দর্পহরন পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
139

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৫

সালিম সাহেবের ডাক পেয়ে ফাহিম যারপরনাই অবাক হলো। সবার আগে যে প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেলো তা হচ্ছে, ওরা কি কোনভাবে জেনে গেছে যে সোহেলের ব্যাপারটায় ও জড়িত? মনে মনে ভয়ে ভীত হয়ে গেলো ফাহিম। খুব দ্বিধায় ছিলো যাবে কিনা সেটা ভেবে। পরে যখন বলা হলো তুলতুলের বিষয় নিয়ে কথা বলবে তখন ভয়টা একপাশে রেখে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। বোনের বিষয়ে কি কথা বলবে সালিম সাহেব সেটা জানতে হবে। বোনটাকে কি ফিরিয়ে দেবে? তাহলে সানন্দে বোনকে নিয়ে আসবে ফাহিম। সালিম সাহেবের অফিস ঘরে বসে নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে ফাহিম। তখন তুহিন ভেতরে যেতে বললো। ফাহিম সালিম সাহেবের কামড়ায় ঢুকলো।
“আরে, আসছো তুমি? আসো বসো।”
ফাহিম ভ্যাবাচ্যাকা খায়। এই খাতিরের কোন অর্থ খুঁ’জে পেলো না। ফাহিম কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললো-“কি বলতে ডেকেছেন আমাকে?”
সালিম সাহেব মোটেও রাগলেন না। হাসি হাসি মুখ করে বললো-“শুনলাম তুমি নাকি পার্টি করতেছ। আমরা একই পার্টির মানুষ তাই আলাপ পরিচয়ের জন্য ডাকলাম আরকি।”
ফাহিম জবাব দিলো না। সে বোঝার চেষ্টা করছে সালিম সাহেব কি বলতে চাইছেন। সালিম সাহেব হাসলো-“তুমি আমার আত্মীয় হয়ে আরেকজনের জন্য কাজ করবা এইটা কেমন জানি লাগে দেখতে।”
এবার যেন সালিম সাহেবকে খানিকটা বুঝতে পারছে ফাহিম। সে কঠিন গলায় বললো-“তো? আমি কার হয়ে কাজ করবো না করবো সেটা তো একান্তই আমার ইচ্ছে। তাতে আপনার বলার কিছু আছে বলে মনেহয় না।”
“না, তা ভুল কিছু বলো নাই। কিন্তু তবুও বিষয়টা বিবেচনা করা দরকার। আমি এবার মেয়র পদে ইলেকশন করবো। তুমি তরুণ প্রজন্মের মানুষ, আমার হয়ে যদি কাজ করতা খুব খুশি হইতাম। এলাকার সাংসদ আমার মেয়ের জামাই তুমি তার হয়ে কাজ করো তাতে আমার দুঃখ নাই বরং আমি খুশি। তুমি আমার বউমার ভাই। শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই মিলে একটা পরিবারই তো। সবাই যদি সবার পাশে দাঁড়াই তাহলে আমাদেরই লাভ। বুঝলা না?”
“না বুঝি নাই। আপনে কোনদিন আমাদের পাশে দাঁড়াইছেন বলে মনে পড়ে না। তাছাড়া বিয়ের পর আমার বোনটা আপনাদের কাছে বন্দী বলা যায়। এখন আবার বাচ্চা দিয়ে বন্দী করছেন। আর আপনে আশা করেন আমি আপনের জন্য কাজ করবো।”
সালিম সাহেব চুপ করে গেলেন। নম্রস্বরে বললো-“তুমি যা বলছো তা একান্ত পারিবারিক বিষয়। তবুও যা বলছো ভুল বলো নাই। বউমাকে কিন্তু আমি মুক্তি দিয়ে দিছিলাম। বিশ্বাস না হইলে তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস কইরো। তারপর জানলাম নাতি আসতেছে। আমার ছেলেটা নাই তার পরবর্তী বংশধর আসার খবর শুনে আমি আবেগী হয়ে গেছি। নিজের রক্তের জন্য অন্যরকম টান হয় বাবা সেটা তুমি আমার বয়সে না আসলে বুঝবা না। যাইহোক, এখন আমরা বউমার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার বড় ছেলে শরীফের সাথে বউমার বিয়ে দিব। তাতে নাতি আর বউমা দু’জনই আমাদের ঘরে থাকবে। শরীফ ভালো ছেলে, তোমার বোন ভালো থাকবে তার সাথে।”
“আমার বোন কি রাজি আপনার আরেক ছেলেকে বিয়ে করতে? নাকি এবারও জোর করে বিয়ে দিবেন?”
সালিম সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে ফাহিমের দিকে তাকায়-“ধরো বোনকে নিয়ে গেলা। তারপর কি করবা? বাচ্চাসহ নতুন করে শুরু করতে পারবে তোমার বোন? কিংবা আমাদের কাছে বাচ্চা রেখে দিলাম তবুও কি সব আগের মতো হবে? তারচেয়ে এই কি ভালো না যে শরীফকো বিয়ে করে জামাই বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করবে? যাইহোক, তুমি দেখো কি করবা? আমার কাজ করলে আমি খুশি হবো না করলেও কোন ক্ষতি নেই। সবার ব্যক্ স্বাধীনতা আছে। জোর করা ঠিক না। যাও তাহলে।”
ফাহিমকে পুরোপুরি দ্বিধায় ফেলে দিলো সালিম সাহেব। ফাহিম অনেকটা মোহগ্রস্তের মতই বাড়ি ফিরে এলো।

*****

মোর্শেদ বেশ চিন্তিত হয়ে গেছে। তন্ময় ঘুরে ফিরে খুশির কথা বলছে। সে খুশিকে বিয়ে করবে বলে জেদ ধরে বসে আছে। দু’দিন ধরে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়েছে। বারবার বুঝিয়ে বলার পরও তন্ময় গো ধরে আছে। বিরক্ত হচ্ছে মিনুও। ছেলের সাথে কয়েকদফা মিটিং করেও তাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়ানো গেল না। মোর্শেদ অসহায় চাহুনি দিয়ে মিনুকে দেখলো। দুজনই ছেলের উপর বিরক্ত। মোর্শেদ পড়েছে বিপদে। তার ভয় হচ্ছে পাছে তন্ময়ের জেদে পড়ে ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক না খারাপ হয়। এখন বসে বসে ভাবছে কি করবে। মিনু ডাকলো-“আপনে না হয় সালিমের সাথে কথা বলে দেখেন একবার। রণর মায়ের সাথে কথা বলে দেখেন সে কি বলে। শুনছি সেই নাকি শুভ্রারে বিয়ে করাইছে। তাহলে তন্ময়ের সাথে তার সমস্যা হওয়ায় কথা না।”
“কিন্তু রণ তো শুনছি আগেই মানা করে দিছে। শুভ্রা কথা তুলছিল তো।”
“একবার মানা করছে এইবার হ্যা বলতেও পারে। একবার কথা বলতে দোষ কি?”
মিনুর কথা মোর্শেদের কাছে গ্রহনযোগ্য মনেহয়। সে কথাটা ভাইয়ের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হয়।

“সালিম আছোস?”
“হুমমম, ভাইজান। আসেন ভিতরে আসেন।”
মোর্শেদ ঘরে ঢুকে বসলেন, ইতস্তত করতে করতে বারবার ঘরে নজর ঘুরিয়ে চলছেন। সালিম সাহেব বুঝলো ভাইজান কিছু বলতে চায় কিন্তু কোন কারন বশত দ্বিধায় ভুগছে।
“আপনি কি কিছু বলতে চান ভাইজান?”
“হহহ। তন্ময়টা খুব জ্বালাইতেছে। দুইদিন ধইরা খায় দায় না। তার এক কথা খুশিরে বিয়া করবো। বহুত বুঝাইছি কিন্তু মানে না। তোর ভাবিও বুঝাইছে অনেকবার, কোন কথাই শোনে না। এখন কি করি ক।”
সালিম সাহেব অবাক হলেন। এই পরিবারের সবার হইছেটা কি? যা করা যাবে না সবাই যেন তাই করার জন্য উঠে পড়ে লাগছে। এটা কি ধ্বংসের আগের পরিস্থিতি? হাসফাস লাগে সালিম সাহেবের। মোর্শেদ দোনোমোনো করে বলে-“তোর ভাবি কইতেছিল, একবার বেয়াইনকে বলতে। সেই তো শুভ্রারে বিয়া করাইছে, মন নরম মানুষ। তাই তারে কইলে হয়তো মাইনা নিতে পারে। একবার কথা কয়া দেখবি নাকি? জামাই তো অহন দেশে নাই। চল কাইলকা তুই আমি যাই শুভ্রার বাসায়। ওর শাশুড়ীর লগে কথা কইয়া আসি।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলেন-“ঠিক আছে ভাইজান তাইলে দেরি করুন যাইবো না। কাইলই যামু আমরা। দেখি বেয়াইন কি কয়।”

*****

বাবা আর চাচাকে একসাথে দেখে ভীষণ অবাক হলো শুভ্রা। তাদের দু’হাত ভরা মিষ্টির প্যাকেট। কিছু বুঝে পাচ্ছে না সে। হুট করে কিছু না জানিয়ে বাবা চাচা তার বাসায় কেন এলো? শুভ্রা সালাম জানিয়ে বলেই ফেললো-“আব্বা, আপনেরা হঠাৎ? কি হইছে আব্বা?”
সালিম সাহেব হাসলো-“তেমুন কিছু না আম্মাজান। আপনে তো বাড়ির রাস্তা ভুলছেন তাই আমরাই আইলাম আপনেরে দেখতে। ভিতরে যাইতে কইবেন না আব্বারে?”
শুভ্রা দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়-“আসেন আব্বা।”
খাবারের প্যাকেটগুলো টেবিলে রেখে সোফায় বসলো। সালিম সাহেব বললো-“আপনে কেমুন আছেন আম্মাজান? কত্তদিন হইলো বাড়ি যান না।”
“উনি ব্যস্ত থাকেন আব্বা। আমারই সব দেখে রাখতে হয় তাই যাওয়া হয় না কোথাও।”
সালিম সাহেব মেয়েকে দেখলেন একনজর। শাড়ী পরে থাকা শুভ্রাকে কেমন অচেনা লাগে তার কাছে। তার মেয়ে কোনদিন শাড়ী পরেছে বলে মনে পড়ে না। ঈদ পার্বনে দুই একবার সালোয়ার কামিজ পরেছে হয়তো। সালিম সাহেব দীর্ঘ শ্বাস গোপন করলেন। মেয়েটা যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে।

মোর্শেদ ভাইকে খোঁচা দিলে সালিম নিজেকে সামলে নিলো। মোর্শেদ জানতে চাইলো-“বাসায় আর কেউ নাই? আপনের শাশুড়ী মা কই শুভ্রা? তারে খবর দেন কথাটথা বলি।”
শুভ্রা মাথা নেড়ে ভেতরে গেল। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলো-“আসতেছে।”
বলে চুপচাপ বসলো। শুভ্রা মনটা খচখচ করছে কেন যেন। মনেহচ্ছে বাবা চাচা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে। হুট করে কেন যেন ভয় লাগতে শুরু করলো তার। মনটা অকারণে ছটফট করতে লাগলো৷ কেন তার মনেহচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটবে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৬

শুভ্রার বাবা আর চাচার একসাথে আসার খবর শুনে জলি প্রথমে বিস্মিত হলো। তারপর খানিকক্ষণ ভাবার পরে পুরো ব্যাপারটা বুঝে তার মুখে অদ্ভুত ধরনের একটা হাসি ফুটে উঠলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো ভাবে পরিপাটি করে ফেললো। বহুদিন আগের গভীর ক্ষততে আজ প্রলেপ পড়বে ভেবে তার মনটা কি ভীষণ রকম আনন্দিত হচ্ছে তা বাইরে থেকে জলিকে দেখে কারো বোঝা সম্ভব নয়। নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট জলি শাড়ীর আঁচল মাথায় তুলে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াতেই সালিম আর মোর্শেদ উঠে দাঁড়ায়, সালাম দেয়। জলি প্রতিউত্তর দিয়ে তাদের বসতে বলে। শুভ্রাকে বললো-“হাসিখুশিকে ডাকো আর তোমার বাবা চাচার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। তাদের কি খালিমুখে বিদায় জানাবে নাকি?”
শুভ্রাকে বিচলিত দেখায়। জলির কন্ঠে মিষ্টি কথা শুনে তার অস্থির লাগে। সে দ্বিধা নিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাসি খুশি এসে সালাম দিলো। দু’চারটে ভালো মন্দ আলাপের পরে ওরা ভেতরে চলে গেলো। এরমধ্যে মোর্শেদ নতুন করে খুশিকে দেখলো মন দিয়ে। ছেলের পছন্দের প্রসংশা করলো মনে মনে। ওরা ভেতরে ফিরে যেতেই জলি কথা বললো-“তা আপনারা হুট করে এলেন। কোন বিশেষ প্রয়োজনে?”
দুই ভাই একে অপরকে দেখলো চোরা চোখে। সালিম সাহেব হাসলো-“অনেক দিন আম্মাকে না দেখে খারাপ লাগতেছিল আপা। তাই ভাবলাম আম্মাজানকে একটু দেখে যাই।”
“আচ্ছা, ভালো করেছেন। মেয়ের প্রতি বাবাদের টান অন্যরকম হয়। আপনার মেয়ে ভাগ্যবান তার বাবার স্নেহ ভালোবাসা পেলো। আর আমার মেয়েদের কপাল দেখেন।”
জলির কথা শুনে মোর্শেদ খুকখুক করে কাশে-“আপা, অনুমতি দিলে একটা কথা বলার ছিলো।”
জলি থামলো, তার মুখের রেখার প্রশ্ন দেখা দিলো-“জ্বি বলেন। কি বলতে চান?”
সালিম সাহেব চুপ করে আছেন। কেন যেন মনেহচ্ছে তন্ময়ের কথা বলাটা উচিত হবে না। কিন্তু ভাইকে থামতে বলবেন কিনা সে বিষয়ে দ্বিধা আছে। মোর্শেদ হাসার চেষ্টা করলো-“আমার ছেলে তন্ময়কে তো দেখেছেন।”
“হ্যা দেখেছি তো। কিছুদিন আগে আমাদের বাসায় আসতো প্রায়ই।”
মোর্শেদ বিগলিত হলো-“আমার ছেলেটা মাশাল্লাহ ভালো ছাত্র। অস্ট্রেলিয়ান ডিগ্রি আছে, চাইলে ওখানেই কিছু করতে পারবে নতুবা আমাদের তো কম কিছু নাই। এখানেও চাইলে নিজের মতো কিছু করতে পারবে। ওর যা ইচ্ছে হবে করবে আর কি।”
“হ্যা, সবই ঠিক আছে কিন্তু এসব আমাকে বলছেন কেন?”
জলি অবাক হলো। মোর্শেদ গলা পরিস্কার করে-“না মানে আপা, আপনার তো দুই মেয়ে মাশাল্লাহ দেখতে বেশ ভালো। পড়ালেখাতেও ভালো ওরা। বলছিলাম কি, আপনার মেয়ে খুশিকে যদি আমাদের ছেলে তন্ময়ের জন্য দিতেন বড়ই আনন্দিত হইতাম।”
শুভ্রা চা আর নাস্তা নিয়ে এসেছিল ওর পা কেঁপে উঠলো। টি র্যাকে আচমকা ধাক্কায় চা ছলকে পড়লো। নিজেকে কোনরকমে সামনে বাবা চাচার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো-“চাচাজান, আমিতো আব্বাকে এই বিষয়ে আগেই সব পরিস্কার বলেছি। আজকে আবার নতুন করে এসব কথা উঠতেছে কেন?”
মোর্শেদের মুখের রেখায় বিরক্তির আভাস। জলি বলে ফেললো-“আমি তো কথা বলছি বউমা। তুমি এরমধ্যে কোন কথা বলো না।”
শুভ্রা চমকে গেলেও উত্তর করলো না। জলিকে ইদানীং তার ভয় লাগে। সেই নরম মনের মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কেমন করে যেন তাকায় শুভ্রার দিকে। শুভ্রা চুপচাপ এককোনে বসলো। জলি কথা বলে-“ভাই, কি যেন বলছিলেন আপনে? আপনার ছেলের কথা তাই না?”
মোর্শেদ মাথা দুলায়। জলি হাসলো-“আসলে হয়েছে কি ভাই আমরা আমাদের অতীতটা খুব সহজে ভুলে যাই। যাইহোক, আমার যদি ভুল না হয় তাহলে আপনার যোগ্য ছেলে তন্ময় মনেহয় একবার মেয়ে ঘটিত কেসে ফেঁসে গেছিল। ভুলক্রমে সেই মেয়েটা আবার আমাদের এলাকার প্রতাপশালী রঘুনাথ দাসের মেয়ে ছিলো। বাধ্য হয়ে ওদের সাথে আপোষ করে ছেলেকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন।”
মোর্শেদ আমতাআমতা করলো-“আপা, তখন অল্প বয়স ছিল, ওই বয়সে এরকম পাগলামি নরমাল।”
“নরমাল! আমার ছেলের এরকম একটা কেস দেখান। জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে কুদৃষ্টি দেয়নি আমার ছেলে এটা হলপ করে বলতে পারি। আচ্ছা, তখনকার কথা বাদ দিলাম এখনকার কথা বলি। অস্ট্রেলিয়াতে কি করেছে আপনার ছেলে? শুনেছি এক পাকিস্তানি মেয়েকে রে*প করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।”
মোর্শেদ গর্জে উঠলো-“এসব মিথ্যা অভিযোগ আপা। জানেন তো পাকিস্তানিরা একাত্তরে কি করেছিল আমাদের সাথে। ওরা সবসময় সুযোগ পেলেই বাঙালিদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে।”
জলি মৃদুস্বরে হাসলো-“বুঝলাম পাকিস্তানিরা খারাপ। তাছাড়াও আপনার ছেলের আরও কর্মকান্ডের কথা কি বলবেন।”
মোর্শেদ এবার হাতের কাপটা স্বশব্দে নামিয়ে রাখলো-“বুঝেছি আপা। আপনি মেয়ে বিয়ে দিবেন না। সুযোগ পেয়ে আমাদের অপমান করতেছেন।”
জলি হেসে দিলো-“অপমান করতেছি? আমি শুধু আপনাদের সাহস দেখতেছি। কি ভাবছেন, আপনাদের মেয়ে বিয়ে করায়ে আনছি, আত্মীয় হইছেন তাই আপনাদের অতীতের কুকীর্তি সব ভুলে গেছি, মাফ করে দিয়েছি?”
মোর্শেদ আর সালিম ওকে অপরকে দেখলো। শুভ্রা কি করবে বুঝতে না পেরে একবার শাশুড়ীকে দেখে আরেকবার বাবা চাচাকে দেখে। জলি বললো-“তেরো বছর আগে কি করেছিলেন আপনারা মনে আছে? আমার স্বামী নির্বাচনে আপনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল বলে তাকে গুম করলেন। তারপর তাকে আর দেখার সৌভাগ্য হলো না আমাদের। রণ তখন আঠারো বছরের তরুণ। আমার হাসিখুশি মাত্র আট বছরের।”
সালিম সাহেব আড়চোখে মেয়েকে দেখলো। শুভ্রার চোখে বিভ্রান্তি। সে অবিশ্বাস নিয়ে বাবা চাচাকে দেখছে। সালিম সাহেব বললো-“আপা, কি বলতেছেন এইসব? আমরা কেন এমন কিছু করবো?”
জলি তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থেকে বললো-“আমি প্রতিদিন আপনার বাসায় যেতাম। কত আকুতি মিনতি করেছি আপনাদের। একফোঁটা মন গলেনি আপনার। আপনারা কি ভেবেছিলেন, সেসব দিনের কথা ভুলে গেছি? আপনি আপনারা ভুলে যেতে পারেন কিন্তু আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবো না। নিজের স্বামীর কবর পর্যন্ত নসীব হয় নাই। আমার সন্তানেরা জানেই না বাবার পরিনতি। এসব কখনো ভুলে যাওয়া যায়? সেই আপনার মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে বউ করে এনেছি। কি মনেহয় আপনার? এমনিতেই?”
সালিম সাহেব বাকহারা হয়ে গেলেন। জলির কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কি বলছে এসব মানুষটা? শুভ্রাকে বিয়ে করানোটা পরিকল্পিত? শুভ্রাও হতবাক হয়ে চেয়ে আছে শাশুড়ীর দিকে-“আন্টি, কি বলেন এসব?”
জলি ক্রুর হাসলো-“আমার আঠারো বছর বয়সী ছেলের কাঁধে সংসারের জোয়াল উঠলো। ছেলের সুন্দর দিনগুলো পরিশ্রমে বদলে গেলো। আমার মেয়েদের শৈশব হলো অবহেলিত। প্রতিরাত একা একা ছটফট করতে করতে ভেবেছি কি করলে আপনাকে শাস্তি দেওয়া যাবে? কি করলে আমার স্বামীর প্রতি আপনাদের জঘন্য আচরণের বিচার হবে। ভাবতে ভাবতে একদিন উপর ওয়ালা সুযোগ দিলো। সালিম সাহেবের কন্যা তার জানের জান। সেই কন্যার জীবনটা যদি নিলামে তোলা যায় তাহলে কেমন হয়?”
“আপা!”
জলি আঙুল তুললো-“চিৎকার করবেন না ভাই। আপনি এখন কোথায় আছেন এটা ভুলে যাবেন না। আপনারা কি আশা করে এ বাড়িতে এসেছেন? আপনার অকর্মার ঢেঁকি মেয়েকে আমি মেনে নিয়ে মাথায় তুলে নাচবো? তারপর আপনার লম্পট ছেলের হাতে আমার মেয়ে তুলে দেব? এতো সহজ? এতো সস্তা ভাবেন আমাদের? অপরাধ নিজে করেছেন বলেই দোষ চোখে পড়ছে না ভাই সাহেব। সমস্যা নেই। একদিকে খুব ভালো হয়েছে আজ আপনারা এসেছেন। আল্লাহ প্রতিবার আমাকে দারুণ সুযোগ করে দিয়েছেন। এবারও দিলেন।”
“মানে? কি বলতেছেন আমি বুঝতেছিনা।”
সালিম বিস্ময় নিয়ে বললো।
“বুঝবেন সব বুঝে যাবেন এখনই। খুব সহজ ভাষায় বলি, আপনার গুনধর মেয়েকে আপনি এবার নিজের সাথে নিয়ে যাবেন। সে আমার ছেলের উপযুক্ত না মোটেও। ছেলেকে আমি আবার বিয়ে করাবো।”
“আন্টি!”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো। জলি খেঁকিয়ে উঠলো-“কিসের আন্টি হ্যাহ? যাও নিজের সব গুছিয়ে নাও। বাবার সাথে ফিরে যাও নিজের বাসায়। আমার বাবাই এর জীবন যথেষ্ট খারাপ করেছ আর না।”
সালিম আর মোর্শেদ দু’জনই দাঁড়িয়ে গেলো। সালিম সাহেব হুঙ্কার দিলেন-“কি বলতেছেন এইসব। আপনে আমাদের অপমান করতেছেন? নিজে সাইধা আমার মেয়েকে বিয়ে করাইছেন এখন উল্টা পাল্টা বলতেছেন। মেয়েকে নিয়ে যাবো মানে কি? কেন নিয়ে যাব?”
“কারন আমি আর ওকে বউমা হিসেবে স্বীকার করতে চাই না। বাবাই ফিরলে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। আপাতত নিয়ে যান ওকে।”
“আন্টি, এসব কি বলছেন? কেন বলছেন? কি করেছি আমি?”
বলতে বলতে শুভ্রা কেঁদে দিলো। জলি বিরক্তি নিয়ে হাত ঝাকায়-“এরকম নাকি কান্না কেঁদো নাতো। তোমার বিয়ে দিতে কোন সমস্যা হবে না তোমার বাবার। তাই না ভাই সাহেব? আজ ডিভোর্স হলে কাল পাত্রের ভীড় জমিয়ে দেবেন। যাও, তাড়াতাড়ি নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বিদায় হও।”
শুভ্রা ফুপিয়ে কেঁদে দিলো-“আমি যাবো না আন্টি। উনি আমাকে চলে যেতে বলেননি। ওনার সাথে কথা না বলে আমি যাবো না।”
“বাবাই আমার কথার উপর কথা বলবে বলে মনেহয় তোমার? এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছে দেখছি। শোন মেয়ে, তোমাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত যেমন আমার ছিলো তেমনি তোমার এ বাড়ি থাকা না থাকার সিদ্ধান্তও আমারই হবে। বুঝতে পেরেছ?”
“আমি মানি না আপনার সিদ্ধান্ত। কেন এমন করছেন আপনি? আন্টি প্লিজ এমন করবেন না। আব্বা, আপনি কিছু বলেন না। বলেন আপনি কিছু করেন নাই।”
শুভ্রা জলির পায়ের কাছে পড়লো। সালিম সাহেব চেচিয়ে উঠলো-“কাজটা ভালো করতেছেন না আপা। খুব অন্যায় করতেছেন? আপনে আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা নিয়ে খেলতেছেন।”
জলি হাসলো-“আপনার চাইতে বেশি অন্যায় কি করছি? এ যে দেখছি ভুতের মুখে রাম নাম।”
মোর্শেদ এগিয়ে এসে শুভ্রার হাত ধরলো-“চল শুভ্রা। যেখানে মান থাকেনা সেখানে থাকতে হয় নারে মা। চল।”
“না আমি যাব না চাচ্চু। উনি বিদেশ থেকে ফিরুক, নিজের মুখে বলুক আমাকে চায় না তাহলে চলে যাব।”
“আম্মাজান, চলেন। এইখানে আর এক মুহূর্ত না। এই বাড়ির কিছুই নিবেন না। আপনের আব্বার কিছু কম নাই। সব আপনার পায়ে লুটায় দিব। কিন্তু অসন্মানের জায়গায় আর না আম্মা।”
“না আমি যাবো না। ওনার সাথে কথা না বলে যাবো না।”
সালিম সাহেব এবার গর্জে উঠলো-“আম্মাজান, আপনার আব্বার মান ডুবায়েন না। চলেন বলতেছি। না গেলে আপনার আব্বার মরা মুখ দেখবেন কইলাম।”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো-“আব্বা এমন কথা বইলেন না। কেন এমন করতেছেন আপনারা? আমার দোষটা কোথায়?”
“তোমার দোষ তুমি আমার কাছে এসেছিলে আমার ছেলের সর্বনাশের ইচ্ছে নিয়ে। তোমাদের পরিবারের বড় গর্ব, দাম্ভিকতা তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অন্যায় করেও তোমরা বীরদর্পে চলাফেরা করো। আমাদের প্রতি এতো বড় অন্যায় করেও তোমার বাবা থামতে চায়নি। তোমার একভাই আমার ছেলেকে মারতে চায় আরেক ভাই আমার মেয়ের দিকে নজর দেয়। আজ তুমি ফিরে গেলে যদি তোমার বাবার অহংকার চূর্ণ হয়।”
শুভ্রা অবাক চোখে জলিকে দেখলো-“আপনি এইজন্য আমাকে বিয়ে করিয়েছিলেন? আপনার ছেলে ভালোবাসে আমাকে। তার কথাও ভাবলেন না?”
“ভালোবাসলে ভুলেও যাওয়া যায়। তুমি ওকে নিয়ে ভেবোনা শুভ্রা। ও ঠিক সামলে নিতে পারবে। তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো।”
শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। এতোদিনের পরিচিত মুখটাকে ভীষণ অচেনা লাগে তার কাছে। জলির মুখটায় আগে মা মা ছায়া থাকতো। আজ কেমন ভয়ংকর লাগছে। মুখটা আজ কেবলমাত্র একজন প্রতিশোধ পরায়ন নারীর মুখ হয়ে গেছে।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৭

পুরোটা পথ কেটে গেলো নিরবতায়। মোর্শেদ, সালিম কিংবা শুভ্রা কেউই কারো সাথে কথা বললো না। শুভ্রা মনে মনে প্রথমে শাশুড়ীর উপর তারপর নিজের বাবা চাচার উপর ভীষণ রেগে থাকলো। ওরা আজ না গেলে নিশ্চয়ই এমন কিছু হতো না। রণ থাকলে ওর মার এরকম উল্টো পাল্টা কিছু করার প্রশ্নই আসে না। এখন রণ ফেরার পর যখন শুনবে বাবা আর চাচা তার অনুপস্থিতিতে তার বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তখন নিজের মাকেই ঠিক মনেহবে তার। নিশ্চয়ই শুভ্রাকে দোষ দেবে। অথচ এসব বিষয়ে শুভ্রা কিছুই জানে না। শুভ্রার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। শরীর জ্বলছে মেজাজের চাপে। নিজের বাবার দিকে একবার তাকালো সে। এতোদিন জানতো বাবা তাকে ভালোবাসে। আজ সেই ভালোবাসা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে। ভালোবাসলে নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন করতে পারে? জেনেবুঝে মেয়ের জীবন নষ্ট করবে কেন? শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু ভালো লাগছে না।

সালিম সাহেব মেয়েকে দেখলো একনজর। মলিন মুখটা দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো। যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়েছিল। এখন মেয়েটা ফিরে গেলে লোকসমাজে ছিছি তো হবেই সেই সাথে হেরে যাওয়ার সূক্ষ্ম ক্ষত তৈরি হবে। যে ক্ষত চুইয়ে রক্ত ঝড়বে চিরজীবন। তাদের পরিবারের উপর নজর লেগে গেছে বোঝা যাচ্ছে। সবদিক দিয়ে চাপে পড়ে গেছে। এরমধ্যে ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলে যেন একহাত হারিয়ে ফেললো সালিম সাহেব। এখন মেয়ের এই অবস্থা কিভাবে সামাল দেবেন? পুরনো রাগের ধারা ফিরে আসছে তার মধ্যে। নাহ, নরম হয়ে বেশ বিপদে পড়ে গেছেন দেখা যায়। এখন তো সেই পুরনো রুপে ফেরা ছাড়া গতি নেই তার। সেই খুনো সালিম যাকে দেখে বাঘা বাঘা নেতারা মাথা নুইয়ে থাকতো। সালিম ঠিক করে ফেললো, এবার মেয়র নির্বাচনে যে কোন মুল্যে জিতবেন৷ তারপর এই শহর চালানোর ক্ষমতা নিজের হাতে নেবেন। রণকে দেখিয়ে দেবেন পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। রণর মা আজ যা করলো তার জন্য আফসোস করতে হবে তাকে। সে ভুলে গেছে কার সাথে কথা বলেছে। ইব্রাহিম সালিম কোন মামুলি মানুষ না। এখন হয়তো তার সময় খারাপ তাই বলে শেষ হয়ে যায়নি সে। তার মেয়ের সাথে খারাপ করে রণ টিকতে পারবেনা এই পৃথিবীতে। দরকার পড়লে রণকে ওর বাপের মতোই নিশ্চিন্হ করে দেবে। তখন দেখবে রণর মা কিভাবে বড়াই করে। সালিমের চোয়াল শক্ত হয়, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ।

এদিকে মোর্শেদ কিছুটা সংকোচ নিয়ে বসে আছে। নিজের কাছে বড্ড অপরাধী লাগছে। ছেলের বিয়ের কথা বলতে এসে এমন কান্ড হবে টের পায়নি। সালিম একবার বলেছিল বটে কিন্তু সত্যি সত্যি পরিস্থিতি এভাবে বদলে যাবে ভাবেনি। এখন শুভ্রাকে দেখে বুক গুড়গুড় করছে। মেয়েটা মনেহয় জামাইকে ভালোবাসে তা নয়তো এভাবে শাশুড়ির পায়ে পড়তো না। এখনতো ভয় হচ্ছে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে না যায়। মোর্শেদ অপরাধী মুখ নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।

*****

দুইদিন পরে রণ ফিরলো। মনটা ভীষণ উৎফুল্ল ছিলো। এবার সব কাজে বেশ ভালো পারফরম্যান্স করেছে তারা। ইনভেস্টমেন্ট এর ব্যাপারে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বন্দর ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা গড়ে তুলতে বেশ ভালো প্রস্তাব এসেছে। এখন সে প্রস্তাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেত্রী ভীষণ খুশি বলা যায়। গাড়িতে আসতে আসতে শুভ্রার কথা ভাবলো বারকয়েক। ফোন দিতে গিয়ে থেমে গেলো। ভাবলো ফোন না দিয়ে সরাসরি বাসায় গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক মেয়েটা খুব খুশি হবে।

ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ঢুকলো রণ। যথারীতি মায়ের ঘরে গেলো প্রথমে। টুকটাক আলাপ সারতে সারতে রণ ভেতর ভেতর ছটফট করে। কখন দেখতে পাবে শুভ্রাকে। সে এলে শুভ্রাই দরজা খোলে, শরবত তৈরি করে নিয়ে আসে। আজ শুভ্রার ছায়াও দেখলো না। গেলো কোথায় মেয়েটা। রণ অস্থির হয়ে বলেই ফেললো-“আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি মা। দীর্ঘ জার্নি তো শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে।”
জলি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ঠোঁট দু’টো চেপে রইলো। রণ উত্তরের অপেক্ষা করলোনা। ছুটে এলো নিজের কামড়ায়। শুভ্রাকে ডাকলো বারকয়েক। কোন সারা না পেয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে আসার পরও যখন শুভ্রার পাত্তা নেই তখন তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। এরকম তো কখনো করে না শুভ্রা। ফোন নিয়ে ঝটপট ফোন লাগায়। ফোনটা বিছানার উপরই একবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। হাতে নিয়ে দেখলো চার্জ শেষ। সে কি মনে করে একবার রান্না ঘরে উঁকি দিলো। সেখানে কাজের মেয়েটা কাজ করছে। রণ ছুটে এলো মায়ের ঘরে-“মা, শুভ্রা কোথায়? আমি এলাম এতোক্ষণ হলো কিন্তু ওকে দেখলাম না।”
জলির মুখের রেখাগুলো বদল হলো। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রান চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রণ যেন জলিকে কিছুটা পড়তে পারে। বুঝলো কিছু একটা হয়েছে, ঘরে কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। তার বুকটা ধকধক করছে। মনে কু ডাকছে। সে উত্তেজিত হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“মূ, তুমি চুপ করে আছো কেন? কি হয়েছে? শুভ্রা কোথায়?”
জলিকে কিছুটা বিচলিত দেখায়। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে ছেলেকে দেখলো। শীতল কণ্ঠে বললো-“শান্ত হয়ে আমার সামনে বোস। কথা আছে তোর সাথে।”
রণর ছটফটানি বাড়লো। সে চঞ্চল হয়ে জলির সামনে বসলো-“কি বলবে বলো। তার আগে বলো শুভ্রা কোথায়?”
জলি নিজেকে শান্ত রেখে স্থিমিত কন্ঠে বললো-“সে নাই চলে গেছে।”
“চলে গেছে! কোথায় চলে গেছে?”
রণ না বুঝে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে জলি দীর্ঘ শ্বাস ফেললো-“ক’দিন ছিলি না। তোর অনুপস্থিতিতে অনেক কিছু ঘটে গেছে বাবাই। তোর শশুর আর চাচা শশুর এসেছিল আমাদের এখানে। তারা খুশির বিয়ের প্রস্তাব এনেছে তন্ময়ের সাথে। তুই ভাবতে পারিস ওদের সাহস কতো?”
রণর চোয়াল শক্ত হলো। সে ঠান্ডা গলায় বললো-“তুমি আমাকে ফোন দাওনি কেন মা? ওদেরকে তখনই শায়েস্তা করতাম।”
“তুই গেছিস কাজে তাই তোকে বিরক্ত করিনি। কিন্তু কথা হলো তোর বউ কিভাবে এলাও করলো এসব? তুই মানা করার পরও ওর বাবা আর চাচাকে খুশির বিয়ের প্রস্তাব আনতে বললো কেন?”
রণকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“কিন্তু মা, শুভ্রার এমন কিছু করার কথা না। ও নিজেই তন্ময়ের সাথে বিয়েতে রাজি ছিলো না। ওর বাবাকে নিষেধ করে দিয়েছিল। ও হয়তো জানতো না ওরা প্রস্তাব নিয়ে আসবে।”
জলিকে অসন্তুষ্ট দেখায়-“মানতে পারলাম না বাবাই। তুই বলতে চাস ওর বাবা ওকে না জানিয়ে এখানে এসেছিল? এটা কি সম্ভব?”
রণ জবাব দিতে পারলোনা। চুপ করে রইলো।
“ওর বাবা আর চাচার সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আমি শুভ্রাকে বলেছি নিজের পরিবার নিয়ে এসব করার ইচ্ছে থাকলে যেন সে চলে যায় তার বাবার সাথে। বিয়ের পর তো আমাদের আপন ভাবেনি। বাবা ভাইয়ের জন্য টান সর্বদা তাহলে এ বাড়িতে থেকে কি হবে। তাই না বল?”
রণ অবিশ্বাস নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না মা কি বলছে। মায়ের মাথাটাথা খারাপ হলো নাকি? সে বড়বড় চোখপ জানতে চাইলো-“তুমি কি বলছো আমি বুঝতে পারছি না। শুভ্রাকে চলে যেতে বলেছ মানে কি?”
“গতবার এমন একটা ঘটনা ঘটালো ওর ভাই তবুও শুভ্রা তারই পক্ষ নিলো। এবার ও বাবা চলে এলো প্রস্তাব নিয়ে। মেয়েটা এ বাড়িতে থাকলে এসব চলতেই থাকবে এটা ভেবেই আমি বলেছি ও না হয় বাড়ির হয়ে থাকুক না হয়ে ও বাড়ি ফিরে যাক। দোটানায় তো সংসার হয় না বাবাই। ওর জন্য আমি আমার মেয়েদের জীবন রিস্কে ফেলবো কেন? আজ ঘরে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে কাল যে জোর করে তুলে নিতে চাইবে না তার কি গ্যারান্টি?”
“এসবের সাথে শুভ্রার সম্পর্ক কি মা? ও তো কাউকে এসব করতে বলেনি।”
জলির চেহারা কঠিন হলো-“শক্ত হয়ে মানাও তো করছে না। অনেকদিন সহ্য করেছি বাবাই। সবচেয়ে বড় কথা তোর বউ চলে গেছে ওর বাবার সাথে। ওর যদি তোর জন্য আমাদের জন্য সামান্যতম টান থাকতো তাহলে কি যেতে পারতো? বরং ও বাড়ির সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতো। কিন্তু তা না করে কি করলো? একবারও তোর আমার কথা ভাবেনি। প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করেছিল তা কমপ্লিট করে এখন বিদায় নিয়েছে। বুঝেছিস?”
কিছুই বুঝলো না রণ। মায়ের কথার কোথাও শুভ্রার দোষ না পেলেও মায়ের সামনে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারলোনা। মায়ের একটা কথায় সে সহমত পোষণ করলো। আসলেই তো, এতো সহজে ও চলে গেলো কেন? নিজের সংসার ফেলে কেন গেলো? সেদিনই না রণকে ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করলো? কেন জানতে চেয়েছিল তাহলে? যদি সংসারই না করবে তবে ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? রণর বুকটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। হাসফাস করে রণ উঠে দাঁড়ায়। জলি বারকয়েক খাওয়ার কথা জানতে চাইলো কিন্তু সেসব কথা রণর মাথায় ঢুকলো না। সে মোহগ্রস্তের মতো মায়ের কামড়া থেকে নিজের কামড়ায় এলো। অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে পুরো কামড়ায় নজর ঘুরালো। পুরো কামড়া শুভ্রাময়। মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে গেছে! ওর বাবার বাড়িতে ফিরে গেছে! অথচ ও ভেবেছিল শুভ্রা ভালোবাসা ওকে। জেদের বিয়ে ভালোবাসায় গড়িয়ে গেছে ভেবে খুশি হয়েছিল। বাবার খুনির মেয়েকে নিয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল রণ। রণ পাগলের মতো কিছুক্ষণ ঘরে পায়চারি করে। বিরবির করলো, কেন চলে গেলে শুভা? আমার জন্য একটা বার অপেক্ষাও করলেনা? কেন শুভ্রা কেন? এতোদিনে তোমার মনে একটুও কি ভালোবাসা, বিশ্বাস জন্মেনি আমার জন্য? আহহহহ! কেন এমন করলে? রণ হুট করে শুভ্রার মোবাইল ছুঁড়ে দিলো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করলো-“শুভ্রাআআআআআ!”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে