দর্পহরন পর্ব-৪০+৪১

0
151

#দর্পহরন
#পর্ব-৪০

রণর কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে শুভ্রা। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হতেই আপনাতেই রণর হাত উঠে এলো শুভ্রার মাথায়। ধীরে ধীরে শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রণ। কিছু সময় পার হওয়ার পর শুভ্রার কান্নার শব্দ কমে এলে রণ মোলায়েম কন্ঠে ওকে ডাকলো-“শুভ্রা, কি হয়েছে? কেন কাঁদছেন বলবেন একটু? বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে? আবার যেতে চান?”
শুভ্রা মাথা নাড়লো। রণ ধৈর্য্য না হারিয়ে নরম কন্ঠে বললো-“তবে? কেউ কিছু বলেছে?”
শুভ্রা এবার ছোট্ট করে উত্তর দিলো-“হুমম।”
“কে বলেছে?”
“আন্টি।”
রণ শুভ্রার দু বাহু ধরে সামনে আনলো। শুভ্রা মাথা নিচু করলো সাথে সাথে। রণ কয়েক সেকেন্ড নতমুখী শুভ্রাকে দেখে অবাক গলায় বললো-“মা! মা কি এমন বলেছে বলুন তো?”
শুভ্রা ভাঙা গলায় বললো-“আন্টি আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি নাকি আপনাকে মেরে ফেলতে চাই তাই বিয়ে করেছি।”
এ কথা শুনে রণ এবার পেছনে হেলান দিয়ে আয়েস করে বসলো-“ভুল কি বলেছে মা? মারতে তো চান আপনি আমাকে।”
শুভ্রা রেগে গেলো-“অযথাই বাজে বকবেন না। আমি কেন আপনাকে মারতে চাইবো?”
“আপনাকে কিডন্যাপ করেছিলাম বলে। দুই মাস বন্দী থেকে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আপনি প্রতিশোধ নিতে আমাকে মেরে ফেলতে চান। মা ভুল কিছু তো ভাবেনি।”
শুভ্রার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো-“মানলাম প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি তাই বলে মেরে ফেলবো? মেরে ফেললে লাভ কি হবে আমার? বরং আপনি বেঁচে থাকেন তারপর আমি রসিয়ে রসিয়ে অত্যাচার করবো আপনাকে। তাহলেই না মজা?
তাহলে বলুন মেরে ফেলার চিন্তা করবো কেন আমি?”
রণ চোখ গোল করে তাকায়-“রসিয়ে রসিয়ে অত্যাচার করবেন? তা রসালো অত্যাচারটা কেমন হতে পারে একটু বলবেন?”
শুভ্রা অপ্রস্তুত হয়ে রণর দিকে তাকালো। রণর মুখের চোরা হাসিটা অনেক কষ্টে বুঝে আসলো ওর। শুভ্রা ভেতরে ভেতরে রেগে গেলো খুব। এই লোকটা আস্ত একটা বদ। সবসময় চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর তালে থাকে। খারাপ লোক একটা। শুভ্রা গম্ভীর মুখে বিছানা থেকে নেমে যেতে চায়। রণ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো-“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আপনার খাবার আনতে। খাননি নিশ্চয়ই?”
“বেশি করে আনবেন খাবার। আজ আপনিও সারাদিন খাননি বুঝতে পারছি। আমার ভাগেরটা খেয়ে পোষাবে না আপনার। আর হ্যা, যাওয়ার আগে শাড়ীটা ঠিক করে নিন। এমন আলুথালু বেশে বাইরে গেলে কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে বলুন তো?”
রণর ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি। শুভ্রা এবার ঝটপট নিজের শরীরের দিকে তাকালো। ভীষণ লজ্জায় নুইয়ে গেলো সে। বুকের উপর থেকে আঁচল সরে গেছে। তা কোনরকমে লুটোপুটি খাচ্ছে কাঁধের উপর। শুভ্রা একবার রণকে দেখলো। সে ঠোঁটের দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শুভ্রা দ্রুত হাতে বুকের উপর আঁচল টেনে নিলো। তার গাল লাল হয়ে গেছে এরই মধ্যে। মাথাটা লজ্জায় নুইয়ে পড়ে আছে। তার এমন অবস্থা দেখে রণ দারুণ মজা পাচ্ছে, তা বুঝতে পেরেই শুভ্রা অতিদ্রুত ঘর ছেড়ে পালায়।

*****

“আচ্ছা, আন্টি যদি আমাকে ছেড়ে দিতে বলে তাহলে ছেড়ে দেবেন?”
রণর খাওয়া থেমে যায়। শুভ্রার কথা বুঝতে চোখ কুঁচকে তাকায়-“কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।”
শুভ্রা ইতস্তত করলো-“মানে আন্টির কথায় যেমন আমাকে বিয়ে করেছিলেন তেমনভাবেই যদি আন্টি আমাকে ডিভোর্স দিতে বলে দিয়ে দেবেন?”
এবার একটু স্বস্তি পেলো রণ। সে রহস্য করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“আপনার কি মনেহয়? কি করা উচিত হবে আমার?”
শুভ্রা ঠোঁট উল্টো বলে-“তার আমি কি জানি? মা ভক্ত ছেলে আপনি মায়ের কথাই নিশ্চিয়ই শুনবেন?”
রণ মুচকি হাসলো-“তাই কি করা উচিত না? মায়ের কথা শুনেছিলাম বলেই তো আজ আপনার সাথে বসে খাবার খাচ্ছি। এটা কি খুব খারাপ হয়েছে?”
শুভ্রা জবাব দিতে পারলোনা। তবে মনের ভেতরটা টলমল করছে। তাহলে কি মায়ের কথায় রণ ওকে ছেড়ে দেবে? রণ খেতে খেতে বললো-“গতদিন যেটা হয়েছে তাতে মা ভয় পেয়েছে। আর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। এখন সেই ভয় থেকে সে যদি আপনাকে কিছু বলে তাহলে মনখারাপ করবেন না। আপনি বরং মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করুন। তাকে বোঝান সে যা ভাবছে তা ভুল। তাহলেই তো সব প্রবলেম সলভ হয়ে যায়।”
শুভ্রা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো-“কিন্তু কিভাবে বুঝাবো আন্টিকে?”
রণ হেসে দিলো-“এটাও আমাকে বলে দিতে হবে?”
শুভ্রা নিরীহ মুখ করে বললো-“তো আমি কিভাবে জানবো? আগে কি বিয়ে করেছি নাকি?”
রণ চোখ বড় করে তাকায়-“আমার বুঝি এটা দ্বিতীয় বিয়ে?”
শুভ্রা গাল ফোলায়-“শাশুড়ীকে কিভাবে পটাব সেটা শাশুড়ীর ছেলেই বলে দেবে।”
রণ অবাক হয়ে তাকায়-“তাই? তা বুদ্ধি দাতার জন্য কি বরাদ্দ থাকবে?”
“আপনি খুব খারাপ জানেন এটা? সবকিছুতে বিনিময় খোঁজেন। কেন নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে সাহায্য করা যায় না? পূণ্যের কাজে বিনিময় খুঁজতে নেই জানেন না?”
শুভ্রার অভিমানি কথা শুনে রণ হা করে কিছুক্ষণ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হো হো করে হাসলো-“কথা তো ভালোই জানেন দেখছি। আর আমি কিনা এতোদিন ভেবেছি আপনি কম বোঝা মানুষ।”
শুভ্রা মন খারাপ করে বললো-“আমি যেমন আন্টিকে খুব ঠান্ডা মানুষ হিসেবে জানতাম। এখন দেখছি সে পুরাই আগ্নেয়গিরি।”
রণর মুখের হাসি মুছে গেলো-“মা কিন্তু ঠান্ডা মানুষই। তাকে কোনভাবেই ভুল বুঝবেন না। আমারও তাকে নিয়ে কিছু শুনতে মোটেও ভালো লাগবে না।”
শুভ্রা নিভু নিভু গলায় বললো-“ভুল আমারই। সব দিক দিয়ে আমিই দোষী।”
“আমি উঠছি। কাল আবার একটু ফরিদপুর যাব।”
রণ উঠে দাঁড়াতেই শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন, আমি কি কিছু করতে পারি? মানে বাড়িতে বসে থাকা খুব বোরিং লাগছে।”
রণ ভাবলো কিছু সময় তারপর জবাব দিলো-“আমার আপত্তি নেই তবে মাকে একবার জিজ্ঞেস করে নেবেন।”
বলেই আর দাঁড়ালো না। শুভ্রা খাবার প্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো।

*****

দেরি করে ঘুম ভেঙেছে শুভ্রার। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসেছে তখনই জলি এসে দাঁড়ায়-“বউ হয়ে এসেছ কম দিন তো হয়নি। আর কতদিন এরকম নতুন বউ সেজে থাকবে? তুমি কি এখানে অতিথি? দেরি করে উঠবে, ইচ্ছেমতো সময়ে নাস্তা খাবে। সংসারে কোথায় কি হচ্ছে কোন খবর রাখবে না। এভাবে কি সংসার করা যায়? মন কি এখনো বাপের বাড়ি রেখে এসেছ? শোন মেয়ে, সংসার করার ইচ্ছে থাকলে মন দিয়ে সংসার করো। না হলে বিদায় নাও আমাদের জীবন থেকে। এমনিতেও বাপ ভাইয়ের আগে আর কিছু চোখে পড়ে না তোমার।”
শুভ্রার কান্না পেলেও চুপ করে রইলো। জলি থামার পর আস্তে করে জানতে চাইলো-“আন্টি, আপনি কেন আমার সাথে এমন করছেন আমি জানি না। তবে ভাইয়া ওনার উপর হামলা চালাবে এটা সত্যি আমি জানতাম না। আপনি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝছেন। আর সংসারের কাজ নিয়ে আমার জ্ঞান কম তাই যদি বলে দিতেন কি করতে হবে আমাকে। আমি তাই করার চেষ্টা করবো। বাবার বাড়ি নিয়ে ভয় পাবেন না। আজকের পর আর বাবার বাড়ি যাবো না। কারো সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ রাখবো না।”
এসব কথা শুনেও জলি নরম হলো না। কড়া গলায় বললো-“কাল থেকে সকালে উঠবে। বাবাই যেন না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না। রান্না কি হবে, বাজার আছে কিনা, মেহমান এলে কি খাবে, কোথায় থাকবে, কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেসব দেখবে। না বুঝলে আমায় জিজ্ঞেস করে নেবে।”
জলির কথা শুনে বারকয়েক ঢোক গিললো শুভ্রা। কেথায় ভাবছিল চাকরি বাকরি করবে। এখন দেখছে তাকে ঘরকন্নার কাজ দেওয়া হচ্ছে যা করার কথা কখনো মাথায় আসেনি। সারাজীবন বাড়ি থেকে একা একা দূর দেশে থেকেছে। বাড়িতে বেড়াতে এলেও কাজ করার লোক ছিলো বলে কখনো কাজ করতে হয়নি। আর এখন কিনা তাকেই এতোসব কাজ করতে হবে? এতো এতো কাজের ফিরিস্তি শুনেই কেমন যেন লাগছে। মনেহচ্ছে এরচেয়ে কঠিন কাজ একটাও নেই। জলি তীক্ষ্ণ নজরে শুভ্রাকে মাপছিল-“শোন, তিনদিন পরে তোমার শশুরের মৃত্যুবার্ষিকি আছে। তেমন কিছু করি না। কেবল এতিম বাচ্চাদের জন্য কাপড় কিনে দেই আর নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াই। এবার তো আমার শরীর ঠিক নেই। কাজেই কাপড় কেনা আর রান্নার ভার তোমার নিতে হবে। হাতে তিনদিন আছে, মন দিয়ে রান্নাটা শিখে নাও। দেখি কেমন পারো। সালিম সাহেব ছেলেমেয়েকে খালি গুন্ডামী শিখিয়েছেন নাকি কাজও শিখিয়েছেন সেটাও দেখা হয়ে যাবে এই ফাঁকে।”
বাবার কথা শুনেই বুঝিবা শুভ্রার মন শক্ত হলো। সে মাথা দুলিয়ে বললো-“পারবো আন্টি। আমি ঠিক পারবো। আপনি ভাববেন না।”
জলি হেলাভরে জবাব দিলো-“পারলেই ভালো। না হলে বাবাইয়ের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে। ছেলে আমার জন্য কেন ভুগবে, তাই না বলো?”
শুভ্রা কিছু না বলে চুপচাপ নাস্তা নিলো প্লেটে। যদিও খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও সব ঠিক আছে জলিকে এটা দেখাতেই যেন জোর করে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করলো।

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৪১

গত তিনদিনে শুভ্রা যত চেষ্টাই করেছে সব মোটামুটি ফেল গেছে। কোনভাবেই জলিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। আজ রীতিমতো বুক কাঁপছে তার। সকাল থেকে রান্নার প্রিপারেশন নিয়ে ভয়ে ভয়ে গরুর মাংস, মুরগী আর পোলাও রান্না করে গোসলে গেছে। রান্নার স্বাদ কেমন হয়েছে বুঝতে পারছে না। নিজের কাছে মোটামুটি লেগেছে এখন এই রান্না বাচ্চাগুলো তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলেই শুভ্রা খুশি।

এ বাড়িতে আজ খুব ভীড়। রণর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী বলে কাছের আত্মীয়, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ভীড় করেছে। তাদের জন্য স্পেশাল রান্না হচ্ছে যা বাবুর্চী করছে। জলির মা, দুই বোন, ভাইয়েরা, তাদের বউ বাচ্চা সবাই এসেছে। হাসিখুশি কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রণও আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। শুভ্রা তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গেলো। সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় ঘোমটা টেনে দোতলায় এলো।

এতিম বাচ্চাগুলো চলে এসেছে। মোট বারোজন বাচ্চা। তাদের নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ানোর আদেশ দিয়েছে জলি। শুভ্রা প্রতিটা প্লেটে যত্নের সাথে খাবার তুলে দিলো। বাচ্চাগুলোর কাছে বসে থেকে খাবার খাওয়ালো। বারবার জানতে চাইলো, খাবার কেমন হয়েছে। ছোট ছোট ফুলের মতো বাচ্চারা মিষ্টি হেসে খেতে লাগলো। বড় ভালো লাগে শুভ্রার। এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম শুভ্রার। মনটা অজানা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে তার। খাবার খাইয়ে বাচ্চাদের হাতে কিছু নতুন কাপড়, খাতা, কলমের প্যাকেট তুলে দিলে ওরা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো।

জলি বসে চোখের পানি ফেলছে আর রণ মায়ের সামনে বসে আছে। তারও মনটা আর্দ্র হয়ে আছে। তবে মায়ের সামনে সে সহজে চোখের পানি ফেলে না। সেলিনা মেয়ের কাছে বসে আছে। জলি মায়ের দিকে তাকালো-“তেরো বছর হইলো মা। তেরো বছর ধরে লোকটা নিখোঁজ থেকে গেলো। কি জ্বালা ধরে মনে কেমনে বুঝাই।”
সেলিনা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলো। রণর চোখ ছলছল। চোখের জল লুকাতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। জলি চাপা গলায় বললো-“লাশ পাইলেও মনকে স্বান্তনা দিতে পারতাম। তার তো কোন কবর নাই। দোয়া করি কেমনে? জানতেও পারলাম না মানুষটা বেঁচে আছে না মারা গেছে। মারা গেলে কেমনে মারা গেছে।”
সেলিনা ভেজা গলায় বললো-“আর তুই জামাই এর অপহরণকারীর মেয়েকে ঘরে তুলে আনছিস। কেন এই কাম করছিস জলি? ওই মেয়েকে দেখলেই রাগ উঠে আমার।”
জলি চোখ মুছলো-“বাবাইকে বাঁচাতে। স্বামী নাই, ছেলেকে হারাইলে কেমন করে বাঁচবো মা? ওই শয়তানটাকে চিনি তো। সুযোগ খুঁজে বাবাইকে মারার চেষ্টা করতো। ভাবছিলাম নিজের মেয়েকে নিশ্চয়ই বিধবা করতে চাবে না। কিন্তু দেখলাম মেয়ে বোন কারো কেয়ার করে না এরা এমনই জালিমের বংশ। এখন ঠিক করছি, ওই মেয়েকে বিদায় করে দিব। আর ভয় পাবো না। বাবাইকে ভালো কোন মেয়ে দেখে বিয়ে দিব।”
রণ আঁতকে উঠলো-“মা! কি বলো এইসব? বিয়ে কি ছেলেখেলা? আজকে একে তো কালকে তাকে? দয়া করে এমন কিছু করবা না তুমি।”
জলি খেপে গেলো-“আমার উপর দিয়ে কথা বলবি না বাবাই। ওকে আমিই তো বিয়ে করতে বলেছিলাম এখন আমিই বলছি ওকে ছেড়ে দিতে। একেতো মেয়েটা এই সংসারের উপযুক্ত না তারউপর ওর বাপ ভাই। ওই লোককে কিছুতেই মাফ করবোনা আমি। ওই বদমাশ লোককে এভাবেই শায়েস্তা করতে হবে। ওর মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে।”
রণ খেপে গেলো-“মা, পাগল হয়ে গেছ তুমি? কিসব বলছো? আমি তো বিয়ে করতে চাইনি তুমি জোর করেছিলে। এখন এসব পাগলামির মানে কি? নানু প্লিজ মাকে বোঝাও।”
জলিও পাল্টা রাগ দেখায়-“এতো তাড়াতাড়ি বাবাকে ভুলে গেছিস বাবাই? কিভাবে পারলি?”
রণ অবাক হয়ে গেলো-“এসব কথার সাথে বাবাকে ভুলে যাওয়া না যাওয়ার সম্পর্ক কি মা?”
“সম্পর্ক নেই বলতে চাইছিস? তোর বাবাকে তুলে নেওয়া ওই খুনীর মেয়ের জন্য এতো মায়া কেন তোর? এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলি?”
রণ চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলে নেয়-“কিসব বলছো মা? তোমার মাথা দেখি সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। একটা সত্যি কথা হলো ওই মেয়েটার কোন দোষ নেই। ওর একমাত্র দোষ হলো ও সালিম সাহেবের কন্যা। তুমি জোর করেছিলে বলে ও এ বাড়িতে এসেছে। তাই বলে ভেবনা এখন তোমার কথা শুনে ওর সাথে কোন অন্যায় করবো আমি। আমার এখন ক্ষমতা আছে। যার সাজা তাকে দেবার চেষ্টা করবো।”
জলি ফুঁসে উঠলো-“ওই মেয়েকে আর কিছুতেই মেনে নেব না। তোকে মেরে ফেলতে চাইছিল ওরা।
তুই তোর মায়ের বিপক্ষে যেতে চাইলে যেতে পারিস কিন্তু মনে রাখিস ওই মেয়ের জন্য আমার মন থেকে কোন দোয়া আসবে না। বাকী তোর ইচ্ছে।”
রণ মরিয়া হয়ে বললো-“আমি ওকে তোমার মনের মতো বানাতে চাইছি মা আর তুমি অন্য কিছু চাইছো। গতবারও তোমার চাওয়া ভুল ছিলো এবারও তাই। পার্থক্য হলো গতবার নিজের মনের বিরুদ্ধে যেয়ে কাজ করছি এবার তোমার বিরুদ্ধে যেয়ে। ক্ষমা কর মা।”
“ক্ষমা! কখনোই না। তুই ওই মেয়ের জন্য নিজের মাকে অপমান করছিস! তুই কি আমারই বাবাই?”
জলির কন্ঠে স্পষ্ট খেদ। রণ উঠে দাঁড়ায়। জলি আরও কিছু বলতো কিন্তু সেলিনা তাকে থামিয়ে দিলো। রণ ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই মেয়ের উপর হামলে পড়লো-“তোর মাথা খারাপ জলি? ছেলের সাথে এইভাবে কথা বলে? ঠিকই তো বলেছে রণ, বিয়ে করতে চায়নি ও। তুই বাধ্য করেছিলি। এখন বউয়ের সাথে খাতির হয়েছে কেন ছাড়বে বউকে?”
জলির চোখ দুটো জ্বলে উঠলো-“খাতির হয়েছে খাতির ছুটিয়ে দেব। ওই সালিম আর ওর মেয়েকে আমার পায়ে পড়াব। ওর মেয়েকে রণর জীবন থেকে বিদায় করে ছাড়বো। দেখো তুমি।”
সেলিনা মেয়েকে ঠান্ডা করতে চাইলো-“যা করবি আওয়াজ না করে করবি। কেউ যেন বুঝতে না পারে তুই কিছু করেছিস। বুঝতে পেরেছিস?”
মায়ের কথা কিছু বুঝলো কিছু বুঝলো না জলি। তার মনটা টগবগিয়ে ফুটছে কেবল। ওই শয়তানের মেয়ের জন্য তার সাথে তর্ক করলো রণ যা আগে কোনদিন করেনি।

*****

কিছুক্ষণ আগে জলির কামড়ার সামনে গেছিল শুভ্রা। বাচ্চাগুলো খেয়ে খুশি মনে বিদায় নিয়েছে সে কথা জ্বানাতেই গেছিল কিন্তু তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে শুনেই পা থেমে গেছিল নিজের অজান্তেই। তারপর পুরো কথোপকথন শুনে আর সাহস হয়নি জলির সামনে দাঁড়ানোর। একই সাথে ভালোলাগা আর খারাপ লাগার অনুভূতি মিলে মিলে একাকার হয়ে গেছে। যে জলির হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিল সেই জলি তাকে আর পছন্দ করছে না এটা নিয়ে খারাপ লাগলেও রণ তাকে প্রটেক্ট করেছে এটা নিয়ে ভালোলাগায় মন ছেয়ে আছে। কিন্তু সেই সাথে মনে ভয় জেঁকে বসেছে, সত্যি যদি জলির কথা মেনে রণ ওকে ছেড়ে দেয়? জলি যেভাবে কথা বলেছে তাতে এটুকু পরিস্কার জলি ওকে ভীষণ জ্বালাবে। সহজে মেনে নেবে না। তখন কি করবে শুভ্রা? রণকে ছেড়ে চলে যাবে? মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে।

ঘরে ফিরে শুভ্রাকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে রণর ভ্রু কুঁচকে যায়। কাছে দাঁড়িয়ে শুভ্রাকে ডাকলো-“শুভ্রা শুনছেন? শুয়ে আছেন কেন অবেলায়? দুপুরের খাবার খাবেন না? বাচ্চারা খেয়ে চলে গেছে?”
শুভ্রা উঠে বসলো। নিজের মনের হাল রণকে বুঝতে দেবে না এই প্রত্যয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললো-“হ্যা, চলে গেছে। আর কেউ না খেলে একা খাওয়া যায়?”
রণ বিস্মিত হতে গিয়েও হেসে দেয়-“সবাই খাচ্ছে। আপনিও খেয়ে নিন।”
শুভ্রা জানতে চাইলো-“আপনি? আপনি খাবেন না?”
রণ কিছুটা মন খারাপ করে বিছানায় বসলো-“খেতে ইচ্ছে করছে না। খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেব ভাবছি।”
“তাহলে তো আমারও খাওয়া উচিত হবে না।”
রণ মুচকি হাসে-“কেন? আপনি খাবেন না কেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো-“আমারও খেতে মন চাইছে না।”
রণ ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবলো তারপর বললো-“এককাজ করুন, আপনি নিজ হাতে যা রান্না করেছেন সেগুলো নিয়ে আসুন আমাদের দু’জনার আন্দাজে।”
শুভ্রা খুশি হয়ে বললো-“আমার রান্না খাবেন?”
“হ্যা, কেন? খাওয়া যাবে না নাকি?”
“যাবে না কেন? আমি এখনি আনছি।”
শুভ্রা ছুটে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর দু’হাত ভরে খাবার নিয়ে এলো। টেবিলে সাজিয়ে রণকে ডাকলো-“আসুন, খাবার সাজিয়ে ফেলেছি।”
পোলাওটা একটু নরম নরম। গরুর মাংসে মারাত্মক ঝাল আর মুরগীটা চলনসই। চুপচাপ খাচ্ছিল রণ। শুভ্রা হঠাৎ জানতে চাইলো-“খাবার কেমন হয়েছে?”
“অতোটা ভালো না তবে খাওয়া যাচ্ছে।”
রণ অমন কথায়,সাথে সাথে শুভ্রার মুখের হাসি নিভে গেলো-“হুমম, গরুর মাংসটা মারাত্বক ঝাল। বাচ্চারা কিভাবে খেলো? রান্না করে বুঝতে পারিনি কেন?”
রণ ঝাল শুষতে শুষতে বললো-“ওরা খেতে পেয়েছে তাতেই খুশি। ঝাল মিষ্টি কোন কিছুতে আপত্তি নেই ওদের। শুনুন, আপনি আবার আমার কথা শুনে মন খারাপ করবেন না। সত্যি বলেছি, মিথ্যে প্রবোধ দেওয়ার চাইতে সত্য ভালো।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। নিজে খেতে যেয়ে বুঝলো রণ মিথ্যে বলেনি। প্রচুর ঝাল হয়েছে গরুর মাংসে। শুভ্রার নাক দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। খাবার শেষ করতে পারে না ঝালের কারণে। দ্রুত হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। রণ মুচকি হাসছে আর খাচ্ছে। শুভ্রা ওর প্লেট কেঁড়ে নিলো-“আর খাবেননা প্লিজ। অনেক ঝাল, শরীর খারাপ করবে।”
রণ হেসে দিলো-“ঝাল খেয়ে মুখ জ্বলছে মিষ্টি খেতে দিন তাড়াতাড়ি।”
শুভ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আমি এখনি আনছি।”
রণ ওর হাত টেনে ধরে ঠোঁটের পানে ইশারা করলো-“আমি ওই মিষ্টি খেতে চাই। তাড়াতাড়ি দিন। লজ্জা লাগলে চোখ বন্ধ করছি আমি।”
রণ সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করলো। শুভ্রা ততক্ষণে লজ্জায় লাল নীল বেগুনি কিন্তু তবুও আজ কেন যেন রণর হাক ফিরিয়ে দিতে মন চায় না। রণর ফর্সা ত্বক ঝাল খেয়ে লাল, ঘামে চিকচিক করছে। শুভ্রা সম্মোহিতের মতো রণকে দেখছে। আচমকা রণর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সম্বৃদ্ধ গালে হাত রেখে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। গালে চুমু পেয়ে চমকে তাকায় রণ। দু’জনার চোখাচোখি হলো, কেউ নজর ফিরিয়ে নিলো না। না বলা কতো কথা বলে ফেললো দু’জন চোখের ইশারাতে। কি হলো কে জানে শুভ্রা হঠাৎ আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো রণর উপর। কিছুক্ষণ পর রণ টের পেলো ওর পুরুষালি অধরদ্বয় বেদখল হয়ে গেছে।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে