তোর শহরে ভালোবাসা পর্ব-২২

0
2237

#তোর_শহরে_ভালোবাসা ?

পর্ব-২২

ফাবিহা নওশীন

??

ঘুম ভাংতেই সামুর মাথাটা চিনচিন করছে।সারারাত ঘুম হয়নি।প্রচুর কেদেছে তাই মাথা ভারের সাথে প্রচন্ড ব্যথা।মাথা চেপে ধরে উঠে বসে।ঘড়িতে সময় দেখে লাফিয়ে উঠলো।
৯টা৪৪মিনিট।সকালের দিকে ঘুমিয়েছে কখন চোখ লেগে এসেছে।বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে বাইরে যেতেই একজন সার্ভেন্ট এসে একটা বড় খাম দিয়ে গেলো।সামু কিছুই বুঝতে পারছেনা।কে দিলো এটা।

তাই সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করলো,
–এটা কার?কে দিয়েছে?
–আদি স্যার পাঠিয়েছে।

সামু বুঝতে পারছেনা কিসের খাম দিবে আদি এত সকালে।সামু আর কিছুনা বলে উপরের দিকে একবার চেয়ে খামটা খুলে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে।সামু জোরে চিতকার করে উঠলো।ওর চিতকার শুনে সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।

আদির বাবা,মা,বোন সবাই এসে হাজির।সবাই জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কিন্তু ওর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা।নিশি ওকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তুলতে পারছেনা।ওর হাতে থাকা কাগজগুলো হাতে নিলো।
তাতে একটা চিঠি আর আদির সাইন করা ডিভোর্স পেপার।নিশির হাত থেকে পেপারটা পড়ে গেলো।সবাই স্তব্ধ হয়ে ডিভোর্স পেপারের দিকে চেয়ে আছে।

নিশি চিঠিটা খুলে জোরে জোরে পড়া শুরু করলো,

“আমার সাথে থাকা যায়না তাই না?মুক্তি দিয়ে দিলাম আজীবনের জন্য মুক্তি দিয়ে দিলাম।আমি চলে যাচ্ছি আর কোনো দিন ফিরবোনা।তুমি আমার ভালোবাসার কোনো দাম দেওনি,,শুরু পাগলামিটাই দেখেছো।এখন দেখো আমাকে ছাড়া কতটা ভালো থাকতে পারো।তুমি আমাকে ভেঙে কয়েক টুকরো করেছো আর আমি তোমাকে শত টুকরো করে দিয়ে গেলাম।নিজের টুকরো গুলো হাতরেও খোজে পাবেনা।শেষ কথা আমি তোমাকে ঘৃণা করি।খুব ঘৃণা করি।
বিদায়।”

আদির খোজ করে জানা গেলো সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।নিশি ফোনে বারবার ট্রাই করছে কিন্তু সুইচড অফ।
সামু কিছু না বলে পেপারগুলো নিয়ে উপরে চলে গেলো।আদির মা নিশি সামুর পিছু পিছু গেলো।সামু দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।

বাইরে থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে।
–নিশি আপু প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দেও।
সামু আবারো চিঠিটা খোলে,,
চোখের পানিতে চিঠিটা ভেসে যাচ্ছে।
সামান্য একটা কথার জন্য এতবড় শাস্তি দিলে আদি?এত ঘৃণা করো এত?আমি বলেছি থাকা যায়না কিন্তু এটা তো বলি নি তোমার সাথে থাকবো না।এটা তো একবারো বলিনি,,কেন এমন করলে আদি?আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম।এতদিন তোমার সব কথা মেনে চলেছি,ভালোবেসেছি তার কি কোনো মূল্যই নেই।এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারলে তুমি?

সামু চিঠিটা বুকে জড়িয়ে হাওমাও করে কাদছে।
আহনাফ চৌধুরী কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।আদির মা কাদছে।নিশি পাইচারি করছে আর বারবার চেষ্টা করছে আদির খোজ করার।কিন্তু পারছেনা।বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—ভাইয়া এটা কি করলো?রাগ অভিমান হয়েছে কিছুদিন নাহয় দূরে থাকতে পারতো কিন্তু ডিভোর্স??

আহনাফ চৌধুরী আদির মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–দেখোছো কি ছেলে পেটে ধরেছো?বাবার উপরের ক্ষোভ বউয়ের উপর দেখালো।আমি থাপ্পড় মেরেছি,,দুচার কথা বলেছি।সামুকে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছি এসব বলেছি তাই সামুকে তার শাস্তি দিলো।
ওকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করবোনা।ও আমার ছেলেই না।সামু আমার মেয়ে হয়েই এ বাড়িতে আজীবন থাকবে।ওর মতো ছেলের দরকার নেই আমার।

কেউ কোনো কথা বলছেনা।সামু নিচে নামছে।ওকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে কোথাও যাচ্ছে।সবাই উঠে দাড়ালো।
সামু কোথাও যাচ্ছিস?
সামু শুখনো মুখে বললো,
–আমি চলে যাচ্ছি বাবা।
সবাই ওর কথা শুনে হতবাক।নিশি বলছে,
–সামু কি বলছিস তুই পাগল হয়ে গেছিস?

–আমি ঠিকই আছি।ডিভোর্সের পর কোন মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থাকে?তাই আমি চলে যাচ্ছি।

আদির বাবা,
–না তুই কোথাও যাবি না,,তুই আমার মেয়ে।তুই এখানেই থাকবি।

আদির মা,
–সামু তুই যাস না,,আদি রাগের মাথায় এসব করেছে দেখবি ঠিক চলে আসবে।

–না মা,,আদি রাগের মাথায় করেনি।ভেবেচিন্তে করেছে।চিঠি পড়ে বুঝোনি।ওর আমার উপর রাগ হয়েছে ও রাগ করে কোথাও চলে যেতে পারতো কিন্তু তা করেনি আমাকে একবারে ওর জীবন থেকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে গেছে।তাহলে আমি এখানে কেন থাকবো?কিসের টানে থাকবো।

আদির বাবা,,
–সামু তুই কোথাও যাবি না।

–আমাকে আটকিও না।আমার এখানে অনেক কষ্ট হচ্ছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমার জন্য আর কঠিন করোনা।আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাদের।মাফ করে দিও।তোমরা আমার জন্য যা করেছো তার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবোনা।ভালো থেকো।

সামু বেরিয়ে গেলো।হাজার চেষ্টা করেও কেউ ওকে আটকাতে পারেনি।আদি যাওয়াতে ওরা যতটা না ভেঙে পড়েছে তার চেয়ে বেশি সামুর জন্য ভেঙে পড়েছে।মেয়েটার জীবন ধ্বংস হয়ে গেলো।

সামু গাড়িতে বসে আছে।চোখের পানি বাধ মানছে না।ওড়না দিয়ে বারবার চোখের পানি মুছে নিচ্ছে।এ-শহর ওকে এত স্বপ্ন দেখিয়ে ওর সাথে এমন প্রতারণা করবে ভাবতে পারেনি।

অতিরিক্ত কোনো কিছুই নাকি ভালোনা।অতিরিক্ত ভালোবাসা,জেদ,রাগ,বিশ্বাস,ইগো,লোভ।লোকে বলে অতিরিক্ত জিনিস মানুষের জীবনে দুঃখ ডেকে আনে।আর সেটা যদি অতিরিক্ত রাগ হয় তাহলে তার ফলাফল অতি ভয়াবহ।অতিরিক্ত রাগ জীবন ধ্বংস করে দেয়।রাগের বশে নেওয়া একটা ভুল ডিসিশন সব তছনছ করে দেয়।

??
Jinke darmiyan guzri thi abhi
Kal tak yeh meri zindegi
Lo unn bahon ko thandi chao ko
Hum bhi kar chale alvida
.. Alvida abvida
Meri rahein alvida
meri sasein kehti hai alvida
Alvida alvida ab kehna aur kiya
Jab tune keh diya alvida…….

?????

গাড়ি গিয়ে সামুদের বাসার গেইটের সামনে থামলো।নিজেকে মৃত মনে হচ্ছে।গাড়ি থেকে নামার শক্তি পাচ্ছে না।শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেইটের সামনে দাড়িয়ে রইলো।গেইট খোলা।ভিতরটা দেখা যাচ্ছে।সামু ধীর পায়ে হেটে যাচ্ছে।যেন বোধ নেই।রোবটের মতো এগিয়ে চলেছে।মেইন ডোরের সামনে গিয়ে বেল বাজিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
সামুর আম্মু এসে দরজা খোলে সামুকে দেয়ালের সাথে হেলান দেওয়া অবস্থায় দেখে।ওর চোখমুখ শুখনো।চুলগুলো এলোমেলো কেমন বিধ্বস্ত লাগছে।ওর মায়ের বুক ধক করে উঠলো।

উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
–সামু,,,কি হয়েছে?

সামু মায়ের দিকে শান্ত চাহনি দিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে কেদে দিলো।সামুকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছেনা।ভিতরে নিয়ে বসিয়ে সামুর আব্বুকে ফোন করে বাসায় ডেকে আনে।সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেও কোনো কথা বের করতে পারেনি।কেদেই যাচ্ছে।
সামুর বাবা উপায় না দেখে আহনাফ চৌধুরীকে ফোন করে,,তিনি সবটা বলেন না শুধু বলেন আদি আর সামুর মধ্যে ঝামেলা হয়েছে।কোন মুখে বলবেন সবটা।তাই এটুকুই বলেন।

রাতের বেলা সামু নিজের ঘরে বসে বাবা-মাকে সবটা খোলে বলে।আদি ওকে চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে গেছে আর ফিরবেনা।সামুও আর ও বাড়ি ফিরবেনা সব জানায়।সামুর বাবা রেগে গিয়ে আদির বাবাকে ফোন করতে গেলে সামু বাধা দেয় আর বলে ওদের কোনো দোষ নেই।সামুর মা সামুকে জড়িয়ে কেদেই চলেছে।
সেদিন রাতে একবুক কষ্ট নিয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।

সামু খাওয়া নাওয়া সব ছেড়ে ঘরেই পরে থাকে।চারদেয়ালে নিজেকে বন্ধি করে নিয়েছে।কারো সাথে কথাও বলেনা।সারাদিন রাত কেদেই চলেছে।

এক সপ্তাহ পর,,,
ভোরবেলা আজানের শব্দে সামুর ঘুম ভেঙে যায়।বিছানা ছেড়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নামাজে দাড়ায়।আজ থেকে নতুন ভোরের শুরু।নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরে।সেখানে তার মনের গোপন বাসনা গুলো আল্লাহর দরবারে পেস করে।
নামাজ শেষে ছাদে যায়।চারদিকে আলো ফুটছে।পাখিরা কিচিরমিচির করছে।স্নিগ্ধ বাতাস বইছে।বাতাসেরা সামুকে ছুয়ে যাচ্ছে।টপে ফুটে থাকা ফুল গুলো ছুয়ে ছুয়ে দেখছে।অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করছে।রেলিং ধরে দাড়ায়।আকাশের দিকে চেয়ে বলে,

“আদি আজকের পর আমি আর তোমার জন্য কাদবোনা,তোমার জন্য কষ্ট পাবোনা।আজ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু।আমি তোমাকে বলেছিলাম তুমি আমাকে ছেড়ে দিলে আমি ধ্বংস হয়ে যাবো আর তুমি সেই পয়েন্ট ব্যবহার করেছো।তুমি ভেবেছিলে আমাকে ধ্বংস করে দিবে কিন্তু না আমি সেটা হতে দিবোনা।আমিও ভালো থাকবো।তুমি আমাকে ঘৃণা করো তাই না ঠিক আছে তাই করো।কারণ তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসোনি।ভালোবাসলে তুমি এটা করতে পারতে না।আমিও আর তোমাকে নিয়ে ভাববোনা।
হে মাবুদ!তুমি আমাকে শক্তি দেও,,এমন কিছু করো যাতে আমার জীবনে বেচে থাকার শক্তি জোগায়।আমাকে লড়াই করার সাহস দেয়।আমাকে শক্তি দেও।আমার বেচে থাকার শক্তির উৎসর সন্ধান দেও।মনে শান্তি দেও।”

সকাল ১০টা।সামু আহনাফ চৌধুরীকে ফোন করলো,,
–আসসালামু আলাইকুম বাবা।

–অলাইকুম আসসালাম।কেমন আছিস?

–জ্বী ভালো। আপনি?

–দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।
বাড়িটা কেমন যেন হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে কেউ মারা গেছে।
সামু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–আমার তোমার একটা সাহায্যের প্রয়োজন।আমার ভার্সিটির ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দিন।আমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চাই।আমি চাইলেই হোস্টেল কিংবা অন্যভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু আমি আর ওই শহরে ফিরতে চাইনা।

আদির বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, আচ্ছা।আমি ব্যবস্থা করে দিবো।তোর খুশিতেই আমি খুশি।তোর বাবাকে বলিস আমাকে মাফ করে দিতে।

–ভালো থাকবেন।নিজের খেয়াল রাখবেন।

.
.

সামু নিজ শহরের ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলো।শুরু হলো নতুন পথচলা।নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে।পড়াশোনা করছে।নিয়মিত ভার্সিটি যাচ্ছে।তবে শরীর ঠিক যাচ্ছেনা।ইদানীং মাথা ঘুরায়,,কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা,গা মেজমেজ করে।শরীর অনেক দূর্বল লাগে।শুধু ঘুম পায়।
ডিভোর্স পেপার খুব যত্নে রেখেছে।অনেক বার সেখানে সাইন করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সাহসে কুলোয় নি।কিসের যেন একটা বাধা আসে বারবার।কিসের যেন টান,,,বারবার এই টান উপেক্ষা করতে চাইলেও পারেনা।

শরীর ভালো না লাগায় ভার্সিটি থেকে বাড়িতে চলে এসেছে।শরীর অনেক দূর্বল লাগছে।কলিং বেল বাজিয়েই ধপাস করে পড়ে গেলো।
সামুর মা দরজা খোলে এভাবে সামুকে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে চিতকার করে উঠলো।

.
.

সিডনি রাতেরবেলা-
আদি নাইট ক্লাবে বসে বসে মদ খাচ্ছে।নেশায় পুরো টুইটুম্বুর।পকেট থেকে ফোন বের করে সামুর একটা ছবি বের করে বলে,,
আই হেইট ইউ সামু,,হেইট ইউ।।হেইট ইউ,,
তারপর নেশায় ঢলে পড়ে।

সামু নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে।পাশেই ওর আম্মু,আব্বু,সামির আর একজন ডাক্তার বসে আছে।তিনি সামুকে চেকাপ করছে।গুরুগম্ভীর অবস্থা,,,
সামুর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–উনি মা হতে চলেছেন।
পুরো ঘরে পিনপতন নীরবতা।

সামুর চোখে পানি ছলছল করছে।আল্লাহ ওর দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন।ওর জীবনে বেচে থাকার শক্তি পাটিয়েছে।ওর সানসাইন,,ওর বেবি।যে ওকে বেচে থাকার শক্তি দিবে।লড়াই করার সাহস জোগাবে।
কিন্তু ওর মা-বাবার মুখ দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছেনা।কেমন চুপসে আছে।তাতে কি সামু তো খুশি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে