আসে।
আমরা মা, রাবেয়া বাথরুমে যাবে।
বারান্দায় এসে রাবেয়া হাই তুলল। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, কি চনমনে গন্ধ ফুলের, না?
হুঁ। ফুলের গন্ধ তোর ভালো লাগে, রাবেয়া?
না, বাজে।
বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, পলা কবে আসবে, খোকা?
পলার সঙ্গে তার কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। মাঝে মাঝেই পলার কথা জানতে চায়। কে জানে কুকুরটা যে কিসের দুঃখে বিবাগী হল।
আজ রাতেও এক ফোঁটা ঘুম হবে না। দু মাস পরেই পরীক্ষা, এক রাত্রি ঘুম না-হলে পরপর দু দিন পড়া হয় না। বুঝতে পারছি কোন ফাঁকে মশা ঢুকেছে। কয়েকটা। কেবল গুনগুন করছে। কানের কাছে। কান অথবা মুখের নরম মাংস থেকে এক ঢোক করে রক্ত না-খাওয়া পর্যন্ত এ চলতেই থাকবে। পাখা করে মশা তাড়াবার ইচ্ছে হচ্ছে না। বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের জন্যে প্ৰাণপণে আমার সমস্ত ভাবনা মুছে ফেলতে চাইলাম।
হঠাৎ করেই অনেকটা আলো এসে পড়ল ঘরে। শীলুদের বারান্দার এক শ ওয়াটের বাঘাটা জ্বলিয়েছে। কেউ। কে হতে পারে? শীলুর বাবা না। নাহার ভাবী? শীলু কিংবা তার মাও হতে পারে। শীলুর মা চমৎকার মহিলা। এক বার এসেছিলেন আমাদের ঘরে।
শীলুর মা, যিনি সন্ধ্যায় লিনে বসে শীলুর বাবার সঙ্গে হেসে হেসে চা খান, বিকেলে প্রায়ই হারুন ভাই-এর পার্টনার হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাডমিন্টন খেলেন, যাঁর একটি গাঢ় সবুজ শাড়ি আছে, যেটি পরলে তাঁর বয়স দশ বৎসর কম মনে হয়, তিনি এক দিন এসেছিলেন আমাদের বাসায়। সেদিন ছিল শুক্রবার। রুনুর স্কুল বন্ধ ছিল, বাবা ছিলেন অফিসে। শীলুর মা লাল বুটি দেওয়া হালকা নীল শাড়ি পরেছিলেন। সোনালি ফ্রেমের চশমায় তাঁকে কলেজের মেয়ে-প্রফেসরের মতো দেখাচ্ছিল। আমার মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, কী করে যত্ন করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন। না। আর শীলুর মা? তিনি মূর্তির মতো অনেকক্ষণ বসে থেকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তাঁর দিকে। তিনি থেমে থেমে প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে বলেছিলেন, হারুনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনার মেয়ে রাবেয়াকে বিয়ে করতে চায়।
আমরা সবাই চুপ করে রইলন। তিনি বলে চললেন, আপনার মেয়েকে পাঠাবেন না ওখানে। কি করে সে ছেলের মন ভুলিয়েছে! মাথার ঠিক নেই একটা মেয়ে। ছি! মা লজ্জায় কুকড়ে গেলেন।
রাবেয়া অকারণে মার খেল সেদিন। সব শুনে বাবার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। কেন সে যাবে হ্যাংলার মতো? রাগিলে বাবার মাথার ঠিক থাকে না। বয়ঙ্কা আধপাগলা একটা মেয়েকে তিনি উন্মাদের মতোই মারলেন। রাবেয়া শুধু বলছিল, আমি আর করব না। মারছ কেন? বললাম তো আর করব না।
কী জন্যে মরা খাচ্ছিল তা সে নিশ্চয়ই বুঝছিল না। বারবার তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে। মা নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। আর আশ্চৰ্য, কান্না শুনে প্রথম বারের মতো হারুন ভাই এলেন আমাদের বাসায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি অল্প অল্প কাঁপিছিলেন। তাঁর চোখ লাল। তিনি থেমে থেমে বললেন, ওকে মারছেন কেন?
বাবা তাকালেন হারুন ভাই-এর দিকে। আমিও ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম। হঠাৎ তাঁর আমাদের এখানে আসা আমাদের ঠাট্টা করার মতোই মনে হল। রাবেয়া বলল, দেখুন না, আমাকে মারছে শুধু শুধু।
হারুন ভাই-এর ফ্যাকাশে মুখে আমি স্পষ্ট গভীর বেদনার ছায়া দেখেছিলাম। তবু কঠিন গলায় বললাম, আপনি বাসায় যান। আপনি এসছেন কেন?
শীলুদের বাসার জানালায় শীলু আর তার মা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রাবেয়াকে কদিন চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হল। তার দরকার ছিল না, হারুন ভাই-এর বিয়ে হল নাহার ভাবীর সঙ্গে। তাঁর খালাতো বোন, হোম ইকনমিক্সে বি. এ. পড়তেন। হারুন ভাই জার্মানী চলে গেলেন কেমিকেল ইঞ্জিনীয়ারিং-এ ডিগ্ৰী নিতে। আগেই সব ঠিক হয়ে ছিল।
নাহার ভাবী সমস্তই জেনেছিলেন। বিয়ের সাত দিন না পেরুতেই তিনি আমাদের বাসায় এসে সবার সঙ্গে গল্প করলেন। রাবেয়াকে নিয়ে গেলেন তাঁদের বাসায়। রাবেয়া হাতে হলুদ রঙের একটা প্যাকেট নিয়ে হাসতে হাসতে বাসায় ফিরল।
মা দ্যাখো, ঐ মেয়েটি আমায় কী সুন্দর একটা শাড়ি দিয়েছে। আমি চাই নি, ও আপনি দিলে।
রাবেয়া নীল রঙের একটা শাড়ি আমাদের সামনে মেলে ধরল। চমৎকার রং। অদ্ভুত সুন্দর।
কাক ডাকল। ভোর হচ্ছে বুঝি। কোমল একটা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আযান হল। মাঠের ওপারে ঝাঁকড়া কাঁঠালগাছের জমাট-বাঁধা অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। বাঁশের বেড়ার উপর হাত রেখে নাহার ভাবী খালি পায়ে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। খুব সকালে ঘুম ভাঙে তাঁর। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন অল্প, বললেন, আজ দেখি খুব ভোরে উঠেছেন।
আমি চুপ করে রইলাম, হ্যাঁ-বাচক মাথা নড়লাম একটু।
নাহার ভাবী বললেন, রাতে আপনার গান বাজিয়েছিলাম, শুনেছেন?
জ্বি, শুনেছি।
রুনুর পছন্দ-করা গান। সেই সাজিয়ে দিয়েছিল। রুনু ঘুমুচ্ছে এখনো?
জ্বি।
ডেকে দিন একটু, খালি পায়ে বেড়াবে শিশিরের ওপর। চোখ ভালো থাকে।
রুনু রাবেয়ার গলা জড়িয়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। আমি ডাকলাম রুনুরুনু।
কদিন ধরেই দেখছি মা কেমন যেন বিমর্ষ। বড়ো ধরনের কোনো রোগ সারবার পর যেমন সমস্ত শরীরে ক্লান্তির ছায়া পড়ে, তেমনি। বয়স হয়েছে, ভাঙা চাকার সংসার টেনে নিতে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, দেহ মন শ্রান্ত তো হবেই। তবু তাঁর এমন অসহায় ভাবটা আমার ভালো লাগে না। খুব শিগগিরই হয়তো আমি একটি ভালো চাকরি পাব। আমি সবাইকে পরিপূর্ণ সুখী করতে চাই। মাকে নিয়ে একবার সীতাকুণ্ড বেড়াতে যাব। কলেজে যখন পড়ি, তখন কবন্ধুকে নিয়ে এক বার গিয়েছিলাম। এত সুন্দর, এত আশ্চর্য! চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে দূরে সমুদ্র দেখা যায়। মা নিশ্চয়ই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠতে পারবেন না। মা আর বাবাকে নিচে রেখে আমরা সবাই উপরে উঠব। বাবাও হয়তো উঠতে চাইবেন। ঠিক সন্ধ্যার আগে-আগে উঠতে পারলে সূর্যস্ত দেখা যাবে! রেকর্ডপ্লেয়ার নেব, অনেক রেকর্ডও নিয়ে যাব।
খোকা, ও খোকা।
কি মা।
কিছু না, গল্প করি তোর সাথে, আয়!
বসেন, সারা দিন তো কাজ নিয়েই থাকেন।
কই আর কাজ?
আপনার স্বাস্থ্য খুব ভেঙে গেছে, মা।
আর স্বাস্থ্য!
মা বসলেন আমার সামনে। তাঁর চোখের কোণে গাঢ় কালি পড়েছে। তিনি থেমে থেমে বললেন, কাল রাতেও আমার ঘুম হয় নি, খোকা।
আমায় ডাকলেন না কেন, ওষুধ ছিল তো আমার কাছে।
দু বার ডেকেছি, তুই ঘুমুচ্ছিলি।
মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আমার খুব ঘুম বেড়েছে দেখছি। রাত নটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ি, উঠি পরদিন আটটায়। মা বললেন, রাবেয়াকে নিয়ে তোর বড়ো খালার কাছে একবার যাব।
হঠাৎ কী ব্যাপার?
এমনি-ঘুরে আসি একটু।
কোনো পীরেব খোঁজ পেয়েছেন বুঝি?
মা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আমি দেখলাম, মার নাকের পাতলা চামড়া তিরতির করে কাঁপছে। মাকে আমার হঠাৎ খুব ছেলেমানুষ মনে হল। বললাম, রাত-দিন কী এত ভাবেন?
কই, কিছু ভাবি না তো। চা খাবি এক কাপ?
এই দুপুরে।
খাঁ না। আগে তো খুব চা চাইতি।
মা উঠে চলে গেলেন। মার ভিতর একটা স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে। শরীর সুস্থ নয় নিশ্চয়ই। মাকে এক জন বড়ো ডাক্তার দেখালে হত। রুনুর স্কুল ছুটি হয় সাড়ে চারটায়। আজ সে দুপুরেই হাজির। হাসতে হাসতে বলল, স্কুল ছুটি হয়ে গেল দাদা।
সকাল সকাল যে! কি ব্যাপার?
মনিং স্কুল আজ থেকে। সকাল সাতটায় স্কুলে গেলাম। তুমি তো তখন ঘুমে। বাৰ্বাহ্, এত ঘুমুতেও পার।
মা চা নিয়ে ঢুকলেন। রুনু বলল, আমায় এক কাপ দাও না মা।
আরেকটা কাপ এনে ভাগ করে নে।
না, তা হলে থাক। দাদা খাক।
আহা, নে না।
রুনু চা নিয়ে বসল একপাশে। চুমুক দিতে কী ভেবে হাসল খনিকক্ষণ। বলল, মা খিদে পেয়েছে, কি রানা মা আজকে?
মাছ। খিদে নিয়ে চা খেতে আছে?
ওতে কিছ হবে না, মা। আচ্ছা, আপাকে দেখলাম বাবার সঙ্গে রিকসা করে যাচ্ছে। কোথায়?
কি জানি কোথায়। তোর আম-কাঁঠালের বন্ধ করে রুনু।
দেরি আছে, সামনের মাসের পনের তারিখ থেকে।
আমি তোর খালার বাসায় যাব বেড়াতে। তুই তাহলে থাকবি?
সে কি, তোমার সঙ্গে কে কে যাবে মা?
আমি, রাবেয়া আর তোর আব্বা।
বেশ তো! আমি বুঝি বাতিল?
রুনুর কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেললাম। সবাই। রুনু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, তোমার চাকরি হলে আমায় নিয়ে বেড়াতে যাবে?
নিশ্চয়ই।
আমি কিন্তু কক্সবাজার যাব। শীলুরা গিয়েছিল গত বার।
বেশ তো।
আর যেদিন প্রথম বেতন পাবে সেদিন—
সেদিন কি রুনু?
সেদিন আমাকে দশ টাকা দিতে হবে। দেবে তো?
হ্যাঁ, কী করবি?
এখন বলব না।
রুনু লম্বা হয়েছে একটু, চোখের তারাও যেন মনে হয় আরো গভীর কালো। চাঞ্চল্যও এসেছে একটু। সেদিন দেখলাম অনেকক্ষণ ধরেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াল। সে কি বুঝতে পারছে তার চোখের পাতায়, তার হলুদ গালে, বরফিকাটা মসৃণ চিবুকে রূপের বন্যা নামছে। যৌবনের সেই লুকান চাবি দিয়ে প্রকৃতি একটি একটি করে অজানা ঘর খুলে দিচ্ছে তার সামনে। সে দেখছি প্রায় রাতেই শুয়ে শুয়ে উপন্যাস পড়ে। পড়তে পড়তে এক এক বার চোখে রুমাল দিয়ে কেঁদে ওঠে। আমি বলি, কী হয়েছে রুনু?
কই, কিছুই তো হয় নি।
কাঁদছিস কেন?
কাঁদছি, না তো।
কি বই পড়ছিলি দেখি।
রুনু উঁচু করে বই দেখায়। কেঁদে ভাসাবার মতে, কিছু নয়। জীবনে একটি সময় আসে যখন তীব্র অনুভূতিতে সমস্ত আচ্ছান্ন হয়ে থাকে। প্রথম বেতন পেলে রুণুকে একটা চমৎকার শাড়ি কিনে দেব আমি। সবুজ জমিনের উপর সাদা ফুলের নকশা। রোল নাম্বারা থাটিন পর্যন্ত দেখতাম।
অনেক দিন পর শীলুকে দেখলাম। সবাই মিলে চাটগায় গিয়েছিল বেড়াতে। বেশ কিছু দিন পর ফিরল। এত দিন শান্তি কটেজকে কি বিষণ্ণই না লাগছিল। দেখতাম সন্ধ্যা হতেই শান্তি কটেজের বুড়ো দারোয়ান বারান্দায় বাতি জ্বলিয়ে একা একা বসে চুপচাপ। খালি বাড়ি পেয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলতে হাজির হচ্ছে সকাল-বিকাল।
ফুলগাছ নষ্ট করো না গো, ও লক্ষ্মী ছেলেমেয়েরা।
প্রতিবাদের সুরও যেন খালি খাড়ির মতোই বিষন্ন। মাঝে মাঝেই ঝড়ের মতো হাজির হোত রাবেয়া। গেটের বাইরে থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচাত–এই দারোয়ান এই, এই বুড়ো।
কি খুকি। আপা?
এরা কোথায় গেছে?
বেড়াতে।
কোন বেড়াতে গেল?
দারোয়ান হাসত কথা শুনে। আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলত, আবার আসবে আপামণি।
কবে আসবে? কাল?
ষোল তারিখে আসবে।
না, কালকেই আসতে হবে। তুমি ওদের আনতে যাবে ইষ্টিশনে?
জ্বি, আপামণি।
আমিও সঙ্গে যার।
আচ্ছা।
তুমি নিয়ে যাবে তো আমাকে?
জ্বি, আপনাকে নিয়ে যাব, ঠিক যাব। আপামণি।
পেয়ারা পেড়ে দাও আমাকে।
লম্বা আকশি নিয়ে খুশি মনে পেয়ারা খোঁজে বুড়ো। গ্যারেজের উপর ঝাঁকেপড়া গাছে ঝোপে পেয়ারা হয়েছে।
খালি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমিও রাবেয়ার মতো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কবে আসবে শীলু, যাকে আমি করুণা বলে নিজের মনেই ডাকি। করুণা ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে বাগানে, নিজের খেয়ালে গান গেয়ে উঠবে আচমকা। আমাদের বাসার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ডাকবে, রুনু, রুনু, বাসায় আছ?
এর জন্যে আমি অপেক্ষা করে ছিলাম। ভালোবাসা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমি বুকের ভেতর গোপন ভালোবাসা পুষেছি।
কত দিন পর দেখলাম শীলুকে।
গাড়ি থেকে নামতেই আমার সঙ্গে দেখা। খুব কোমল কণ্ঠে বলল, আপনারা সব ভালো ছিলেন তো? রুনু ভালো?
তেমনি লম্বাটে মুখ, কপালের দিকে টানা ভুরু, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কথা বলতে-বলতে হঠাৎ থমকে অন্য দিকে তাকাল। আমার হৃৎপিণ্ড দুলে উঠল, শীলুর চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে গিয়ে অদ্ভুত কষ্ট হল। আমি বললাম, তোমরা ভালো তো শীলু?
জ্বি।
শীলুর মা মালপত্র নামাতে নামাতে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে। বুড়ো বয়সেও ঠোঁটে আর মুখে রং মেখেছেন। বয়স অগ্রাহ্য করে পরা চকচকে শাড়িতে তাঁকে হাস্যকর লাগছিল, কিন্তু তবু তিনি শীলুর মা, আমি বিনীত ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সবার শেষে নামলেন নাহার ভাবী। ভারি সুন্দর হয়েছেন তিনি। গায়ের মসৃণ চামড়া ঝকঝকি করছে। নাকের উপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। রোদ লোগে। নাহার ভাবী আমাকে দেখে ছেলেমানুষী ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনাদের কথা যা ভেবেছি।
আমিও ভেবেছি।–আপনারা কবে যে আসবেন!
রুনু আর রাবেয়া কোথায়?
রুনু স্কুলে। রাবেয়া বেড়াতে বের হয়েছে।
রুনুর জন্যে আমি অনেক গল্পের বই এনেছি। অনেক নতুন রেকর্ড কিনেছি।
শীলুর মা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, রোদে তোমাদের মাথা ধরবে, ভেতরে গিয়ে বস, মেয়েরা।
শীলু, তোমাকে আমি গোপনে করুণা বলে ডাকি। তোমার জন্যে আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয়। প্রতি রাতে তোমাকে নিয়ে কত কি ভাবি। যেন তোমার কঠিন অসুখ করেছে। শুয়ে শুয়ে দিন গুনছ মৃত্যুর। হঠাৎ এক দিন আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তোমার বিছানার পাশে। তুমি ছেলেমানুষের মতো বললে, এত দিন পরে এলেন?
আমি বললাম, তুমি তো আমায় কখনো ডাক নি শীলু। ডাকলেই আসতাম। তুমি বিবৰ্ণ ঠোঁটে হাসলে। আমি বসলাম তোমার পাশে। জানালা দিয়ে হুঁহু করে হাওয়া আসছে। হাওয়ায় কাঁপছে তোমার লালচে চুল। আমি তোমার মাথায় হাত রাখলাম। তুমি বললে জানেন আমার যে একটি ময়না ছিল। সেটি ঠিক মানুষের মতো শিস দিত, খাঁচা ভেঙে পালিয়েছে।
কী হাস্যকর ছেলেমানুষী ভাবনা! কত দিন ভাবতে-ভাবতে রাত হয়ে যেত। রাস্তায় নিশি-পাওয়া কুকুর চেঁচাত। ঘুম ভেঙে মাস্টার কাকা উঠে আপন মনে কথা বলতেন।
আমার বন্ধু রমিজ এক বিবাহিতা ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছিল। মেয়েটি তার স্বামী ও দুটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল রমিজের সঙ্গে। ভদ্রমহিলার স্বামী দুঃখে লজ্জায় এন্ড্রিন খেয়ে মরেছিল। ঘটনাটি শুনে রমিজের প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা হয়েছিল। এর অনেক দিন পর যখন শীলুরা ঘর অন্ধকার করে বাইরে বেড়াতে গেল, তখন কেন যেন মনে হল।রামিজ কোনো দোষ করে নি।
ভালোবাসার উৎস কী আনি জানি না। আশফাক বলত, ভালোবাসা হচ্ছে নিছক কামনা, যৌন আকর্ষণের পরিভাষা। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমার গলা জড়িয়ে শীলু কখনো ঘুমিয়ে থাকবে।–এ ধরনের কল্পনা তো কখনো মনে আসে না।
একদিন শীলুর বয়স হবে। পাক ধরবে তার চুলে, পোকায় কাটা অশক্ত দাঁতে কালো ছোপ পড়বে, ছানি-পড়া চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে তখন কি সে দেখতে পারবে বছর ত্ৰিশোক আগে একটি অনুভূতিপ্রবণ তরুণ ছেলে কান পেতে আছে কখন সেই কোমল কণ্ঠ শোনা যাবে, দাদু ভাই, রুনু বাসায় আছে?
আমি ইদানীং কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছি। মা আমাকে মাঝে মাঝে বুঝতে চেষ্ট করেন। রুনু প্রায়ই অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো আমার বোঝার ভুল। তবু তার হাবভাব যেন কেমন। যেন কিছু জানতে চেষ্ট করছে। সেদিন অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে বসল, শীলুকে কি তোমার খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হয়, দাদা ভাই?
আমি নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখতে প্ৰাণপণ চেষ্টা করে বললাম, হ্যাঁ।
তোমার কাছে ওকে ভালো লাগে?
তা লাগে।
কিন্তু, ও কী বলে জান?
কী বলে?
বলে তোমার দাদাভাইকে দেখলেই মনে হয় বোকা, তাই না?
বলা বাহুল্য আমি সেদিন দুঃখিত হয়েছিলাম। আমাকে কেউ বোকা বলছে, সেই জন্যে নয়। আমার গভীর আবেগের কথা সে জানছে না, এই জন্যে। আমার ধারণা, শীলু। যখন সমস্ত কিছু জানবে, তখন নিশ্চয়ই আমাকে অন্য চোখে দেখবে। আমি বললাম, শুনে তোর খারাপ লেগেছে, রুনু?
হ্যাঁ।
শীলু কি তোর খুব ভালো বন্ধু?
হ্যাঁ, ভালো বন্ধু।
চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে