দৃষ্টিভ্রম পর্ব-০৩

0
607

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ০৩||

“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”

কথাটা শুনতেই বিষম খায় শতরূপা। মুখের খাবার না চিবিয়ে বসে আছে শায়ান। দু’জন দু’জনার দিকে তাকাচ্ছে। হাম্মাদ আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। যেন সে অস্বাভাবিক কিছুই বলেনি। দুই দিনের পরিচয়ে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেয় বলে জানা ছিল না। তাছাড়া হাম্মাদের বয়সের সাথে নিজেকে ঠিক মানায় না। তিন যুগ পেরিয়ে সাঁইত্রিশ বছরে কদম রাখা মানুষ আর মাত্র চব্বিশ বছর বয়সের সে। এই লোকটা এত বয়সেও কেন বিয়ে করলো না কে জানে! যদি বিয়ে করারই হতো তাহলে আরো আগে করলেই পারতো এই বুড়ো বয়সে কেন বিয়ে করবে! এটার বলার পরক্ষণেই ভাবলো, নাহ! বুড়ো বয়সে কথাটা ভুল। হাম্মাদ মোটেও বুড়ো নয়। নিজেকে যথেষ্ট ইয়াং রেখেছে সে। আসলে সবই সুখ আর টাকার খেলা।

শায়ান খাবার চিবাতে চিবাতে বলল, “আমি একটু ওয়াশরুম হয়ে আসছি স্যার।”

শতরূপা কেন জানি একা বসে থাকতে ভয় পাচ্ছে। শায়ান যে ইচ্ছে করেই এখন গিয়েছে তা ভালোই টের পাচ্ছে সে। হাম্মাদ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল, “পরিবারকে সুখী করতে টাকার চেয়ে বড় অন্য কিছুই নেই। টাকার সুখ কিনতে হলে যে-কোনো একজন মানুষের বিসর্জন দেওয়া জরুরি। সেটা হোক মনের, ভালোবাসার, ইজ্জতের, সুখের কিংবা যৌবনের।”

শতরূপা বুঝতে পারছে না হাম্মাদ কী বলতে চাচ্ছে। এক ঢোক পানক গিলে জিজ্ঞেস করল, “বুঝলাম না কী বলতে চাচ্ছেন! আর আমাকেই কেন আপনি বিয়ে করতে চাচ্ছেন? আপনার জন্য তো মেয়ের অভাব না, তাহলে আমাকে কেন বলছেন?”

“মেয়ের অভাব না কে বলল? আর আপনাকেই কেন বিয়ে করত্র চাচ্ছি এটার জবাব হলো, আমি আপনাকে পছন্দ করি তাই।”, বলেই টেবিলের উপর হাত রেখে কিছুটা তার দিকে ঝুঁকে বসে সে।

শতরূপা সোজা হয়ে বসে। শায়ান এখনো আসছে না কেন! তার ভীষণ খারাপ লাগছে। হাম্মাদ আবারো বলল, “আমি আপনাকেই বিয়ে করতে চাই এবং সেটা এই মাসেই। আমি আপনার জন্য সব করতে রাজী। কখনো কোনো কমতি হতে দেব না। বিয়ের পর চাকরিও করতে হবে না, আমার বিজনেসের ৫০% তো আপনারই। মাস শেষে আমার যা ইনকাম তা আপনারও। আমি আপনাকে অনেক সুখে রাখব। আজকের সপ্তাহ সময় দিলাম। ভেবে আমাকে জানাবেন।”

কথা শেষ করে হাম্মাদ কাউন্টারে গিয়ে বিল পে করে চলে যায়। খাবারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতরূপা। সে যেমন জীবনসঙ্গী চায় তেমনটা হয়তো কোনোদিনও পাবে না। হাম্মাদকে বিয়ে করলে তার জীবন গড়ে যাবে। পরিবারের ভালোর জন্য প্রত্যেক জায়গাতেই কেউ না কেউ সেক্রিফাইস করতে হয়। তার পরিবারে এখনো কেউ সেক্রিফাইস করেনি। তাহলে কী সেই সেক্রিফাইসটা তাকেই করতে হবে!

শায়ান শতরূপার সামনে বসতে বসতে বলল, “স্যার ভীষণ ভালো মনের মানুষ। উপর দিয়ে একটু শক্ত হলেও তার ভেতরটা খুবই নরম। অফিসের স্টাফদের কথা তিনি পরিবারের সদস্যদের মতোই ভাবেন। একবার ভেবে দেখ যদি তুমি তাকে বিয়ে করে ফেল তাহলে তোমার খেয়াল তিনি কীভাবে রাখবেন! পরিবারের একমাত্র ছেলে তিনি। দেখতেও খারাপ না। বয়সটা যে খুব বেশি তাও না। এই বয়সে অনেকেই বিয়ে করছে। স্যারের বয়স তো তেমন বোঝাও যায় না। আসলে পরিশ্রম করতে গিয়ে বয়স বেড়ে গিয়েছে বিয়ে করা আর হয়ে উঠেনি। তবে সত্যি বলছি, দেখে নিও, অনেক ভালোবাসবেন তোমাকে তিনি।”

শতরূপা চুপচাপ বসে আছে। শায়ান বিল চেয়ে ওয়েটারকে ডাকে। কিন্তু সে কিছুক্ষণ পর এসে বলে বিল অলরেডি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। মৃদু হেসে সে শতরূপাকে বলল, “দেখলে তো স্যার কতটা কেয়ারিং! এত সুখ কোথাও পাবে না তুমি। ভেবে দেখ একবার। স্যারের জন্য আঠারো বছরের কম মেয়েদেরও লাইন লেগে আছে কিন্তু তিনি কখনো কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চান না। হয়তো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন যার কারণেই এভাবে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। এখন তুমি ভাবো ভালো করে। তুমি অবুঝ নও, বাকিটা তোমার ইচ্ছা।”

বাসায় ফেরার পর থেকে হাম্মাদের বলা কথা নিয়ে ভাবছে সে। শায়ান যা বলেছে তা একটুও মিথ্যে নয়। হাম্মাদের মতো ছেলে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে এটাও একটা ভাগ্য! একরাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো মানে নেই। যেহেতু এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে সেহেতু ভালো করে ভেবেচিন্তেই জবাব দিতে চায় সে।

অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয় শতরূপা। বাস স্ট্যান্ডে বসে অপেক্ষা করছে। অনেক মানুষের ভীড় এখানে। জানে না আজ বাসে জায়গা পাবে কী না! বাস আসতেই হুড়মুড়িয়ে মানুষ উঠতে লাগে। ধাক্কাধাক্কি করে বাস ভরে যায়। সে আর চড়তে পারে না। বাস ছেড়ে দিতেই সেখানে একটা গাড়ি এসে থামে। গাড়ির গ্লাস নামাতেই ভেতর থেকে পরিচিত চেহারা বেরিয়ে আসে। হাম্মাদ বসে আছে। চোখে কালো চশমাটা খুলে তার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।

“অফিসে ড্রপ করে দিব?”

শতরূপা ইতস্তত করে বলল, “জি না, আমি বাসে করে যাব।”

সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “অলরেডি সাড়ে নয়টা। দশটায় অফিস। নেক্সট বাস আধাঘন্টা পর অর্থাৎ দশটায়। তাহলে আপনি যাবেন কখন আর অফিস ধরবেন কখন?”

বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। এই সময় সে হেঁটেও যেতে পারবে না। আর রিকশা বা সিএনজি করে যাওয়ার মতো ভাড়া তার কাছে নেই। বাস আসবে না জেনেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকায়। হাম্মাদ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আর কোনো উপায় না দেখে সে ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। হাম্মাদ দরজাটা খুলে দেয়। উঠে বসতেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় তারা। শায়ান কিছুটা দূরে বাইকে বসে তাদের দেখছিল। একসাথে যেতে দেখে ক্ষীণ হাসে সে। অবশেষে হয়তো দু’টি প্রাণ এক হতে চলেছে।

গাড়িতে একটা কথাও বলে না তারা। শতরূপা ভয় পাচ্ছিল যদি কোনো কথা বলে তবে সে কী উত্তর দেবে কিন্তু না হাম্মাদ একটা প্রশ্নও করেনি তাকে। অফিসের সামনে গাড়ি থামাতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যায় সে। দশটা বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। হাম্মাদকে একবার জিজ্ঞেস করেও যায় না। সে তাকে পেছন থেকে ডেকে কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু কোনো কথা না শুনেই ভেতরে চলে যায়।

অফিসের ভেতরে আসতে আসতে দশটা দশ বেজে যায়। এরমধ্যেই বস তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পিয়ন সেলিম এসে বলল, “আপা, ষাঁড় ডাকে আপনারে। তাড়াতাড়ি যান, নাইলে পরে চেইত্যা গেলে গুতাগুতি শুরু করবো। তয় সাবধানে থাইকেন। কিছু বললে চুপ কইরা থাকবেন না। সাহস রাইখেন মনে।”

সেলিম ইচ্ছে করেই স্যার শব্দকে ষাঁড় বলে উচ্চারণ করে। এমন বাজে লোককে নাকি তার ষাঁড়ের মতোই লাগে। ভালো নামে ডাকতে মন চায় না। মন থেকে একটুও সম্মান আসে না। কেবল পেটের জ্বালায় পড়ে আছে নাহলে কবেই এই লোককে জবাই করে জেলে যেত সে।

সেলিমের কথায় মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানায় শতরূপা। বুকের ওড়নাটা আরেকবার ঠিক করে নেয়। লম্বা করে নিশ্বাস ফেলে সোজা কদম বাড়ায়। দরজায় ঠকঠক শব্দ করতেই ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, “আসেন মিস, ভেতরে আসেন।”

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

সালামের জবাব নিয়ে তাকে চেয়ারে বসার কথা বললেন। সে গুটিসুটি মেরে চেয়ারে বসে আছে। এই কেবিনে আসলে তার আত্মা শুকিয়ে যায়। সিদ্দিক সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই কলিজাটা কেঁপে উঠে তার। ঘামতে শুরু করে। একটা ভয় এসে জেঁকে বসে যে, এই বুঝি তিনি তার গায়ে হাত দিলেন, এই বুঝি তাকে অশ্লীলভাবে ছুঁয়ে দিলেন। কথা বলতে বলতে তার কাছে এসে দাঁড়ান তিনি।

হাম্মাদ গাড়ি সাইড করে মোবাইল হাতে নিয়ে অফিসের ভেতরে আসে। শতরূপা ভুল করে তার মোবাইলটা গাড়িতে ফেলে এসেছে। এটা তার হাতে দিয়ে চলে যাবে সে। পিয়নকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, “আফা তো ষ্যাড়ের রুমে গেছে।”

সিদ্দিক সাহেবের রুমে অনুমতি ছাড়া অফিসের কেউ ঢোকা নিষেধ। তিনি বললে তবেই কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে। কিন্তু হাম্মাদ কারো অনুমতির অপেক্ষা করে না।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে