তোমার স্মৃতি পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
4083

#তোমার স্মৃতি
#পর্বঃ১৫(শেষ পর্ব)
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা

কেটে গেছে পাঁচবছর। শশীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে নিবিড়ের বন্ধু ডাক্তার শ্রাবণ মাহমুদের সঙ্গে। ছেলেটা অনেক ভালো। শশীকে অসম্ভব ভালোবাসে।

আজ সানজিদার জন্মদিন ছিল। শশী সানজিদার ডায়েরিটা বুকে জরিয়ে চোখ বন্ধ করলো চোখ বন্ধ করতেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো। তখনই কারো আলতো স্পর্শে শশী কিছুটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু সে চোখ খুললো না। কারণ সে যে চেনে এই স্পর্শ। এটা যে শ্রাবণের স্পর্শ। শ্রাবণ শশীকে এক হাতে জরিয়ে ধরে দোলনায় বসলো সে। সে বসতেই শশী তার কাধে মাথা রাখলো। শ্রাবণ পরম যত্নে শশীর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো।

শশী শ্রাবণকে জরিয়ে ধরে বলল “আচ্ছা ভালোবাসা এতো কষ্ট কেন দেয়। সব ভালোবাসা কেন পূর্ণতা পায়না বলো না।”

শ্রাবণ চুপ করে রইলো। প্রশ্নটির কি উত্তর দিবে জানা নেই তার। প্রায় অনেক সময়ই এই কথা জিঙ্গাসা করে শশী শ্রাবণকে। শশী কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্রাবণ আলতো করে শশীকে কোলে তুলে নিলো। বারান্দা থেকে শ্রাবণ ওকে রুমে এনে বেডে শুয়ে দিলো। শশী গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো। শ্রাবণ শশীকে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আর ভাবতে লাগলো।ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত। কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়। কাউকে পূণর্তা দেয়। আবার কখনো কখনো অপূর্ণতার চাদরে ঘিরে ধরে। ভালোবাসার মানুষের সংস্পর্শে আসলে অস্বাভাবিক মানুষও স্বাভাবিক হয়ে যায়। আবার ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে গেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষের সবকিছু মনে করে কষ্টে বিভর হয়ে পাগলামি শুরু করে। তেমনটাই হয় তো ঘটেছিল নিবিড়ের ক্ষেত্রে। সে যে সানজিদার শোকে পাগল হয়ে গিয়েছে। আজ তার স্থান হয়েছে মানসিক হাসপাতালের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনায়। অতিরিক্ত কষ্টের কারণে সে পাগলামি শুরু করে। সানজিদা কবরের কাছে গিয়ে সারাদিন বসে থাকতো সে। নাওয়াখাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার। একমাসের মধ্যেই সে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে সে। তাকে আর কন্টোল করা যাচ্ছিলো না। তারপর থেকেই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন মানসিক হাসপাতালে আছে। সানজিদা মারা যাওয়ার আগে রেহেলা বেগমকে বলেছেন যেন সে নিবিড়ের সঙ্গে শশীর বিয়ে দেয়। কিন্তু সেই কথাটা রাখতে পারেননি। কিন্তু সে দায়িত্ব নিয়ে শ্রাবণের সঙ্গে শশীর বিয়ে দিয়েছিলেন। শশী মেয়েটাও ভেঙে পরেছিলো। তারও খুব দরকার ছিল একটা ভরসার হাত। সেই ভরসার হাত হিসেবে সে শ্রাবণকে বিয়ে করে। রেহেলা বেগম দুইবছর আগে দুনিয়ার মায়া ত‍্যাগ করেছেন। সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেছে।

আচ্ছা যদি রোহানের ওমন অসুখ না হতো আর সানজিদা যদি নিবিড়ের জীবনে না আসতো। কিংবা নিবিড়
সানজিদার মায়ায় না জরাতো। তাহলে সবার জীবনটা অন‍্যরকম হতো। নিবিড়েরও এমন অবস্থা হতো না। শ্রাবণ এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ফজরের আজান দিয়েছে। শুনতে পেয়ে শ্রাবণ রুমে চলে এলো। এইদিনে তার ঘুম হয় না। কারণ এইদিন তার প্রিয়বন্ধু নিবিড় কল দিয়েছিল। তার ব‍্যাপারে সবকিছু বলতে কিন্তু সে কল রিসিভ করেনি। তাকে তখন কিছু কাজের জন‍্য দেশের বাহিরে থাকতে হয়েছিল। কাজের ব‍্যস্ততা ছেড়ে যদি বন্ধুটাকে সময় দিতো। তাহলে হয় তো বন্ধুটার এই অবস্থা নাও হতে পারত।

শ্রাবণ রুমে এসে দেখলো শশী ঘুমিয়ে আছে। সে ওযু করে এসে আস্তে আস্তে শশীকে ডাকতে লাগলো নামাজের জন‍্য। শশী আর শ্রাবণ একসঙ্গে নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর দুইজন আবার বারান্দায় চলে গেল। দুইজন মিলে একসঙ্গে সূর্যউদয় দেখলো।

সকাল দশটার দিকে শশী শ্রাবণ বের হলো তাদের ছোট তিন বছরের বাচ্চা সানিয়াকে নিয়ে। ওরা ওদের মেয়ের নাম রেখেছে নিবিড় আর সানজিদার সঙ্গে মিলিয়ে।

ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল একটা অনাথ আশ্রমে। নিবিড় এখানে সময় পেলেই আসতো। সানজিদাকেও নিয়ে এসেছিলো।

বাচ্চারা শ্রাবণ আর শশীকে দেখে দৌড়ে তাদের কাছে এসে জরিয়ে ধরলো। শ্রাবণ ওদের বিভিন্ন গিফট দিলো। তখনই ওরা সবাই নিবিড়ের কথা জিঙ্গাসা করতেই ওদের হাসিমাখা মুখ ছোট হয়ে গেল। শ্রাবণ কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে হেসে নিবিড়ের কথা এরিয়ে গেল। শশীকে মন খারাপ করা দেখে শ্রাবণ তার মেয়েকে কোলে নিয়ে শশীকে একপাশ থেকে জরিয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো

“জান দেখ মন খারাপ করোনা প্লীজ। দেখ তোমার মন খারাপ দেখলে কিন্তু এই বাচ্চাগুলোর মন খারাপ হয়ে যাবে আমার আর আমার মেয়ের ও।” সানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল “তাই না আম্মু।”

সানিয়া ও মাথা নাড়ালো। ওদের বাবা মেয়ের কান্না কান্না ফেস দেখে শশী ফিক করে হেসে উঠে।

শশীকে হাসতে দেখে ওরাও মুচকি হাসলো। আশ্রমের বাচ্চারা ওদের পেয়ে অনেক খুশি। ওরা ওদের সঙ্গে অনেকক্ষণ আনন্দ মজা করে। তারপর শ্রাবণের আনা খাবার সবাইকে দেওয়া হলো। শশী সব বাচ্চাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। সবাইকে লোকমা করে খাওয়াচ্ছে সে। তখনই শ্রাবণ এসে হা করে। শশী চোখ ছোট ছোট করে বলল

“তুমি কি ছোট বাচ্চা যে ওদের সঙ্গে খাবে। যাও একা খেয়ে নেও।”

শ্রাবণ মুখ ফোলালো শশীর কথা শুনে। শশী বিষয়টি বুঝতে পেরে এক লোকমা খাবার শ্রাবণের মুখের সামনে ধরলো। প্রথমে না করলেও পরের বার মুচকি হেসে সে খাবার মুখে নিলো। তারপর শশীর কোমর পেঁচিয়ে ধরে। এতে যেন শশীর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। সে বলে উঠলো “একি করছো বাচ্চারা আছে তো।”

শ্রাবণ বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বলল “বাচ্চা চোখ বন্ধ করো তো তোমরা।”

বাচ্চারা সবাই চোখ বন্ধ করলো তখন সানিয়া বলল “বাবাই চোখ বন্ধ করলে কিন্তু চকলেট দিতে হবে।”

শ্রাবণ বলল “আচ্ছা আম্মু” সানিয়াও তার বাবার কথায় মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে। শ্রাবণ শশীর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। শশীও পরম আবেশে চোখ বুজে নেয়।

ওরা কিছুটা ঘোরাঘুরি বেরিয়ে পরে নিবিড়ের সঙ্গে দেখা করতে। শশী শ্রাবণ দুইজনের মুখে এক অন‍্যরকম গম্ভীরতার ছাপ। তারা হাসপাতালে জানালা দিয়ে তাকায় নিবিড়ের কেবিনের দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘর। ঘরের ছোট জানালা দিয়ে খিন আলো প্রবেশ করছে রুমে। রুমের দেওয়ালের চারপাশে শুধু একটা নাম সোভা পাচ্ছে সেটা হচ্ছে সানজিদা। কোনো কিছু দিয়ে দেওয়ালে আঘাত করে নামটি লেখা হয়েছে। মাঝের বিছানাটা এলোমেলো অবস্থায় পরে আছে। রুমের এক কিনারায় নিবিড় পা ছড়িয়ে বসে আছে। চুলগুলো তার বড়বড়। হাতের নখের অবস্থাও খারাপ। কাটতে দেয় না হয় তো। মুখ ভরতি দাড়ি। অনেকটা ভয়ংকর লাগছে তাকে। সে বিরবির করছে। তার এই অবস্থা দেখে শশী আর শ্রাবণ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না। নিবিড় এবার হুট করে চেচাতে লাগলো। তার কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সে চেচিয়ে বলে উঠলো

“ভালোবাসা অদ্ভুত। কখনো কাঁদায় কখনো হাসায়। কাউকে পাগল করে কাউকে পাগল থেকে সুস্থ করে। পাবোনা জেনেও ভালোবেসেছি প্রিয় অনেক বেশি ভালোবাসি সানজিদা। অনেকবেশি ভালোবাসি। একালে তোমাকে না পাই। আল্লাহ যেন পরবর্তী কালে আমাদের এক করে।” বলেই দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললো সে। তার আর কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হলো। সে চলে গেছে তার সানজিদা কাছে। ত‍্যাগ করেছে পৃথিবীর সেই যন্ত্রণাদায়ক মায়া থেকে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে