দৃষ্টিভ্রম পর্ব-০১

0
1297

|দৃষ্টিভ্রম|| ||পর্ব: ০১||
লিখা: বর্ণালি সোহানা

“সন্ধ্যার পর তো ফ্রি থাক। চলো না আজ ডিনারে যাওয়া যাক। হোটেলে একটা রুম বুক করে দিব, কেউ জানবে না। নিঃসঙ্গতা কাটাতে একটু সময় একসাথে থাকতে পারি আমরা। তাছাড়া আমার খেয়াল যদি তুমি রাখ তাহলে দেখবে অফিসের বস করে দিব আমি তোমাকে।”, বলেই পান চিবুতে চিবুতে হলদেটে দাঁতগুলো বের করে হাসলেন সিদ্দিক সাহেব।

শতরূপার শরীর ঘিন ঘিন করছে। কিছুদিন পরপরই এমন অশ্লীল প্রস্তাব পেতে হয় তাকে। যখন যেখানে সুযোগ পান সিদ্দিক সাহেব তাকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন নিজের চাহিদা মেটালে তিনিও তার চাহিদা মিটিয়ে দেবেন। অফিসের বস বলে মুখ খুলে কখনো কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না সে। অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়, চরিত্রও নষ্ট হয় কিন্তু সবার নয়। সবাই যদি চরিত্র বিক্রি করে সুখ-সাচ্ছন্দ্যকে আপন করে নেয় তাহলে হয়তো পৃথিবীটা ভালো মানুষের অভাবে পুড়ে যেত। শতরূপা এতটাও নিচে নামতে চায় না। তাছাড়া তার একটা লক্ষ্য আছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেই জীবনের সুখ না আসুল কিছুটা ভালো দিন ঠিকই ফিরে আসবে। তাই তো তার ডাকে কখনোই সাড়া দেয়নি সে। এতে অবশ্য তিনি পিছু ছাড়েননি। সুযোগ পেলেই নিজের বউয়ের সাথে বনিবনা হয় না, বউটা তাকে সুখে রাখতে পারছে না ইত্যাদি ধরনের ইতিহাস খুলে বসেন। শুধু যে তার সাথেই এমন তা কিন্তু নয়। অফিসের অন্য মেয়েরাও এমন হয়রানির স্বীকার। কোনো বিবাহিত মেয়েকে এখানে চাকরিতে নেওয়া হয় না। সিঙ্গেল হলে তবেই চাকরি কনফার্ম করা হয়। এর পেছনে যে সিদ্দিক সাহেবের স্বার্থ লুকিয়ে আছে তা প্রথমে কেউ না বুঝলেও পরবর্তীতে অনেকেই বুঝে যায়। কেউ কেউ তো সুযোগ দেয় তাকে। আবার কেউ চাকরি ছেড়ে দেয়। কেউ বা অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে যায়। শতরূপার কপালটা হয়তো মন্দ। তাই তো অন্য কোথাও চাকরি হচ্ছে না। কত জায়গায় সিভি দিয়ে রেখেছে। কোথাও থেকে যদি একটা বার ডাক আসে সেই আশায়!

অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের শহর যতটা সুন্দর ততটাই ভয়ানক। জানোয়ারের থেকে ভয়ংকর মানুষ নামের হায়না। এদের ভয়ে রাতে মেয়েদের বের হওয়াটা নিরাপদ নয়। চলতে চলতে একটা সময় থমকে দাঁড়ায় শতরূপা। এই মূহুর্তে নিজেকে বড়ই অসহায় লাগছে। একটা কুকুর সেই কখন থেকে তার কাছে এসে ঘেউঘেউ করছে। সে না পারছে সামনে যেতে আর না পারছে পেছনে যেতে। মনে হচ্ছে কী এক গোলকধাঁধায় আটকে আছে। আশেপাশে কেউ নেই৷ একটু সাহায্যের জন্য উপরওয়ালার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে। জামার সাথে কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে দোয়া পড়তে লাগে। ভয়ে শরীরটা কুঁচকে একটুখানি হয়ে আসে। হৃদপিণ্ডটা কাঁপছে। এই রাতে তাকে কে আসবে সাহায্য করতে! তার সম্মুখে একটা গাড়ি এসে থামে। গাড়ির হেড লাইটের আলো একদম চোখে এসে লাগছে। হাত তোলে চোখের উপর ছায়া করে তাকানোর চেষ্টা করছে সে। গাড়িটা একবার সামনে আগাচ্ছে তো একবার পেছনে যাচ্ছে। বারবার হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। কুকুর সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। গাড়ির সামনে লম্বভাবে কারো ছায়া পড়ে। শতরূপা তার ছায়ার তলে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে সেই ছায়া ছোটো হতে লাগে। তার দিকে এগিয়ে আসতেই রাস্তার ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলে উঠে। কিছুক্ষণ আগের বিদ্যুৎহীন শহরে এখন আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠেছে। ছায়া মানবের মুখে আলো পড়তেই শতরূপা ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। গত সপ্তাহে এই মানুষটাকে সে তার অফিসের বসের বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মূখ্য অতিথি হিসেবে দেখেছে। শহরের এক বিশিষ্ট শিল্পপতি হাম্মাদ খন্দকার। বেশ নামডাক আছে তার এই শহরে। শতরূপা মৃদু হাসার চেষ্টা করল।

হাম্মাদ পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “এই রাতে আপনি এখানে! তাও একা!”

শতরূপা হাতের ছোট্ট ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল রাত এগারোটার উপর বাজে। রাতের বেলা তার রাস্তায় থাকার কথা নয়। তবুও সে আজ রাস্তায় কেবল তার বসের কারণে। মাসের শেষ পর্যায়ে হিসাব বন্ধ করে বাসায় যেতে হয়। আর এই গুরুদায়িত্ব গত দুই বছর ধরে তার উপর।

গলা পরিষ্কার করে শতরূপা বলল, “আসলে অফিস থেকে এই রাস্তাটায় আসলে তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া যায়।”

মিথ্যে কথার মধ্যেও সত্য লুকিয়ে আছে। এই রাস্তা দিয়ে সময় কম লাগে তা ঠিক কিন্তু হেঁটে যাওয়ার জন্য এটাই উত্তম রাস্তা। কেননা সোজা রাস্তায় বাসায় ফিরতে হলে রিকশা বা অটোতে করে যেতে হবে। যাতে শ’পঞ্চাশ ভাড়াই চলে যায়। মাস শেষে রিকশা করে বাসায় যাওয়ার জন্য ব্যাগে এত টাকা থাকে না তার। যা থাকে তা দিয়ে কোনো রকম সকালে বাসে চড়ে অফিস ধরতে হয়। বাসায় দেরিতে পৌঁছালে সমস্যা নেই কিন্তু সকালে তাড়াতাড়ি অফিসে না গেলে বস তার বেতন থেকে একশ টাকা কেটে দেন। একশ টাকা যে কত প্রয়োজন তা একমাত্র সেই জানে।

“আচ্ছা! জীবনের থেকে চাকরি জরুরি নয়। এমন চাকরি করার কী প্রয়োজন যেখানে একটা মেয়েকে রাত এগারোটায় বাসায় যেতে হয়।”, বলেই পকেট থেকে হাত বের করে সোজা হেঁটে গাড়িতে চেপে বসে।

শতরূপা পেছনে ম্লান হেসে দাঁড়িয়ে রয়। যাতের পকেটে টাকা আছে তারা টাকার বিছানাতে আড়মোড়া ভেঙে এসব বলাটা স্বাভাবিক। যারা কষ্ট করে বাঁচে তারাই জানে কত রকমের হয়রানিকে উপেক্ষা করে টাকা আয় করতে হয়। বিশেষ করে একটা মেয়ের ক্ষেত্রে।

শতরূপাও হাঁটতে শুরু করে। হাম্মাদ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তার কাছে এসে থেমে বলল, “বিশ্বাস করতে পারলে গাড়িতে উঠুন আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দিব। না করলে, পাশ কাটিয়ে চলে যান। আমার আবার অনেক তাড়া আছে।”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় শতরূপা। কেউ এভাবে কথা বলে! কথার মাঝেই অহংকারের ছড়াছড়ি। প্রথমে গাড়িতে উঠবে না ভেবেছিল কিন্তু একা বাসায় যাওয়াটা এখন ভয় করছে তার। তাই কোনো উপায় না পেয়ে গাড়িতে উঠে বসে। রাতের বেলা চোখে কালো চশমা কোন বাঁদরে পরে! অবশ্য হাম্মাদকে তার কাছে বাঁদর মনে হচ্ছে না। দেখতে খুব একটা সুদর্শন না হলেও অনেক স্মার্ট। গায়ের বর্ণ শ্যামলা। তার মধ্যে একদম কড়া বাদামী রঙের একটা শার্ট গায় দেওয়া। গালের সাথে লাগানো হালকা দাড়ি। কোনো ছেলের দিকে সে কখনো এভাবে তাকায়নি যেরকম নিখুঁতভাবে হাম্মাদের দিকে তাকাচ্ছে। নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হয় তার। গাড়ির ভেতর কেমন একটা শীত শীত লাগছে। এসি অন করা সেজন্যে হয়তো। আচমকা ঠাণ্ডার মাত্রাটা একটু কমে আসে। হাম্মাদ এসির তাপমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এই লোকটা তাকে অবলোকন করছে তা ভালোই বুঝে যায়। নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে। তাদের মধ্যে আলাদা কোনো কথা হয় না। সে বাসার রাস্তা বলে দিচ্ছে কেবল। বাসার সামনে এনে নামিয়ে দেয় তাকে। শতরূপা ঘুরে ধন্যবাদ দিতে যাবে ওমনি গাড়ি টান দিয়ে চলে যায় সে। কেমন অদ্ভুত লোক!

বাসার ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে শতরূপা। এই ভয় নতুন নয় তার জন্যে। এর আগেও তাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে কিন্তু ভয়টা সেই আগের অবস্থানেই র‍য়ে গেল। কাটেনি এখনো। আস্তে করে গেট খোলার চেষ্টা করে কিন্তু ভেতর থেকে তালা দেওয়া। এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল। রুম নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালা তাকে বলে দিয়েছিল, রাত করে বাসায় ফেরা যাবে না। কোনো ছেলে মানুষ আনা যাবে না। অহেতুক আওয়াজ করা যাবে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। শতরূপা এর মধ্যে কোনোটাই করে না কেবল মাসে কয়েকদিন রাত করে বাসায় ফেরা ছাড়া। ব্যাগ থেকে ওয়ালটনের মোবাইলটা বের করে বাসার মালিকের ছেলে ইরামকে কল করে। দের করে আসলেই ইরামই তার মূখ্য সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ইরাম এসে চুপিচুপি গেট খুলে দেয়।

২.
হাম্মাদ গেটের সামনে এসে একনাগাড়ে হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। দারোয়ান দৌড়ে এসে গেট খুলে দেয়। গেটের ভেতরে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল, “এতক্ষণ লাগে গেট খুলতে? ঘুমাচ্ছিলি নাকি? কষ্ট যদি হয় জেগে থাকতে তাহলে চাকরি ছেড়ে দাও। আর যেন এমন না হয়।”

গাড়ির চাবি দারোয়ানের দিকে ছুঁড়ে মেরে ঘরের ভেতর চলে যায়। সম্পূর্ণ ফ্লোরে কাঁচ পড়ে আছে৷ আজ আবারও কিছু একটা হয়েছে! হাম্মাদের শরীরটা ঘামছে। কানের পাশ দিয়ে একফোঁটা ঘাম বেয়ে পড়ে। যে মানুষ ঘরের বাইরে বাঘ সে ঘরের ভেতর আসলে বিড়াল হয়ে যায়। ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে যায় সে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে