দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৭

0
865

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৭
#Arshi_Ayat

আজ দু’দিন ধরে বেশ গরম পড়ছে।আবহাওয়া বার্তায় ঝড়বৃষ্টির পূর্ভাবাস থাকলেও এখনো হয় নি।তবে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান সেই সাথে ভ্যাপসা গরম তো আছেই।তবে আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে।আকাশ গুড়গুড় করে ডাকছে।বাতাস হচ্ছে বাইরে।বিদ্যুৎ নেই।ঘর অন্ধকার হয়ে আছে।এখন আনুমানিক রাত সাড়ে বারোটা হবে।আধঘন্টা আগে অহর্নিশ এসেছিলো অহির ঘরে কিন্তু অহিকে ঘুমন্ত ভেবে হতাশ হয়ে চলে গিয়েছিলো।দুইদিন ধরে অহি ওকে এড়িয়ে চলছে।যেমন আগে সকালে উঠে কথা হতো কিন্তু এখন হয় না ও হয়তো রুমে থাকে না, নাহয় ঘুমিয়ে থাকে।আবার সারাদিনে ফোন দিলেও ধরে না।রাতে আসার আগেই ঘুমিয়ে যায়।অহর্নিশ বুঝতে পারছে খুব সুক্ষ্ম ভাবে অহি ওকে এড়িয়ে চলছে।ভেবেছিলো আজ একটু হলেও কথা বলবে কিন্তু আজও ঘুমিয়ে গেছে।এদিকে অহর্নিশ যাওয়ার পর অহি বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাড়িয়েছে।আজ বাইরের আবহাওয়া আর মনের আবহাওয়া একরকম।দুদিকেই ঝড় হচ্ছে।একটা ঝড় গোপনে,আরেকটা প্রকাশ্যে!

ঝড়বৃষ্টি বেশিক্ষণ হয় নি।কিছুক্ষণ পরপরই গর্জে উঠছে মেঘ।অহি ঘর থেকে বেরিয়ে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ছোয়ার অভিপ্রায়ে ছাঁদে চলে গেলো।বৃষ্টির জমে থাকা ঠান্ডা পানিতে অহির পা ভিজলো।সে একটু একটু করে এগিয়ে গেলো রেলিঙ এর কাছে।ঠান্ডা মিহি একটা বাতাস ওর শরীর ছুয়ে মিলিয়ে গেলো।বাতাসে ঝড়ের স্বচ্ছ,স্নিগ্ধ একটা গন্ধ!রেলিঙ ঘেঁষে দাড়িয়ে সুবৃহৎ অন্তরীক্ষের পানে বৃথাই চেয়ে রইলো।অনেক্ক্ষণ!কতক্ষণ সেটা অহি জানে না।দৈবাৎ মনে হলো কেউ ওর পিছনে দাড়িয়ে আছে।কারো উপস্থিতি জানান দিচ্ছে খুব কাছ থেকে।অহি ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়ালো।অস্পষ্ট অনমিশায় সামনের সুবর্ণকেশী যুবকটিকে চিনতে তার বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না।তাকে রেলিঙের সাথে দু’হাতে আবদ্ধ করে দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করে রেখেছে ছেলেটি।অন্ধকারে চাহনীর গভীরতা পরিমাপ করা না গেলেও সে যে দৃষ্টির তীক্ষ্ণ ফলা বিঁধিয়ে দিতে চাচ্ছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।ক্ষণিককাল কারো মুখেই বুলি ছিলো না।নিরবতা বিরাজ করছিলো শুধু!নিরবতার লাগাম টেনে অহর্নিশ ক্ষীণ অথচ আকুল কন্ঠে বলল,’আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না?বেশি না এই একটু!বাসবে না অহি?

এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে অহি?যেখানে সে নিজেই ভালোবাসার সুবিশাল সমুদ্রের তীব্র
জোয়ারে প্রতিনিয়াত ভাসছে!ডুবছে!

নিশ্চুপ পরিবেশ সেই সাথে মেয়েটিও।ছেলেটি ব্যগ্রচিত্তে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য।কিন্তু উত্তর তো মেলে না!ছেলেটি পূর্ববৎ ব্যাকুল স্বরে বলল,’বলো!বলো অহি!আমায় একটু ভালোবাসবে না?’

ধারালো ছুরির ফলার মতো ছেলেটির কন্ঠস্বর মেয়েটির বক্ষঃস্থল ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে!নয়নের আঙিনায় জলে ভরাট হয়ে গেছে।শির নিচু করে সেটা লুকানোর বৃথা চেষ্টা চলছে।কিন্তু হলো না।শুষ্ক কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনতা পানির রেখা।ছেলেটি মেয়েটির চিবুক স্পর্শ করে শির উঁচু করলো।অতিযত্নে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো মুছে দিলো।এটাই হয়তো দরকার ছিলো।তাইতো মেয়েটি নিজেকে সর্বস্ব দিয়েও ধরে রাখতে পারলো না।দৈবাৎ হরিণীর বেগে ঝাপিয়ে পড়লো ছেলেটার বুকে।শীতল হলো বক্ষ!শান্তি মিললো প্রাণে।বাহুডোরে আবদ্ধ হলো মেয়েটি।কিছুক্ষণ!তারপর অনেক্ক্ষণ!

অহি এখনো কাঁদছে।অহর্নিশ বাঁধা দিচ্ছে না শুধু শক্ত করে আবদ্ধ করে রেখেছে ওকে যেনো নিভৃতে কাঁদতে পারে কেউ যাতে ওকে বিরক্ত না করে।অহর্নিশ শান্ত কন্ঠে বলল,’নিজের মধ্যে এতো কষ্ট লুকিয়ে রেখে তুমি আবার আমাকেই কষ্ট দিতে চাইছিলে?কেনো অহি?কেনো এই দূরত্ব?ভালোবেসে ও কেনো স্বীকার করছো না?কেনো ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছো?বলে দাও তুমি শুধু আমারই!’

অহি মাথা উঁচু করে অহর্নিশের আঁখিতে আঁখি মেললো।আর্দ্র কন্ঠে বলল,’আমাদের দেখা অসময় কেনো হতে হলো বলুন তো?কেনো এভাবেই আমাদের দেখা হতে হলো?কেনো কোনো একটা সোনালী রাঙা বিকেলে হঠাৎ করে আপনার আমার দেখা হলো না?কেনো স্বাভাবিক ভাবে আমি আপনাকে পেলাম না?’ বলতে বলতেই অহির কন্ঠরোধ হলো!কান্নার দমকে কথা বলতে পারলো না আবারও অহর্নিশের বুকে এলিয়ে পড়লো।কথাগুলোয় কতোট অসহায়ত্ব লুকিয়ে আছে তা কেবল ওরাই আচ করতে পারছে।পরিস্থিতি মানুষকে এতোটাই অসহায় বানিয়ে দেয় তখন চাইলেও কিছু করা যায় না।

পাশাপাশি দু’টো মানুষ বসে আছে।একটু আগেই অহি নিজেকে স্বাভাবিক করে অহর্নিশের পাশে বসেছে।আজ নিশ্চুপ অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেয়েছে।এতোটা সময় কথা খুব অল্পই হয়েছে।অহি জমাট বাধা কান্নার জন্য কথা বলার নিমেষমাত্রও পায় নি।
——————-
কাল রাতে ঘুমাতে দেরি হওয়ায় আজ উঠতেও দেরি হয়েছে।তবে তাতে কিছু ক্ষতি নেই।কারণ আজ রবিবার!রবিবার মানেই আরাম আর আনন্দ!সপ্তাহের কর্মব্যস্ততার সব ক্লান্তির অবসান হয় মাত্র এই একটি দিনে।আজ সেই সাপ্তাহিক কাঙ্খিত দিন।আজ সকাল ১১ টা পর্যন্ত অহর্নিশ ঘুমিয়ে কাটিয়েছে আর এদিকে অহি দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে তবে অহর্নিশের মতো অতোও দেরি হয় নি সে সাড়ে আট’টায় উঠেছে।

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অহিকে কল দিলো।একই বাড়িতে থেকেও ফোনে কথা বলতে হয়।কপাল বলে কথা আছে না!অহি প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ করলো।

‘খেয়েছো?’

‘হ্যাঁ।আপনি?’

‘খাচ্ছি।আচ্ছা শোনো তুমি বিকেলের দিকে একটু বের হয়ো তো!’

‘কেনো?’

‘কোথাও একটা যাবো।’

‘কোথায়?’

‘সারপ্রাইজ!’

অহি মুখট বাকা করে বলল,’এই কি ফন্দি আটছেন বলুন তো?লক্ষ্মণ তো ভালো ঠেকছে না।আমাকে এভাবে ডাকছেন কেনো?কোথায় নিয়ে যাবেন?’

‘কাজি অফিসে।আর কয়দিন এভাবে সিঙ্গেল থাকবো বলো?একই বাসায় থেকেও ফোনে কথা বলবো!ডুয়েল খাটে সিঙ্গেল ঘুমাবো!জানো ক্ষণে ক্ষণে তোমার অভাববোধ করছি।’

অহি ঠাট্টা মেশানো কন্ঠে বলল,’তাই নাকি ডাক্তার সাহেব!’

‘হ্যাঁ তাই বেগম সাহেবা।’

অহি শব্দহীন হাসলেও ফোনের ওপাশ থেকে অহর্নিশ বুঝে ফেললো।অতঃপর আরো দু’একটা কথা বলে ফোন রেখে দিলো দু’জনই।

দুপুরের খাওয়া শেষে পূর্ব চৌধুরী রুমে গেলেন বিশ্রাম করতে আর মিসেস অনামিকা শপিংএ গেলেন।এটাই সুযোগ দুজনেই বেরিয়ে গেলো তবে আগে পরে!অহি আগে বের হলো তার দশমিনিট পর অহর্নিশ বের হলো।অহর্নিশ যাবার সময় পূর্ব চৌধুরীকে বলে গেলো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কিন্তু অহি কাউকেই কিচ্ছু বলল না।এই বাড়িতে তাকে কৈফিয়ত দিতে হয় না।

অহি আর অহর্নিশ গ্রামের রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাটছে।কথা হচ্ছে না তবে একটু পর পরই একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।হাসির কারণটা অজানা!ওরা হাঁটতে হাঁটতে খালপাড়ে পৌঁছে গেলো।এই খালটা অনেক বড়ো।এর এইপাড় থেকে ওইপাড়ে যেতে একটা বাঁশের পোল দেওয়া হয়েছে।ওইপাড়ের জায়গাটা ভীষণ সুন্দর।অহর্নিশের ইচ্ছে অহিকে নিশে ওইপাড়ে ঘুরে আসবে।কিন্তু অহি বাশের পোলটা দেখেই ভীত চোখে অহর্নিশের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিললো।আর করুণ কন্ঠে বলল,’পার হওয়ার কি আর কোনো উপায় নেই?’

‘আছে তবে দেড়ঘন্টার মতো লাগবে।এটাই শর্টকার্ট।’

‘তাহলে ওইপাড়ে না যাই।এই জায়গাটাই অনেক সুন্দর।এখানে থেকে একটু ঘুরে চলে যাই।’

‘না অহি।আমরা ওইপাশে যাবে।এইপাশে থাকাটা রিস্ক।আমার অনেক পরিচিত আছে।দেখলে সমস্যা হবে।’

অহি দাঁত কটমট করে বলল,’আগে বললেই পারতেন আমাকে পানিতে চুবিয়ে মারার ইচ্ছে আপনার।’

অহর্নিশ দাঁত বের করে হেসে বলল,’আগে বললে তুমি আসতে না।আচ্ছা সমস্যা নেই আমরা নৌকা দিয়ে পার হবো।’

অহি খুশি হয়ে বলল,’আচ্ছা তাহলে চলুন।’

অহর্নিশ ঘাট থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে সেখানে সাবধানে অহিকে নিয়ে উঠলো।অহি তো নৌকাতে উঠেই কাপাকাপি শুরু।বারবারই আতংকিত গলায় বলছে,’নৌকা ডুবে যাবে।আমরা পড়ে যাবো তো!’

অহর্নিশ অহির কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে ওকে নিশে নৌকায় বসলো প্রথমে নিজে বসলো তারপর ওকে নিজের সামনে বসিয়ে পিছন থেকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে কানেকানে ফিসফিস করে বলল,’এখন আর পড়বে না।আমি আছি তোমার কাছাকাছি।’

ভরসা পেলো অহি।এখন আর ভয় লাগছে না।অহি বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিলো।নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো লাগছে।একটা মুগ্ধতা কাজ করছে মনজুড়ে।অহি একহাত খালের পানিতে ছোয়াল।কি স্বচ্ছ!ঠান্ডা,নির্মল পানি।ছুঁতেই ভালো লাগার শিহরণ বয়ে যায়।

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে