তুমি রবে ৪৫

0
2001
তুমি রবে ৪৫ . . শুকনো টাওয়ালটা পরে আঁকা-বাঁকা পা ফেলে এসে বিছানায় বসে পড়ল আশফি। মাহি ভেজা শরীরে আর শ্যাম্পু জড়ানো মাথা নিয়েই রুমে ঢুকল তিরিক্ষি মেজাজে। এসে আর একটা টাওয়াল হাতে নিয়ে আশফির সামনে দাঁড়াতে তার ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা দেখে রাগে লোকটার মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে মাহির। এর মাঝেই পরপর তিন বার হাঁচি দিয়ে উঠল আশফি। মাহি রুমের লাইট অন করতে গেলে পেছন থেকে আশফি হাঁক ছেড়ে বলে উঠল, – “রুমে কোনো লাইট জ্বলবে না আজ থেকে।” – “তো কী জ্বলবে?” চড়া কণ্ঠে বলল মাহি। আশফি গম্ভীরস্বরে বলল, – “এখন যা জ্বলছে তা-ই জ্বলবে।” কথা বলার পরই আরও দু’বার হাঁচি দিলো সে। মাহি তার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে তার সামনে এসে টাওয়ালটা এগিয়ে দিলো ভেজা চুল মোছার জন্য। আশফি কয়েক মুহূর্ত সেই টাওয়ালটার দিকে চেয়ে থেকে সেটা হাতে নিয়ে বিছানার ওপর ফেলে রাখল। এরপর সেই টাওয়াল পরা অবস্থাতেই সে শুয়ে পড়ল। মাথা প্রচন্ড ভার লাগছে তার। ঘুম ঘুমও পাচ্ছে খু্ব। কিন্তু তাকে তো ঘুমালে চলবে না। মাহিকে তো ধরায় হয়নি। আর পরের দুটো স্টেপ তো পড়েই রইল। এটা ভাবতেই সে দ্রুত আবার উঠে বসলো। – “মাথা না মুছে জামা কাপড় না পরেই শুয়ে পড়ছেন কেন?” – “হুঁ।” – “কী হুঁ?” এরপর মাহি আর কথা খরচ না করে নিজ উদ্যোগে আশফির ভেজা চুল মুছে দিতে আরম্ভ করল। আর আশফি নজর উঁচু করে তার সেই ঝিমিয়ে পড়া চোখে দেখতে থাকল তাকে। চুল মোছার পর তার হাঁচির পরিমাণ বেশি দেখে আবার হেয়ার ড্রায় দিয়ে চুলগুলো শুকিয়েও দিলো সে। তারপর ক্লোজেট থেকে ব্ল্যাক কালার ক্যাজুয়াল ফুল স্লিভ টি শার্ট আর একটা ট্রাওজার বের করে আশফিকে গরম মেজাজে বলল, – “দ্রুত পরুন। আগে ট্রাওজার পরবেন তারপর টি শার্টটা পরবেন।” এ ক্ষেত্রে আর কোনো ত্যাড়ামি করল না সে। মাহি জানে এ কথা মান্য করলেও সে নির্ঘাত কোনো দ্বিধা ছাড়াই মাহির সামনে প্যান্ট পরতে শুরু করবে। তাই সে বাথরুমে ঢুকে গেল। তাকেও গোসল করতে হবে। বাথট্যাবে বসে পড়ে তখন আশফি সারা শ্যাম্পু নিজের মাথায় ঢেলে নেয়। মাহি তাকে আটকাতে গেলে সে উঠে দাঁড়িয়ে মাহির মাথাতেও শ্যাম্পু ভরে দেয়। অনেক রাগারাগি করার পর আশফির মাথা ধুয়ে দিতে সক্ষম হয় সে। বাথট্যাবে বসেই তখন থেকে সে হাঁচতে আরম্ভ করেছিল। জোর করে তাকে টেনে তুলে তার গা, হাত, পা মোছার দায়িত্ব শেষমেশ মাহিকেই নিতে হয়েছে। মাহি ভাবতে থাকল এই লোকটা যদি নেশার ঝোঁকে এমন অদ্ভুত আচরণ করে তবে তো এর সাথে আর যাই হোক সে ঘর করতে পারবে না। লোকটাকে সে সিগারেট ছাড়তে বলেছিল। তা তো সে ছাড়েইনি উল্টে আরও বড়সড় বাজে অভ্যাস পুষতে শুরু করেছে। তাকে যদি এই লোকটার সঙ্গেই থাকতে হয় তবে তার এই সব অত্যাচারী কাজ সে সহ্য করবে না কখনোই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল আশফি ট্রাওজারটা পরে হাতের কনুই ধরে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে সেখানে। টি শার্টটা সে তখনো পরেনি। – “কী হয়েছে? জামা পরেননি কেন?” কনুইয়ের আঘাত দেখতে দেখতে সে বলল, – “পরব না।” – “কী হয়েছে হাতে?” মাহি এগিয়ে এসে তার হাতটা টেনে দেখল সেখানে একটু ছিলে গেছে। সে যখন তার হাতের ছিলে যাওয়া জায়গা দেখছিল তখন হঠাৎ মাহির নজর পড়ে আশফির চেয়ে থাকা দৃষ্টি পানে। কেমন গাঢ় সেই চাউনি। যে চাউনিতে মাহি বারবার আটকে যেতো এক সময়। কেমন যেন চাইলেও সেই চাউনি থেকে নজর ফেরাতে পারতো না সে। মুহূর্তে সে প্রগাঢ়ভাবে দূর্বল বনে যেতো। আজও সেই একই অনুভূতি হচ্ছে তার মাঝে। নিজেকে সামলে টি শার্টটা হাতে তুলে আশফিকে সে বলল, – “অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেবো পরে। এটা পরুন।” টি শার্টটা মাহির হাত থেকে নিয়ে সে গায়ে ঢুকাতে মাহি সেটা নিচে নামিয়ে দিয়ে তাকে পরতে সাহায্য করল। মাহি বুঝতে পারল এই মুহূর্তে যে কাজটাতে মাহি তাকে আদরের সুরে করতে নির্দেশ করবে তখন সে বিনাবাক্যে সেটা করে ফেলবে। মাহি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে দেওয়ার সময় আশফির পায়ে হাত লাগল। বরফের মতো পা ঠান্ডা হয়ে আছে তার। পা গরম না হওয়া পর্যন্ত আবার ঘুম হওয়াটাও কষ্টকর। ক্লোজেট থেকে সে খুঁজে খুঁজে পায়ের মোজা বের করে তার পায়ে পরিয়ে দিলো। আশফি শুয়ে থেকে মাহির সবকিছুই দেখছে। ব্যালকনির দরজাও বন্ধ করে দিয়ে এলো মাহি। যাতে ঠান্ডা বাতাস না আসে। এরপর সে নিজে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নিলো। আধা ঘন্টা পর মাহি বেরিয়ে এসে দেখল আশফি একদম বিছানার মাঝে গিয়ে শুয়ে আছে। ঘন নিঃশ্বাস পড়ার শব্দও শুনতে পেয়ে বুঝতে পারল সে গভীর ঘুমে। চুলগুলো মোছা শেষে আশফির পাশে এসে বসতেই এই হলুদ মৃদু আলোতে তার নিদ্রাচ্ছন্ন মুখটা দেখে এক অদমনীয় বাসনা জেগে উঠল মাহির মাঝে। কেন যেন এই মুহূর্তে তার প্রচন্ড খুশি লাগছে। তার মনে হচ্ছে যেন সে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর একজন মানুষকে তার স্বামীরূপে পেয়েছে। যাকে পাওয়ার জন্য অনেক বড় ভাগ্য প্রয়োজন। আর যেই ভাগ্য তার আছে। মাহি সেই অদমনীয় বাসনা হঠাৎ পূরণ করে ফেলল। আশফির কপাল জুড়ে পড়ে থাকা রেশমী কোমল চুলগুলোতে আঙুল চালাতে চালাতে তার সেই সুন্দর মুখটার পানে চেয়ে তাকে দেখতে থাকল। ওষ্ঠে তার ফুটে উঠল হঠাৎ মৃদু হাসি। মুহূর্তেই আশফি তার ঘুম জড়ানো চোখদুটো মেলে তাকাল তার দিকে। দেখতে পেলো সে তার প্রিয় মুখটাতে এক প্রশান্তির মুচকি হাসি। মাহি দ্রুত আশফির থেকে সরে আসার সময় আশফি তাকে হঠাৎ সজোরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে মৃদুস্বরে বলল, – “আমার না একটা বাক্য মনে পড়ছে তোমার এই মিষ্টি হাসিটা দেখে।” মাহি তাকে জিজ্ঞেস করল না কিছু। কিন্তু চেয়ে রইল তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আশফি বেশ কবিতা আবৃত্তির সুরে বলে উঠল, – “স্মিত হাস্যে নাহি চল লজ্জিত বাসরশয্যাতে।” আশফির মুখে এমন একটা বাক্য শুনে মাহির সারা শরীর হঠাৎ কেমন যেন কেঁপে উঠল। প্রচন্ড লজ্জা লাগছে তার আশফির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তার বুকের মাঝখানটাতে হয়তো কান পাতলে দ্রুতবেগে হৃদ-স্পন্দনের অনুকার শব্দও শোনা যাবে। আর একটা মুহূর্ত এই মানুষটার কাছে থাকা যাবে না। থাকলে নিশ্চিতভাবে সে কিছু করে বসবে।
এবারও তার ভাবনা ভাবনাতে থাকতেই আশফি আচমকা তার ওষ্ঠদ্বয়ের এক উষ্ণতা ভরা কোমল স্পর্শ করে বসলো মাহির অধরপল্লবে। মাহি এ ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়ল। আশফিকে সরিয়ে দিয়ে মাহি উঠে যেতে গেলে আশফির তার হাত টেনে ধরে তার সেই গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে। কয়েক মুহূর্ত মাহি তার দিকে অনুভূতিশূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে আশফির খুব কাছে এলো। আশফির দিকে ঝুঁকে পড়ে সে মৃদু আওয়াজে বলল, – “আশফি মাহবুব! আপনি জানেন আমার এইখানটায় কী চলে?” নিজের বুকের বাঁ পাশটা ইশারা করে বলল মাহি। এরপর আবার বলল, – “সেই দিনটাতে আমি কেন ভেঙে পড়েছিলাম জানেন? কেন কোনো প্রতিউত্তর দিতে পারিনি সেদিন নিজের চরিত্রে অতো বড় দাগ লাগতে দেখেও, জানেন কি? যখন দেখেছিলাম ঐন্দ্রীর পেছনের মানুষটা ছিল সেই মানুষটা যাকে নিজের জীবনে অর্ধাঙ্গরূপে পাওয়ার ইচ্ছা বাড়ির মানুষগুলোর কাছে প্রকাশ করতে না পারলেও কিন্তু উপরওয়ালার কাছে সেই ইচ্ছা জানাতাম প্রতিনিয়ত, দু’হাত তুলে মোনোজাত করতাম তাকে পাওয়ার জন্য। সেদিনের তিরটা এসে লেগেছিল বুকের ঠিক এই জায়গাটাতে। যেখানে প্রথম কারো জন্য ভালোবাসার সেই সুখের অনুভূতি অনুভব করতে পেরেছিলাম। সেই জায়গাটাকে কীভাবে রক্তাক্ত করেছিলেন জানেন? জানেন না আপনি। শুধু ভাবুন তো, আমার জায়গাটিতে আপনি আর ঐন্দ্রীর সেই পেছনের মানুষটা আমি। কী অনুভব করতেন সেদিন আমার জন্য আপনি?” এই প্রশ্নের জবাবে আশফি কিছু মুহূর্ত নীরব থাকল মাহির সিক্ত দুটো চোখের দিকে। কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রশ্নের উত্তর সে ঠিকই দিলো। তার সেই জবাবের কাছে মাহি মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে বাধ্য হলো। শুধু চোখের পানিটুকুই ঝরতে থাকল তার। …………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে