ধোয়ার-নেশা পর্ব (৯+১০)

0
1506

#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (৯+১০)

অনিকশা বাইরে দাড়িয়েই অন্ত্রীশাকে খুজছে। রুমে তো দেখতে পাচ্ছিনা,এতোরাতে গেলো কোথায়? আমি কি ভেতরে যাবো? নাকি চলে যাবো? কিন্তু অরিদ্রা??

অনিকশা অরিদ্রার দিকে তাকাতেই পালকের চোখে চোখ পড়ে গেছে। এখন এভাবে চলে যাওয়াটা খারাপ দেখাবে ভেবেই অনিকশা ভেতরে ঢুকে পড়লো। অরিদ্রাকে কোলে নেওয়ার উদ্দশ্যে হাত বাড়াতেই পালক ওর হাতের কব্জীর অংশটা চেপে ধরে বললো,

“” কেমন আছো,পত্রী কন্যা?””

অনিকশা পালকের দিকে তাকাতে গিয়েও তাকালোনা। ভয় হচ্ছে তার ভীষন ভয়! ঐ চোখে তাকালেই যে তার ভেতরটা অপরাধবোধে ফেটে যায়! অনিকশা অরিদ্রার দিকে তাকিয়েই বললো,

“” হাত ছাড়ো পালক!””

পালক হাত ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। অনিকশার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। ঠোটের এককোনটা বাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো,

“” আগেতো হাত না ধরার কারনে আমার সাথে অসংখ্য ঝগড়া করেছো। আর আজ হাত ধরাতেও রাগ দেখাচ্ছো? তোমরা মেয়ে জাতিরা এমন কেন বলোতো? আমার তো মনে হয় তোমরা কি চাও সেটা তোমরা নিজেরাও জানোনা!””

অনিকশা নিজের অন্যহাত দিয়ে পালকের হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় বললো,

“” পালক আমার লাগছে,ছাড়ো। আমি তোমার তেতো কথা শুনার জন্য আসিনি। অরিদ্রাকে নিতে এসেছি। আর তুমি আসছো জানলে আমি আসতামও না।””
“” সত্যি আসতেনা?””
“” হুম!””
“” কিন্তু আমি যে চাই তুমি আসো!””

অনিকশা পালকের হাতের বাধন থেকে ছুটতে না পেরে পালকের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বললো,

“” হাত ছাড়ো,প্লিজ! অন্ত্রীশা দেখলে ব্যাপারটা কত জগন্য হবে বুঝতে পারছো? অরিদও হয়তো এতক্ষনে এদিকে আসছে!””

অরিদ নাম শুনেই পালকের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। অনিকশাকে টেনে নিজের কাছটাতে এনে বললো,

“”অরিদ তোমার কোন তৃষ্ণা মিটিয়েছিলো যে একদিনেই বিয়ে করে নিলো।””
“” পালক,ঠিকভাবে কথা বলো। ও আমার স্বামী!””

পালকের রাগ হচ্ছে! এতো বেশি রাগ হচ্ছে যে শরীরের প্রতিটা শিরাউপশিরা ফুলে ফেপে উঠছে। এই চার বছরের সবটা রাগ এখন ঢেলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ কোনো নিয়ন্ত্রণের বাধা তার মানতে ইচ্ছে করছেনা। কার ভালো হবে,কার খারাপ হবে,কে কি ভাববে তার কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। নিজের রাগগুলোকে আর কত পুষে রাখবে? এবার কি তবে রাগ ঢেলে দেওয়ার সময় এসেছে??

“” পালক,আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ছাড়ো বলছি। এতো রাতে এভাবে সিন ক্রিয়েট করোনা!””

অনিকশার কথা গায়ে মাখছেনা পালক। ওকে টানতে টানতে অন্ত্রীশার খোলা বারান্দায় নিয়ে এসেছে। যেখানে গ্রিল দিয়ে বন্দী করা হয়নি বেলকনির স্পেসটাকে। আশেপাশে তেমন গাছ না থাকায় এখান থেকে মেঘে ঢাকা পুরো আকাশটাকে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির সাথে সাথে কালো মেঘেরাও আজ নিচে নেমে আসছে। পালকের ইচ্ছে হচ্ছে সেও আজ এই কালো মেঘের বৃষ্টির সাথে নিজের জমিয়ে রাখা সবটা রাগ ধুয়ে ফেলতে।

অনিকশাকে বেলকনির ঠিক কর্নারে দাড় করিয়ে ওর হাতটা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

“” আমার আজ সব প্রশ্নের উত্তর চাই পত্রীকন্যা। ইচ্ছে তো করছে নিজের সবটা রাগ আর অভিমান দিয়ে তোমাকে জ্বালিয়ে ফেলি। কিন্তু বেহায়া মন যে তার পত্রীকন্যাকে কষ্ট দিতে নারাজ। কেন সেদিন তুমি আমাকে ফেলে চলে এলে? কেন সেদিন অন্য কারো দখলে চলে গেলে? কি দোষ ছিলো আমার? অনিকশা আমার সব উত্তর চাই!””

পালকের হাত থেকে ছাড় পেয়ে অনিকশা পালিয়ে আসতে গেলে ওর হাতটা চেপে ধরে ফেললো পালক,,

“” সেদিন যদি বুঝতে পারতাম এই যাওয়াই তোমার শেষ যাওয়া তাহলে কখনোই তোমাকে পালাতে দিতাম না! আজ আমি আমার উত্তর না নিয়ে তোমাকে ছাড়বোনা।””

বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোটাগুলো বাড়ি খেয়ে পালক আর অনিকশাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। অনিকশা যাতে পালাতে না পারে তার ঠিক সামনেই পালক দাড়িয়ে রয়েছে। কিছুটা দুরত্ব রেখেই দাড়িয়েছে সে। অন্যের দখলধারীকে সে কখনোই ছুতে চাইনা। যখন নিজের দখলে ছিলো তখনই সে ছুয়ার সাহস পায়নি,তাহলে আজ কিভাবে পাবে??

বৃষ্টির পানি মুখ চুয়ে চুয়ে নিচে পড়ছেপালকের। পালকের চোখের দিয়ে তাকিয়ে অনিকশার গলা শুকিয়ে এলো। চোখগুলো লাল রক্তবর্নের আকার ধারন করে আছে। ঐ চোখ দেখেই বুঝতে পারছে আজ সে পালকের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারবেনা৷ পালকের রাগ দেখার সৌভাগ্য তার কখনো হয়নি,আজ সেটাও হয়ে গেলো।

পালক বেশ তীক্ষকন্ঠে চিৎকার করে বললো,

“” কি হলো বলছোনা কেন? আমার কি দোষ ছিলো?””
“” এভাবে চিৎকার করছো কেন? আমি তোমার কোনো উত্তর দিতেই বাধ্য নই””

পালকের রাগ এবার আরো বেড়ে গেলো। অনিকশার দিকে রাগে ফুসতে ফুসতে এগুতেই অনিকশা বেলকনির অর্ধাংশ দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো। কিছুটা বাহিরের দিকে বেকে গিয়ে,চোখ বন্ধ করে ফেললো,

“” পালক,তুমি ভুলে যেওনা অন্ত্রীশা আমার ছোট বোন।””
“” তুমিও ভুলে যেওনা তোমার বোন আমার বউ!””
“” মানে?””
“” আমার উত্তর চাই!””
“” তুমি অনতিকে কষ্ট দিতে পারোনা৷ এখানে ওর তো কোনো দেষ নেই। আমাদের মাঝখানে ওকে কেন আনছো?””
“” তুমিও তো আমাদের মাঝখানে অরিদকে এনেছো,কেন এনেছো?””
“” পালক তুমি এখন হুশে নেই,আমি রুমে যাবো। সরো এখান থেকে!””
“” তুমি কোথাও যাবেনা। আগে আমার উত্তর দিবে তারপর যাবে। নাহলে আজকে আমি সব ধ্বংস করে দিবো!””
“” আমি জানি তুমি এমন কিছু করবেনা।””
“” এতো কিছু জানো তাহলে এটা কেন জানলেনা তুমিহীনা আমি কিছুই না। বুকের ভেতরটা জ্বলেপুরে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। আমাকে একটু বিষ এনে দাও আমি খেয়ে মরে যাই। মনটা তাও এটাভেবে শান্তি পাবে সে তার পত্রীকন্যার হাতে জীবন বলি দিয়েছে!””

পালকের কথায় অনিকশার কান্না পাচ্ছে,চোখ ঠিকরে পানি বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে,হয়তো বেড়িয়েও এসেছে যা বৃষ্টির সাদাপানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমি তো এমনটা চাইনি। এই পৃথিবীতে হয়তো আমিই সবচেয়ে পাপী যে দুটো মানুষকে কাঁদিয়ে এখনো বেঁচে আছে।

“” পালক,এমন ছেলেমানুষি কথা কেন বলছো? সব ঠিক হয়ে যাবে। অনতি আর তুমি অনেক সুখী হবে। অনতি অনেক লক্ষী একটা মেয়ে।””
“” আমার লক্ষী মেয়ে চাইনা। আমার পত্রীকন্যাকে চাই। যদি সে অলক্ষী হয় হোক। আমিও ওর সাথে মিশে অলক্ষী হয়ে যাবো।””
“” এটা কখনোই সম্ভব না পালক! জীবনের অনেকটা পথ পেড়িয়ে এসে পড়েছো। সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার শুরু করো!””

পালক অসহায় সুরে বললো,

“” তাহলে তোমাকে ভুলে যাওয়ার ঔষধের নাম বলে দাও।””

অরিদ নিজের হাতে খায়িয়ে দিচ্ছিলো বলে অন্ত্রীশা মুখ বুঝে খেয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু তা বেশিক্ষন পেটে রাখতে পারেনি। পালকের দেওয়া ধোয়ার বিষগুলো কুন্ডুলী পাকিয়ে অন্ত্রীশার পেটে ক্ষনে ক্ষনে হামলা করছিলো। এই হামলার ফল হিসেবে সে বমি করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। পর পর দুবার বমি করাতে শরীরটা অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে আসে অন্ত্রীশার। মাথাটাও ভারী হয়ে আসছিলো। শরীরটাকে ঠান্ডা করতেই অন্ত্রীশা দ্বিতীয়বারের মতো সাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়েছে। মাথায় টাওয়ালটা বেধেই বারান্দার দিকের দরজাটা আটকাতে এগুলো। বৃষ্টির ঝাপটাই আর বাতাসের ধাক্কায় দরজা একটু পরে পরে বাড়ি খাচ্ছে দেওয়ালের সাথে। অন্ত্রীশা দরজার কাছে দাড়িয়েই অবাক।

“” আরে কি করছেন,আপু তে পড়ে যাবে!””

হঠাৎ অন্ত্রীশার কন্ঠ পেয়ে পালক অনিকশার থেকে সরে এসে অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়েছে। অনিকশাও সে ফাঁকে পালকের কাছ থেকে ছুটে এসে বললো,

“” তোর বরটা তো আমাকে ভয়ই পায়িয়ে দিয়েছিলো। পালক যে আসবে অরিদকে বলিশনি? তাহলে তো আর অরিদ্রাকে রেখে যেতোনা। তোর কি বুদ্ধীসুদ্ধী কিছু হবেনা? আর অরিদটাও হয়েছে মাথামোটা!””

অনিকশা কাপুনি আর ভীত কন্ঠে অন্ত্রীশাকে দুচারটে কথা শুনিয়ে চলে গেলো।

অন্ত্রীশা পালকের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

“” আপনি না বলেছিলেন আসবেননা,তাহলে আবার এলেন যে? আমাকে মিস করছিলেন?””

পালক অন্ত্রীশাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে ওর হাত চেপে ধরে ফেললো অন্ত্রীশা! দুজন দুদিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে।

“” ভিজেই তো গেছেন। থাকুননা কিছুক্ষন!””
“” আই হেইট রেইন।””
“” আপনাকে দেখে তা মনে হচ্ছেনা। আমার জন্য নাহয় অপছন্দ জিনিসটাকে একটু পছন্দ করলেন।””
“” অপছন্দ আর ঘৃণা দুটো শব্দ এক না অন্ত্রীশা! আমি চেন্জ করবো,হাত ছাড়ো।””

অন্ত্রীশা পালকের হাত ছেড়ে দিয়ে উল্টোদিকে ঘুরেই বললো,

“” আমরা কি বন্ধুও হতে পারিনা?””
“” না।””
“” কেন?””
“” সব কেন এর উত্তর হয়না।””

পালক সেখানে আর একদন্ডও দাড়ালোনা। রুমের দিকে পা বাড়ালো। অনিকশার কাছে থেকেও তার যতটা না অসস্থি হচ্ছিলো অন্ত্রীশার উপস্থিতিতে তা দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে। মেয়েটার কথার মধ্যে কিছুতো আছে যা পালকের সব কিছুকে থামিয়ে দিতে চাই।

অনিকশা অরিদ্রাকে বিছানাতে শুয়িয়ে দিতেই অরিদ চেচিয়ে উঠলো,

“” তোমরা মা,বেটি কি বৃষ্টিতে ভিজে এলে নাকি? আমাকে কেন নিলেনা অনি? ইশ! তোমার সাথে সে কবে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম!””

অনিকশা অরিদের কাছে এসে ঝাপটে জড়িয়ে নিলো। ধরে আসা গলায় বললো,

“” একটু ভালেবাসবে অরিদ? একটু না অনেকখানি ভালেবাসতে হবে। যে ভালোবাসায় মনে হবে আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে গিয়েছে। যেখানে অনুভূতি নামের কোনো শব্দ থাকবেনা।””

অনিকশা কথা শেষ করতেই অরিদ ওকে কোলে তুলে নিয়েছে। গুটিগুটি পায়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজের ভরটা ওর উপর ছেড়ে দিলো। কপালে অরিদের ঠোটের ছোঁয়া পেতেই অনিকশা আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।

অরিদ পলকহীনভাবে চেয়ে আছে। বৃষ্টির পানিগুলো এখনো বিন্দু বিন্দু জমে আছে অনিকশার মুখে। ঠোটজোড়াও ভিজে। চোখের পাপড়িগুলোও ভিজে একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। এরকম চেহারায় বেশ আবেদনময়ী লাগছে অনিকশাকে। যেকোনো ছেলেকেই কামুকতায় মাতিয়ে দিবে। তাকেও দিচ্ছে। তবে তারটা পবিত্র কামুকতা। কেননা সেতো তার বউ! তারা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ!

অরিদ্রা আসার পর অনিকশাকে এতোটা কাছে পাওয়া হয়নি অরিদের। আজ তার খুব লোভ হচ্ছে অনিকশার মধ্যে নিজেকে ডুবে দেওয়ার তার ইচ্ছেপুরনের অন্য পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়ার তবে সেটা অনুভূতিহীন নয়,অনুভূতির সাগরে ডুবে থাকা পৃথিবীতে। যে সাগরে শুধু তারা দুজন ডুবে ডুবে মিলিয়ে যাবে।

অনিকশার নাকে একটা চুমু খেয়ে অরিদ বললো,

“” কাউকে ভুলতে নয় আমার ভালেবাসার ক্ষুধা পাবে যেদিন সেদিনই তোমাকে ভালোবাসবো। আর সেদিন আসবে,খুব শিঘ্রই আসবে,আমিতো সেদিনের অপেক্ষায় আছি,অনি। আমি যে তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি। আমার নিজের ভালেবাসার উপর সম্পুর্ন আস্থা আছে। জামাটা চেন্জ করে ঘুমিয়ে পড়ো। ঠান্ডা লেগে যাবে!””

অরিদ অনিকশার উপর থেকে সরে এসে অরিদ্রার পাশে শুয়ে পড়লো। এই প্রথম সে তার ভালেবাসার মানুষটার অবাধ্য হলো। বেশ অভিমানও হচ্ছে। তবে অনির উপর নয় নিজের উপর! এই অবাধ্যটা তার আরো আগে হওয়া উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আজ তাকে এভাবে নির্ঘুমে রাত কাটাতে হতোনা। লোভ আসলেই মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। তাকেও দিয়েছে। ভালেবাসার মানুষটাকে কাছে পাওয়ার লোভে নিজের ভালোবাসাগুলে ধ্বংস করে ফেলেছে!

পালক চেন্জ করে এসেও অন্ত্রীশাকে রুমে দেখতে পায়নি। হয়তো বৃষ্টিতে ভিজছে। হয়তো তারও বৃষ্টি পছন্দ। পালক অন্ত্রীশাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অন্ত্রীশা আসলে নাহয় নিচে শুয়া যাবে! চোখ বুঝতেই পালক তার রঙিন অতীতে ডুবে যাচ্ছে।

পত্রীকন্যা তার তৃতীয় চিঠীও একটা বোরকা পরিহিত মেয়ের হাতে পাঠিয়েছে। সেই তাদের চিঠি আদান প্রদান করবে বলে চিঠীতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরো চিঠীতেই কড়া করে বলা হয়েছে তাকে খুজার কোনো চেষ্টা যেন না করে!

পত্রীকন্যা কড়া চিঠিতেও হাজার হাজার ভালোবাসার ঘ্রান পেলো পালক। সেই ঘ্রানে মাতাল হয়েই নিজেও চিঠি লিখতে বসে পড়লো।

***প্রিয় ডিস্টার্ভিং গার্ল,

এতো কেন ডিস্টার্ব করছেন আমাকে? আপনার জ্বালায় আমি ঘুমুতে পারছিনা,খেতে পারছিনা,পড়তে পারছিনা,গোসলও করতে পারছিনা। আমি আজ তিনদিন ধরে গোসল করছিনা। গোসল করতে গেলেই আপনি আমাকে ডিস্টার্ভ করছেন। আপনার নীল নকশা কি সিল মারা হয়েছে? আর কত সময় নিবেন সিল মারতে? আমি ঠিক করেছি আপনার সাথে আমিও আপনাকে কলংকিত করবো তারপর একসাথে দুজন গোসল করে সেই কলংকের দাগ ধুবো!

আপনি কি জানেন? এইবার আপনার হিংসে আমাকে এতোই প্রজ্বলিত করেছে যে আমি পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিয়েছি। দুদিন পর নোটিশ বের্ডে টপ নোটিশ লেটারেই ফলা করে লিখে দিবে,প্রখর মেধাবী পালক প্রেমে কলংকিত হয়ে সবার মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছে। সবাই কলংকিত পালকের থেকে দুরে থাকুন!

পত্রীকন্যা আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেননা। এই ভয়াবহ ডিস্টার্বে আমি খারাপভাবে আহত হচ্ছি! আমার উপর মায়া না হোক প্রিন্সিপালের উপর একটু মায়া করবেন। উনার হাসি হাসি মুখটা চুপসে দিবেননা।

ইতি

পত্র পুরুষ

ঘন্টাখানিক পার হওয়াতেও যখন অন্ত্রীশার আগমনের কোনো লক্ষন দিলোনা পালকের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। এতক্ষনে বৃষ্টিরবেগও তো কমে এসেছে। ও এখনো বারান্দায় কি করছে? ও যা খুশি তাই করুক,আমার কি? পালক আবার চেখ বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু কপালের ভাজটা কমার বদলে আরো বেশি কুচকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষন কাটানোর পর পালক উঠে বসলো। এই মেয়েটা করছে কি? এর জ্বালায় তো আমি অতীতে ডুবতেও পারছিনা। ধ্যেত!

পালক বিছানা ছেড়ে বিরক্ত নিয়েই বারান্দার দিকে এগুলো। দরজায় পা রাখতেই পালকের বুকটা কেঁপে উঠলো। অন্ত্রীশা ভেজা মেঝেতে পড়ে রয়েছে!

পালক দৌড়ে অন্ত্রীশার কাছে গেলো। এক অজানা ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলেছে,,

“” অন্ত্রীশা,কি হয়েছে তেমার? তুমি ঠিক আছোতো?””

অন্ত্রীশার গালে হালকা করে থাপ্পড় দিতেই অন্ত্রীশা কিছুটা নড়ে উঠলো,অস্পষ্ট স্বরে বললো,

“” সব কেনএর উত্তর হয় চুমুবাবু! আপনি আমাকে ভুল বুঝাচ্ছেন!””

পালক অন্ত্রীশাকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে হাতের তালু মালিশ করতে করতে বললো,

“” তোমার তো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বৃষ্টিতে ভেজার কি দরকার ছিলে? উফ! হাতটা এতো ঠান্ডা হয়ে আছে কেন?””
“” আমাকে বন্ধুও বানাবেননা তাও এতো অস্থির হচ্ছেন? বন্ধু বানালে না জানি কত অস্থির হতেন। আর বউ ভাবলে কি করতেন?””
“” এসব আজেবাজে কথা বাদ দাওতো। তোমার তো কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। নিশ্বাস নিতেও কি কষ্ট হচ্ছে?””

পালকের কথার জবাব দেওয়ার শক্তিটুকুও আর পাচ্ছেনা অন্ত্রীশা। কিন্তু তার যে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এই প্রথম উনি তাকে প্রশ্ন করছেন,নিজের ইচ্ছেই কথা বলছেন।

পালক অন্ত্রাীশাকে ছেড়ে পায়চারী শুরু করে দিয়েছে। কি করবে সে? ওর বড় কিছু হয়নি তো? ও কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে? কথা বলছেনা কেন? আমি কি কাউকে ডাকবো? কিন্তু কাকে ডাকবো?

অন্ত্রীশার সাদা জামাটা ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে,শরীরের সাথে মিশে গেছে। মাথার চুলগুলোও ভিজে গলার সাথে অগোছালেভাবে ল্যাপ্টে আছে। এই জ্বরের মধ্যে এই অবস্থায় থাকলেতো শরীরের তাপমাত্রা হুড়হুড় করে বেরে যাবে। জামাটা চেন্জ করা দরকার! অন্ত্রীশাতো কথাই বলতে পারছেনা কিভাবে চেন্জ করবে? তাহলে কে করে দিবে? অনিকশাকে ডাকবো? না না ওকে ডাকা যাবেনা! ওর আম্মুকে ডাকবো? কিন্তু উনি যদি বুঝে যান আমাদের বিয়ের সম্পর্কটা অন্যদের মতো সাজানোনা। কষ্ট পেলে? উনাকে কেন কষ্ট দিতে যাবো? উফ! তাহলে কাকে ডাকবো? টেনশনে মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে পালকের।

যে মেয়েটাকে বউয়ের স্বীকৃতি দিতে পারবোনা সে মেয়েটার জামাতে হাত দেওয়া কি ঠিক হবে? পালক আর কিছু ভাবতে পারছেনা। সব ভাবনা দুরে ঠেলে অন্ত্রীশার গলায় পেচানো ভেজা ওড়নায় হাত দিলো!

চলবে

#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (১০)

অন্ত্রীশার সাদা জামাটা ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে,শরীরের সাথে মিশে গেছে। মাথার চুলগুলোও ভিজে গলার সাথে অগোছালেভাবে ল্যাপ্টে আছে। এই জ্বরের মধ্যে এই অবস্থায় থাকলেতো শরীরের তাপমাত্রা হুড়হুড় করে বেরে যাবে। জামাটা চেন্জ করা দরকার! অন্ত্রীশাতো কথাই বলতে পারছেনা কিভাবে চেন্জ করবে? তাহলে কে করে দিবে? অনিকশাকে ডাকবো? না না ওকে ডাকা যাবেনা! ওর আম্মুকে ডাকবো? কিন্তু উনি যদি বুঝে যান আমাদের বিয়ের সম্পর্কটা অন্যদের মতো সাজানোনা। কষ্ট পেলে? উনাকে কেন কষ্ট দিতে যাবো? উফ! তাহলে কাকে ডাকবো? টেনশনে মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে পালকের।

যে মেয়েটাকে বউয়ের স্বীকৃতি দিতে পারবোনা সে মেয়েটার জামাতে হাত দেওয়া কি ঠিক হবে? পালক আর কিছু ভাবতে পারছেনা। সব ভাবনা দুরে ঠেলে অন্ত্রীশার গলায় পেচানো ভেজা ওড়নায় হাত দিলো!

ওড়না চেপে ধরতে গিয়েও ধরতে পারছেনা পালক। এক অপরাধবোধ তাকে খুব করে পেচিয়ে ধরছে। এভাবে কখনো অন্য একটা মেয়ের গলা থেকে ওড়না খুলতে হনে সেটা কি সে কখনো ভেবেছিলো? না ভাবেনি। যার ওড়নায় হাত দিতে গিয়েই হাত কেঁপে উঠছে তার জামাটা সে কিভাবে খুলবে? এতো কেন বিবেক নাড়া দিয়ে উঠে আমার? ও তো আমার বউ হয় তবুও এতো কেন এতোটা অসস্থি আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে? তবে কি শুধু সম্পর্কের নামই সব কিছু নয়? সম্পর্কের টানটা ফুটে উঠতে দুজনের মধ্যে অনুভূতিটাও খুব জরুরী? আচ্ছা ওর জায়গায় যদি পত্রীকন্যা হতো? তাহলেও কি আমার ভেতরটা এমন হাজারও তুচ্ছ প্রশ্নের সম্মুখীন হতো? না হতো না,কখনোই না। ও তো আমার ভালোবাসার মানুষ হতো!

পালক চোখটা বন্ধ করে অন্ত্রীশার ওড়নাটা খুলার চেষ্টা করতেই ওর হাতটা চেপে ধরে অন্ত্রীশা!

“” আমি হুশে আছি,এখনো বেহুশ হয়নি!””

অন্ত্রীশার ঠোঁট কেঁপে উঠা কথায় পালক দ্রুত চোখ মেলে ফেললো। ওর চোখে চোখ পড়তেই অন্ত্রীশা আবার বলে উঠলো,

“” এমনভাবে ছুচ্ছেন যে,আপনার কাছে নিজেকে পঁচা নর্দমার কীট মনে হচ্ছে। আমার শরীরটাকি এতোটাই নগন্য? ছুলে আপনার হাত পঁচে যাবে? দুর্গন্ধ বের হবে?””

অন্ত্রীশার কথার পিঠে পালক কি বলবে বুঝতে পারছেনা। নিজেকে এতো ছোট করে বলছে কেন? আমি কি ওসব ভেবেছি? যাকে ভালোবাসিনা সে বউ হলেই কি সবকিছুর অধিকারীনী হয়ে যাবে? নাকি তার কাছে নিজের সবকিছুর অধিকার নিয়ে নিতে হবে? অন্যদের কাছে বিয়ে মানে কি আমি জানিনা। কিন্তু আমার কাছে বিয়ে মানেই শরীরকে ভোগ করা নয়। একজন নারীর শরীরের প্রতিটা অঙ্গে লুকিয়ে আছে হাজারও অনুভূতি। যা সম্পুর্নভাবে অনুভব করার জন্য প্রয়োজন দুপক্ষের অসীম ভালোবাসার সম্মতি!

“” আমাকে উঠতে একটু হেল্প করবেন প্লিজ? আমি নিজেই চেন্জ করতে পারবো। আমি চাইনা আমাকে ছুয়ে আপনি ভয়াবহ পঁচা রোগে আক্রান্ত হোন!””

কারো অনুরোধের পেছনেও যে এমন তাচ্ছিল্য থাকতে পারে তা পালকের জানা ছিলোনা। সে কোনটাকে গ্রহন করবে,অনুরোধ নাকি তাচ্ছিল্য?

“”তুমিতো ঠিকমতো কথাও বলতে পারছোনা। চেন্জ করবে কিভাবে?””
“” দুর্বলতা মেয়েদের প্রধান বৈশিষ্ট হলেও কঠিন মুহুর্তে তারা দুর্বলতাকে বশ করে, নিজেকে কঠিন হতে কঠিনতর রুপে সাজিয়ে বিজয় লাভ করে!””

অন্ত্রীশার এক একটা কথা পালকের পশম দাড় করিয়ে দিচ্ছে। ও কি ইচ্ছে করেই আমাকে অপমান করছে নাকি অন্য কিছু বুঝাতে চাচ্ছে?

“” প্লিজ!””

পালক অন্ত্রীশাকে উঠিয়ে বসিয়ে দিতেই ও বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে পড়লো। উঠতেই মাথাটা ঝাকি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার উপরের ভাগ আর নিচের ভাগ দুভাগ হতে চাচ্ছে। চোখটা ঝাপসা হয়ে অন্ধকার হয়ে আসতেই অন্ত্রীশা আবার বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো।

“” তুমি ঠিক আছো তো?””

অন্ত্রীশা ছলছল নয়নে পালকের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখ দিয়েই পালককে বলতে চাচ্ছে, ঠিক নাই আমি,একটুও ঠিক নেই। আপনি কি সেটা বুঝতে পারেননা??

অন্ত্রীশা মনে সাহস নিয়ে আবার উঠে দাড়ালো। ওয়াড্রভ থেকে একটা সুতির জামা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। পুরো শরীরটা কেঁপে কেঁপে তাকে বুঝাচ্ছে সে কতটা দুর্বল। কিন্তু এই মুহুর্তে সে দুর্বল হতে চাইনা। আর এই মানুষটার সামনে তো নাই।

অন্ত্রীশা নিজের জামাটাকে আকড়ে ধরেই ধীর পায়ে এগুচ্ছে। নিশ্বাসগুলোর গরম তাপ নিজেই অনুভব করছে। কয়েক কদম এগুতেই অন্ত্রীশার পায়ের কাঁপনটা বেড়ে গেলো। চোখের সামনের সবকিছু আবার ঝাপসা গয়ে আসছে। অন্ত্রীশা মনে মনে নিজের দুর্বলতাটাকে প্রকাশ করতে না চাইলেও তার শরীরটা ঠিকই চাচ্ছে। অন্ত্রীশার মনের বিরুদ্ধে গিয়েই ঢলে পড়তে গেলেই পালক এসে জড়িয়ে ধরলো।

“” আমি বলছিলাম তুমি পারবেনা!””

পালক অন্ত্রীশার চোখে চোখ রেখে কথাটা বলতেই অন্ত্রীশার ভেতরটা তুফান বয়ে গেলো। এই মুহুর্তে পালককে খুব নিজের মনে হচ্ছে!

পালকের চোখে চোখ পড়তেই অন্ত্রীশা নিজের চোখদ্বয় বন্ধ করে নিয়েছে৷ ঐ চোখে সে কখনোই চোখ রাখবেনা। তাহলে যে তার ভেতরটা অনেককিছুই করতে চাইবে! অন্ত্রীশা চোখ বন্ধ করেই বললো,,

“” বলছি তো আমি পারবো। আপনি কি বুঝতে পারছেননা? ছাড়ুন আমাকে!””
“” জিদ করছো কেন? জিদ করলেই কি তুমি সব পারবে?””

অন্ত্রীশা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় বললো,

“” হুম! আমাকে পাড়তে হবে। সব পারতে হবে। আপনি আমাকে এভাবে ধরে আছেন কেন? নর্দমার কীটকে এভাবে ধরে থাকলেতো আপনার শরীরে ভয়াবহ পঁচা রোগ দেখা দিবে!””

এ পর্যায়ে পালকের ভীষন রাগ হচ্ছে। এতো তেতো কথা এই মেয়েটা বলে কিভাবে? দেখতে এতো মিস্টি অথচ কথা? চেহারার সাথে কথাগুলো কিছুতেই মানাচ্ছে না।

অন্ত্রীশা জোর করে ছুটার চেষ্টা করতেই ওকে সোজা করে দাড় করিয়ে নিলো পালক। কিন্তু ওর হাতদুটো অন্ত্রীশার বাহুর দিকে চেপে ধরে আছে। চোখটা অন্ত্রীশার দিকে তাক করা!

অন্ত্রীশা মেঝের দিকে তাকিয়েই পুনরায় কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,

“” ছাড়ুন আমাকে। আমি পার….””

অন্ত্রীশার কথা শেষ হওয়ার আগেই পালক ওর জামার পেছনে থাকা চেইনটা টান দিয়ে খুলে চিৎকার করে উঠলো,

“” আমি যে বলছি,তুমি পারবেনা। সেটা শুনতে পারছোনা? খুব জেদ দেখাচ্ছো আমাকে? আর একটা কথা বললে, তোমাকে তুলে নিয়ে খোলা বারান্দা দিয়ে ঢিল মেরে নিচে ফেলে দিবো। চুপচাপ এখানে দাড়িয়ে থাকবে। নড়লেই মাইর খাবে!””

পালকের ঘুম ভাংতেই বিছানাটা শুন্য পেলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো ৮ টা বেজে ১২ মিনিট। খুব বেশি সকাল তো হয়নি তাহলে ও উঠে গেলো কেন? ও কি সুস্থ হয়ে গেছে? কিন্তু কাল রাতেও তো ও বেশ ভালোই অসুস্থতাই ভুগেছে। শরীরের তাপমাত্রাটাও তো অত্যাধিক বেশি ছিলো। এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে সুস্থ হলো?? ধুর! আমি কেন এতো ভাবছি ওকে নিয়ে? ওর মনে হয়েছে ও উঠে গেছে তাতে আমার কি?

পালক আড়মোড় ভেংগে উঠে দাড়াতেই বিছানায় নজর আটকে গেলো একটা চেইনের উপর। অন্ত্রীশা যে জায়গাটায় শুয়ে ছিলো সেখানে একটা ছেড়া চেইন পড়ে আছে। সূর্যের আলোতে চিকচিক করে বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে সে সোনার তৈরী!

“” আমার শালীকে এতো বেশি অত্যাচার করা কি ঠিক হচ্ছে,ছোট ভাই?””

পালক ছেলে কন্ঠ পেয়ে পেছনে ঘুরতেই অরিদকে দেখতে পেলো। ঠোটে সৌজন্যমুলক হাসি এনে বললো,

“” মানে?””
“” ভরটা একটু কম ছাড়ো। শালীতো আমার ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছেনা।””

অরিদের কথার অর্থ পালক বুঝে উঠতে পারছেনা। কিসের অত্যাচার,আর কিসের ভরের কথা বলছেন উনি? আমি কখন ওকে অত্যাচার করলাম? ও কি সবাইকে এসবই বলে বেড়িয়েছে?

অরিদ পালকের কাছ ঘেষে এসে ওর কাধে হাত রেখে বললো,

“” মজা করছিলাম,ছোট ভাই! ব্রেকফাস্ট রেডি। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আবার বেশিক্ষন না খেয়ে থাকতে পারিনা!””

পালক আবার একটু হাসির চেষ্টা করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। এই লোকটাকে সে বিয়ের দিনই যে প্রথম দেখেছিলো তা নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে সামনাসামনি কথা হলো এই প্রথম। নিজের মধ্যে জড়তা কাজ করছে। এই তো সে ব্যক্তি যার জন্য সে তার পত্রীকন্যাকে হারিয়ে ফেলেছে।

“” পালক!””

পালক ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেলো। অরিদের দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অরিদ আবার ওর কাছে চলে আসলো।

“” তোমাকে একটাবার জড়িয়ে ধরি?””

অরিদের এমন অদ্ভুত কথায় পালক ওর দিকে অদ্ভুতভাবেই তাকিয়েছে। পালকের উত্তরের অপেক্ষা না করেই অরিদ ওকে জড়িয়ে নিলো।

অরিদের এমন ব্যবহারে পালক বেশ বিব্রত হচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তারও কি অরিদকে জড়িয়ে নেওয়া উচিত? কিন্তু এমন হুট করে জড়িয়ে ধরার কারন কি? এমন ও ত নয় তাড়া দুজন খুব পরিচিত। হ্যা অনিকশার স্বামী হওয়ার সুবাধে পালক ওকে চিনে কিন্তু তাদের মাঝে কখনো কথা হয়নি। তাহলে কোন সম্পর্কের টানে জড়িয়ে ধরেছে? অরিদের তো আমাকে চেনারও কথা নয়৷

পালককে খুব শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে অরিদ ধরা গলায় বললো,

“” তুমি আমাকে ভাই বলেই ডেকো। দুলাভাইতো অনি ডাকেই। তুমি নাহয় ভাই বলে ডাকলে!””
“” জ্বী!””

পালককে ছেড়ে ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো অরিদ। বেশ কিছুক্ষন কাটার পর ঠোটে হাসির রেখা টেনে বললো,

“” তোমার জন্য খাবার টেবিলে ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো!””

অরিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পালক। হাসি হাসি মুখটার জায়গায় একটা অভিমানের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলো পালক। কিন্তু কিসের অভিমান? ঠোটে হাসি থাকলেও চোখদুটো যে নোনা পানিতে চিকচিক করছিলো সেটাও খুব ভালো করেই নজরে পড়েছে পালকের। পালকের চোখেও কিছুটা পানি জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু কেন? তারও কি অভিমান হচ্ছে? নাকি ভালো লাগছে? লোকটা জড়িয়ে ধরার পর থেকে একটা নতুন সম্পর্ক সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সত্যিই অরিদকে সে বড় ভাই বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার তো রাগ উঠার কথা। এই লোকটিই তো তার পত্রী কন্যাকে তার থেকে কেড়ে নিয়েছে। তবুও কেন তার একটুও রাগ হয়নি?

“”মাথা ব্যথা কমেছে মামনি? খেতে হবেনা?””

লিয়াকত সাহেবের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে অন্ত্রীশা। চোখটা বন্ধ করেই বললো,

“” তোমার আদর খেয়েই তো আমার পেট ঢোল হয়ে গেছে। আবার কি খাবো,আব্বু?””

অন্ত্রীশার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন লিয়াকত সাহেব। বেশ কিছুক্ষন হাসির পর্ব শেষ করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“” আল্লাহ কোন মানুষদেরকে বেশি পছন্দ করেন, তা কি তুমি জানো,মা?””
“” যে ঠিকমতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে,আর ভালো কাজ করে।””

অন্ত্রীশার উত্তরে এবারও লিয়াকত সাহেব হেঁসে উঠলেন,তবে উচ্চস্বরে না।

“” তোমার উত্তর পুরোপুরি সঠিক হয়নি,মা। আল্লাহ ধৈর্যশীল মানুষকে সব থেকে বেশি পছন্দ করেন।””
“” সত্যি?””
“” হুম। আর আমি জানি আমার মেয়েও যথেষ্ট ধৈর্য্যশীল! তুমি তোমার ধৈর্য্য হারিয়োনা। দেখো আল্লাহ তোমার জন্য সব থেকে বেস্ট উপহারটা বেছে রেখেছেন। আর বেস্ট উপহারটা পেতে হলে তো তোমাকে অবশ্যই বেশি ধৈর্য্য ধরতে হবে। তুমি কি চাওনা বেস্ট উপহারটা নিতে?””

অন্ত্রীশা শোয়া থেকে উঠে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বাবারটা তার সবকিছু কিভাবে বুঝে ফেলে? বাবা,মা সম্পর্ক সৃষ্টির সময় কি তাদের মধ্যে আরেকটা ইন্দ্রীয় যোগ করে দেওয়া হয়? যার সাহায্যে উনারা সন্তানের না বলা কথাগুলো বুঝে ফেলে?

“” আমার আম্মাজান চুপ হয়ে গেলো যে?””

অন্ত্রীশা বাবাকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

“” আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধৈর্যশীল হয়ে দেখাবো,আব্বু। আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বেস্ট উপহারটাতো আমার চাই ই চাই।””

লিয়াকত সাহেব ঠোটে হাসি রেখেই বললো,

“” মনে হচ্ছে,তোমার পেটে ক্ষুদারা আবার হাজির হয়েছে?””

অন্ত্রীশাও হাসি হাসি মুখে বললো,

“” ঠিক বলেছো। তবে আমি তোমার হাতে আয়েশ করে খাবো৷ তোমার রুমে,ঠিক এই জায়গাটাতে বসে।””

অরিদ আর পালক পাশাপাশিই খাবার টেবিলে বসে আছে। দুজনেই চুপচাপ। অনিকশা আর মিসেস মনিরা খন্দকার টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছেন। কিছুক্ষন পরেই লিয়াকত সাহেব চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

অনিকশা, অরিদ আর পালকের সামনে নাস্তার প্লেট রেখে চলে যেতে নিলেই ওর হাত চেপে ধরে অরিদ।

“” কোথায় যাচ্ছো? এইখানটাই বসো।””

অরিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে অনিকশাকে ওখানে বসিয়ে পাশের চেয়ারটাতে নিজে বসে পড়লো।

অরিদ এমন জোর করে অনিকশাকে বসিয়ে দিলো যে এখন উঠতেও পারছেনা। এক পাশে অরিদ তো অন্যপাশে পালক। এভাবে দুজনের মাঝখানে বসে অনিকশা ঘামতে শুরু করেছে।

“” খাচ্ছোনা কেন?””

অরিদের কথায় অনিকশা পরোটা ছিড়ে মুখে পুড়তেই পালক পাশ থেকে বললো,

“” তোমার পাশে বসে নাস্তাতো করছি,কিন্তু তোমাকে বউ বলে ডাকতে পারছিনা। চোখের সামনে নিজের পত্রীকন্যার হাত অন্যজন ধরে আছে। এটা দেখার পরও কি আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে,পত্রীকন্যা?””

পালকের কথা শুনে অনিকশার খাবার মুখে আটকে গিয়েছে। বুকে জ্বালা ধরিয়ে কেঁশে উঠতেই পালক আর অরিদ একসাথে পানিভর্তি দুটো গ্লাস এগিয়ে ধরলো। কার গ্লাসটা সে নিবে? এমন পরিস্থিতে তাকে না পড়লেই কি হতোনা? অরিদের জোরকে পাশে রেখে কি সে উঠে যেতে পারতোনা??

অরিদ নিজের গ্লাসটা ফেরত নিয়ে নিজেই ঢকঢক করে পানি খেয়ে ফেললো। অনিকশা অরিদের এমন ব্যবহারে থ হয়ে গেলো।

অরিদ খালি গ্লাসটা টেবিলে রেখে অনিকশার দিকে চেয়ে নিচু স্বরে বললো,

“” তুমি বিব্রত হও এমন কোনো কাজই আমি করবোনা,অনি। পানিটা খেয়ে নাও!””

কিছুক্ষন পরেই শ্বশুড়বাড়ির উদ্দশ্যে পা বাড়াবে অন্ত্রীশা। আবার কবে আসবে কে জানে? ভাবতেই অন্ত্রীশার বুকে চাপা কষ্ট হচ্ছে। আব্বু,আম্মু,আপু,দুলাভাই সবাইকে খুব মিস করবে সে। খুব মিস করবে।

দুপুরের খাবার শেষ করে পালক বিছানায় নিজেকে মেলে দিয়েছিলো। হয়তো খুব টায়ার্ড ছিলো তাই চোখে ঘুম নেমে আসে। রাতেও তেমন একটা ঘুম হয়নি। নিজের রুম ছাড়া অন্য কোথাও সে ঘুমুতে পারেনা। তবে আতিশের সাথে সে মাঝে মাঝেই ঘুমিয়েছে। ওর বিছানাই এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করে পালক।

পালকের ঘুম ভাংগে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে। চোখ মেলে পাশ ফিরতেই অন্ত্রীশার দিকে চোখ আটকে গেলো। পাতলা মিস্টি কালারের জর্জেটের শাড়ী পড়েছে সে। দুহাত ভর্তি মিস্টি রঙের চুড়ি। চুড়ি হাতে দিয়ে মাথা আচড়ানোর ফলেই এতো শব্দ করছে। অন্ত্রীশার এমন সাজে বেশ অবাক হলো পালক। একটু পরেই তো এ বাড়ি ছেড়ে যাবে। কোথায় সে মন খারাপ করে বসে থাকবে তানা সাজুগুজুতে ব্যস্ত!

পালক অন্ত্রীশার থেকে চোখ সরাতে গিয়েও আবার থেমে গেলো। এবার চোখ আটকেছে অন্ত্রীশার শাড়ীর ভাজে লুকিয়ে থাকা পেটে!

“”বিয়ের পর তুমি যখন আমার সাথে রাগ করবে তখনি আমি টুপ করে শাড়ী পড়ে ফেলবো। পেট বের করে পড়বো। নাভীটাও বের করে পড়বো। আমি তো শুনেছি,মেয়েরা শরীর দেখিয়ে নাকি ছেলেদের যাদু করতে পারে। আমি নাহয় আমার মেদহীন পেটের মধ্যে থাকা গর্তহীন নাভী দেখিয়ে তোমার রাগ ভাংগাবো। কিগো তোমার রাগ ভাংবে তো? না ভাংলেও মিছেমিছি ভাংগাবে। নাহলে কিন্তু আমি ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিবো।”” এমনি হাজারও দুষ্টুমিষ্টু কথা দিয়ে সাজিয়ে কত চিঠি লিখেছিলো তার পত্রীকন্যা। আমিতো আজো রাগ করে আছি তোমার উপর। তাহলে তুমি কেন আমার রাগ ভাংগাতে আসছোনা,পত্রীকন্যা?

অন্ত্রীশা আয়নায় পালকের চেয়ে থাকা দেখে বেশ আনন্দিত হচ্ছিলো। একটু দুষ্টুমীর বাহানা টুপ করে শাড়ীটা টেনে পেট ঢেকে ফেললো। এভাবে পেট ঢেকে ফেলায় পালকের ভাবনাও কেটে গিয়েছে। কিছুটা লজ্জাবোধ নিয়েই চোখটা সরিয়ে ফেললো।

অন্ত্রীশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে হাটা ধরতেই পালক বলে উঠলো,,

“” তুমি আর কখনো শাড়ি পড়বেনা অন্ত্রীশা। যাও এখনি এটা চেন্জ করে আসো!””

পালকের এমন কথায় অন্ত্রীশা থেমে গেলো। বড় বড় পা ফেলে পালকের ধারে এসে দাড়িয়েছে। কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে এসে পালকের চোখে চোখ রেখে বললো,

“” কেন পড়বোনা?””
“” আমি বলছি তাই!””

অন্ত্রীশা এবার তার ছোট ছোট চোখগুলো বড় বড় করে ফেললো। মুখে রাগ এনে পালকের দিকে আরেকটু ঝুকলো,,,

“” আপনি বললেই আমায় শুনতে হবে? কেন শুনবো আমি? কে হোন আপনি? আপনি কি আমার কিছু হোন? নাকি আমি আপনার কিছু হয় যে আপনার কথা আমায় পালন করতে হবে। আপনার হুকুম আমাকে মানতে হবে। আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে বলে কি আমি আপনার ক্রীতদাসী হয়ে গেছি? না শুনলে আমাকে মারবেন? কি দিয়ে মারবেন? চাবুক দিয়ে??””

অন্ত্রীশার এমন রাগ ঝরানো কথায় পালককেও রাগিয়ে দিলো। অন্ত্রীশাকে টেনে বিছানায় ফেলে দিয়েছে। ওর উপর উঠে ওর বাহুজোড়া চেপে ধরে বললো,

“” আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। তুমি শাড়ী পড়বেনা মানে পড়বেনা।””
“” ১০০ বার পড়বো,১০০০ বার পড়বো,১০০০০০ বার পড়বো। শুনবোনা আপনার কথা আমি,কি করবেন আপনি?””

অন্ত্রীশার আগুন ঝরানো চাহনি যেন পালককে পুড়িয়ে দিচ্ছে৷ পারছেনা সে চোখে চোখ রাখতে। তবুও জোর করে তাকিয়ে রইলো।

“” বলছেননা কেন? কি করবেন আপনার হুকুম না মানলে?””

পালক অন্ত্রীশার কথার উত্তর না দিয়েই নিজের ডান হাতটা ওর শাড়ীর কুচিটা খামচে ধরলো। অন্ত্রীশার চোখে চোখ রেখেই শাড়ীর কুচি টেনে খুলে ফেললো!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে