দখিনের জানলা পর্ব-০৪

0
521

#দখিনের_জানলা (পর্ব-৪)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৭.
আজকের আকাশটা বেশ পরিষ্কার। মেঘ নেই। মাঝখানে দুইদিন ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল। অতিরিক্ত গরম পড়েছিল তার আগে। তবে আজ তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে। চমচম তার ব্যাট নিয়ে বাসা থেকে বের হলো চুপিচুপি। মা দেখলে আস্ত রাখবেনা। এমনিতেও আজ কেন স্পোর্টস ড্রেস পরেছে সেই নিয়ে বারবার প্রশ্ন করেছে তাকে। চমচম বারবার ‘ইচ্ছে হয়েছে’ বলে এড়িয়ে গেছে। এখন মা চিনির রুমে। চিনির চুলে তেল মালিশ করছে। চমচম অবশ্য চিনিকে বলেছে যে সে খেলতে যাবে। মাকে যেন সে সামলে নেয়।

নিচে এসে চমচম দেখল তার সঙ্গী সাথী সব চলে এসেছে। আজকে বড় ছোট বেশ কয়েকজন এসেছে। তবে চমচমই সবার বড়। চমচমকে আসতে দেখে বাম্পা এগিয়ে আসে।

-‘আপু! ব্যাট আগে আমি করি?’

-‘খবরদার বাম্পা! ভুলেও এই কথা বলবি না। আমি বড় মানে আমি আগে ব্যাট করব। তুই বল করিস। ঠিক আছে!’

বাম্পা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। চমচম ব্যাটিং এ আগে গেলে সহজে ফেরে না। চার ওভার পুরো করে সবসময়। তারপর সে বল হাতে নিলে উইকেটও নিয়ে নেয় ফটাফট। বাসার সামনের সরু রাস্তাতেই তারা সবসময় খেলে। আশেপাশে মাঠ নেই। যাও একটা আছে বড় ছেলেরা খেলে সেখানে।

খেলা শুরু হয়েছে। ব্যাটিং এ আছে চমচম। বল হাতে আছে অন্তর। স্ট্যাম্প এর পেছনে বাম্পা। আম্পায়ার তন্ময়। মিতু, রিনি, চয়ন, সোহান ফিল্ডিং করছে।

প্রথম বলেই চমচম ছক্কা হাকালো। তা দেখে বাম্পা সহ সকলের চোখমুখ কুঁচকে যায়। সবে তো শুরু। এখন রানের বন্যা বইবে। এরপর প্রতি বলেই চমচম দুই রান, চার, ছয় এমন করে করে টার্গেট খাড়া করল। একে একে সবাই এসে সেই টার্গেট পূরণ করতে ব্যর্থ চেষ্টা করল। সবার শেষে চয়ন এলো। চয়ন চমচমকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষ’ম’তা রাখে। ক্লাস টেনে পড়ে সে। বাকিদের থেকে বড়। তাই সে ভালোই খেলতে পারে। চমচম বল করছিল। চয়ন চার, ছয় মা’রছে। টেনশনে চমচমের মাথা ব্যথা করতে লাগল। হারা চলবেনা! কোনো ভাবেই না। আর দুই বল আছে। টার্গেট পূরণ করতে চয়নের লাগবে দশ রান। একটা ছয় আর চার মে’রে দিলেই খেল ক্ষ’ত’ম!

আব্রাহাম আর তার কয়েকজন বন্ধু মিলে তখন কোথাও থেকে আসছিল। বাসার সামনে রাস্তায় চমচমকে ক্রিকেট খেলতে দেখে তাজ্জব হয়ে সে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ের আক্কেল জ্ঞান বলতে কি কিছু নেই? এত বড় মেয়ে দৌঁড়ে গিয়ে বল করছে। সে পাশ ফিরে বন্ধুদের দিকে তাকালো। তারা বেশ ইঞ্জয় করছে তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বন্ধুদের মধ্যে একজন আব্রাহামকে বলল,

-‘এটা চমচম না?’

আব্রাহাম গম্ভীর স্বরে জবাব দিল,
-‘হু।’

-‘বেশ ভালো খেলে মেয়েটা। মেয়েটা তো ফুটবলেও ভালো।’

আব্রাহাম বেশ অবাক হলো। চমচম ফুটবলও খেলে? আব্রাহামের অপর পাশ থেকে আরেকজন বন্ধু বলে উঠল,

-‘ফিগারটাও সেই।’

আব্রাহামের রা’গী চোখে সেই বন্ধুর দিকে তাকাতেই সে মেকি হেসে বলল,

-‘আমি বলতে চাইছি খেলোয়াড় হিসেবে বডি ফিটনেস আছে ভালো।’

আব্রাহাম বন্ধুদের রেখে সামনে এগিয়ে গেল। চমচম এখন লাস্ট বল করছে। আগেরটায় চয়ন ছয় হাকিয়েছে। এবার বেশ সা’ব’ধা’নে বলটা করতে হবে। চমচম দৌঁড়ে বল করতে নিলেই আব্রাহাম এসে চমচমকে টেনে নিয়ে যায়। সবাই এতে হৈ চৈ শুরু করে দেয়। চমচম নিজেও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। আব্রাহাম পাত্তা দিল না। বরং সবাইকে জোরে এক ধ’ম’ক দিয়ে চমচমকে নিয়ে চমচমদের বাসার গেইটে ঢুকে পড়ে। চমচম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু আব্রাহামের শক্তপোক্ত হাতের বন্ধন একটুও আলগা করতে পারে না।

-‘ছাড়ো! ছাড়ো! উফ, হাতে ব্যথা পাচ্ছি আমি।’

-‘একটা থা’প্প’ড় দিব বে’য়া’দ’ব। বাহিরে কুদাকুদি করছিস কেন? তোর কুদাকুদির বয়স আছে? বেদিন বললি না বড় হয়েছিস! তা হলে এখন এসব কি? যা বাসায় যা!’

আব্রাহাম লিফটের সামনে এসে চমচমের হাত ছাড়ল। চমচম হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল লাল হয়ে আছে। রা’গে চমচমের মাথায় আ’গু’ন ধরে গেল। তাকে এমন ফুঁ’সতে দেখে আব্রাহাম বলল,

-‘কি! চোখ রাঙাচ্ছিস কাকে তুই? একদম তোর চোখ গেলে দিব। এখনই বাসায় যাবি। আবার নিচে এসে খেললে তোর খবর আছে। ঠ্যাং ভেঙে দিব তোর।’

আব্রাহাম চলে আসতে নিলেই পেছন থেকে চমচম বলল,
-‘হাম রো’গী একটা! কি মনে করছস তোরে আমি ভ’য় পাই! আমার ঠ্যাং ভাঙবি তুই? তোর ক’ল্লা ভাঙব আমি।’

কথাটা শুনেই আব্রাহামের রা’গ তড়তড় করে বেড়ে গেল। সে পেছন ফিরে চমচমের দিকে এগিয়ে যেতেই চমচম দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। সে ভেবেছে লিফটের দরজা খুলে যাবে কিন্তু লিফট ব্যাটা বিশ্বাসঘা’ত’ক’তা করল তার সাথে! পাঁচ সিঁড়ি উঠার আগেই চমচমকে ধরে ফেলল আব্রাহাম। চমচমকে ধরার জন্য সে নিজেও দৌঁড়ে এসেছিল। চমচম বলল,

-‘এই ছাড়ো! বারবার হাত ধরে টানাটানি কেন করো?’

-‘তুমি তুমি করে আর সম্মান দেখাতে হবে না। এতক্ষণ যেভাবে কথা বলছিলি সেভাবেই বল।’

-‘এই আব্রাহাম! বেশি করতেছস। ছাড়!’

-‘তোর সা’হ’স খুব বেশি তাই না? বেশি বাড়ছস? আয়! আজ তোরে একটা শিক্ষা দেই। ওইদিনও সেইম কাজ করছস। কী ভাবছস! বারবার এমন বে’য়া’দ’বি করবি আর আমি ছেড়ে দিব তোরে! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’

৮.
আব্রাহম টেনে হিঁ’চড়ে চমচমকে নিয়ে লিফটের সামনে গেল। চমচম দেখল বিশ্বাসঘা’ত’ক লিফট্ টা খুলে গেছে একবারেই! সে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো আব্রাহামের দিকে। সে ভেবেছে তাকে নিয়ে তার বাসায় গিয়ে বিচার দিবে আব্রাহাম। কিন্তু আব্রাহামকে ১১ সংখ্যা চাপতে দেখেই সে চমকে উঠল। ছাদ! আব্রাহাম তাকে ছাদে কেন নিচ্ছে? অজানা আ’শং’কায় তার বুক কেঁপে উঠল।

-‘এই হাম ভাইয়া! ছাড়ো! আমি আঙ্কেলের কাছে তোমার নামে নালিশ করব।’

-‘নালিশ করার মতো অবস্থায় থাকলেই তো করবি!’

আব্রাহাম বাঁকা হাসল। চমচমের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। এই পাজি ছেলেটা সমাজে, লোকচক্ষুর সামনে যতই ভদ্র মানব সেজে থাকুক, অন্তত চমচম তো জানে আব্রাহাম আসলে কি!

ছাদে আসতেই দেখল পুরো ছাদ ফাঁকা। অন্যদিন সাত তলার, নয় তলার আন্টিরা গল্প গুজব করে। আজকে কেউই নেই! উফ! আজ সব কিছু তার বিপক্ষে। প্রকৃতিও বোধ হয়!

আব্রাহাম চমচমকে নিয়ে একেবারে কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। চমচম আ’ৎকে উঠে বলল,

-‘হাম ভাইয়া! কি করতে চাইছ?’

-‘দেখ কি করি!’

চমচমকে একেবারে রেলিং এর কাছে এনে ঠেস দিয়ে দাঁড় করালো আব্রাহাম। তারপরই ঝড়ের বেগে মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে একদম ফেলে দেওয়ার ভঙ্গিমায় চমচমকে নিচের দিকে ঠেলে দিল।

‘হাম ভাইয়া!’ বলেই চমচম আব্রাহামের বুকের কাছের শার্ট চেপে ধরল। চোখ খিঁচে ফেলল। আব্রাহাম তার ভীত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

-‘কি? ভ’য় পাচ্ছিস!’

-‘হু!’

-‘কই? একটু আগেও তো বললি ভ’য় পাস না!’

-‘পাই পাই! পাচ্ছি তো ভ’য়!’

চমচম এবার অন্য হাতে আব্রাহামের পেটের কাছের শার্ট টেনে ধরল। আব্রাহাম বলল,

-‘আর কোনো দিন করবি এমন?’

-‘করব।’

আব্রাহাম চমচমকে আরেকটু পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,

-‘কি বললি? আবার বল!’

চমচম তাড়াতাড়ি বলল,
-‘করব না। আর করব না।’

-‘মনে থাকবে?’

-‘হু।’

-‘মনে যদি না থাকে তবে তোকে ফেলেই দিব। কার সাথে লাগতে আসছস তোর কোনো আইডিয়া আছে? ডাফার!’

চমচম দেখল সে তার সত্তা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। সে ভ’য় পাচ্ছে। যা তার স্বভাব বি’রো’ধী! সে যদি আজ এমন ভাবে পরাজয় মেনে নেয় তবে আব্রাহাম তাকে নিয়ে মশকরা করবে সর্বদা। সে এবার চোখ মুখ স্বাভাবিক করে আব্রাহামের দিকে তাকালো। আব্রাহামও তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হঠাৎ করেই চমচম তার পা দিয়ে আব্রাহামের পায়ে লা’থি মা’রে বেশ জোরে। আকস্মিক এমন কান্ডে চমচমের দিকে সে একটু ঝুকে যায় আর চমচমও সোজা হয়ে দাঁড়াতে নেয়। ঠিক তখনিই! একদম হুট করেই দুজনের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে যায়। সেই সময় আয়মান তাদের ছাদে এলো জামাকাপড় নিয়ে যেতে। পাশাপাশি ছাদ হওয়ায় সে আসতেই তার নজরে পড়ে গেল তার বড় ভাই আর চমচমের এমন চুম্বন মুহূর্ত! সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। এটা কি হচ্ছে?

চমচম ঘটনাটা ঘটার সাথে সাথেই ধা’ক্কা দিয়ে আব্রাহামকে নিজের দিকে থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। প্রবল বাতাস হচ্ছিল তখন। চমচমের চুল উড়ছিল। সেই চুল আব্রাহামের চোখে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ফেলতেই এমন আকস্মিক ধা’ক্কা খায় সে আর এতে ব্যালেন্স হারিয়ে আব্রাহাম তার আরো ঘনিষ্ট হয়ে যায়। চমচমের গা কাঁ’টা দিয়ে ওঠে। আবারও একই কান্ড ঘটে গেল। চমচম পুনরায় ধা’ক্কা দিতেই সে দুই কদম পিছিয়ে গেল। তবে এবার খুব দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

চমচমের ল’জ্জা হচ্ছে না। বরং অসম্ভব রকমের রা’গ হচ্ছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো রা’গ। স’হ্য করার মতো নয় সে রা’গ। তার গা কাঁপছে। অত্যন্ত রা’গের ফলে চোখ ছলছল করছে। সে বেশ খানিকটা দূরত্ব তৈরি করে ক্ষি’প্ত স্বরে আব্রাহামকে বলল,

-‘অস’ভ্য ছেলে! এটা কি করলে! ছিঃ আমি আন্টিকে বলে দিব। সবটা বলে দিব। তার ছেলে কত বড় অ’স’ভ্য আর অ’ভ’দ্র তার তো জানার দরকার।’

চমচম দ্রুত কদম ফেলে ছাদ থেকে চলে গেল। আব্রাহাম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তাদের ছাদের দিকে নজর যেতেই দেখল আয়মান দুই হাত কোমরে রেখে চোখ মুখ কুঁচকে বি’র’ক্ত ভঙ্গিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আব্রাহাম এগিয়ে এলো রেলিং এর কাছে। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

-‘শোন! তুই যা ভাবছিস তা নয়।’

আয়মান কাঠকাঠ গলায় জবাব দিল,

-‘ভাবাভাবির কিছু নেই। চোখেই দেখেছি।’

আব্রাহামের নিজের চুল ছিঁ’ড়’তে ইচ্ছে করছে। এটা কি ঘটিয়ে ফেলেছে সে! আয়মান কাপড় দড়ি থেকে নিয়ে ছাদ ছেড়ে যাওয়ার আগে আব্রাহামকে বলল,

-‘আমার তো টেনশন হচ্ছে! এই কিসের চক্করে না জানি কি কি পোহাতে হবে তোমার। সা’ব’ধা’নে থেকো ভাই।’

আয়মান চলে গেল। আব্রাহাম রেলিং এ হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,

-‘ইট ওয়াজ মাই ফার্স্ট কিস। এন্ড উইদ হুম! চমচম!’

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে