তোকে চাই❤ (সিজন-২)part: 70

0
2820

তোকে চাই❤
(সিজন-২)part: 70
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

ডক্টরের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভারি শরীরটা নিয়ে হাঁটতেও কষ্ঠ হচ্ছে আমার। এই মুহূর্তে যে মানুষটির কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে তিনি হলেন শুভ্র৷ সারাটাক্ষণ বুকে আগলে রাখা মানুষটি আজ এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমার পাশে নেই। এর থেকে অসহায় পরিস্থিতি কি আদৌ কোনো মেয়ের হতে পারে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটু এগিয়ে যেতেই সাহেল ভাইয়ার কন্ঠ কানে এলো,

— ডক্টর? এর কি কোনো সমাধান নেই। ইউ আর আ ডক্টর! ডক্টর হয়ে এভাবে গিভ আপ করতে পারেন না। একটা জীবনের সাথে অনেকগুলো জীবন জড়িয়ে থাকে ডক্টর। কারো জন্য কারো জীবন থেমে না থাকলেও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। একটু আগে যে ছেলেটাকে অটি থেকে বের করলেন সেও পারবে না।

— আমি আপনাদের ইমোশন বুঝতে পারছি। আমার ক্যারিয়ারে অনেককেই প্রিয়জন হারাতে দেখেছি। হাহাকার করতে দেখেছি। পারলে আমি সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতাম কিন্তু সেই শক্তি সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেন নি। বো..

উনাদের কথার মাঝেই ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি৷ হাসিমুখে বললাম,

— হ্যালো ডক্টর।

ডক্টর কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে জোরপূর্বক হাসলেন। বললেন,

— হ্যালো। প্লিজ সিট।

আমি বসলাম। একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে উঠলাম,

— ডক্টর? আমার এক্সাক্ট প্রবলেমটা কি? এর কি কোনোই চিকিৎসা নেই? প্রায় সব রোগেরই চিকিৎসা আছে তাহলে…

ডক্টর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো সামনে রেখে বলে উঠলেন,

— আপনার যে সমস্যাটা সেটা হলো অ্যানিউরিজম। অ্যানিউরিজম শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। মস্তিষ্কের ভেতরের ধমনিতে এক ধরনের অ্যানিউরিজম দেখা যায় যাকে ‘বেরি অ্যানিউরিজম’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ধমনী বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। অ্যানিউরিজম ফেঁটে না যাওয়া পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু আশঙ্কা থাকে না। চিকিৎসকরা অস্ত্রপাচারের মাধ্যামে অ্যানিউরিজমের চিকিৎসা করে থাকে। কিন্তু যদি অ্যানিউরিজম ফেঁটে যায় তাহলে চিকিৎসকের হাতে কিছু করার থাকে না। এসব ক্ষেত্রে কিছু রোগী সাথে সাথেই মারা যায় আবার রক্তপাত অর্থাৎ ব্লিডিং এর পরিমান কম হলে কিছু রোগী কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে থাকে। সেদিক থেকে আপনি লাকি বিকজ আপনারও সেইম সমস্যা হলেও আপনার হাতে কিছু সময় আছে। কিন্তু সরি টু ছে, আমাদের হাতে করার মতো কিচ্ছু নেই।

সাহেল ভাইয়া বললেন,

— হঠাৎ করে এমন একটা সমস্যা কেন হলো? এক্সিডেন্টের জন্য?

— অ্যানিউরিজম কি কারণে হয় তার সঠিক তথ্য এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা যায় না বললেই চলে তাই মানুষ ব্যাপারটাকে আমলে নেন না। এমনও হতে পারে আগে থেকেই উনার অ্যানিউরিজম ছিলো কিন্তু বুঝতে পারেন নি। আজ ফেঁটে যাওয়ায় ব্যাপারটা ওঠে এসেছে। অ্যানিউরিজম হলে নর্মাল কিছু সমস্যা দেখা যায় যেমন, মাথা ব্যাথা, শরীরের দুর্বলতা, চোখে বেশি দেখা নয়তো কম দেখা, শরীরের অসাড়তা, কথা বলা অথবা মনোযোগ দেওয়ায় সমস্যা ইত্যাদি। হয়তো এসব উনি ফিল করেছেন কিন্তু তেমন গুরুত্ব দেন নি। অ্যানিউরিজম মাঝে মাঝে পরিবারের মেডিকেলহিস্ট্রির ওপর ভিত্তি করেও হতে পারে। অর্থাৎ, বংশগতও বলতে পারেন। পরিবারে আগে কারো হয়ে থাকলে পরবর্তীতে অন্যকারো হওয়ার সম্ভবনাটা বেশি থাকে।

আমার চট করেই দাদুর কথা মনে পড়ে গেলো। দাদুও এমন কিছু কারণেই মারা গিয়েছিলেন। তখন ছোট ছিলাম বলে ব্যাপারটা পুরোপুরি জানি না। তাহলে কি! কথাটা ভেবে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই বলে উঠলাম আমি,

— ডক্টর? আমি ডেলিভারি করাতে চাই। অ্যানিরজমে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আপনি বলেছেন কিছু সময় আমার হাতে আছে। এই সময়টুকু আমি আমার বাচ্চাকে দিতে চাই। ডক্টর প্লিজ ডু ইট ফার্স্ট।

ডক্টর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুঃখী দুঃখী গলায় বললেন,

— সরি ডিয়ার। তুমি আমার মেয়ের বয়সী তাই তুমি করেই বলি। তোমার আরেকটা সমস্যা আছে।

কথাটা শুনে হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো আমার। না জানি কি শুনতে হবে এখন। তবু দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করে বললাম,

— কি সমস্যা, ডক্টর?

বয়স্ক ডক্টরটি আমার দিকে আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট টি এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

— তোমার “অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম” এর সমস্যাও দেখা দিয়েছে।

আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। একটা ঢোক গিলে নিয়ে বললাম,

— মানে?

ডক্টর একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

—“অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম ” এই অবস্থায় পেটের মধ্যের বড় রক্তনালী ফুলে বেলুনের মতো হয়ে যায়। বেলুনের মতো অংশটা ফেঁটে না যাওয়া পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু সমস্যাটা হলো অ্যানিউরিজম কখন ফেঁটে যাবে সেই সম্পর্কে আগাম জানা ডক্টরদের পক্ষ এখনও সম্ভবপ্রায় হয়ে ওঠে নি। অ্যানিউরিজম ফেঁটে গেলে প্রচুর রক্তপাত হয়। তাকে বলে ইনটারনাল ব্লিডিং।এসময় প্রচুর রক্ত লাগে এবং দ্রুত অপারেশন করে রক্তনালী মেরামত করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হয়। না হলে রোগী বাঁচানো সম্ভব হয় না। অপারেশন করলেও বাঁচার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগের বেশি না। আর তোমার পেটেও ট্রিপল-অ্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু সেটা এখনো ফাঁটে নি তবে ফুলে আছে। আমরা রিস্ক নিয়ে অপারেশন করতে পারতাম যদি তুমি প্রেগনেন্ট না হতে। আমার ডাক্তারী জীবনে এমন কোনো কেইস দেখি নি আমি। একসাথে দু’জায়গায় অ্যানিউরিজম ধরা পড়া রোগী আমার ক্যারিয়ারে তুমিই প্রথম। তারপর তুমি প্রেগন্যান্ট। তোমার ব্লাডপ্রেশারের অবস্থাও ভালো না। এই রোগটি বৃদ্ধদের বেশি হয় তারপর হয় প্রাপ্ত বয়স্কদের কিন্তু সেদিক থেকে তুমি একদমই তরুনী। সত্যি বলতে এই সমস্যা আমাদের সামনে সম্পূর্ণই নতুন। এটা হয়তো আমাদের ব্যর্থতা কিন্তু সত্য এটাই আমরা কিছু করতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের দেশে অ্যানিউরিজম রোগটি খুব কম দেখা যায় আর যেগুলো হয় সেগুলো আমরা সহজেই হ্যান্ডেল করতে পারি বাট তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো, ইউ আর ডিফারেন্ট ওয়ান। আমাদের কাছে ভালো ডক্টর থাকলেও এই নতুন উপসর্গের সাথে পেরে উঠার মতো টেকনিক আমাদের নেই।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। পুরো দুনিয়াটা যেন ঘুরছে আমার। প্রথমত মাথা ব্যাথা তারউপর এতোসব কিছু! ডক্টর এবার উঠে দাঁড়ালেন। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন,

— আই এম সরি ডিয়ার। আমি পারলে অবশ্যই সাহায্য করতাম তোমায়। তার থেকে যতক্ষণ সময় তোমার কাছে আছে ততক্ষণ সময় তোমার প্রিয়জনদের সাথে বাঁচার চেষ্টা করো। কালেক্ট সাম বিউটিফুল মোমেন্ট ডিয়ার।

আমি জল টলমলে চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

— কোনো কি উপায় নেই ডক্টর? আমাকে নয় আমার বাচ্চাটাকে বাঁচানোর একটা উপায় বলুন ডক্টর। প্লিজ! আমার কয়েকঘন্টার বিউটিফুল টাইমের থেকে আমার বাচ্চাকে ৬০ বছরের একটা বিউটিফুল জীবন দিতে পেরে আমি বেশি খুশি হবো ডক্টর। আমার বাচ্চার জীবনটাকে শুরুর আগেই এভাবে গিভ আপ করতে দিতে পারেন না। ওকে বাঁচতে হবে। এই পৃথিবীতে আসতে হবে। পৃথিবীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে হবে। খিলখিল হাসিতে চারদিক মুখরিত করতে হবে। কষ্ট পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে আমায় একবার হলেও মিস করতে হবে। আমার না পাওয়া সময়টুকুও ওকে পেতে হবে। আমার পুরো না করা স্বপ্ন আমার হয়ে ওকে পূরণ করতে হবে৷ ওর বাবাকে সামলাতে হবে। এই পৃথিবীতে আমার কয়েকঘন্টার চেয়ে ওর আসাটা বেশি প্রয়োজন ডক্টর। ওর বাবার জন্য ওকে বড্ড প্রয়োজন ডক্টর। তারজন্য আমার এই কয়েকটা ঘন্টা তো আমি হাসতে হাসতে কুরবান করতে পারি। প্লিজ ডক্টর, কিছু একটা উপায় তো হবে। প্লিজ!

ডক্টর কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,

— আই এম নট সিউর বাট তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো। এই একটা উপায় ছাড়া আর কোনো উপায়ই চোখে পড়ছে না আমার।

আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,

— কি উপায়?

ডক্টর আবারও চেয়ারে বসলেন। আমার চোখে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন,

— ডক্টর সিংহানিয়া সেনের নাম শুনেছো? ওয়ার্ল্ড হেল্থও বেশ কিছু বছর কাজ করেছেন উনি। তার একটা টিম অ্যানিউরিজম নিয়ে রিসার্চ করছে। উনি যে টিম লিড করছেন সেখানে আমি সহ আমেরিকা,ভারতীয় আর দুটো দেশের মোট ১০ জন ডক্টর কাজ করছেন। উন্নত বিশ্বে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্দান্ত আধুনিকায়ন সত্ত্বেও এ ধরনের রোগীদের শতকরা ৭৫ জনেরও বেশি অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাই এই রিসার্চটা বেশ গুরুত্বও পাচ্ছে। একবছর ধরে আমরা অ্যানিউরিজমের রুগীদের উপসর্গগুলো, ডিফিকাল্টিজগুলো অবজার্ভ করছিলাম। অবশেষে খুবই অদ্ভুত একটা কেইস সামনে এলো। আমি তোমার মেডিক্যাল রিপোর্টস ডক্টর সেনের কাছে মেইল করেছি। উনি রিপোর্ট দেখে অবাক হয়েছেন। এবং তোমার প্রতি বেশ ইন্টারেস্টেট। কিন্তু তারজন্য তোমায় কোলকাতা যেতে হবে। দে আর রেডি ফর ইউ…

— কিন্তু ডক্টর আমার পাসপোর্ট নেই। তাছাড়া টাইমও নেই। পাসপোর্ট ভিসার ঝামেলায় অনেক সময় লাগে। আপনি নিশ্চয়…

ডক্টর হাসলেন। টেবিলে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলে উঠলেন,

— তোমার রাজি হওয়াটা ম্যাটার করে মাই ডিয়ার। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ প্রয়োজনে একদিনে পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়। আর তোমার ব্যাপারটা তো আরো বিশেষ। জানি তোমার কাছে একদিন সময়ও নেই। বাট আমাদের কাছে ইন্টারন্যাশনাল পারমিশন আছে। অর ডক্টর সেনের মতো ডক্টররা রিসার্চে সফল হওয়ার জন্য সব করতে পারেন। আর এই রিসার্চটাকে একটু বেশি গুরুত্ব সহকারেই দেখছেন উনি। তোমার ওদেরকে যতটা প্রয়োজন তারথেকে বেশি ওদের তোমাকে প্রয়োজন। বিকজ ইট ইজ আ ডিফারেন্ট কেইস ইন সিক্সটি ইয়ারস্। তাই তোমাকে সঠিক সময়ে কোলকাতা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এবং প্রয়োজন দুটোই ওদের।এই রিসার্চের পেছনে ওদের অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তাই তোমাকে ওরা নেওয়ার ব্যবস্থা করবেই সেটা আইন মেনে হোক বা না মেনে। বুঝতে পারছো নিশ্চয়? (কথাটা বলে মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসলেন) তবে, তাদের একটা শর্ত আছে।

ভাইয়া বললো,

— কি শর্ত, ডক্টর?

— ওরা মিসেস. আহমেদকে নিজ দায়িত্বে কোলকাতা নিয়ে যাবে। অপারেশনের দায়িত্বও ওদের বাট অপারেশন সাকসেসফুল না হলে তারজন্য তারা দায়ী নয়। তারা আপনাদের কাছে কোনো জবাবদিহিও করবে না।(আমার দিকে তাকিয়ে) তুমি মৃত্যুপথযাত্রী তাই তোমাকে নিয়ে রিসার্চ করতে চাই তারা। এতে তুমি তো মারা যাবেই তোমার সন্তানও মারা যেতে পারে আবার বেঁচেও যেতে পারে। ইউ নো, ফিফটি ফিফটি চান্স। এখন তুমি ডিসাইড করবে তুমি যাবে কি যাবে না। তোমার উপসর্গটা ডিফারেন্ট বলেই এই চান্সটা তুমি পাচ্ছো। এটা তোমার বাচ্চার জীবনের জন্য গোল্ডেন চান্স হতে পারে। এখন তু..

আমি কিছু না ভেবেই বললাম,

— আমি রাজি।

ডক্টর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

— ওকে দেন। আমি ওদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। তুমি মানুষিকভাবে প্রস্তুত হও। তিনঘন্টার মধ্যে তুমি কোলকাতায় থাকবে। ফ্যামিলির সাথে সময় কাটানোর জন্য তোমার হাতে দু’ঘন্টা সময় আছে। এই দু’ঘন্টায় সব ব্যবস্থা করে ফেলবো আমরা। দু’ঘন্টা পর কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হবে। ঢাকা থেকে কোলকাতা একঘন্টার পথ। আই থিংক, কোনো সমস্যা হবে না। এনিওয়ে, আপনাদের কারো কাছে পাসপোর্ট বা ভিসা নেই? তাহলে কেউ মিসেস. আহমেদের সাথে যেতে পারতেন। সাপোর্ট হিসেবে। এমন কেউ কি আছে?

সাহেল ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট তো আমার, শুভ্র, অভ্র ভাই, আঙ্কেল আর নাবিলার আছে। শুভ্রদের বিজনেসের একটা শাখা আছে ওখানে। আর নাবিলার ফ্যামিলি তো ওখানেই স্যাটেল। ওর বাবা কোলকাতায় বাংলাদেশ এম্বেসীতে আছেন। সো এদের মাঝে,শুভ্র ছাড়া যে কেউ যেতে পারবে। ইটস নট আ ম্যাটার।

— সবাই তো যেতে পারবেন না। শুধু একজন এলাউড। আপনারা ডিশিসন নিন কে যাবেন। আমি ওদের সাথে কথা বলছি।

হসপিটালের করিডোরে মাথানিচু করে বসে আছি। এতোক্ষণে সবাই চলে এসেছে হসপিটালে। বাবা,মা, ভাইয়া, আপু সবাই মরা কান্নাজুড়ে দিয়েছে। হয়তো আমিই একমাত্র মেয়ে যে নিজের মৃত্যুতে সবার কান্না, আহাজারি দেখে তারপর মরতে যাচ্ছি। ওদের কান্না দেখে আমারও বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু তারথেকেও বেশি বিরক্তি হচ্ছি। এই দুটো ঘন্টা কি কেউ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না? আমি চোখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,

— কাঁদতে ইচ্ছে করলে আমার সামনে থেকে যাও। আমাকে বিরক্ত করবে না। জাস্ট গো…

সবাই ধীরে ধীরে চুপ হয়ে গেলেও মা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতেই থাকলেন। একবার বিরক্ত হলেও আবার ভাবলাম, থাক কাঁদুক। মায়ের কাঁদার অধিকার আছে। যে আমি দু’দিন আগেও অবুঝের মতো ব্যবহার করতাম সে আজ নিজের বাচ্চাটার জন্য একা একা যুদ্ধে নেমে যাচ্ছি আর মা তো ২০ বছর ধরে আগলে রেখেছে আমায়। এই কান্নার অধিকার তার আছে। সবার সামনে শক্ত থাকলেও শুভ্রর কেবিনে গিয়ে ওর ঘুমন্ত মায়ামাখা মুখটা দেখে নিজেকে আটকাতে পারলাম না আমি।উনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। যে মানুষটি আমার একফোঁটা চোখের জল সহ্য করতে পারতেন না তিনি আজ কতো নিস্তব্ধ। আমি এমন পাগলের মতো কাঁদছি তবু একটিবার তাকিয়ে দেখছেন না আমায়। হায়রে সময়! যে মানুষটার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছি আজ তার জন্য একটা ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারছি না। আজ আমার সব আছে শুধু সময়টাই নেই। বুক থেকে মাথা তুলে উনার মুখটা অসংখ্য ভেজা চুমুতে ভরিয়ে তুলললাম। উনি যদি জেগে থাকতেন তাহলে নিশ্চয় হাসিমুখে বলে উঠতেন,

— ছি রোদপাখি। আমার মতো ইনোসেন্ট ছেলের সাথে এমনটা করতে পারলে তুমি? আমার ভার্জিনিটি হাফ শেষ করে দিলে তুমি।

কিন্তু আজ উনি নিশ্চুপ। একদমই নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ উনার কাছে থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। উনার পাশে থাকলেই দুর্বল হয়ে পড়বো। তাছাড়া উনার জ্ঞান ফেরার সময়ও হয়ে এসেছে প্রায়। উনার জ্ঞান ফেরার আগেই চলে যেতে হবে আমায় নয়তো কি করবেন উনি কে জানে? বাইরে বেরিয়ে আদ্র-রোদ্রকে কিছুক্ষণ আদর করে কিছুক্ষণ মার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলাম। কিছুক্ষন পর আমাকে ডাকা হলো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই নার্সের কন্ঠ কানে এলো। কোনো ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

— ডক্টর? ২৪৪ এর প্যাশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।

মুহূর্তেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। শুভ্র জেগে গেছে। ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। হাতে যে সময় নেই। শুভ্রর তার রোদকে শেষবারের মতো দেখার ভাগ্য হলো না। যখন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলাম তখন সাথে ছিলো সবসময় সঙ্গে থাকা আমার ব্যাগ আর সাহেল ভাইয়া। তারসাথে এক আকাশ আশা, হতাশা, কষ্ট আর অনিশ্চয়তা। যাত্রা শুরুর আগে দেশটাকেও প্রচন্ড রকম মিস করছিলাম আমি। দেশের মাটি, ধুলিকনা,বাতাস আর সবচেয়ে হেটিং ট্রাফিক জ্যাম সবই যেন অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো চোখে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেই সব জিনিস এতো সুন্দর হয়ে ওঠে কেন? বেঁচে থাকতে এতো লোভ জাগে কেন? মনে হয়, আগে জানলে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে দেখে নিতাম সব,,আরেকটু মন ভরে বেঁচে নিতাম!! কোলকাতায় হসপিটালে পৌঁছাতেই ডক্টর সেন এসে দেখা করলেন। মোটামুটি বৃদ্ধ একজন লোক। চোখে চশমা। মুখে ভদ্রলোক ভদ্রলোক ভাব। মুখে স্মিত হাসি। আমায় দেখেই চোখদুটো চকচক করে উঠলো তার। ডক্টরদের উৎসাহ দেখে বুঝতে পারলাম তারা আমাকে প্যাশেন্ট নয় একটা প্রজেক্ট হিসেবে দেখছে। নিজের মনে হাসলাম…নিজেকে জড়বস্তু ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না এখন তবু যদি বাচ্চাটা বাঁচে। শুভ্রর প্রিন্সেসটা বাঁচে! নার্সরা অপারেশনের জন্য রেডি করে দিলেন। মাথায় আর শরীরে বেশ কিছু ইনজেকশন লাগালেন। এই অবস্থায় নাকি প্রচুর শ্বাসকষ্ট হয় তাই এই ব্যবস্থা। আমাকে বলা হলো আধাঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে। আধাঘন্টা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ সাহেল ভাইয়া এসে ডাকলেন,

— সানশাইন?

আমি চোখখুলে তাকালাম। মুহূর্তেই জলে ভরে গেলো চোখ। শুভ্র! সাহেল ভাইয়া উনাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সাথে আছেন অভ্র ভাইয়া। উনাকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন তারা। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। অনেক প্রশ্ন ঘুরে বেড়ালেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে না। থাকুক না কিছু না জানা। শুভ্রর লাল হয়ে যাওয়া ফোলা চোখদুটো টলমল করছে। একদম শান্ত হয়ে বসে আছেন উনি। আমার শুভ্রকে কি এতো শান্ত হিসেবে মানায়? একদমই না। উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতটা নিজের গালে চেপে ধরে কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,

—আমি বাঁচতে চাই রোদপাখি। তোমার সাথে বাঁচতে চাই। তুমি তো আমায় বুঝো,বলো? আল্লাহর কাছে কেন এমন দোয়া করেছিলে রোদ? তুমি খুব সার্থপর রোদ, একটাবার আমার কথা ভাবো নি। একটাবারও না। আই ওয়ান্ট ইউ। আমার তোকে চাই রোদপাখি। প্লিজ! যদি কেউ আমায় কোনো শর্ত দিয়ে বলতো এর বিনিময়ে তোমায় আমি পাব তবে আমি তাই করতাম রোদ। আল্লাহ তোমাকে আমার পাজর দিয়ে বানালেন অথচ আমার হায়াত তোমাকে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা কেন করলেন না বলো তো। এভাবে মেরে দিলেন আমায়।

কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কাঁদছেন উনি। উনাকে কখনোই এভাবে কাঁদতে দেখি নি আমি।উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে উনার মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। দুঃখ-কষ্টের ভারগুলো স্বার্থপরের মতো উনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বললাম,

— আপনি এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। সহ্য হয় না আমার। আমি থাকবো না তো কি হয়েছে? আপনার প্রিন্সেস তো থাকবে। দেখবেন ওর মাঝে আমার সবটা থাকবে, সব। ওর জন্য আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমার বাচ্চাটা তো এই পৃথিবীতে এতিমের মতো বেঁচে থাকতে পারে না। আপনি তাকে পৃথিবীর সব হ্যাপিনেস এনে দিবেন। ওকে জানতে হবে ওর বাবা ওকে কতো ভালোবাসে। ওকে জানতে হবে ওর বাবা ওর মাকে কতো ভালোবাসতো। আমাদের ভাঙা স্বপ্নটা পূরণ করতে হবে তাকে।ওর জন্য আপনাকে বাঁচতে হবে। প্রমিজ করুন আমায়….

সেই মুহূর্তেই দু’জন ডক্টর কেবিনে ডুকলেন। পাঁচ মিনিট পর আমাকে অপারেশ থিয়াটারে নিয়ে যাওয়া হবে। শুভ্র তাঁদেরকে রিকুয়েস্ট করলেন যেন তাকে অপারেশন থিয়েটারে থাকতে দেওয়া হয়। সে আমার শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত আমায় পাশে থাকতে চান। ডক্টররা চলে যেতেই আমার দিকে তাকালেন শুভ্র। কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

— সরি রোদপাখি। আমি তোমার কথা রাখতে পারবো না।

আমি ফিসফিস করে বললাম,

— আপনাকে পারতে হবে। বাঁচতে হবে।

উনি বললেন,

— সম্ভব নয়।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর দশ মিনিট পর অজ্ঞান করা হবে আমায় তারপর শেষ হবে আমার জীবন। শুভ্র আমায় দেখতে পেলেও এই দশটা মিনিটই উনাকে আমার শেষ দেখা….অনুভব করার শেষ সীমা।

এখানটাতেই শেষ হয়েছে লেখা। জেনি আরো কিছু পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখলো কিন্তু আর কোনো লেখায় খুঁজে পেলো না সে। পেছনের সবগুলো পেইজই ফাঁকা। ডায়েরীটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে কাঁচের জানালার বাইরের শহুরে বৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলো সে। কি নিস্তব্ধ বৃষ্টি! চারদিকে শব্দ নেই শুধু বৃষ্টির সাদা নির্মল জল। জেনির মাথায় হাজারও প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোদের মৃত্যুর পর কি হয়েছিলো শুভ্রর? ডক্টররা কি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পেরেছিলো? আর শুভ্র কি বেঁচে আছে এখনও?

#চলবে….

(কিছু অপ্রাসঙ্গিকতার জন্য ৭০ পার্টটি রি-পোষ্ট করা হলো। আশা করছি গল্পকে গল্প হিসেবেই নিবেন। বাস্তব জীবন আর গল্প এক হয় না। আর গল্পে কো-ইনসিডেন্ট থাকে বলেই এটা গল্প। ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে