ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৩

0
492

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩

বন্ধুদ্বয়ের সাথে কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটেছে অনেকক্ষণ। নামীদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় চনমনে চিত্তে বসে আছে সুহাস। ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। সে অশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দু’বার কল করল মাকে। দু’বারই ফোন বন্ধ শোনাল। এরপর কিয়ৎকাল ভেবে কল করল ছোটো বোন সিমরানকে। তার ফোনও বন্ধ বলছে। মা আর বোন কক্সবাজার বেড়াতে গেছে। হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা তাই কল ঢুকছে না। বুঝল সুহাস। তবুও একটু পর পর চেষ্টা করে গেল। একবার না একবার নিশ্চয়ই ঢুকবে। এদিকে কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে সিমরান। মাকে ছবি তুলে দিতে দিতে অস্থির সে। এবার নিজের হেয়ার স্টাইল ঠিক করে পরিপাটি হয়ে নিল। নেকি কণ্ঠে মাকে বলল,

‘ আম্মু, এবার ফটাফট আমাকে ছবি তুলে দাও তো। তুমি অনেক তুলেছ এবার আমার পালা। সূর্যাস্তের সময় কিন্তু ঐ ছবিটা ওঠব৷ একদম ব্রোর স্টাইলে। ওকে গিয়ে দেখাতে হবে না? ‘

শেষ বাক্যটি বেশ অহমিকার সঙ্গে বলল সে।উদয়িনী মুচকি হেসে বলল,

‘ ওকে বেবি। ‘

সিমরান মায়ের হাতে ফোন দিতে উদ্যত হলো। উদয়িনী বলল,

‘ ওয়েট বাবু, হাতা গুটিয়ে নিই। ‘

উদয়িনী তার পরিহিত শার্টের হাতা গোটাতে শুরু করল। মায়ের পরনে নীল রঙা লেডিস শার্ট, শুভ্র রঙা প্যান্ট। সঙ্গে মিলিয়ে শুভ্র রঙা স্কার্ফ গলায় প্যাঁচানো। সাতচল্লিশ বছর বয়সী আধুনিকা ডক্টর মায়ের বেশভূষা দেখে বরাবরের মতোই মুগ্ধ হলো সিমরান। মা মেয়ে আজ একই বেশে বেরিয়েছে। এটা তাদের পূর্ব পরিকল্পনাই ছিল। দুজনের বেশভূষা এক হলেও পার্থক্য রয়েছে চুলের কালারে। সিমরানের চুল ঈষৎ রক্তিম৷ যদিও এটা কৃত্রিম কালার। আর উদয়িনীর চুলগুলো স্বাভাবিকের ন্যায় কালোই। সিমরান মনে মনে ভাবল, মাকেও চুল কালার করে দিতে হবে। উচিৎ ছিল বেড়াতে আসার আগেই এটা করা। তখন খেয়াল করা হয়নি। এখন হয়েছে। তাই বাড়ি ফিরেই মাকে নিয়ে পার্লার ছুটবে সে৷ মনে মনে ভাবনাটি ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ চমকে ওঠল ফোনের রিংটোনে। তার ব্রো অর্থাৎ সুহাস ফোন করেছে। ভ্রু কুঁচকে কল কেটে দিল সে। বোঝাল সে এবং মা মহা ব্যস্ত। মনে মনে ভেঙচিও কাটল৷ এদিকে বারকয়েক ফোন বন্ধ শোনার পর যাও একবার কল ঢুকেছে। সে কলটাও কেটে দিল সিমরান? মেজাজ খারাপ হলো সুহাসের। ত্বরিত ম্যাসেজ করল,

‘ পিচ্চি, আমি কি তোর সৎ ভাই? নাকি তোরা মা, মেয়ে মিলে আমাকে তেজ্য করে দিয়েছিস। ফোন ধর বেয়াদব! ‘

প্রথম বাক্যগুলো পড়ে পৈশাচিক আনন্দ পেলেও শেষে ধমক খেয়ে চটে গেল সিমরান। এতক্ষণ নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য ফোন বন্ধ শোনাচ্ছিল। এবারে ভাইয়ের ওপর চটে গিয়ে এরোপ্লেইন মোড করে রাখল ফোন। সুহাস মা, বোন কাউকেই আর ফোনে পেল না। অবসন্ন বদনে কেবল স্বরণ করল বোনের এহেন আচরণের রহস্য।

সিমরানের এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সুহাস তার বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিনে গিয়ে ঘুরে এসেছে। এই নিয়ে সিমরানের সে কী মন খারাপ হয়েছিল। ভাইয়ের সঙ্গে দু’দিন কথা পর্যন্ত বলেনি। সে কষ্ট করে দিন রাত জেগে পড়াশোনা করছে। আর তার ভাই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। এটা কী কোনো আদর্শ ভাইয়ের লক্ষণ হতে পারে? কখনোই না৷ অথচ সে সব সময় সবার কাছে বলে বেড়ায় তার ভাই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ভাই। বোনের সেই রাগ, অভিমান সুহাস একা ভাঙাতে সক্ষম হয়নি৷ বান্ধবী নিধির সাহায্য নিতে হয়েছে। সে ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার উপস্থিত বুদ্ধি বেশ দক্ষ। তাই তার পরামর্শ নিয়েই শুক্রবার করে তিন বন্ধু বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল। সৌধর বাইকে নিধি, সুহাসের বাইকে সিমরান আর আইয়াজ একাই। তাদের পিছন পিছন গিয়েছিল যমুনা সেতু বেড়াতে। যেহেতু তাদের শহর থেকে যমুনা সেতুর দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেহেতু বোনের অভিমান ভাঙাতে এ স্থানই বেছে নিয়েছিল৷ দইয়ের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাকে বলে। কিন্তু বোন সিমরানকে এত সহজে বাগে আনা যায়নি। শুধু অভিমানটাই ভেঙেছিল। শতহোক ভাই তার অভিমান ভাঙাতে বন্ধুদের সাহায্য নিয়েছে। এরপরও কি অভিমান করে থাকা যায়? বন্ধুদের সামনে ভাইয়ের প্রেস্টিজ রক্ষা করেছে সে৷ কিন্তু চার বন্ধুকে সিমরান ছ্যাঁকা দিয়েছিল যমুনা থেকে ঘুরে আসার পর। বাড়ি ফিরেই দাঁত ক্যালিয়ে মাকে বলেছিল, পরীক্ষার পর ছুটিতে তাকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যেতে হবে। শর্ত একটাই ভাইয়াকে নেয়া যাবে না। সিমরানের এই কাণ্ড যখন সুহাস ক্যাম্পাসে এসে বন্ধুদের বলেছিল, একেকজনের পেটে খিল ধরে গিয়েছিল হাসতে হাসতে৷ সৌধ, আইয়াজ তো গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। বেচারি নিধি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুহাসকে বলেছিল,

‘ বন্ধু কপাল গুণে বোন পাইছিস। এই মেয়ে যার বউ হবে সে তো গেল! ‘

সেই যে সিমরান মায়ের কাছে বায়না ধরল। সে বায়না পূরণ করতেই মেয়েকে নিয়ে উদয়িনী চলে এলো কক্সবাজারে। শর্ত পূরণ করতে ছেলেকেও সঙ্গে নেয়নি৷ মা তাদের ভাই, বোনের ছোটো থেকে বড়ো সব চাওয়াই পূর্ণ করে। সব বায়নাকেই দেয় বিশেষ গুরুত্ব। ছেলেমেয়ে দুটো সব সময় মায়ের থেকে অতিরিক্ত যত্ন পায়। সুহাস বাবার চোখে ভালোবাসার থেকে দায়িত্ব বেশি দেখলেও মায়ের চোখে দেখেছে শুধুই ভালোবাসা আর যত্ন৷ তাই তো মায়ের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আর মায়া কাজ করে৷

বোন আর মা চলে গেল বেড়াতে। বোনকে চটাতে চায়নি সুহাসও। তাই ছুটির দিনে মায়ের পিছু না নিয়ে বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। আর এসেই পড়ে গেছে গ্যাঁড়াকলে। অবশ্য মনস্থির করেছে সে। মেনে নিয়েছে বাবার শর্তকে। বিয়ে করবে নামীকে। স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করছে, অল্প বয়স। দায়িত্ব নেয়া এখন সম্ভব না। বাবাও তার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেবে না৷ শুধু মেয়েটার সামাজিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। মন থেকেই সে স্বীকৃতি দেবে সে। কারণ ঐ মেয়েটা আজ থেকে তার শারীরিক খোরাক মেটাবে। বিয়ে যখন করছে এমনি এমনি তো আর সাজিয়ে রাখবে না৷ শারীরিক সম্পর্ক তো অবশ্যই করবে। যৌবনটাকে হালাল রূপে উপভোগ করার সুযোগটা লুফে নেবে৷ বুকের মধ্যিখানে খুশির ঢেউ খেলে গেল সুহাসের। উত্তেজনায় শরীরের লোমকূপ গুলোও সজাগ হলো৷ কখন রাত হবে? এসব অনুভূতির ভীড়ে তার মাথায় আরো কিছু ভাবনা এলো। তাদের মধ্যে মনের কোনো সম্পর্ক নেই। কী আর করার সে না হয় ধীরেধীরেই তৈরি হবে৷

লোকে বলে মনের সম্পর্ক ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক অর্থহীন। মন না ছুঁয়ে শরীর ছোঁয়া অনুচিত। কিন্তু সে জানে দুটো বিষয়ই পরিস্থিতি কেন্দ্রিক। শহরের আনাচে কানাচে বহু নর নারী সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা মানুষকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করে। তারা কি আদেও মন স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করে শরীর স্পর্শ থেকে নিজেদের বিরত রাখে? নাকি খুব অল্প সময়েই মনে পৌঁছাতে পারে? পারে না। কেউ যদি সাত দিন বা এক মাসের পরিচয়ে বলে মন স্পর্শ করেছে তাহলে সেটা ডাহা মিথ্যা। তারা আসলে শরীরটাকেই আগে স্পর্শ করে৷ এরপর একসঙ্গে বসবাসকালে ধীরেধীরে তাদের মনের মিলন ঘটে। সুহাস নামীর ক্ষেত্রেও না হয় সেটিই হবে। আচম্বিতে কেঁপে ওঠল সুহাস। যদি বাবা, মায়ের মতো হয় তখন? পরোক্ষণেই ভাবল, নাহ সে তার বাবার মতো হবে না৷ কারণ তার মায়ের কষ্টটা সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। এ পৃথিবীতে যে ছেলে খুব কাছ থেকে মায়ের যন্ত্রণাগুলো দেখতে পায়। সে ছেলে কখনো স্বেচ্ছায় তার স্ত্রীকে কষ্ট দিতে পারে না।

মা বোনকে না জানিয়ে বিয়ে করবে সুহাস। কিন্তু অবিবাহিত অবস্থায় মায়ের সঙ্গে শেষ সময় কাটাতে পারল না। এই নিয়ে আফসোস হচ্ছে। শেষ কথাটুকুও হলো না৷ দেখা তো দূরেই থাকুক। বোনের হিংসেমি আর নেটওয়ার্ক সমস্যাই এর জন্য দায়ী।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। আচমকা চোখ চলে গেল উঠান পেরিয়ে টিন সেট বিল্ডিং ঘরটায়৷ জানালার পাশে গুটিকয়েক মহিলা মানুষ দেখা যাচ্ছে। সুহাস স্পষ্ট বুঝতে পারল উনারা তাকে চুপিচুপি দেখছে। কিন্তু কেন? চুপিচুপি দেখছে কেন? সামনে এসে দেখুক না। পরিচয় হয়ে কিছুক্ষণ বসে আলাপও করুক৷ একা একা বসে থেকে বেশ বিরক্ত লাগছে। বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল সে। তার দুরন্ত মন উৎসুক হয়ে এগিয়ে এলো। বারান্দার রেলিং ধরে উঁকি দিয়ে তাকাল ও ঘরের জানালার দিকে। ও ঘরে উঁকিঝুঁকি করা মেয়ে গুলো হুড়মুড়িয়ে আড়ালে চলে গেল। যারপরনাই অবাক হলো সুহাস। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ কী ব্যাপার এরা কি আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে নাকি! ‘

নামীর দুই চাচাত ভাইয়ের বউ, আর চাচি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল সুদর্শন যুবক সুহাসকে। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট! দেখতেও আহামরি সুন্দর! মা মরা শ্যামলা বরণের নামীর ভাগ্যটা ওদের কাছে বেশ বিস্ময়কর লাগছে। নামীর ভাবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুহাসকে দেখে মন্তব্য করে বসল,

‘ দেখতে সুন্দর। ধবধবা ফর্সা, লম্বাও মাশাআল্লাহ। সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু একটু ক্যাচড়া লাগতেছে। পুরুষ মানুষ মোটাসোটা না হলে কেমন দেখায়। জোয়ানকি ভাব আসে নাই। একেবারে হ্যাংলা পাতলা মনে হয় সুপারি গাছ। জোরছে বাতাস এলেই হেলে পড়বে। জামাই হিসেবে মানাচ্ছে না। ‘

নামীর চাচি বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘ এত খুঁত ধইরো না বউ। অল্প বয়স। আমার রাজিবের থেকেও বয়সে ছোটো। একুশ, বাইশ বছরের পোলাপান তো এমনই থাকে। মেয়ে মানুষ তরতরিয়ে ডাঙর হলেও ওরা কি আর তরতরিয়ে ডাঙর হয়। হয় না তো। ‘

‘ কিন্তু আম্মা এই ছেলের চোখ দু’টো দেখছেন? বিড়াল চোখা। অমন ছোটো ছোটো ঘোলাটে সাদা মনির চোখ দেখেই তো আমার ভয় লাগে৷ তাছাড়া মুখে চাকমা চাকমা ভাব আছে। ‘

বড়ো ছেলের বউয়ের কথা শুনে নামীর চাচি বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছালেন। পাশে চুপচাপ বসে থাকা নামীর দিকে চেয়ে বললেন,

‘ নামীর ভয় না করলেই হইছে। তুমি চুপ থাকো। অতো কথা বইল না। ‘

নামী লজ্জা পেয়ে মুখ নত করল। সুহাসকে সে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি। ভাবি যেসব ত্রুটি ধরছে সেসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। বাবার কাছে শুনেছে, সুহাসের নানি চাকমা সম্প্রদায়ের ছিলেন। খাগড়াছড়ি বেড়াতে গিয়ে নানা প্রেমে পড়েন। একমাসের ব্যবধানে প্রেম করে নানিকে নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। ফলশ্রুতিতে জিনগত কারণে সুহাসের মা মায়ের গড়ন পেয়েছে। আর সুহাসও পেয়েছে তার মায়ের গড়ন। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী। মনে পড়ল সুহাসের সঙ্গে একান্তে আলাপের সময়টুকু। এরপর যখন ক্রোধান্বিত হয়ে সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। সোহান আংকেল তাকে নিয়ে আলাদা কথা বলতে চলে গেল বাড়ির সামনের রাস্তায়৷ সেখানেই সুহাস সম্পর্কে অনেকটা জানিয়েছে আংকেল। একটা মেয়ে উনিশ, বিশ বয়সে যতটা পরিণত হয়, একটা ছেলে ঠিক ততটা পরিণত হয় না৷ তাদের মানসিকতা পরিপক্ব হতে বেশ সময় নেয়। সুহাস অপরিপক্ব মস্তিষ্কের ছেলে। প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের। এ সম্পর্কে জানিয়েছে আংকেল সঙ্গে এটিও বলেছে,

‘ মামনি, এই যে বিয়েটা হচ্ছে। এটা কিন্তু তোমার সংসার জীবনে পা রাখার জন্য না। বরং এই দেশে নিশ্চিত ভাবে থেকে তোমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য এই বিয়ে হচ্ছে। ‘

নামী সরল চোখে তাকিয়ে রয়। বিয়েটা তো ছেলেখেলা নয় এটা সারাজীবনের ব্যাপার। একটি স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে আরেকটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটাবে? তার জীবনে কী প্রেম, ভালোবাসা, সংসার নামক জিনিস গুলো থাকবে না? মনের প্রশ্ন সহসা মুখেও বলে দেয় নামী। সোহান খন্দকার হো হো করে হেসে ফেলেন। বলেন,

‘ তোমরা এখন বিয়ে করবে। তোমাদের সম্পর্ক হঠাৎ করেই তৈরি হবে না। সময় লাগবে। আমি চাই দু’জনই সম্পূর্ণ স্টাডিতে মনোনিবেশ করবে। সংসার চ্যাপ্টারটা ফিউচারের জন্য জমিয়ে রাখো। তবে হ্যাঁ পড়াশোনা ম্যানেজ করে যদি দু’জন মিলে প্রেম করতে চাও সেটা করতে পারবে। শান্তি কী জানো? তোমাদের প্রেম হবে বাঁধা মুক্ত সম্পূর্ণ হালাল। ‘

‘ কিন্তু আপনার ছেলে আমাকে মানবে তো? ‘

‘ তুমি মানতে পারবে? ‘

‘ মানতে পারব বলেই বিয়েতে মত দিয়েছি। ‘

‘ আমি সুহাসকে চিনি। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো। ‘

নামীকে নিশ্চয়তা দিলেও সোহান খন্দকার চিন্তিত ছিলেন। ডানপিটে ছেলেকে নিয়ে নয় বরং স্ত্রীকে নিয়ে। তবে তারও জেদ নামীকে সে পুত্রবধূ করবেই।
সারাজীবন সকলের জেদের স্বীকার হওয়া সে এবার নিজের জেদে অটুট। তাছাড়া তার সহজসরল, দুরন্তমনার ছেলেকে সেই অতিশ মেজিস্ট্রেটের ছোটো মেয়ে অরিনের হাত থেকেও রক্ষা করা জরুরি। মেয়েটা তো উচ্ছন্নে গেছেই তার ছেলেকে উচ্ছন্নে পাঠাতেও ওঠে পড়ে লেগেছে!

হবু শশুরের সঙ্গে কথা বলার পর নামীর চিন্তা কমলেও সুহাসের সঙ্গে হওয়া ঐ অল্প কথোপকথন মাথা থেকে যাচ্ছে না। অতিরিক্ত চঞ্চল আর ঠোঁটকাটা ছেলেটার সঙ্গে তার মতো মেয়ের মিলবে কীভাবে কে জানে। সবদিক থেকেই তারা দু’জন যেন বিপরীত মেরু।

সন্ধ্যার পর মৌলভি ডেকে সতেরো, বিশজনকে সাক্ষি রেখে তিন কবুল বলার পদ্ধতি অবলম্বন করে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলো সুহাস, নামী। সুহাস একদমই প্রস্তুতি ছাড়া এখানে এসেছে। কোনো কাগজপত্র সঙ্গে আনেনি৷ ফলে আইনিভাবে বিয়েটা স্থগিত থাকল। সোহান খন্দকার বন্ধু আখতারুজ্জামানকে কথা দিলেন, সময় করে রেজিস্ট্রি করিয়ে দেবে। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সকলে মিষ্টি মুখ করছিল। নামীর দাদি পিরিচে করে চারটা মিষ্টি আর একটি চামচ হাতে দিলেন সুহাসের। বললেন,

‘ নাত জামাই বউরে মিষ্টি খিলাই দেও। ‘

বউ! শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল যেন। কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে একবার দাদি আর একবার নামীর দিকে তাকাল সুহাস। হালকা মেকআপে আবৃত শ্যামলা মুখটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। ফিনফিনে দেহে ফিরোজা রঙের জামদানী জড়ানো মেয়েটি তার বউ! বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল সুহাসের। অবনত মুখশ্রীতে বসা নামীর দিকে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে। যা দেখে ঘরে থাকা প্রতিটি সদস্যের মুখে লেপ্টে রইল মিটমিটে হাসি। দাদি রসানো রসানো কিছু বুলি আওড়ে মিষ্টি দিল। সুহাস নামীকে মিষ্টি খাইয়ে দিলে নামীও দিল। ভীড়ের মাঝে একটু ফাঁক পেয়ে মোবাইল বের করল সুহাস। ম্যাসেন্জারে ঢুকে ম্যাসেজ গ্রুপে লিখল,

‘ বন্ধুরা, আমি এখন ইসলামি নীতি অনুযায়ী বিবাহিত। বউ পাশে নিয়ে বসে আছি। আর শশুর বাড়ির লোকেরা আমাকে চোখ দিয়ে ধ র্ষ ণ করে দিচ্ছে! ‘

আইয়াজ, সৌধ বিস্ময়ে হতবাক। সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিল সুহাস? এভাবে এতিম করে দিল তাদের? দু’জন মিলে এক নাগাড়ে কান্নার ইমুজি দিল। এদিকে নামীর দাদি এসে নামীর হাত আর সুহাসের হাত এক করে দিয়ে বলল,

‘ এই যে হাত ধরাই দিলাম। এ জীবনে আর ছাড়বা না। ‘

সুহাসের ডানহাতের মুঠোয় নামীর মৃদু কম্পিত হাতটা জুড়ে দিল দাদি। চমকাল সুহাস। উষ্ণ নরম হাতটা ছুঁয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি খেলে গেল বুকটায়। বা হাতে টাইপ করে দ্রুত বন্ধুদের জানাল বিষয়টা,

‘ ঐ নামীর হাত ধরে আছি। ওর দাদিই ধরিয়ে দিল! ‘

দুই বন্ধু বিস্ময়ে অভিনন্দন জানাতে লাগল। সৌধ বলল,

‘ কেমন ফিল করছিস? ‘

‘ অদ্ভুত উষ্ণতা পাচ্ছি। শুধু হাতে না পুরো শরীরে। ‘

‘ এটাই তো ম্যাজিক বন্ধু। ‘

ওদের মাঝে ফোঁড়ন কেটে আইয়াজ বলল,

‘ দোস্ত হাতটা কি অনেক বেশি নরম নাকি অল্প? ‘

সৌধ তৎক্ষনাৎ আইয়াজকে রিপ্লাই দিল,

‘ শা’লা মেনা, শা’লা লু চ্চা ওর বউয়ের হাত কতখানি নরম তা জেনে তুই কী করবি? ‘

আইয়াজ বলল,

‘ ভাই আমরা আমরাই তো। বন্ধুর বউ আমাদেরও…’

সুহাস রাগি ইমুজি দিল আইয়াজকে। তা দেখে আইয়াজ বলল,

‘ ওরে বাবা সৌধ দেখ দেখ অবস্থাটা কী! ‘

সৌধ বলল,

‘ ঠিকই আছে। তুই শা’লা ধুরন্ধর। তুই কি ওর বাসর সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা চাইবি নাকি? ‘

আইয়াজ অবাক হয়ে বলল,

‘ কেন চাইব না? সুহাস কি আমাদের পর লোক? আমাদের মধ্যে আগে ও বিয়ে করছে। আমাদের একটু শেখাবে, পড়াবে না?’

‘ কেন শেখাতে হবে কেন? তুই কি আমাদের কলেজের কলঙ্ক? ‘

‘ আরে ইয়ার, ওসব বিদ্যা বাদ। প্র্যাক্টিকেলি তো আর অভিজ্ঞতা নাই। ‘

ওদের কথোপকথন দেখল সুহাস। মুচকি মুচকি হাসল সে৷ বলল না কিছুই। এদের এমন ঝগড়া হরহামেশাই লেগে থাকে। সৌধ বরাবরই দেখতে শুনতে নম্র, ভদ্র, আর জনসম্মুখে মি.পারফেক্ট খ্যাত আইয়াজকে খোঁচাতে ভালোবাসে।

আইয়াজের প্রশ্নটা মাথায় রইল সুহাসের। নামীর হাত নরম কিন্তু কতখানি নরম তা পরোখ করতে হাতটা কিঞ্চিৎ জোরালো ভাবে ধরল। আলতো চাপ দিল। তুলোর মতো নরম সে হাত অনুভব করে সুহাসের কী যে ভালো লাগল! এদিকে সুহাসের এহেন কাণ্ডে নামীর অবস্থা তো শেষ। অল্প শিহরণ, তীব্র লজ্জা, সীমাহীন বিস্ময়ে টলমল লাগল তার। আশপাশে তাকাল সলজ্জে। সবাই তাদের দেখছে। যদি কেউ হাতের দিকে খেয়াল করে? আঁতকে ওঠল নামী। চাপাস্বরে বলল,

‘ কী করছেন কী? সবাই দেখবে। ‘

সুহাস আচমকা সশব্দে বলে ওঠল,

‘ সো হোয়াট? তুমি তো আমার প্রেমিকা নও বউ! ‘

আচমকা ঘরজুড়ে হাসির রোল পড়ল। নামী থমথমে বদনে কয়েক পল সুহাসের পানে তাকিয়ে মস্তক নত করল। সুহাস তার হাতটা আরো জোরাল ভাবে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ মনে হয় কথা ছাড়িনি লাফিং গ্যাস ছেড়েছি। ‘

এ কথা বলে পুনরায় বেশ অহমিকার সঙ্গে বলল,

‘ অবশ্য মেডিকেলে পড়া স্টুডেন্ট’সদের মধ্যে এমন বহুত এক্সট্রা ট্যালেন্ট থাকে। তুমি তো সামনে এক্সাম দেবে রাইট? একদিকে মেডিকেল স্টুডেন্ট অপরদিকে আমার বউ। দু’টো মিলেমিশে এক্সট্রা ট্যালেন্ট’স প্রো ম্যাক্স হয়ে যাবে৷ ‘

নামীর মাথা ব্যথা ধরে গেল। আশপাশে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ একটু চুপ থাকুন প্লিজ। শশুর বাড়ি এসে নতুন বরদের এত কথা বলতে হয় না৷ লোকে নির্লজ্জ ভাবে। ‘

‘ কিন্তু আমিত নির্লজ্জ নই। স্পষ্টভাষী। ‘

নামী করুণ চোখে তাকাল। সুহাস মিটিমিটি হাসছে। ফ্যালফ্যাল করে দেখছে নামীর করুণ মুখশ্রী। কিন্তু সুহাসের এই মিটিমিটি হাসি কিছুক্ষণ পরই বন্ধ হয়ে গেল। যখন শুনল৷ আজ তাদের বাসর হবে না৷ হঠাৎ বিয়ে হলেও যে হঠাৎ বাসর হয় না। তা হারে হারে টের পেতে লাগল সে। নামীকে নিয়ে তার চাচি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এরপর একে একে সবাই তাকে রেখে চলে গেল। তার জন্য বিছানা গোছানোর দায়িত্ব নামীর ভাবির কাঁধে পড়েছে। সে এসে সুহাসকে বলে গেল, কয়েক মিনিট পর যেন পাশের ঘরে চলে যায়। মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গেল সুহাসের। ফাঁকা ঘরে কপাল কুঁচকে বসে কল করল সৌধকে। সৌধ সব শুনে বলল,

‘ বলিস কী মাম্মা এইভাবে ছ্যাঁকা! ‘

সুহাস রাগে গজগজ করে বলল,

‘ এটা কোন ধরনের আচরণ বল তো? আর ঐ নামীদামিও কী অদ্ভুত! বর রেখে বাড়ির লোকের কথায় নাচতে নাচতে চলে গেল। ‘

‘ আরেব্বাস নাচ দেখিয়েছে নাকি? ‘

‘ আরে বা’ল না। কথার কথা। ‘

সৌধ মুখ চেপে হাসল। বন্ধুর চরম বিপদে কী পরামর্শ দেয়া যায় কয়েক পল ভেবে নিয়ে বলল,

‘ বাসর করতে না দিক। অন্তত একান্তে কিছু সময় তো কাটাতে দেবে। একটু মনের কথা বলবি, হাত ধরবি। বেশি কিছু ইচ্ছে থাকলে কয়েকটা কিসও করবি। আপাতত এইটুকুর সুযোগ তো দেয়া উচিত ছিল রে দোস্ত। ‘

অনুভূতির জোয়ারে ভাঁটা পড়া বুকটায় তরতরিয়ে ঢেউ খেলে গেল। অনুরাগের স্বরে বলল,

‘ এই বাড়ির সবকটা লোক ডিজঅনেস্ট দোস্ত। আর সবচেয়ে বড়ো হিটলার তো আমার বাবা। নিজের মনে তো রঙঢঙ নেই। শা’লার আমার রঙেও জল ঢেলে দিল। ক্যান ব্যাটা বিয়ে করাতে পারলি বাসরের ব্যবস্থা ক্যান করলি না। একেকটা মীর জাফরের দল। ‘

দারুণ চটে গেছে সুহাস বুঝতে পেরে সৌধ বলল,

‘ কুল সুহাস কুল। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। ‘

একটু ভেবে বলল,

‘ ও বাড়িতে তোর শালিকা টালিকা বা নামীর ভাবি, দাদি টাইপ কেউ নাই? থাকলে তাদের সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দে।’

‘ কেন কী বলবি তুই? ‘

সৌধ দুষ্টুমি ভরে বাঁকা হাসল। বলল,

‘ অন্তত একটা হাগ আর কয়েক মিনিট চুমুর ব্যবস্থা করে দিব। ‘

‘ সিরিয়াস পারবি? ‘

‘ইয়েস বস। ‘

‘ দোস্ত এর বিনিময়ে যা চাইবি সব পাবি। ‘

‘ নিধিরে চারদিন ধরে দেখি না। ছুটি শেষ হতে আরো ছয়দিন। এর আগে ওরে দেখার সুযোগ করে দিবি। ‘

সুহাস এক মুহুর্ত চুপ থেকে বলল,

‘ আগে আমার কাজটা করে দে। কাল বাবাকে বলে তোদের সবাইকে নামীদের বাড়িতে দাওয়াতের ব্যবস্থা করে দিব। শুনেছি এদিকে নাকি দুইশ এক গম্বুজ মসজিদ তৈরি হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষের দিকে। সবাই মিলে ওদিকটাও ঘুরে আসব। ‘

‘ ওকে ডান। যা এবার, যা বললাম তাই কর। ‘

সুহাস আর দেরি করল না। পাশের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে নামীর ভাবিকে ডাকল,

‘ ভাবি আমার বন্ধু আপনার সাথে কথা বলতে চায়। ‘

ভাবি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে ফোন নিল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে রইল সন্দিহান মুখে। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে আশপাশে তাকাতে লাগল সুহাস। সৌধ ভাবির সঙ্গে কথা বলে পুরো বিষয়টা ভাবিকে বোঝাল৷ সুহাস খেয়াল করল, ভাবি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। হাসছে মুচকি মুচকি। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাল সুহাস। ইশারায় বলল,

‘ হেল্প করবেন তো? ‘

ভাবি তাকে কিছুই বলল না৷ ফোনের ওপাশে থাকা সৌধকে বলল,

‘ বুঝেছি আর বোঝাতে হবে না। আজকালকার ছেলেদের ধৈর্য্য তো নেই’ই। সাথে লজ্জার ল ‘ও নেই! ‘

কথাটা বলেই ফোন ফিরিয়ে দিল ভাবি। সুহাস তাজ্জব বদনে ফোন নিল। ভাবি চাপাস্বরে বলল,

‘ সুযোগ বুঝে পাঠাব। কিন্তু বেশি কিছু যেন না হয়। বড়োদের সামনে তাহলে আমি বা নামী কেউই মুখ দেখাতে পারব না। এটা তোমাদের শহর না। এটা গ্রাম। শুনলাম নামীকে নিয়ে ক’দিন পর তোমাদের ওখানে চলে যাবে? নিজের বাড়িতে নিজের বউয়ের সঙ্গে যা খুশি তাই করো। এ বাড়িতে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ মাফিক চলবে। ‘

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে