তুমি আসবে বলে পর্ব-০১

0
1953

#তুমি আসবে বলে
#পর্ব_১
#ইভা রহমান

কনের সাজে বঁধু বেশে কাজি অফিসের সামনে গত দেড় ঘন্টা ধরে বিহানের অপেক্ষায় বসে আছে হিয়া। যদিও তাকে ঘিরে রাখা তার ঔষধজেঠ্যু,তার ফুফুমণি,আর তার অনেক কাছের বন্ধু অর্পা এরা তিনজনের প্রত্যেকএই নিজেদের সব ধর্য্যটুকু ফুরিয়ে এটা মেনে নিয়েছে বিহান আর আসবে না। বিহান হিয়াকে ঠকিয়েছে,হিয়ার সাথে এক নোংরা প্রতারণার খেলায় সামিল হয়েছে তারা নিজেরাও। কিন্তু হিয়ার আবেগীমন তা মানতে নারাজ,তার বিশ্বাস বিহান আসবে। এক্ষুনি এসে বলবে হিয়া আমি এসে গেছি,আমি এসে গিয়েছি তোমাকে নিজের করতে। আর কোনো বাঁধা নেই হিয়া।

হিয়াকে শান্তনা দিতে ঔষুধজেঠ্যু হিয়ার মাথায় হাত রাখলো। আশাবাদী কন্ঠে বলে উঠলো”আমরা বোধহয় একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি মা”ঔষুধজেঠ্যুর কথাটা ঠিক হজম হলো না অর্পার। অর্পার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো বিহান বলে লোকটা ঠিক সুবিধের না। সে শুধু হিয়ার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে হিয়াকে দিনের পর দিন ব্যবহার করছে,একটা নিরাপদ ভবিষ্যতের নকল চশমা হিয়ার চোখে পড়িয়ে দিয়ে সে হিয়ার সর্বস্ব গ্রাস করতে চাইছে।

-এটা কোনো কথা না ঔষধজেঠ্যু,যতো তাড়াতাড়ি এটা মেনে নিবা যে বিহান আমাদের সাথে প্রতরণা করেছে ততোই সেটা তোমাদের সবার জন্য মঙ্গল।

-আহ অর্পা কি হচ্ছে কি,দেখতেই তো পাচ্ছিস মেয়েটার মন মানসিকতা ঠিক ভালো যাচ্ছে না। একটু চুপ কর,মানুষের তো সমস্যা থাকতে পারে না-কি।

-যার আসার সে এতোক্ষণে এসে যেতো জ্যেঠু।

-এভাবে কেনো বলছিস অর্পা তুই,বিহান হয়তো রাস্তায় কোথাও জ্যামে আঁটকে আছে,আমি জানি নয়তো নয়তো ওর অফিসে কোনো জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই হয়তো। বিহান আমাকে ঠকাতে পারে না অর্পা,,সে তো আমাকে ভালোবাসে।

অর্পা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উঠলো,সত্যি কি হিয়া এতোই বোকা!

-বিহানের ম্যাছ এখান থেকে বড় জোড় বিশমিনিটের পথ হিয়া। রাস্তায় অঢেল গাড়ির জ্যাম লেগে থাকলেও না হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই আসা যায়,আর অফিসের জরুরি কাজ। শুক্রবার কোন সরকারি অফিস খোলা থাকে হিয়া। বল আমাকে। যুক্তি দে। তুমিই বলো ফুফি তোমার কি মনে হচ্ছে বিহান আসবে এখনো?

নিজের চোখের পানি টা আড়ালে মুছে নিয়ে ফুফি অনেক কষ্টে কথা বলতে সক্ষম হলো,

-আমি আর কি বলবো। ছেলেটার ফোন বন্ধ,অফিসে ফোন করে খোঁজ নিয়ে দেখলাম বন্ধ অফিস,সেখানেও সে নেই,ওর যা বন্ধু আছে সবাইকে চেষ্টা করে দেখলাম কেউ বিহানের খোঁজ জানে না। এখন।

-এখন আর কি। বাড়ি চলো,এখানে থাকতে দম বন্ধ লাগছে আমার।

বলেই অর্পা রাগে হাতে থাকা বিয়ের যাবতীয় জিনিসপত্র রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো,ফুফুমনি ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলেও পরক্ষণেই নিজেকে শক্ত করে বললো তাহলে অর্পার কথাই হোক,এখন আমাদের বাড়ি ফেরা উচিৎ। ফুফুমনি শেষ অবধি হার মেনে অর্পাকে অনুসরণ করে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো,,হিয়ার মাথায় হাত রেখে ঔষধজ্যেঠু অস্ফুটে হিয়াকে ডাকলো। হিয়া ঔষধজেঠ্যুর হাত টা শক্ত করে চেপে নিলো আর দৃঢ় কন্ঠে বললো,,

-তুমি চিন্তা করো না ওষুধজেঠ্যু এটুকু বিষয়ে আমি ভেঙে পড়ার মেয়ে না।

ঔষুধজেঠ্যু একটা স্বস্তির দম ছাড়লো,তিনি জানেন তার হিয়া দূর্বল না,যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও হিয়া নিজেকে শান্ত আর স্থির রাখতে সক্ষম।

গাড়িতে এসে বসলো হিয়া।ঔষধজেঠ্যু বললো তোমরা আগাতে শুরু করো আমি আসছি। হিয়া কথা বাড়ালো না। জানালার থাই টা নামিয়ে কাজি অফিসের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। হিয়া বসে থাকাকালীন সময় দুটো বিয়ে কাজি সেরে ফেলেছিলো। এখনো তারই বয়সী একটা মেয়ে বিয়ে করবে বলে তার বরের সাথে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার চোখেমুখে দেখা মিলছে এক অন্যরকম শান্তির চিহ্ন আজ তার বিয়ে হবে আর তার ভালোবাসার মানুষটা তারই হাত ধরে বসে আছে। মেয়েটার মুখের হাসি হিয়ার বিক্ষিপ্ত মনটাকে আরো ক্ষেপিয়ে তুললো,উথাল-পাতাল ঢেউ তুললো হিয়ার বুকের মাঝে,সপাটে জানালাটা লাগিয়ে দিলো হিয়া,না দূর্বল হলে চলবে না তার। বিহানের না আসার কারণ জানার পরই সে ঠিক করবে সে কি বিহানকে ভালোবেসে বড্ড বোকামি করে ফেলেছে। বিহানকে অগাধ বিশ্বাস করে বিহানের খেলার পুতুল সেজেছে নাকি তার আর বিহানের ভালোবাসা টা এখনো পবিএ,এখনো আস্থার!!

অর্পা রাগে মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে কিন্তু হিয়া হাত চিপে ধরে অর্পাকে থামিয়ে দিলো,এই মুহুর্তে এইসব কথা শুনতে তার একদমই মন সায় দিচ্ছে না। গাড়ি চলতে থাকলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি পৌঁছে শুরু হলো পাড়াপ্রতিবেশীর নোংরা মনের নোংরা কথা বার্তা। বধু বেশে আবার ফিরে এসেছে কনেপক্ষ। সবাই যেনো একটা নতুন আলোচনার বিষয় পেয়ে গেলো। কেউ বা জানালার পর্দা সারিয়ে দেখতে গিয়ে ব্যাঙ্গাত্নক হাসি দিয়ে উঠলো। কেউ বা সরাসরি কাছে এসেই জানতে চাইলো কি গো বর আসে নি না-কি,বাপ মা মরা মেয়ে কপাল টাই পুড়া,এ জন্মে এই অলক্ষুণে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবা তো তুমি সাহেলা।

সবার কথা দাঁতে দাঁত চিপে হজম করে বাড়িতে ঢুকলো সবাই। হিয়া যে সবার চোখে এখন হাসির পাএ হয়ে গিয়েছে এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না তার,শুধু কি সে তার ফুফুমনিকেও তো সবাই এরপর রাস্তাঘাটে কথার আড়ালে ছিঁড়ে একদম কুচি কুচি করে খাবে,আর তার জন্য দায়ি কে থাকবে বিহান না তার বিহানের উপর করা অন্ধবিশ্বাস….!!
!
!

বাবা-মা কে হারিয়ে অনাথ হিয়া মানুষ হয়েছে তার ফুফুমনির কাছে। মধ্যবওি পরিবারের মেয়েরা যেমন হয় হিয়াও ঠিক সেরকমই ছিলো। বেশকিছু আবদার ছিলো না তার। পড়াশুনার পাশাপাশি ঔষুধজেঠ্যুর সহযোগী হয়ে তার কাজে সহয়তা করাই ছিলো তার নিত্যদিনের কর্ম। এতে অবশ্য তার আয় রোজগাড় ও হতো কিছুটা। হাতে যা আসতো তা দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস টুকু মিটিয়ে বাকি টাকা পুরোটাই ফুফুর হাতে তুলে দিতো সে। একদিন হিয়ার এই সাধারণ পরিপাটি জীবনে রঙীনতার ছোঁয়া নিয়ে বিহান আসে। সে হিয়াকে আশ্বাস দেয় সে হিয়াকে নিরাপদ আশ্রয় দেবে,সে হিয়াকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেবে,তার আর হিয়ার একটা সুন্দর সংসার হবে,হিয়ার কিশোরী মন বিহানের সেই চাটুকারিতাকে সহজেই ভালোবাসার উপাধি দিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলো সবটা। এক বছরে সম্পর্কে বিহান যে ওর ফুফুমনি থেকে শুরু করে তার সমবয়সী ছোট বোন বুলিকেও এতো সহজে আপন করে নিয়েছিলো তা দেখে আবেগে ভরে উঠেছিলো হিয়া৷ নতুন নতুন জামার পসরা,বাড়িতে এলেই মিষ্টি মণ্ডার হাঁড়ি,নতুন নতুন উপহার হিয়া সহ বাড়ির সকলের মন জুগাতে যথেষ্ট ছিলো বিহানের। যদিও হিয়া এসব কখনোই নিজে থেকে বিহানের থেকে চায়নি,বিহান নিজে সেগুলো করেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ সব ঠিক থাকার পরো বিহানের এই না আসাটা কিছুতেই যেনো মেনে নেবার মতো ছিলো না। কিছুতেই না।

!
!

নিজেকে সামলে নিয়ে হিয়া ঠিক করে সে বিহানের খোঁজে বের হবে। কোথায় যেতে পারে আর বিহান। ছোট্ট এই শহরে কি তাঁকে খুঁজে বের করা এতোই দুষ্কর!হিয়া বিহানকে খুঁজতে যাবার আগেই বিহানের অফিস কলিগ রাহাত অর্পাকে ফোন করে জানায় “বিহান গত পরশু রাতেই শহর ছেড়ে তার নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে। তার ভাই উজান শাহরিয়ার বিহানের থেকে হিয়ার ব্যাপারে সব শুনে কিছুতেই হিয়াকে মেনে নিতে চাই নি। তার নাকি সোজাসাপ্টা কথা ছিলো কোনো অনাথ মেয়ে যার কোনো সহায়সম্পদ নেই সেই মেয়েকি না হবে শাহরিয়ার পরিবারের পুএবধু। কখনোই না,উপরন্তু উজান শাহরিয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিহান যদি হিয়াকে বিয়ে করে নেয় তাহলে সে তো বিহানকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে করবে সাথে শাহরিয়ার বাড়ির দরজা সারাজীবনের জন্য বিহানের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হবে। আর যেহেতু বিহানের বাবা বেঁচে নেই আর তার চাকরি টাও উজানের রেকমেন্ডেশনের উপর অর্জিত তাই চাকরি টাও যে তার আর থাকবে না সেই ভয়ে সে হিয়ার নিরাপত্তার কথা ভেবেই নাকি সেদিন বিয়ে করতে আসে নি। সব হারিয়ে হিয়াকে ভালো রাখা তার পক্ষে সম্ভব না। আর হ্যা উজান শাহরিয়ার ঠিক করেছে তার ছোট ভাইকে তাদের চিটাগাং এর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ওখানকার যাবতীয় দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে ওখানেই তার স্থায়ী ঠিকানা গড়ে দেবে তাই সেই সূএেই বিহান সামনের সপ্তাহে পাড়ি দিচ্ছে চিটাগং,হিয়া যেনো তার অপেক্ষায় আর বসে না থাকে।

অর্পার বলা কথা গুলো অনেক কষ্টে হজম করলো হিয়া। তাহলে এই ছিলো বিহানের মনে। হিয়া কিছু বললো না। শুধু আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের উপর একটা ব্যাঙ্গাত্নক হাসি দিলো সে।অর্পাকে বললো তুই রুম থেকে বেড়িয়ে যা আমি একটু একা থাকতে চাই। অর্পা বের হতে চাইলো না পাছে যদি হিয়া কিছু করে বসে। হিয়া অর্পাকে আশ্বাস দিলো বঁধু বেশে বাড়ি ফিরে এসে যখন সে ভেঙে পড়েনি তখন এই ঠুকনো বিষয়েও সে নিজেকে দূর্বলচিওের পরিচয় দিবে না। অর্পা বেড়িয়ে যেতেই হিয়া রুমের দরজা লাগিয়ে ঘরটাকে পুরো অন্ধকারে ঢেকে নিলো। বিছানায় শুইয়ে ভাবতে থাকলো বিহানের বলা এই কথা গুলোর যুক্তি টা ঠিক কতোটুকু!সত্যি কি সে পরিস্থিতির চাপে বিয়ে টা করতে আসতে পারলো না নাকি তার মনে সত্যি প্রতরণা ছিলো। তার সাথে উজান শাহরিয়ার বলে মানুষ টাকে আজ দেখবার এক অনন্য বাসনা তৈরি হলে তার মনে। বিহান এর আগেও তার বড়দার কথা বলেছে,,সে নাকি যেমনি রাগি ওমনি বদমেজাজি,মেয়েদের কে সে দুচোক্ষে সহ্য করতে পারে না,কিন্তু মেয়ে রা নাকি তার ভাইকেই পাবার জন্যে পাগল। বাড়িতে কোনো ওদের পরিবারের মতো উচ্চবিও উচ্চপদস্থ কেউ বেড়াতে আসলেই নিজের মেয়ে ভাগ্নীর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয়,কিন্তু উজান শাহরিয়ার নাকি এই সব বিয়ে সংসার এসবে একদমই আগ্রহই নন।কিন্তু তাই বলে,তাই বলে তিনি এভাবে একটা মেয়ের জীবন নিয়ে খেলতে পারেন না নিশ্চয়!কতোটুকু জানেন তিনি হিয়ার ব্যাপরে। একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেওয়া কি এতোই সোজা তাদের মতো পরিবারের ছেলেদের কাছে,,সে কি একবারো ভাবলো না একটা মেয়েকে এরপর ঠিক সমাজ কি রুপে চুষে খাবে,,যদি বিহানের কথা গুলো কে সত্যি বলেই ধরে নেয় তাহলে এসবের জন্য দায়ি আসলে ঠিক কে?আজ উজান বলে লোকটাকে দেখার আগ্রহের পাশাপাশি তার প্রতি প্রবল ঘৃণা জন্মনিলো হিয়ার মনে। যদি তার ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে এই উজান বলে লোকটাকে বুঝিয়ে দিতো বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কষ্ট টা ঠিক কতোটুকু।কতোটা যন্ত্রনাদায়ক ভালোবাসার মানুষের এরকম প্রতারণা,কতোটা ধারালো তাকে নিয়ে মানুষের এই ঠাট্টার ছলে করা বিদ্রুপ!!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে