তুমিময় আসক্তি পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
1824

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
অন্তিম পর্ব

নির্জন সিক্ত গাল দুটো অতি যত্নের সাথে মুছে দিলেন। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,

-অনেক হয়েছে। এবার তো কান্না থামিয়ে একটু হাসো! মলিন হাসি না। সেই আগের মতো প্রানখুলে হাসবে কিন্তু!

চোখ বন্ধ করেই নিঃশব্দে হাসলাম। অভিমানী সুরে বললাম,

-কেন এতো কষ্ট দিলেন আমায়? বিগত পাঁচটা বছর আমার আমার কাছে কতোটা বিষাক্ত ছিল, জানেন? তার ওপর এতো দিন আপনি সব ভুলে যাওয়ার ভান করছিলেন! বারবার ইগনোর করতেন আমায়। মরে যেতে ইচ্ছে করতো তখন।

নির্জন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,

-আরে এসব কী যা-তা বলছো তুমি? আর আমায় এভাবে আপনি-আপনি করে কথা বলছো কেন? এসব কী করেছেন, বলেছেন, দিয়েছেন লাগিয়েছো? একবার বলেছিলাম না, এসবে হার্ট হই আমি।

-আর আমি? সবসময় শুধু নিজের দিকটাই দেখবে, তাই না? আমার তো কোনো ভ্যালুই নেই তোমার কাছে! তিন বছরে তোমায় যতটা কষ্ট দিয়েছি, পাঁচ বছরে সবটা সুদে আসলে উসুল করেও ক্ষান্ত হওনি তুমি! আবার মেমোরি লসের এক্টিং করে নিজের কষ্ট গুলো আমায় ফিল করাতে চেয়েছো। কথা বলবে না আমার সাথে!

মুখ গোমড়া করে নির্জনের থেকে দূরে সরে যেতেই উনি একটানে কাছে টেনে কোমড় পেচিয়ে ধরলেন। আকস্মিক এভাবে টেনে আনায় চোখ বড়বড় করে তাকালাম। নির্জন ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

-তোমায় কে বললো এসব কথা? আমি তোমাকে আমার কষ্ট ফিল করাতে চাইবো! হ্যাভ ইউ গন ম্যাড, গুঞ্জন? এই চিনলে আমায়! তোমার চোখের এক বিন্দু জলের কারণ হওয়ার চেয়ে তো আমার কাছে মৃত্যু অধিক শ্রেয় বলে মনে হয়। তবুও না চাইতেও তোমাকে কাঁদতে হয়েছে অনেক।

নির্জনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। উৎসুক কন্ঠে বললাম,

-তাহলে?

-গুঞ্জন, লেট মি এক্সপ্লেইন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমি কিছু ভুলে যাই নি আর না আমার স্মৃতি চলে গেছে। যখন থেকে আমি হাত-পা নাড়াতে পারতাম, তখন থেকেই আমার সেন্স অফ হেয়ারিং কাজ করা শুরু করে। তোমাদের কথা শুনতে পেতাম বাট চোখ মেলে দেখার মতো এবিলিটি আমার তখনও আসেনি। সেদিন তুমি কেঁদে কেঁদে যখন দূরে চলে যাওয়ার কথা বলছিলে, তার আগের দিন আমি চোখ মেলতে পেরেছিলাম। তবে কাউকে বুঝতে দেইনি। তোমায় সেদিন ঐভাবে কাঁদতে দেখার পর আমার কেমন লেগেছিল, বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু একটা যৌক্তিক কারণেই আমি সবাইকে না চিনতে পারার ভান করেছিলাম।

-কিন্তু সেই কারণটা কী?

নির্জন ঠোঁট গোল করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-আসলে শুভ্রব আর শায়ন্তীকে আমার তখনও ডাউট হচ্ছিল। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। তাই………..

অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,

-মানে কী? শুভ্রব আর শায়ন্তীকে সন্দেহ করেছিলে তুমি? শায়ন্তী তো পাঁচ বছর ধরেই মেন্টালি ডিজঅর্ডারড্! ওকে যদি তুমি দেখতে, তাহলে বুঝতে। আর রইলো শুভ্রবের কথা। শুভ্রব এই পাঁচ বছরে আমাকে কীভাবে সামলেছে, সেটা শুধু আমি জানি। ওনার উৎসাহ পেয়েই আমি স্টাডি কমপ্লিট করতে পেরেছি। আর তুমি এভাবে সুস্থ হয়ে গেছো, এতেও শুভ্রবের অবদান সবচেয়ে বেশি।

-আমি এখন জানি সেটা। কিন্তু প্রথম দিকে তো সেটা জানতাম না! আমি ভেবেছিলাম, আমার মেমোরি লস দেখে শুভ্রব যদি কোনোভাবে খুশি হয়, তাহলে বুঝবো ও এখনো বদলায়নি। কিন্তু না! এ কয়েকদিনে ওর মুখে শুধু কষ্ট আর হতাশাই দেখেছি। তখন বুঝলাম……..

-কী বুঝলে? তুমি ভুল ভেবেছিলে, তাই তো? সবই ভাবো তুমি। কিন্তু এই আমি নামক ব্যক্তিটার কথা তোমার মনে আসে না। ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? এতে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি! এখন ধরা খেয়ে কাছে এসেছো।

মুখ বাকিয়ে বললাম কথাগুলো। নির্জন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেই আগের ভুবন ভোলানো হাসিটা দিলেন। বিরক্তি নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার বৃথা চেষ্টা করতে করতে বললাম,

-ছাড়ুন আমাকে। কথা বলবেন না আমার সাথে। আমাকে এতো কাঁদিয়ে এখন আলগা খাতির দেখাতে এসেছেন! আপনাকে আমি চিনিই না।

নির্জন হাসি বজায় রেখেই বললেন,

-হেই, তোমাকে বলেছি না এসব আপনি-টাপনি না বলতে। আর ছাড়ার জন্য তো ধরিনি! এ জীবনে আর ছাড়া পাচ্ছো না আমার থেকে।

বলেই আমাকে আরো শক্ত করে চেপে নিলেন নিজের সাথে। হতভম্ব হয়ে তাকাতেই দেখলাম, উনি নিজের মুখ আমার দিকে এগিয়ে আনছেন। ভয়ে ভয়ে মুখ পিছিয়ে নিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি কপালে ঠোঁটের স্পর্শ একেঁ দিলেন। আমি ফট করে চোখ খুলে ফেললাম। এটা দেখে নির্জন সশব্দে হেসে দিলেন। হাসতে হাসতেই বললেন,

-কী ভেবেছিলে তুমি, হ্যা? আগে তো জানতাম না, আমার বউ এতো এক্সট্রা ভাবে। ছিঃ কী লুচু তুমি!

ওনার না চাইতেও লজ্জা লাগলো। তবুও সেটা বুঝতে না দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। উনি হালকা হেসে বললেন,

-ভালোবাসার স্পর্শ কপালের সুন্দর, শ্যামাঙ্গিনী!

.

নির্জনের মা সবটা জানার পর ওনাকে বেশ জোরেশোরে দুটো চড় মেরেছেন। বাবা তো তিনদিন কথাই বলেননি! পরে নির্জন অনেক কষ্টে ওনাকে মানিয়েছেন।

শুভ্রবকে আজ সকালে ফোন দিয়ে আসতে বলেছি। এই তিনদিনে বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক হয়েছে। তাই এখন শুভ্রবকে একদম সারপ্রাইজড্ করে দেবো। সারা আর আমার বাবা-মাকেও আসতে বললাম। বাবা-মা দুপুরের পর আসবেন। কিন্তু সারা সকাল সকালই চলে এসেছে।

সারার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর এটা-সেটা নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম। হঠাৎ হাসার মাঝে দেখি সারা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললাম,

-কী রে? হা করে ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন, হুম?

সারা থতমত খেয়ে সোজা হয়ে বসতে বসতে প্রসন্নের হাসি দিয়ে বললো,

-কতদিন পর তোকে এভাবে মন খুলে হাসতে দেখছি, ইয়ার! সেই আগের মতো। ফাইনালি, তোর দৃঢ় বিশ্বাস সফল হয়ে গেল।

সারার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক! সেটা দেখে মৃদু হেসে বললাম,

-সেটা তো হয়েছে! কিন্তু তোর কী খবর বল তো! বয়স তো কম হয়নি! বিয়ে-শাদি কি এ জীবনে করবি না নাকি?

আমার প্রশ্নে সারা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। জোরপূর্বক হেসে বললো,

-আরে ধুর! এমনিই জম্পেশ চলছে। ঐ বিয়ে নামক প্যারা আর ঘাড়ে চাপাতে চাই না!

পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-যদি শুভ্রব তোকে বিয়ে করতে চায়, তাহলে?

সারা চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো। হকচকিয়ে গিয়ে বললো,

-শ্ শুভ্রব! উনি ক্ কেন আমায় বিয়ে করতে চ্ চাইবেন?

-কারণ তুই ওনাকে ভালোবাসিস!

সারা অবাক হয়ে বললো,

-তুই জানিস? আমি তো তোকে কখনো বলিনি!

-আমার জানাটা ফ্যাক্টর না। তুই ওনাকে ভালোবাসিস এটাই আসল কথা।

সারা আমার কথা শুনে মলিন হাসলো। হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,

-আরে বাদ দে, ইয়ার! উনি কখনো আমায় ভালোবাসবেন না। এতো বছরে কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু ওনার এক কথা। আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি এখন। হয়তো উনি আমার ভাগ্যে নেই!

সারার কথা শেষ হতেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,

-গুঞ্জন, ডেকেছিলে কেন? এনি প্রব্লেম?

পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, শুভ্রব দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে সাদা এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ দেখে বুঝলাম, হসপিটালে যাওয়ার পথে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। বসা থেকে দাঁড়িয়ে সারার দিকে তাকালাম। ও একপলক শুভ্রবের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। শুভ্রব সারার এরকম ইগনোরেন্স দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। মুখে সৌজন্যের হাসি ঝুলিয়ে কিছু বলতে যাবো, এমন সময় কোত্থেকে নির্জন হাওয়ার বেগে ছুটে এসে শুভ্রবকে ঝাপটে ধরলেন। আমি আর সারা হালকা ভয় পেয়ে গেলেও নিজেদের সামলে নিলাম। কিন্তু শুভ্রব যেন আকাশ থেকে পড়লেন। চোখ বড়বড় করে নির্জনের পিঠে হাত রাখতেই নির্জন বললেন,

-সরি, সরি, সরি! তুই তোর কথা রেখেছিস। আর আমি? বোকার মতো তোকে সন্দেহ করেছিলাম। মাফ করে দে, ইয়ার! তুই অন্তত মারিস না আমায়। মা এমনি দুই চড়ে গাল ফাটিয়ে দিয়েছে আমার!

শুভ্রবের মাথার ওপর দিয়ে যে সবটা যাচ্ছে, তা ওনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নির্জনের মুখটা সামনে এনে অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,

-তুই আমাকে চিনতে পেরেছিস?

আমি এগিয়ে এসে শুভ্রবকে সবটা খুলে বলতেই উনি নির্জনের দিকে দাঁত কটমট করে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকালেন। রাগী স্বরে বললেন,

-আই নৌ, আমার প্রতি তোর সন্দেহ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তোর জায়গায় আমি থাকলেও সন্দেহ করতাম। কিন্তু এজন্য এই মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারতি। ওকে অন্তত সবটা খুলে বলতি। তুই জানিস, এই পাঁচ বছরে ওর ওপর দিয়ে কী গেছে? আমরা ওকে সাপোর্ট না করলে পাগল হয়ে যেত ও। তার ওপর তুই এসব করেছিস!

নির্জন অপরাধী সুরে বললেন,

-জানি এটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার মাথাও তখন ভালোভাবে কাজ করছিল না। কী করতে কী করেছি?

শুভ্রব কিছু সময় চুপ করে থেকে আচমকা নিজেই নির্জনকে জড়িয়ে ধরলেন। কান্নামাখা গলায় বললেন,

-আমি জিতে গেছি, ইয়ার! আমাদের বন্ধুত্বের চ্যালেঞ্জে আমি জিতে গেছি।

ওনাদের এমন কান্নাকাটি দেখে আমি নিজেই আবেগান্বিত হয়ে গেলাম। না চাইতেও চোখের কোণে জল চলে এলো!

.

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ মনযোগ সহকারে দেখছি। আমার মতো তৃতীয় বার একজন মানুষের জন্যই বউ সাজার সৌভাগ্য কোনো মেয়ের হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। আজ তৃতীয় বারের মতো আমার আর নির্জনের বিয়ে হলো। প্রথম বার ঘরোয়া ভাবে হয়েছিল বলে এবার বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই হলো।

নির্জন ঘরে প্রবেশ করতেই আয়নার ভিতরে ওনার প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম। উনি ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। উনি সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের পলক ফেলছেন না। বেশ কিছু মুহুর্ত কেটে গেলেও ওনার কোনো হেলদোল না দেখে কিছু বলতে যাবো, এমনসময় উনি ঠোঁটে আঙুল বসিয়ে বললেন,

-হুশ…… আজ আমি আমার শ্যামাঙ্গিনীকে প্রাণ ভরে দেখবো। গত দুই বার বধূ বেশে মন মতো দেখতে পারিনি। এবার তো আর সেটা হতে দেবো না!

নির্জন এগিয়ে এসে আমার কপাল থেকে টিকলি সরিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলেন। ওনার বুকে মাথা এলিয়ে দিতেই দু হাতে আগলে নিয়ে বললেন,

-ভালোবাসি, শ্যামাঙ্গিনী। আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব জুড়েই যে তুমি মিশে আছো! সেই কৈশোরকাল থেকেই *তুমিময় আসক্তি* তে জড়িয়ে গেছি আমি। আজীবন তোমাতেই জড়িয়ে থাকতে চাই।

চোখ দুটো ভরে এলো। এটাই তো আমার একমাত্র প্রত্যাশা ছিল। সারাজীবন এই টুকু প্রাপ্তিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে পারবো আমি। আর কিছু চাই না! কিচ্ছু না!!

নির্জন আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললেন,

-একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।

উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি হেসে বললেন,

-চলো আমার সাথে।

হাত ধরে টেনে বারান্দায় এনে দাঁড় করালেন নির্জন। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,

-সামনে বাগানের দিকে তাকাও আর চুপচাপ দেখো।

সামনে নিচের দিকে তাকাতেই দেখলাম, শুভ্রব দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে কারো জন্য ওয়েট করছেন! লাইটিং এর ফকফকে আলোয় বাগানটা একদম পরিষ্কার। হঠাৎ সারাকে শুভ্রবের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অবাক চোখে তাকালাম। দোতলা থেকে ওদের কথোপকথন অনেকটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

সারা শুভ্রবের সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

-এতো রাতে আমাকে এখানে ডেকেছেন কেন? কী বলবেন?

শুভ্রব ইতস্তত করে বললো,

-আব্ আসলে আমি…. মানে বলছিলাম যে, আমি… অব্ আমি আমার ঘড়িটা নিতে এসেছিলাম।

শুভ্রবের কথা শুনে নির্জন আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে কিটকিটিয়ে হেসে দিলেন। আমিও হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসি থামালাম।

সারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,

-মানে? এতো বছর পর আপনি আপনার সেই ঘড়ি ব্যাক করে নিতে চাইছেন! আপনি তো ওটা আমার বরকে গিফট করতে বলেছিলেন!

শুভ্রব সাথে সাথে বলে উঠলেন,

-আরে সেজন্যই তো দিতে বলেছি! ভবিষ্যতে তো সেটা আমাকেই পরাবে। তাহলে আজই পড়িয়ে দেও।

সারা থমকে গিয়ে তাকালো শুভ্রবের দিকে। এমন কিছু সে মোটেও আশা করে নি। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি…..

আর বলতে পারলো না। কন্ঠ আঁটকে আসছে ওর। শুভ্রব এগিয়ে গিয়ে ওর দুই গালে হাত রাখলেন। সারার চোখে পানি টলমল করছে। পলক ফেলতেই পানি গড়িয়ে পড়লো। শুভ্রব সেটা মুছে দিয়ে বললেন,

-এতো ভালোবাসো কেন, হুম? আর সেই ভালোবাসারই বা এতো জোর কেন? তোমাকে হাজার দূরে ঠেলেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলাম না। *তুমিময় আসক্তি* আমাকে হারিয়েই দিলো! সর্বহারা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে ভালোবাসার অনেক অভাব আমার। সেখানে এক চিলতে আলো হয়ে আবির্ভূত হবে কি? বেশি না! শুধু একটু ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত আমি। হবে কি আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন?

সারা ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিতেই শুভ্রবকে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রবও ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন।

নির্জনের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-তুমিই ল এসবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছো, তাই না?

নির্জন ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললেন,

-আমি কিছুই করিনি। জাস্ট, শুভ্রবের ভেতরের সুপ্ত অনুভূতিটাকে জাগিয়ে দিয়েছি। দ্যাটস ইট! যদিও শুভ্রব তোমাকে ভালোবাসত, এখনো হয়তো বাসে। কিন্তু দ্বিতীয় ভালোবাসা তো মানুষের জীবনে আসতেই পারে!

মাথা নাড়িয়ে হেসে বললাম,

-তুমি পারোও বটে! সব দিকে নজর খোলা থাকে তোমার।

নির্জন হেসে দিলেন আমার কথায়।

.
———আট বছর পর———
.

অহি বেশ মনযোগ সহকারে হাতে থাকা রুবিক্স কিউবটা নিয়ে মোচড়ামুচড়ি করছে। কিন্তু কিছুতেই সেটা মেলাতে পারছে না। গালে হাত দিয়ে বসে বসে ওর কান্ড দেখছি এমনসময় আদ্রিশ সেখানে এসে অহিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-তোমার মতো বাচ্চা মেয়েদের খেলনা এটা না। এটা মেলানো টেকনিক আছে।

এমনসময় শুভ্রব আর সারাকে নিয়ে নির্জন এখানে প্রবেশ করলেন। আমিই ইনভাইট করেছিলাম ওদের। অহি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

-আমি বাচ্চা না। আমাদের ক্লাসে একমাত্র আমিই আমার নাম ইংলিশে লিখতে পারি।

অহির মুখে এমন কথা শুনে আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। অবাক চোখে নির্জনের দিকে তাকাতেই দেখলাম, উনি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। সারা আর শুভ্রবেরও এক অবস্থা।

আরোহী জোহায়ের অহি, আমার আর নির্জনের একমাত্র মেয়ে। বয়স চার বছর। আদ্রিশ শাহরিয়ার, সারা আর শুভ্রবের একমাত্র ছেলে। বয়স সাত বছর প্রায়। আমাদের বিয়ের দুই মাস পরেই সারা আর শুভ্রবের বিয়ে হয়। আদ্রিশও অহির তিন বছর আগেই জন্মগ্রহণ করে।

অবাকতা কাটিয়ে নির্জনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

-আমি অহিকে কিচ্ছু বলিনি! আমার কোনো দোষ নেই।

শুভ্রব নির্জনকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,

-আরে ইয়ার, তোর কিছু বলার জন্য ওয়েট করে আছে না কি ওরা। এটুকু বুঝতে পারছিস না? দ্যে আর মেড ফর ইচ আদার। এজন্যই তো তোদের কার্বন কপির মতো ডায়লগ বলছে!

নির্জন শুভ্রবের সাথে হাই-ফাইভ করে বললেন,

-যাক, ফাইনালি বন্ধুত্ব বেয়াইয়ের সম্পর্ক পর্যন্ত গড়াবে। তাই না, বেয়াই?

শুভ্রব সায় জানিয়ে বললেন,

-জ্বি, হ্যাঁ! বেয়াই।

সারাদিন সবাই মিলে অনেক আনন্দ উল্লাস করেই কাটালাম।

রাতে অহি ঘুমিয়ে যেতেই নির্জন আমাকে টেনে ছাদে নিয়ে গেলেন। পূর্ণিমা রাতে চাঁদ তার সম্পূর্ণ আলো ঢেলে দিচ্ছি। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়াতেই নির্জন পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী, বলে না তো কিছু চাঁদ! ”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

নীরবেই হালকা হাসলাম। কিছু মুহুর্ত কথা বলার চেয়ে অনুভব করাটা বেশি জরুরি। নিস্তব্ধতাই তখন অনেক কথা জানিয়ে দেয় যা মুখে বলা যায় না কখনো।

~সমাপ্ত~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে