দৃষ্টিভ্রম পর্ব-১১

0
570

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১১||

“বিয়ে করে আমার জীবনটাকে জাহান্নাম বানিয়ে এখন এমন দরদ কেন দেখাচ্ছেন মি. হাম্মাদ খন্দকার? এখন আর কী চান আমার কাছে? পরিষ্কার বলেই ফেলুন। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমি আপনার চাওয়া পূরণ করে দিব। বিনিময়ে আমাকে মুক্ত নিশ্বাস নিতে দেন। আপনি যেভাবে আমার ক্ষতি করেছেন আমি আপনার কোনো ক্ষতির কারণ হবো না কখনো এই বিশ্বাস রাখতে পারেন।”

হাম্মাদ এক হাতে পানির গ্লাস আর অন্য হাতে ওষুধ নিয়ে শতরূপার সামনে বসে আছে। রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করছে সে। কেউ যখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর রাগ দেখাতে পারে না তখন সে সব থেকে দুর্বল মনের মানুষকে বেছে নেয় তার সকল রাগ, কষ্ট তার উপর ঝেড়ে দেওয়ার জন্য। হাম্মাদের কাছে শতরূপা সেই দুর্বল মানুষ, যার উপর সে তার সকল রাগ ঝেড়ে দেয়।

“তুমি আমার কী জানো?”

ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে শতরূপা জিজ্ঞেস করল, “মানে!”

হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে হাম্মাদ বলল, “তুমি হলে আমার পোষা ময়না পাখি। আমি যা বলব, তুমি তাই তোমার মিষ্টি কণ্ঠে বলবে। রূঢ় কিংবা তেজি কণ্ঠ তোমার থেকে আমি কখনো আশা করি না।”

“আমি মানুষ সাহেব, আমারও আবেগ অনুভূতি আছে। কোনো দেয়াল নই যে যখন যেমন ইচ্ছে আঁচড় দিয়ে যাবেন আর সহ্য করে যাব।”

“খুব বেশি কথা শিখে গেছ দেখছি। কই তুমি তো এমন ছিলে না।”

“আপনি কী এমন ছিলেন, যেমন এখন আপনাকে অনুভব করছি আমি।”

হাম্মাদ তার দিকে মাথাটা হেলিয়ে বলল, “আমি এমনই ছিলাম। তুমি কেবল কোনো বইয়ের একটা অধ্যায় পড়েই সহজ মনে করতে পারো না। পুরো বইটা ধৈর্যসহকারে পড়া উচিত ছিল।”

“সুযোগটা কী দিয়েছিলেন?”

“কেউ কখনো কাউকে সুযোগ দেয় না, সুযোগ করে নিতে হয়। নয়তো নিজেরই বিপদ। এখন ওষুধটা খেয়ে নাও। নাহলে আমি জোর করেও খাওয়াতে পারব।”

শতরূপা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আমার উপর জোর কত খাটাবেন হাম্মাদ সাহেব? আপনার স্ত্রী কি রাগ করবেন না?”

ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকায় হাম্মাদ। শায়ান তাহলে সবকিছু বলেই দিল। এই দিনের জন্যই অপেক্ষায় ছিল সে। রহস্যের পর্দা নিজ থেকে তুলে দিলে মজাটা আর থাকে না। রহস্য অন্যের মাধ্যমে উদঘাটন হলে তবেই রোমাঞ্চকর হয়। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে হাম্মাদ। জীবনটা বেশ একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল এখন বেশ আনন্দমুখর হয়ে উঠেছে৷ দারুণ কিছু অনুভব করছে।

“শায়ান তাহলে এতদিন পর কল করল তোমায়। বেচারা কত চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিফলে গেল তার সব চেষ্টা। আচ্ছা তুমি কী জানো, সে তোমাকে ভালোবাসে?”

সে যেন আকাশ থেকে পড়ে। শায়ানের সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কখনো বুঝতেই পারেনি এমন কোনো আশা ছিল। সেও তো কখনো মুখ ফুটে বলেনি তাকে। ভালোই যদি বাসতো তাহলে বলল না কেন!

“ভাবনায় পড়ে গেলে? কেন তোমাকে সেটা বলেনি এটাই ভাবছো তাই না? দেখলে তো আমি কত স্মার্ট! তোমার মনের ভেতর কী চলে তাও আন্দাজ করে নিতে পারি।”

“শায়ান আমাকে ভালোবাসে!”

“হ্যাঁ সে তোমাকে ভালোবাসে। আর সে কথা কখনো বলেনি এর কারণ আমি। আমি তার উপর এত দয়া করেছি যে, যদি আমি চাইতাম তাহলে সে আমার জন্য জীবনের অন্যতম মূল্যবান জিনিসটাও দিয়ে দিত। তাই তো সুযোগটা কাজে লাগালাম। যেদিন দেখলাম সে তোমাকে প্রপোজ করবে, সেদিনই আমি তাকে ডেকে নিজের মনের কথা বললাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি এই কথা শুনে সে পেছনে সরে যায়।”

শতরূপা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “ভালোবাসেন আমাকে! সত্যিই?”

“এই প্রশ্নের উত্তরটা নিশ্চয়ই অজানা নয়।”

“আমাকে কেন বিয়ে করেছেন বলবেন প্লিজ? আমার কিচ্ছু জানার নেই। শুধু এই প্রশ্নটার উত্তর দিন।”

“আমি তোমার জীবনে রহস্য মানব। আর রহস্য মানবেরা কখনো নিজের রহস্য ফাঁস করে না। সেটা জানতে হলে তোমাকে গোয়েন্দা হতে হবে। উদঘাটন করতে হবে। এতে ব্যপক আনন্দ। একবার চেষ্টা করেই দেখ।”

“রহস্যের বাঁধন বুনতে বুনতে নিজেকেই না হারিয়ে ফেলেন। ওই যে একটা কথা বলে না, যার জন্য গর্ত খুঁড়লেন সেই গর্তে নিজেই পড়লেন।”

হো হো শব্দে হেসে উঠে হাম্মাদ। সে আজ অবধি কখনো কারো কোনো ফাঁদে পা দেয়নি। তাকে আটকানো কঠিন। এত সহজে ধরা দেওয়ার পাত্র সে নয়। হাতের টেবলেটটা ডাস্টবিনে ফেলে চলে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলে, “গেট রেডি ফর এ নিউ সারপ্রাইজ বেবি।”

হাম্মাদ চলে যেতেই চোখের জল মুছে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে সে। শায়ান তাকে ভালোবাসতো! কথাটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। শায়ানকে যদি বিয়ে করতো তাহলে জীবনে অভাব পেলেও হয়তো সে একজন সুখী মানুষ হতে পারতো। সুখের জন্য তো খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। তবে অভাব মেটাতে ঠিকই টাকার প্রয়োজন হয়। এই যুগে যার যত টাকা তার ততই ক্ষমতা। হাম্মাদ যেমন টাকার জোরে আজ কতকিছু করছে।

ওষুধ না খেয়েই শুয়ে পড়ে শতরূপা। গভীর রাতে রুমে কারো উপস্থিতি অনুভব করছে সে। কিন্তু মনে হচ্ছে চোখ খুলে তাকালেই সে নাই হয়ে যাবে। তবু সে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকায়। লাইট জ্বালিয়ে দেখে কিন্তু রুমে কেউ নেই। দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। কিন্তু সে তো দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় তিনটার কাটা ছুঁই ছুঁই করছে। দরজা খুলে বাইরে বেরোয়। দুইতলা বিশিষ্ট এই ফ্লোরে কাজের দুইজন লোকসহ মাত্র চারজন মানুষ। হঠাৎ যেন কারো কান্না শুনতে পায় সে। বুকটা ধক করে ধরে আসে। এই রাতে বাচ্চাদের মতো কে কাঁদছে। এখানে তো কোনো বাচ্চা নেই। নাকি সে স্বপ্নে উলটা পালটা দেখছে। নিজেকে চিমটি কেটে দেখে না এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে শব্দ অনুসরণ করে হাম্মাদের রুমের দিকে যায়। গলার পানি শুকিয়ে এসেছে তার। বুকে সাহস রাখার চেষ্টা করে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। হ্যাঁ ভেতর থেকেই আওয়াজ আসছে। কিন্তু এখন হাসির আওয়াজ। কিছুক্ষণ আগে কান্নার আওয়াজ এখন হাসির শব্দে পরিণত হলো কীভাবে! হাম্মাদের রুমে কী কেউ আছে! নাকি সবই তার কল্পনা মাত্র। শব্দ না করে দরজায় কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা দেয় কিন্তু ভেতর থেকে লাগানো।

কোনো উপায় না দেখে রুমে ফিরে আসছিল তখনই পেছন থেকে ডাক পড়ে, “এত রাতে আমার রুমের বাইরে পায়চারি করছো কেন? আমার গোয়েন্দাগিরি করছো? নাকি প্রেমে-টেমে পড়ে গেলে?”

আৎকে উঠে দাঁড়ায় সে। বুকে থুথু ছিটিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। খালি গায়ে কেবল একটা টাউজার পরে দরজায় হেলান দিয়ে আছে হাম্মাদ। তার চোখজোড়া কেমন লাল বর্ণের হয়ে আছে। এই ছেলের সাথে কোনো ভূত আছে কি না সেই ভয় পাচ্ছে এখন। খালি গলায় ঢোক গিলে সে। হাম্মাদের হাতে একটা গ্লাস। গ্লাসের মধ্যে পানির মতো কিছু একটা আছে।

“এদিকে এসো।”, শতরূপাকে হাতের ইশারা করে ডাকে।

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় সে। হাম্মাদ তার হাত ধরে রুমের ভেতর নিয়ে যায়। শতরূপাও চাচ্ছিল কোনোরকম এই রুমের ভেতরটা দেখতে। অন্ধকার রুমে কেবল টেবিল লাইট জ্বলছে। আশেপাশে চোখ বোলায় কিন্তু এখানে কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। তবে কী আসলেই ভূত আছে! হাজারটা প্রশ্ন জেঁকে বসেছে তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে। হাম্মাদ তার পেছনে খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে নাক লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে। শতরূপা পাথরের ন্যায় দণ্ডায়মান। যেন একটু নড়াচড়া করলেই তার গর্দান যাবে।

খানিকক্ষণ পর প্রশ্ন করে, “এই মিষ্টি সুগন্ধিটা কিসের? এখানে তুমি পারফিউম মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছ? এতই সুখ মনে?”

রাগান্বিত হয়ে পেছন ফিরে দূরে সরে যায় সে। চোখমুখ রাঙিয়ে বলে, “জি না হাম্মাদ সাহেব, কোনো পারফিউম দেইনি আমি। আমার মনে এতটাও সুখ নেই যে পারফিউম মেখে আপনার সামনে এসে ঘোরাফেরা করব। আপনার নাকে আমার গায়ের সুগন্ধি যাক সেটা আমি মোটেও চাই না। এর থেকে ফুটপাতের কোনো ফকিরও ভালো।”

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেলে সে। পরবর্তীতে কী হতে পারে এটা বিবেচনা করেনি সে। হাম্মাদের স্বভাব যে-রকম সে চাইলেই যা ইচ্ছে করতে পারে৷ তাকে বাঁধা দেওয়ার শক্তি কিংবা তার থেকে বাঁচার উপায় কোনোটাই জানা নেই। শুধুশুধু বাঘের খাঁচায় এসে কেন যে নাড়া দিতে গেল সে নিজেই ভেবে পায় না।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে