তোর ছায়ার সঙ্গী হব পর্ব-২৮

0
1219

#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৮

৬৫
দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেই ঈশা দেখল ইভান ফাইলে মুখ ডুবে ভ্রু কুচকে ভাবছে আর তার সামনে চেয়ারে বসে এক সুন্দরি মেয়ে তাকে দর্শন করে যাচ্ছে। আচমকা এমন দরজা খুলে কাউকে ঢুকতে দেখে দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল। কারন ইভানের কেবিনে কেউ কখনও নক না করে ঢুকেনা। ইভান ঈশাকে দেখে আরও বেশি অবাক হল। কারন সে যে আসবে কোন ভাবেই ইভান জানতোনা। হা করে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঈশা একটু বিরক্ত হয়ে ধির পায়ে এগিয়ে এলো। ইভান ফাইল বন্ধ করে রেখে সামনে থাকা মেয়েটাকে বলল
–আমি এই ফাইল গুলা পরে দেখবো। এখন আপনি আসুন।
মেয়েটা ইভানের কথা শুনে কিছু বলল না ঠিকই কিন্তু খুশিও হতে পারলো না। ঈশার দিকে তাকাল। তার চোখে এক রাশ বিরক্তি। সে ঈশাকে ভালো করে দেখে নিলো। ঈশার মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো। সে ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাকাল। ঈশার যে মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি তা ইভান ভালো করে বুঝতে পেরে একটু হেসে বলল
–মিস রিনি মিট মাই ওয়াইফ মিসেস ঈশা ইভান মাহমুদ।
ঈশার রাগ করার কথা থাকলেও আশ্চর্য জনক ভাবে সব রাগ কোথায় হারিয়ে গেলো। ঈশা শান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। কিন্তু মিস রিনি অবাকের সুর টেনে বলল
–স্যর আপনার ওয়াইফ মানে?
তার কথায় দুজনি তার দিকে ঘুরে তাকায়। ইভান একটু হেসে বলে
–ইয়েস মাই ওয়াইফ!
রিনির কথাটা যে পছন্দ হয়নি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রিনি আর কথা না বলে চলে গেলো। ইভান নিজের চেয়ারে বসেই ঈশাকে তর্জনী আঙ্গুলে ইশারা করলো তার কাছে আসতে। কিন্তু ঈশা আসলো না। পাশেই দাড়িয়ে থাকলো। ইভান হালকা চেয়ার থেকে উঠে ঈশার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। তারপর তার কোলে বসিয়ে নিলো। ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–রাগ করার কারণটা জানতে পারি?
ঈশা মুখটা ফুলিয়ে বলল
–রাগ করিনি তো।
ইভান একটু হেসে ঈশার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে বলল
–তাহলে আমার হৃদয়ের আকাশে পূর্ণিমার বদলে ঘোর অমাবস্যা কেন?
ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু হাসল। ইভান আলতো করে ঈশার গালে চুমু দিয়ে বলল
–তুই এখানে হঠাৎ?
ঈশা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কেন আমি আসায় খুব অসুবিধা হল বুঝি?
ইভান চিন্তিত হয়ে বলল
–বেশ না হলেও একটু হয়েছে।
ঈশা রাগ করে উঠে যেতে নিলে ইভান ঈশার চুল খুলে দেয়। ঈশা খুব বিরক্ত হয়ে যায়। তার চুলে মুখ ডুবিয়ে ইভান ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে
–তুই আমার কাছে থাকলে আমি কিভাবে কাজে মনোযোগ দিবো। আমার সমস্ত মনোযোগ তো তোর উপরেই।
ঈশা নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল
–ইরার বাসায় যেতে হবে।
ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কেন? কি হয়েছে? ইরা ঠিক আছে তো।
ঈশা মুচকি হেসে বলল
–সব ঠিক আছে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড!
ঈশার মুখে এমন কথা শুনে ইভানের মুখের হাসি প্রশস্ত হয়ে গেলো। হাসি মুখে ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা আর একটু হেসে বলল
–আজ ইরার জন্মদিন। ভুলে গিয়েছ? আমরা সারপ্রাইজ দিতে যাব।
ইভান চোখ বন্ধ করে ভ্রু উচিয়ে কিছুক্ষন ভাবল। তারপর বলল
–কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম।
ঈশা সামনের টেবিলে থাকা তার ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এক রাশ ভালো লাগা সারা শরীরে ছড়িয়ে গেলো। এতো কিছুর মাঝেও ঈশার ছবিটা যত্ন করে সামনে রাখতে সে ভুলেনি। সেটা হাতে নিয়ে বলল
–চিন্তা নেই। এসবের জন্য আমি আছি তো।
ঈশার কথা শুনে ইভানের মনে তৃপ্তির জোয়ার বয়ে গেলো। ভালো করে চেয়ারে হেলানি দিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা ছবিটা তার জায়গায় রেখে দিয়ে বলল
–ইলহাম কে আমি ফোন করে দিয়েছি। ক্লাস শেষ করে সোজা চলে যাবে।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়েই থাকলো। ঈশা ইভানের এভাবে চুপ করে থাকা দেখে বলল
–আমাকে দেখা শেষ হয়ে গেলে এখন আমরা যেতে পারি?
–তোর এই রুপ সারাজীবন নিস্পলক দেখেলেও শেষ হবেনা।
ইভান একটু হেসে রিনি কে ফোন করে সব মিটিং ক্যান্সেল করে দিতে বলে। তারপর সামনের টেবিলে থাকা সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঈশার সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে
–চল।
ঈশা একটু হেসে তার হাতে হাত রাখে।

৬৬
ইরার খুব মন খারাপ। আজ তার জন্মদিন অথচ কেউ মনে রাখেনি। রাতে একবার শুকনো মুখে রিহাব উইশ করেছিলো শুধু। মন খারাপ করে তাই রান্না করছিলো রান্না ঘরে। বাড়িতে এই মুহূর্তে সে রিহাব আর একজন কাজের লোক আছে। তার শ্বশুর শাশুড়ি দুইদিন হল চলে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। আজ রিহাব হসপিটালে যায়নি। ইরা সকাল থেকে অনেক বার কারন জিজ্ঞেস করেছে সে এক কথায় উত্তর দিয়েছে
–শরীর ভালো লাগছেনা।
ইরা আর কথা বাড়ায় নি। রান্না করতে রান্না ঘরে চলে গেছে। কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে ঘুরতেই দেখতে পায় রিহাব দাড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–কিছু লাগবে?
রিহাব পানির বোতল হাতে নিয়ে ইরার কাছে ধির পায়ে এগিয়ে আসছে। ইরা একটু শুকনো ঢোক গিলে আবার জিজ্ঞেস করলো
–কিছু কি লাগবে?
রিহাব তার কাছে এসে থেমে গিয়ে বলল
–যা লাগবে সেটা কি দিবে?
ইরা তার কথা মানে বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। একটু পিছিয়ে গিয়ে তাকের সাথে লেগে গেলো। রিহাব একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমাকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? তুমি বউ হয়ে আমাকে যতটা ভয় পাও আমার হসপিটালের নার্স রাও আমাকে এতোটা ভয় পায়না।
রিহাবের কথা শুনে ইরার লজ্জা সংকোচ ভয় কিছু সময়ের জন্য উধাও হয়ে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–তাহলে হসপিটালেই জান। বাসায় থাকার কি দরকার।
রিহাব আর একটু কাছে এসে বলল
–হসপিটালে তো আর বউ থাকেনা। বাসায় থাকে।
–কিন্তু বউয়ের কাছে তো কিছুই পাওয়া যায়না। হসপিটালে চাইলেই পেতে পারেন।
ইরার কথা শুনে রিহাব নিশব্দে দাঁত বের করে হাসল। মুখটা আরও একটু কাছে এনে বলল
–বউটা একটু কষ্ট করলেই আমার আর এতো কষ্ট হয়না।
ইরা রিহাবের কথা শুনে একটু হাসল। রিহাব কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল
–আমাকে আমার কাজ করতে দিন আর নিজেও নিজের কাজ করেন।
রিহাব ইরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। ভয়ে ইরার ঠোঁট কাঁপছে। রিহাব সেই ঠোটের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার কম্পমান ঠোঁট আমাকে দুর্বল করিয়ে দিচ্ছে।
ইরা রিহাবের কথা শুনে দুই হাতে মুখ চেপে ধরল। রিহাব ভ্রু কুচকে বলল
–তুমি কি ভাবছ আমি তোমার ঠোঁটে কিস করবো? একটু বেশিই ভাবছ।
রিহাবের কথা শুনে ইরা আশস্ত হয়ে ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে নেয়। রিহাব দেরি না করে ইরার ঠোঁট দুইটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। আচমকা এমন হওয়াতে ইরার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ইরার এমন নড়াচড়ায় রিহাব তাকে দুই হাতে দেয়ালের সাথে জোর করে চেপে ধরে। দুজনের নিশ্বাস ভারি হয়ে যায়। ইরা নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে শান্ত হয়ে যায়। তার হাত পা অবশ হয়ে আসে। রিহাব বেশ কিছুক্ষন পর তাকে ছেড়ে দেয়। ইরা চোখ বন্ধ করে হাপাতে থাকে। রিহাব তাকে ভালো করে দেখে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। ইরা চোখ খুলে রিহাব কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। রিহাব একটু কাছে এসে নিশব্দে দাঁত বের করে হেসে বলল
–তুমি একদম ঠিক ভাবছিলে।
ইরার গালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বলে
–হ্যাপি বার্থ ডে সুইট হার্ট!
রিহাবের কথায় ইরার সারা শরীর কেঁপে উঠে। কাল রাতেও সে উইশ করেছিলো কিন্তু এভাবে না। এক অন্যরকম অনুভুতি। এই অনুভূতির নাম তার জানা নেই। এক অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করে তার মাঝে। রিহাবেরর প্রতি এক অন্য রকম আকর্ষণ। এই মানুষটাকে আজ চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করছেনা। ইরা কিছু না ভেবেই রিহাব কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রিহাব ইরার এরকম স্পর্শে বিচলিত হয়ে যায়। একটু ভেবে সেও ইরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কলিং বেলের তীব্র আওয়াজে দুজনেরি ঘোর কাটে। ইরা লজ্জা পেয়ে রিহাবকে ছেড়ে দেয়। উলটা ঘুরে যায়। রিহাব একটু হেসে বলে
–তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
ইরা ঘুরে রিহাবের দিকে তাকায়। ভ্রু কুচকে বলে
–কি সারপ্রাইজ?
–সারপ্রাইজ কেউ বলে নাকি বোকা মেয়ে।
বলেই দরজা খুলতে গেলো। ইরা গ্যাসের চুলাটা অফ করে রিহাবের পিছে পিছে বেরিয়ে এলো। রিহাব দরজা খুলে একটা হাসি দিলো। ইভান রিহাব কে জড়িয়ে ধরল। ইরা পিছন থেকে দেখে অবাক হয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি?
ইভান রিহাব কে ছেড়ে দিতেই ইরা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার সিস্টার!
ইরা খুব খুশি হল। মাথা বাকিয়ে একটু দেখতেই ঈশাকে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গেলো। তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ঈশাও কেঁদে ফেললো। তারপর তাদের সবাইকে নিয়ে ভিতরে এলো। ইরা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–ইলহাম ভাইয়া কোথায়?
–ক্লাসে। শেষ করে সোজা চলে আসবে।
সোফায় বসতে বসতে ঈশা কথাটা বলল। ইরা একবার রিহাবের দিকে তাকাল। ইভানের সাথে গল্পে ব্যস্ত। সত্যিই মানুষটা তার খুশির কথা ভাবে। এই মুহূর্তে তার কি প্রয়োজন ছিল তা সে ঠিকই বুঝে নিয়েছে।

৬৭
বাসার মাঝখানে সোফায় বসে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এক রাশ গল্প আর হাসাহাসিতে মশগুল সবাই। শুধু ইভান নেই। একটু আগেই অফিস থেকে এক জরুরী কাজের জন্য ফোন আসে। তাড়া হুড়ো করে বের হতে হতে বলে সে এসে ঈশাকে নিয়ে যাবে। অল্প কাজ আছে। বেশি সময় লাগবেনা। তাই তারা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে আর ইভানের জন্য অপেক্ষা করছে। ইরা খুব খুশি। রিহাব তার দিকে তাকাতেই ইরার চোখে চোখ পড়ে। ইরার তখনের কথা মনে পড়তেই এক রাশ লজ্জা নিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। রিহাব বুঝতে পেরে একটু মুচকি হাসে। ইলহাম ইরাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তুই যে এতো ভালো রান্না করতে পারিস আমার সত্যিই ধারনা ছিলোনা।
ইরা এক গাল হেসে বলল
–ভালো লেগেছে?
ইলহাম মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। ইরা হেয়ালি করে বলল
–বিয়ে করে বউ কে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। রান্না শেখাব।
তার কথায় সবাই হেসে ফেললো। এর মাঝেই রিহাবের ফোন বেজে উঠলো। বিরক্তিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–ছুটি নিয়ে একদিন বাসায় বসে থেকেও শান্তি নেই।
ঈশা একটু হেসে বলল
–ছুটি নিয়ে কয়েকদিন দূর থেকে ঘুরে আসেন ভালো লাগবে।
রিহাব ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–তাই ভাবছি। কয়েকদিন ছুটি নিয়ে হানিমুন সেরে আসি।
ইরা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। কি মানুষ রে বাবা। সবার সামনে এমন কথা কেউ বলে। লজ্জা বলতে কিছুই নেই। আবার ফোনের শব্দে চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন নিয়ে উঠে গেলো রিহাব। একটু দূরে গিয়ে কি যেন কথা বলে বিচলিত হয়ে এলো। তার আসা দেখে সবাই তার দিকে তাকাল। ঈশা জিজ্ঞেস করলো
–রিহাব ভাইয়া কোন সমস্যা?
রিহাব ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমাদের তাড়াতাড়ি হসপিটালে যেতে হবে ঈশা।
সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। তার এমন কথার মানে বুঝতে। রিহাব ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–হসপিটাল থেকে ফোন করেছিলো ইভানের…।

চলবে………।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে