তুমিময় আসক্তি পর্ব-১১

0
1095

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_____১১

-ছেলেদের ঘড়িতে ওড়না আটকানোর জন্য কি ওড়না পরো? এটা গলায় ঝুলানোর আগে সামলে রাখার কথাটা মাথায় আসে না?

অগ্নি দৃষ্টিতে সারার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ্রব। নির্জনকে দেখার পর থেকেই রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার! এখন আবার সারার ওড়না ওর ঘড়িতে আঁটকে যাওয়ায় রাগটা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। সারা ভয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ভয়ে হাত-পা কাঁপার কারণে আরো প্যাঁচ লাগিয়ে দিচ্ছে।

শুভ্রব বিরক্তি নিয়ে বললো,

-স্টপ ইট! অনেকক্ষণ যাবৎ টলারেট করছি।

বলেই নিজের হাতের ঘড়িটা খুলে সারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো।

-আরে আপনার ঘড়িটা……….

-ওটা তোমার বরকে বা ফিউচার বরকে গিফট দিও! ভালোই দাম আছে।

এমন কথা শুনে সারা আহাম্মকের মতো তাকালো। সারার দিকে এক পলক তাকিয়ে গট গট করে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেল শুভ্রব। যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলো, নির্জনের জন্য সেটা পূরণ করতে পারলো না। ভাবতেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো শুভ্রব।

.

গাড়ি হঠাৎ থেমে যেতেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। শান্ত দৃষ্টি মুহুর্তেই পরিবর্তন করে বিরক্তি ভরা চাহনি নিয়ে তাকালাম নির্জনের দিকে। নির্জন আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাটকাট গলায় বললেন,

-কী সমস্যা তোমার? আমাকে দেখে কি অষ্টম আশ্চর্যের মতো মনে হচ্ছে? সেই প্রথম থেকেই খেয়াল করছি, তাকিয়ে আছো তো তাকিয়েই আছো!

ডিরেক্ট প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ায় খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। এতোক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম! খেয়ালই ছিল না যে, নির্জন কী ভাববেন? চোখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। অতি সন্তর্পণে চোখের কোণে জমাট বাঁধা অশ্রু কণা গুলো মুছে নিলাম। নির্জন আবার গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

গাড়ি এসে একটা অপরিচিত জায়গায় এসে থামলো। এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে দেখলাম, একটা বাংলোর পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি থামিয়েছেন নির্জন। নির্জন সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,

-নামো।

আমি অবাকতা মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,

-মানেহ্? এখানে! আম্………

-এটা আমার বাংলো। আমার নিজের।

-কিন্তু আমায় এখানে কেন নিয়ে এলেন?

আমার ক্রমাগত প্রশ্নবাণে নির্জন যে তটস্থ হয়ে গেছেন, সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেলাম। দ্রুত বেগে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।

নির্জনের পিছু পিছু বাংলোর ভেতরে ঢুকলাম। বাংলোটা ডুপ্লেক্স। অনেক বড় হলেও পুরো বাংলোই ফাঁকা। কোনো মানুষজন নেই। তবে সবটা বেশ সুন্দর করে সাজানো ও গুছানো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নির্জন কাউকে কল দিলেন,

-হ্যাঁ, নিহাল।……. বাংলোতে কয়েকজন মহিলা সার্ভেন্ট লাগবে। এক ঘন্টার মধ্যে পাঠিয়ে দিবি। রিমেম্বার, ফিমেল সার্ভেন্ট লাগবে।……. তোর ভাবীর জন্য।…….. আমি থাকবো না, আবার থাকবোও।…… ওসব নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। জাস্ট সার্ভেন্ট আর ওয়ান উইকের বাজারের ব্যবস্থা করে ফেল। ওকে!

ওনার কথা শুনে তব্দা খেয়ে গেলাম। ওয়ান উইকের জন্য মানে? আর এসব ব্যবস্থা কেন করছেন? কে থাকবে এখানে?

নির্জনের পিছু পিছু একটা ঘরে ঢুকতেই দেখলাম, বেশ বড়সড় একটা বেড রুম এটা। নির্জন সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন। আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বললাম,

-আমাকে এখানে আনার কারণটা কি বলবেন?

নির্জন এক পলক আমার দিকে তাকালেন। নিজের স্যুটটা গা থেকে খুলতে খুলতে বললেন,

-এতো প্রশ্ন তোমার মনে কেন জাগে? এমনিতেই অফিস থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে তোমার ভার্সিটি গেলাম। একটু পর আবার পার্টি অফিস যেতে হবে। কই জিজ্ঞেস করবে, ‘চা খাবে নাকি কফি?’ সেটা না করে ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো একটা প্রশ্নই করে যাচ্ছো।

বড়বড় চোখে মুখ হা করে তাকালাম। তিরিক্ষি মেজাজে কড়া গলায় বললাম,

-এভাবে হঠাৎ একটা অপরিচিত জায়গায় নিয়ে এলে এমন প্রশ্ন করাটা কি স্বাভাবিক নয়?

নির্জন বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-এখান থেকে তোমায় বিদেশে পাচার করে দেবো! তাই নিয়ে এসেছি। হয়েছে? উত্তর পেয়েছো?

-মানে কী? আপনি মজা নিচ্ছেন আমার সাথে! আমি কিন্তু সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করেছি!!

নির্জন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,

-যাক, এটুকু অন্তত বিশ্বাস করতে পেরেছো যে, আমি পাচারকারী নই! যাই হোক, এখন থেকে এখানেই থাকবে তুমি। বিয়ের আগপর্যন্ত এটাই তোমার বাড়ি। তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, বিয়েটা এক সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ফেলবো আমরা।

বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালাম। এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? আর এখানে আটকে কেন রাখবেন আমায়? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-আপনি আমায় এখানে আঁটকে রাখতে চাইছেন?

-একদমই না। এক্সট্রা বোঝা বাদ দিয়ে মাথা কাজে লাগাও। এখান থেকে শুধু দরকার পড়লে বের হতে পারবে, কিন্তু গার্ড নিয়ে। আজকে যা ঘটলো, এরপর আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না আমি।

হঠাৎ ঐ ছেলেটার কথা মনে পড়তেই বললাম,

-আচ্ছা, ঐ ছেলেটা কে ছিল? এমন ভাবে কথা বলছিল যেন, আমাকে চেনে!

উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি নির্জনের দিকে। নির্জন মলিন হেসে বললেন,

-সবার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারো তুমি! শুধু আমার ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা উল্টো।

মুখ থেকে উৎসাহের আলোটা মুহূর্তেই নিভে গেল। নির্জনের কথাটা কী উদ্দেশ্যে বলেছেন, জানা নেই! তবে কথাটার কারণ ঠিকই বুঝতে পারছি। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, আমার কিছু করার নেই! সারা পৃথিবী ভুল, নির্জন একাই ঠিক – এমনটা তো আর সম্ভব নয়। ভেজা কন্ঠে বললাম,

-বিশ্বাসটা তো আপনি নিজের হাতেই ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন, নির্জন! আপনার কোনো কথাই এখন আমার আর বিশ্বাস হয় না। সেটার মর্মার্থ খোঁজার চেষ্টা তো দূরে থাক!

নির্জন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দুই বাহু দুই হাতে চেপে ধরে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকালেন। আমায় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

-বারবার এক কথা! একই কথার রিপিটেশন কেন করো তুমি? আস্তো একটা ডাফার তুমি! আমার কথাগুলো ভালোভাবে এনালাইসিস করলে ঠিকই সবটা বুঝতে পারতে। কিন্তু না! তুমি তো আছো তোমার জেদ নিয়ে!!

কথা বলতে বলতে নির্জনের হাত আলগা হয়ে এলে ধীরে ধীরে বাহু থেকে ওনার হাত দুটো সরিয়ে দিলাম। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,

-অনেক কষ্টে টলারেট করছেন আমায়, তাই না? আমার প্রতি এতো রাগ! এতো বিরক্তি! তাহলে বিয়ে করছেন কেন? নিজের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নাকি চাহিদা পূরণের জন্য? আম্………….

কথা শেষ করার আগেই নির্জন একহাতে গাল চেপে ধরলেন। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে! গাল থেকে হাত ছাড়াতে চাইলে আরো জোরে ঠেসে ধরলেন। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে আমার। নির্জন একদম আমার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন,

-অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছি! না স্বার্থের জন্য বিয়ে করছি তোমায় আর না চাহিদার জন্য!! নিজের অধিকার আমি এখনি খাটাতে পারি তোমার ওপর। বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। কিন্তু সেটা আমি এতো বছরেও করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে। জানি সম্ভব নয়, তবুও আমার মনে হচ্ছে, একটা দিন আসবে, গুঞ্জন! একটা দিন আসবেই। এসব বলার জন্য নিজের প্রতি ঘৃণা হবে তোমার। আক্ষেপ করবে তুমি। কিন্তু ততদিনে খুব বেশি দেরী না হয়ে যায়!

নির্জন ছেড়ে দিলেন আমায়। দু পা পিছিয়ে সোফাটায় ধপ করে বসে পড়লেন। দু হাতে চুল আঁকড়ে ধরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ।

আমি পেছাতে পেছাতে বেডে হোঁচট খেয়ে বসে পড়লাম। হাত দিয়ে মুখ চেপে শব্দ করে কেঁদে দিলাম। নির্জনকে কেন যেন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে! কিন্তু ওর পক্ষে তো কোনো যুক্তি নেই! সব প্রমাণ ওর বিপক্ষে। হঠাৎ কানে ভেসে এলো,

-কেঁদো না, প্লিজ। সহ্য হচ্ছে না আমার। কান্না থামাও। আই সেইড, স্টপ ক্রায়িং। ড্যাম ইট!

কান্না থামছেই না তবুও। দুজনে ঘরের দুই প্রান্তে বসে আছি। নির্জন মাথা নিচু করে শীতল কণ্ঠে বললেন,

-নিজের দোষে নিজে কষ্ট পাচ্ছো। কেন বুঝো না আমায়? বিয়েটা আমাদের দুজনের জন্যই দরকার। তোমার জন্য কী দরকার সেটা না হয় না-ই বললাম। কিন্তু আমার যে শ্বাস নেওয়ার জন্য হলেও তোমাকে প্রয়োজন। বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে চাই! আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তুমি।

অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালাম। নির্জনের কথাগুলো একটাও মিথ্যে নয়, আমি জানি। কিন্তু! একটা কিন্তু থেকেই যায়, যেটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা। নির্জন আবার বললো,

-এই একটা মাস আমি কীভাবে কাটিয়েছি জানো? তোমার কথাগুলো কানে বাজতো! তোমার সামনে যেতে পারতাম না। তুমি আমার মুখ দেখবে না বলেছো। তবুও দূর থেকে রোজ তোমায় দেখতাম। আজও গিয়েছিলাম। কিন্তু আর আড়ালে থাকতে পারলাম না। যাই হোক, এখন ওসব কথা বাদ দাও। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নাও। কাবার্ডে তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু রাখা আছে।

নির্জন চলে গেলেন। আমিও চোখ মুছে স্বাভাবিক হলাম। কেন যে কেউ আমায় সবটা ক্লিয়ার করে বলছে না?

.

তিনদিন ধরে এই বাংলোতেই বন্ধী আছি। যদিও একদম বন্দী নই, সারা বাড়ি, বাগান ঘুরতে ঘুরতে সময় কাটাই। বাইরে যাওয়ায়ও বারণ নেই, তবে বাসায় বা কারো সাথে দেখা করতে যাওয়া যাবে না। যেন কেউ আমার অবস্থান জানলেই আক্রমণ করবে! বাবা-মায়ের সাথে রোজই কথা হয়।কিন্তু তাদের কোনো হেলদোল নেই। মেয়ে কোথায় আছে সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাদের। নির্জনের সাথে আছি মানে আমি সবচেয়ে নিরাপদ আছি এটাই তাদের ধারণা। নির্জনও এখানেই থাকে, তবে অন্য ঘরে। আমার সাথে দেখা হয় না তেমন। সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে। বাবার ব্যবসা, রাজনীতি আরো কতো কী!!!

বিকেলের দিকে করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ নির্জনের ঘরের সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতেই থেমে গেলাম। নির্জন এখন বাড়িতে নেই। এই সুযোগে ওর ঘরটা একবার সার্চ দিলে কেমন হয়? কিছু না কিছু তো পাবোই!

যেই ভাবা, সেই কাজ। হ্যান্ডেলে মোচড় দিতেই দরজা খুলে গেল। আরে বাহ্! লক করা না। এতো মেঘ না চাইতেই জল! খুশি মনে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সামনে তাকিয়ে বেশ বড়সড় একটা শক খেলাম। এ আমি কী দেখছি? চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। অস্পষ্ট ভাবে কিছু দৃশ্যপট ভেসে উঠতে লাগলো। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তারপর! সব অন্ধকার হয়ে এলো।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে