দৃষ্টিভ্রম পর্ব-০৭

0
518

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ০৭||

শায়ানকে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কল করে শতরূপা। ওপর পাশ থেকে পরপর একটা কথাই ভেসে আসছে, “আপনার ডায়লকৃত নম্বরটিতে এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”

সাধারণত সে কখনো এত কল দেয় না। খানিকটা ভয় পেয়ে আছে। কল করে এভাবে গায়েব হয়ে গেল কেন! চিন্তিত হয়ে বসেছিল তখনই হাম্মাদের মেসেজ আসে।

“একটা ছবি পাঠাও, দেখি হলুদ রাঙা বউকে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলতো হাসার চেষ্টা করে ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয় হাম্মাদের ফোনে। হাম্মাদের মুখে হাসিতে ভরে উঠে তাকে দেখে। ছবিটা আরেকটা নম্বরে ফরওয়ার্ড করে দেয়। টুং করে একটা ছোট্ট রিপ্লাই আসে, “ফাইনালি, সফলতার এক ধাপ এগিয়ে এলো। শুভকামনা।”

বিয়ের বেনারশিতে হাত বুলিয়ে দেখে। এই বিয়ে নিয়ে কতশত স্বপ্ন ছিল তার। অথচ বিয়েতে বাবা-মাকেই পাচ্ছে না। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। কিছু চাওয়াকে পাওয়ার জন্য অল্প বিস্তর হারাতেই হয়। হারানোর পর যে প্রাপ্তি আসে সেই সুখের সাথে কোনো কিছুর তুলনা চলে না।

একটা অন্ধকার ঘরে নিজেকে বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করে শায়ান। মুখে রুমাল আটকে দিয়েছে। চিৎকার করার চেষ্টা করে কিন্তু তার এই চিৎকার কারো কানে পৌঁছাতে সক্ষম হয় না। ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে। বেশ কিছুক্ষণ পর খুলতে সক্ষম হয়। দ্রুত মোবাইল বের করে কিন্তু মোবাইলটা ভেঙে বন্ধ হয়ে আছে। এদিকে তাকে সকাল থেকে আরো দুইবার কল করেছে শতরূপা। কিন্তু এখনো কোনো খবর নেই। পার্লার থেকে মেয়ে এসেছে তাকে সাজানোর জন্য। হাম্মাদ নিজেকে তৈরি করছে বরের সাজে। কত প্রহর অপেক্ষার পর এই দিনটাকে পেয়েছে তা কেবল সেই জানে।

শায়ান বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে দেখে দু’জন সুঠাম দেহি পুরুষ বসে বিড়ি ফুঁকছে আর জায়গাটার পাহারাদারি করছে। এদের চোখে ধোঁকা দিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কোনোরকম লুকিয়ে পেছন দিকে দেয়াল টপকে বেরিয়ে যায় সে। শুনশান নীরব একটা জায়গা। বাইরে এসে বড় একটা বিলবোর্ড দেখে চোখ অগ্নিবর্ণ হয়ে আসে। কিন্তু এই মূহুর্তে আগে নিজে সহিসালামতে পৌঁছাতে হবে। শতরূপাকে এসব বিষয়ে জানাতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব তার কাছে যেতে হবে। রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে একটা সময় গাড়ি পেয়ে যায়।

হাম্মাদ তার পরিবারকে নিয়ে শতরূপাদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে মাত্র। বরণ করে নিয়ে যখনই ঘরে ঢুকে তখনই শায়ানের আগমন। সম্পূর্ণ শরীর ঘেমে একাকার। হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। দ্রুত নিশ্বাস ফেলে চিৎকার করে শতরূপাকে ডাকতে লাগে।

“রূপা… বাইরে এসো। রূপা…”

হাম্মাদ এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “শায়ান! কী হয়েছে? তোমার এই অবস্থা কীভাবে হলো?”

সে তবুও বারবার ডাকছে, “রূপা… রূপা…”

বাড়িওয়ালা এরশাদ ইসলাম এগিয়ে এসে শায়ানকে আটকে ধরে বললেন, “এখানে এভাবে তামাশা করছেন কেন? এটা ভদ্রলোকদের বাড়ি। আর আজ এখানে শুভ একটা দিন। আপনি এখনই এখান থেকে চলে যান নাহলে আমি পুলিশ ডাকব।”

শায়ান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আঙ্কেল, আমাকে একটা বার রূপার সাথে দেখা করতে দিন। এই বিয়েটা আটকাতে হবে। রূপার সাথে আমার কথা বলা দরকার। প্লিজ, যদি আমার কথা শুনে সে বিয়ে করতে চায় তাহলে আমি এখান থেকে চলে যাব।”

এরশাদ ইসলাম শায়ানলে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে দেন। শতরূপা ততক্ষণে নিচে নেমে আসে। ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে আঙ্কেল? কে আমার নাম ধরে চেঁচামেচি করছিল?”

তিনি হেসে বললেন, “না রে মা কেউ না। ওসব তোর ভাবতে হবে না। তুই এভাবে নেমে আসলি কেন? বিয়ের কনের এভাবে আসা উচিত না।”

লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হাম্মাদ তাকে বিয়ের সাজে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সব সৌন্দর্য যেন তার চোখের সামনে নেমে এসেছে। কোনো এক ঘোরের মধ্যে চলে যায়। তখনই তার ছোট ভাই সাহির এসে ধাক্কা দেয়।

“কী ভাইয়া! এখনই এত মুগ্ধ হয়ে গেলে? পরবর্তীতে কী করবে তাহলে? সবাই সামনে আছে। তাছাড়া তুমি নতুন বর, অন্তত একটুখানি লজ্জা পাওয়ার নাটক করো।”

“পাজি ছেলে! চুপ কর।”, বলেই সাহিরের কান টেনে দেয়।

সাহিরও আজ অনেক খুশি। ভাই বিয়ে করে ফেলছে। এবার তাহলে তার রাস্তা পরিষ্কার। সেও দ্রুত বিয়ে করে নেবে। বাইরের সদর দরজাতে ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ আসছে এখনো। শায়ান এখনো শতরূপার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে নিচে নেমে একটা দোকানে মোবাইল চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। অন করার চেষ্টা করছে বারবার। দুই মিনিট পর মোবাইল অন হয়। অন হতেই শতরূপাকে কল করে সে। কিন্তু কল রিসিভ হয় না। দ্বিতীয়বার কল দিতেই মোবাইল বন্ধ দেখায়। দুইটা মেসেজ দিয়ে উপরে উঠে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে বেশ কয়েকবার ডাকে তাকে কিন্তু ভেতরে তেমন কোনো কথা শোনা যায় না। কেবল ধাক্কার আওয়াজ শোনা যায়।

মেজ বোন অর্পা এসে শতরূপাকে নিয়ে উপরে চলে যায়। শায়ানের আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত চলে গেছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করেন। তাদের মধ্যকার ডিলের কথা এই কাবিননামাতে উল্লেখ নেই। কেবল দশ লক্ষ টাকার মোহরানার কথা উল্লেখ থাকে। শতরূপা বুঝে নেয় তাকে পরীক্ষা করার জন্যই হাম্মাদ এমন কাগজে সাইন নিয়েছে। হাম্মাদের ভালোবাসার প্রথম পরীক্ষায় সফল হওয়ায় এখন থেকে সে তার বিবাহিত স্ত্রী।

নব বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় উঠেছে হাম্মাদ। মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন একটা বাসা। অনেক সাজানো গোছানো জিনিস। হাম্মাদের রুমে এসে অবাক হয় শতরূপা। আজ তাদের বাসর অথচ রুমের একটা কোণা ফুল দিয়ে সাজানো তো দূরের কথা, বিছানাতেও কোনো ফুলের ছোঁয়া নেই। কাজের মেয়ে এসে খাওয়ার জন্য ডেকে যায় তাকে। নতুন বউকে ডাইনিং টেবিলে এসে সবার সাথে বসে খেতে হবে বিষয়টা বেশ আশ্চর্যজনক। বিয়ের সাজে হাম্মাদের সামনের থাকতে চেয়েছিল সে। কিন্তু তা আর হলো না। ফ্রেশ হয়ে অন্য একটা শাড়ি পরে খেতে আসে। খাবার টেবিলে হরেক রকম খাবার সাজানো। তবে চেয়ারগুলো শূন্য। পরিবারের কেউ খেতে আসেনি।

শতরূপা অপ্রস্তুত গলায় কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, “কেউ নেই যে? খাবে না কেউ?”

“বড় সাহেব, বড় ম্যাম এবং ছোট সাহেব ঢাকা ফিরে গিয়েছেন। স্যার একটু বাইরে গিয়েছেন কাজের জন্য। আমাকে মেসেজ করেছেন আপনাকে যাতে খাইয়ে ঘুমানোর জন্য পাঠিয়ে দিই৷ দয়া করে আপনি খেতে শুরু করুন। আর কোনো কিছু লাগলে বলুন আমি এনে দিচ্ছি।”

মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে আসে তার। এতবড় বাড়িতে একা একা বসে আছে সে। নতুন বউকে ফেলে কেউ কীভাবে চলে যেতে পারে! এই পরিবারের লোকজনকে বেশ অদ্ভুত লাগছে তার। ম্লান হেসে প্লেটে কিছু নিয়ে খেতে শুরু করে সে। সব সমস্যার মাঝেও পেটের ক্ষুধা এখন তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প খেয়ে পানি নিয়ে রুমে চলে যায়।

রাতের ঘড়িতে বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। শতরূপা এর মধ্যেই হাম্মাদকে পাঁচটা কল করেছে। কল রিসিভ করছে না সে। ভয়ে শরীর একটুখানি হয়ে এসেছে তার৷ চুপচাপ পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বালিশ ভিজে গিয়েছে অনেকাংশ। কিছু একটা অস্বাভাবিক লাগছে তার। কিন্তু এখনো বুঝতে পারছে না। কখন যে চোখ লেগে যায় বলতেই পারে না। বেখেয়ালিভাবে ঘুমোচ্ছে সে। পেটের উপর থেকে শাড়ি অনেকটা সরে গেছে। তখনই রুমে নিস্তব্ধ জোড়া পা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। দরজা থেকে রুমের ভেতর লম্বভাবে পড়েছে একজনের ছায়া।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে