দৃষ্টিভ্রম পর্ব-১৭

0
571

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১৭||

শ্বশুর বাড়িতে এসে দ্বিতীয় বারের মতো পা রাখে শতরূপা। পাঁচ বছর আগের সেই দিনটার কথা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠে। সেদিন তার সাথে যে মানুষটা ছিল সেই মানুষটা আজও সাথে আছে। মাঝখানে কয়টা দিন অশান্তিতে গেলেও আজ সে অনেক সুখী। শতরূপাকে ঘরে না তোলার কারণে আদিয়ানও বাড়িতে আসতো না। তাও মাঝেমধ্যে আসতো কেবল বাবা আর বোনকে দেখার জন্য। হাম্মাদের মা রোকসানা মির্জাকে সে কখনো মা বলে ডাকতে পারেনি। সৎ মা হলেও তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন ছেলে-মেয়েকে মায়ের আদর দেওয়ার। নীতিকে আদর দিয়ে ভোলাতে পারলেও আদিয়ানকে পারেননি। বাবার উপরও আদিয়ানের অনেক রাগ ছিল। কেবল সন্তানের জন্য তার মাকে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছেন এটা ভাবলেই তার হাম্মাদের প্রতি একটা ঘৃণার জন্ম নেয়। কখনো ভালোবাসতে চেষ্টা করলেও কোনো না কোনোভাবে তাদের ঝগড়া বেধে যেত। যার কারণে সমাজের সামনে তাদের সম্পর্কটা অনেক সুন্দর হলেও ভেতরে ভেতরে রাগ আর ক্ষোভে ভরা। আদিয়ানের মায়ের মৃত্যুর পর বাবার প্রতি রাগটা ধীরে ধীরে কমে আসে। মাকে আপন করতে না পারলেও ঘৃণা করে না। কিন্তু হাম্মাদের লোভ এবং চারিত্রিক দোষের কারণে সে তাকে সহ্য করতে পারে না।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে শতরূপা ড্রয়িংরুমে বসে আছে। নিজের বাড়িতে যে মেহমান হয়ে এসেছে সে। কপালের কী অদ্ভুত লিখন! আফতাব খন্দকারকে গিয়ে কাজের লোক খবর দেয় আদিয়ান এসেছে বলে। তিনি নিচে এসে চমকে উঠেন। উৎসবকে দেখতেই তার মনে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, “এটা কী আমার দাদু ভাই?”

শতরূপা মৃদুস্বরে বলল, “জি, বাবা।”

আফতাব খন্দকারের মুখে মুহুর্তেই হাসি ছড়িয়ে যায়। সে এক আনন্দের হাসি। উৎসবকে টেনে কোলে তুলে নেন। চোখে-মুখে আদর দিয়ে বললেন, “দাদু ভাই, আমাকে চিনতে পারছো? আমি তোমার দাদু।”

“দাদু!”, বলেই উৎসব চোখ বড় বড় করে তাকায়।

একদিনেই সে এতগুলো সম্পর্ক পেয়ে যেন দিশেহারা। চমকের পর চমক পাচ্ছে। মায়ের দিকে একবার তাকাচ্ছে তো তার দাদুর দিকে আরেকবার তাকাচ্ছে। কী ভেবে যেন তার কোল থেকে নেমে শতরূপার কাছে চলে আসে। আদিয়ান সোফায় বসে একনাগাড়ে ফোন টিপছে। নীতি উপর থেকে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।

“ভাইয়া, এতদিন পর! তোকে দেখার জন্য মনটা কেমন করছিল বোঝাতে পারব না রে। আমাকে দেখার ইচ্ছে বুঝি তোর করে না?”

আদিয়ান নীতির দু’গালে হাত রেখে বলল, “পাগলী বোন আমার, তোকে না দেখে কী আমি থাকতে পারি? ভিডিওকলে তো প্রতিদিনই কথা বললি, তারপরেও এত অভিযোগ?”

“অবশ্যই, অবশ্যই। ভাবিকে একদিনও দেখিয়েছিস? এদিকে আমাদের ছোট উস্তাদ যে চলে এসেছে সে খবর একবারও জানিয়েছিস? আর ভাবি, তুমি কেমন গো! এত স্বার্থপর কেন?”, বলেই শতরূপার কাছে এগিয়ে আসে সে।

উৎসবকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খায়। শতরূপা আদিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিয়ান মৃদু হেসে জবাব দিল, “তোর ভাবিকে তো আমি মোবাইলই দিইনি। আমিই কথা বলতে নিষেধ করেছিলাম। আর আগে যদি বলে দিতাম তোর ছোট উস্তাদ চলে এসেছে তাহলে কী আজ এতবড় সারপ্রাইজ পেতি?”

“হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। তুই ভাবিকে নিয়ে রুমে যা। আম্মুউ, কই তুমি? দেখ আমাদের উস্তাদ চলে আসছে।”, বলতে বলতে নীতি মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

আফতাব সাহেব হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, “যাও মা, তোমার ঘরে যাও। আমি আমার নাতির কাছে যাই। সে যে আমাকে চিনতেই পারছে না। এই কে কোথায় আছিস, খাবারের আয়োজন কর। সবাইকে খবর দে। আজ বাড়িতে উৎসব হবে, আনন্দ হবে।”

আদিয়ান শতরূপার হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে যায়। পাঁচটা বছর পর আজ সে নিজের রুমে এসে পা ফেলেছে। যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এরপর থেকে কখনো বাড়িতে আসলেই রুমে আসেনি।

“এটা তোমার রুম, মানে আমাদের রুম। তবে মাত্র কয়েক দিনের জন্য।”

শতরূপা আদিয়ানের কথাকে কানে নেয় না। পরের কথা সে এই মুহূর্তে ভাবতে চাচ্ছে না। বর্তমানটাকে উপভোগ করতে চাচ্ছে। রুমটা ঘুরেফিরে দেখতে লাগে। আদিয়ানের কতশত ছবি টানানো দেওয়ালের মধ্যে। কিছু কিছু ছবি দেখে হেসে দেয় সে। আদিয়ান এসে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগলো?”

শতরূপা তার একটা হাত আদিয়ানের গালে রেখে বলল, “একদম মনের মতো। এখানে থাকার সাধ অবশেষে পূরণ হচ্ছে আমার।”

নীতি হুট করে তাদের রুমে এসে ঢুকে। তাদের এই অবস্থায় দেখে বলল, “স্যরি স্যরি ডিস্টার্ব করে ফেললাম?”

আদিয়ান শতরূপাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল, “তোর ডিস্টার্বে কী আসে যায় ভূতনি?”

“ভাইয়া, একদম এভাবে বলবি না আমাকে। তোদের জন্য খাবার লাগিয়ে দিচ্ছি টেবিলে আয়।”, বলেই সে চলে যাচ্ছিল।

দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বলল, “বিগবি নাকি কাল আসছে ওই ঘসেটি বেগমকে নিয়ে। তোমরা তৈরি থেক। এবার কিন্তু ভেজাল একটা বড়সড় হবে।”

নীতি সিন্থিয়াকে ঘসেটি বেগম ডাকে। নিচে বাবার সামনে এমন ভাব নিচ্ছিল, যেন সে কিছুই জানে না। অথচ নীতি শুরু থেকেই সব জানে। শতরূপার আসল পরিবারের ভিত্তিতে হুবহু নকল একটা পরিবার দাঁড় করিয়েছিল। এসবের প্রধান চরিত্র সেই খুঁজে বের করেছি। আজকাল টাকার কাছে সব বিক্রি হয়। কিছু টাকা ফেলতেই কাজ হয়ে যায়। এখানে সামান্য অভিনয়ের জন্য শতরূপার বোন সাজিয়ে এনেছিল একজনকে। বিয়েতে তার বাবা মায়ের অনুপস্থিত থাকাটাও সেই নাটকের অংশ। নিজের আসল পরিবারকে সে এসবে টানতে চায়নি। তারা জানতে পারলে সমস্যা বেড়ে যেত। কারণ তারা সবাই জানে শতরূপার পাঁচ বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তবে হাম্মাদকে নিজের পরিবার সম্পর্কে যা বলেছি তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। শতরূপা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই উঠে এসেছে। এইসব কিছুর মধ্যে সত্য ছিল কেবল তার ফোনে বলা কথাগুলো। নিজের সত্যিকারের পরিবারের সাথেই সবসময় কথা বলেছিল।

আদিয়ান মৃদু হেসে জবাব দেয়, “তোর বিগবি যদি এই গল্পের ভিলেন হয় তবে আমি এই গল্পের নায়ক। ভুলে যাস নে আমি পেশায় একজন ক্রিমিনাল উকিল। বুদ্ধি আমার মাথায় নয়, শিরা দিয়ে দৌড়ায়।”

“সেজন্যেই তাকে এভাবে ঘোল খাওয়াতে পারলি। কিন্তু বিগবি কীভাবে এত সহজে ফেঁসে গেল রে?”

শতরূপা এগিয়ে এসে বলল, “আসলে শায়ান না থাকলে কাজগুলো এত সহজে হতো না। হাম্মাদের এমন মেয়ের সন্ধান ছিল যার কাছে সে উৎসবে দিতে পারবে। যে উৎসবকে সন্তানের মতো রাখবে। আর যখন আমি সেদিন ওই বাচ্চা মেয়ের সাহায্যের জন্য তার সামনে নিয়ে দাঁড়ালাম সেদিন সে ৯০% পটে গিয়েছিল। বাকিটা শায়ান সহজ করে দিয়েছে। বেচারা শায়ান, হাম্মাদকে আমার সামনে নিয়ে এসেছে। আমার ব্যাপারে সুপারিশ করেছে। অথচ সে জানতোই না, তাকে কীভাবে এই খেলার একটা প্রধান অংশ বানিয়ে নিয়েছি।”

কিছুক্ষণ থেমে আদিয়ানের দিকে তাকিয়ে সে আবার বলল, “আরেকটা মজার ব্যাপার জানো? হাম্মাদ শায়ানকে খুঁজে বের করেনি বরং আমরা শায়ানকে খুঁজে হাম্মাদের প্লেটে তুলে দিয়েছি। এমন একজনের প্রয়োজন ছিল যে আমাকে খুব ভালো করে না হলেও মোটামুটি ভালো চেনে। তখনই শায়ানের কথা মাথায় আসে। তাছাড়া সে তখন বেকার ছিল, চাকরির খুব প্রয়োজনও ছিল। হাম্মাদ ভেবেছে সে শায়ানকে ব্যবহার করছে আমাকে পাওয়ার জন্য অথচ শায়ানকে ব্যবহার করে আমরাই তার কাছে পৌঁছার রাস্তা করেছি। শায়ান এমনি এমনিই আমাকে পায়নি, আমিই তার সামনে বেচারি সেজে গিয়েছিলাম। যেভাবে বেচারি সেজে গিয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই বেচারি সেজে বেরিয়ে এসেছি। হাম্মাদ তার সম্পূর্ণ ঘরে সিসি ক্যামেরা সেটআপ করে রেখেছিল যাতে আমার সকল পদক্ষেপ সম্পর্কে সে জানতে পারে। তাই সে যা চেয়েছে আমি তাই দেখিয়ে গিয়েছি সবসময়। এমন অভিনয় করে গিয়েছি যাতে সে বুঝতেই পারে না যে, সে যেই আমাকে দেখছে সেই আমি তার দৃষ্টিভ্রম ছাড়া কিছুই নই।”

নীতি যেন আকাশ থেকে পড়ে। এতকিছু হয়ে গেল আর সে কিছুই জানে না। শায়ানের জন্য তার বেশ খারাপও লাগছে। কিন্তু এটা ভেবে ভালো লাগছে যে সবকিছুর পরে তাদের প্ল্যান সাকসেসফুল।

উদ্বিগ্ন স্বরে সে বলল, “তোমরা কত চালাক! তোমার কোনো বিপদ হয়নি তো ভাবি?”

“একটু-আধটু বিপদে না পড়লে কী চলে? তবে তোমার ভাইয়া সব সামলে নিয়েছে। সে সামনের একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া দিয়ে থেকেছে। সব সময় আমার উপর নজর রেখেছে।”

“কিন্তু একটা বিষয় এখনো বুঝতে পারলাম না। তোমার এই ট্রায়াংগেল বিয়ের কাহিনী কী?”

আদিয়ান আর শতরূপা একে অপরের দিকে তাকায়। দু’জনের মুখেই অদ্ভুত এক হাসি। ইচ্ছে করছে তাকে বলে দিতে কিন্তু এখনই এটা বলতে চায় না তারা৷ নীতি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। জবাবের আশা করছে সে৷

আদিয়ান নীতির মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “এটা সিক্রেট থাকুক তোর বিগবির এবং তোর ওই ঘসেটি বেগমের জন্য। এবার চল ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে।”

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে