তুমিময় আসক্তি পর্ব-১৮

0
1184

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_____১৮

উদাস ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছি। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলগুলো কপল সিক্ত করে দিচ্ছে ক্রমাগত। হাত দিয়ে সেগুলো মুছতেও ইচ্ছে করছে না একটুও। নীরবতা ভেঙে শুভ্রব পেছন থেকে বলে উঠলেন,

-তুমি কি নিউজটা শুনে খুশি হওনি? এমন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

শুভ্রবের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম। আমার কোনো হেলদোল না দেখে শুভ্রব আবার বললেন,

-এভাবে চুপ করে উল্টো ঘুরে থেকে নিজের চোখের পানি আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই, গুঞ্জন। কিছু তো বলবে নাকি? আনন্দটা নিজের ভেতর চেপে রাখাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ?

বুক চিরে ভারি নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। নাক টেনে ভাঙা গলায় বললাম,

-অতি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়, এটা তো জানেন! অতি আনন্দেও মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আমার অবস্থাটাও তাই। আমার কী বলা উচিত, কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

শুভ্রব এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললেন,

-নির্জনের ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে, এটা ডেফিনেটলি একটা গুড নিউজ। তোমার বিশ্বাস সত্যি হচ্ছে তাহলে! আমার এতো বছরের শ্রমটাও ব্যর্থ হবে না। কিন্তু এজন্য তুমি এভাবে কেঁদে ভাসালে তো সেটা ঠিক হবে না, হ্যা!

ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। শুভ্রব আরেক দফা হেসে বললেন,

-চোখ দুটো মুছে নাও। পরে নির্জন সুস্থ হয়ে গেলে বলবে, ‘আমার বউটাকে তোর দায়িত্বে রেখে গিয়েছিলাম না? ওকে কাঁদতে দিয়েছিস কেন তুই?’ ইডিয়েটটা নিজেই এতো কাঁদিয়ে দোষটা সুন্দর ভাবে আমার কাঁধে দিয়ে দিবে।

কান্নার মাঝেই হেসে দিলাম। সত্যি সত্যিই এমনটা হতে পারে! আমার মলিন হাসি দেখে শুভ্রব বললেন,
-তুমি অনেক বদলে গেছ, গুঞ্জন! মানুষ বলে, সময় মানুষকে পাল্টে দেয়। বাট ইউ নৌ হোয়াট? সময় না পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। এই যে দেখো, আজ নির্জন আমাদের মাঝে থাকলে তুমি আগের মতোই উৎফুল্ল থাকতে। হাজারো সময় চলে গেলেও এভাবে প্রাণহীন হাসি দিতে হতো না তোমায়!

শুভ্রব কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ঠোট চেপে কিছুক্ষণ নিজেকে ধাতস্থ করলাম। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-নির্জন তো এখন জাস্ট হাত-পা নাড়ায়, তাও মাঝে মাঝে। সবসময় না। উনি চোখ কবে খুলবেন? কথা কবে বলবেন?

শুভ্রব আমার উৎসাহ দেখে শুকনো হাসি দিলেন। মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

-ওর ব্রেনের রেসপন্স পজিটিভ বলেই মনে হচ্ছে আমার। আই হোপ, খুব শীঘ্রই ও আমাদের মাঝে ফিরে আসবে তাও আবার সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবেই!

এতোগুলো ভালো খবর একসাথে পাবো কখনো এক্সপেক্ট করিনি আমি। শুভ্রব আবার বললেন,

-অনেক তো হলো! এবার তো নির্জন তোমার ডাকে সারা দিচ্ছে! এখন আর অভিমান করে থেকো না। দূর থেকে না দেখে কাছাকাছি যেও এখন থেকে।

মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালাম।

-আর রাগ করে থাকবো না। কিন্তু উনি সুস্থ হয়ে উঠলে এতো এতো কড়া কথা শুনিয়ে দিবো না! একমাস কথাই বলবো না।

নিজের ঘরে চলে আসলাম। এদিকে শুভ্রব একটা হতাশা মিশ্রিত শ্বাস নিয়ে আনমনে বললো,

– তোমায় সবচেয়ে কঠিন সত্যিটা বলতে পারলাম না, বর্ষণবিলাসি! তুমি সহ্য করতে পারবে না। তোমার এই মুহুর্তের আনন্দটা নষ্ট করতে চাই না আমি। আমায় ক্ষমা করো। কিন্তু আমার ধারণা যদি সত্যি হয়, তবে নির্জন চোখ মেলে তাকালে সবটা আমি সামলাবো কীভাবে?

.

প্রথম প্রথম আশার আলো জাগলেও হতাশা এখন আবার ঘিরে ধরেছে সবাইকে। তিন মাস পেরিয়ে গেছে। এখনো নির্জন শুধু হাত-পা ই নাড়ায়। এর বেশি কোনো কিছুই চোখে পড়েনি কারো। পুরোনো সেই অভিযোগ গুলো আবার মনের ভেতর দানা বাঁধছে। আগেই তো ভালো ছিলাম! এখন আবার আশার আলো কেন দেখালে, নির্জন? আশায় হতাশার যন্ত্রণা কি তুমি বুঝবে কখনো?

আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে নিজের কষ্ট গুলো নিয়ে ভাবছিলাম। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না যদিও। কিন্তু ভেতরের দহন যে শ্বাস নেওয়াটা কষ্টসাধ্য করে দিচ্ছে!

-কেমন আছিস, মা?

ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই নির্জনের মা আর বাবাকে দেখতে পেলাম। তাদের দুজনের চোখ মুখই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে এতো বছর এভাবে এই অবস্থায় থাকলে এর থেকে ভালো কিছু আশা করাও যায় না। ওনারা দুজনেই বহু কষ্টে মুখে হাসির রেখা টেনে আছেন।

ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করতেই বললাম,

-আরে, তোমরা! কখন এলে?

মা এগিয়ে এলেন। আমার মনের অবস্থা হয়তো বুঝতে পারলেন! মুখে দুই হাত বুলিয়ে দিতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। নিজের গলায়ও ভারি অনুভব হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছি না তেমন! হয়তো কান্নারা দলা পাকিয়ে গেছে গলায়। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে মায়ের চোখের পানি মুছে দিলাম। মা সাথে সাথেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। সন্তানের জন্য একজন মায়ের আহাজারি দেখে নিজের ভেতরের কষ্টগুলো উগলে বের হয়ে আসতে চাইছে আমার। চোখ নিজের বাঁধ ভেঙে ফেলেছে ইতোমধ্যেই! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও বুকে পাথর চেপে সবটা হজম করছি। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

-ও কী আর উঠবে না রে, মা? আর কতো শাস্তি দেবে আমায় বল তো! কতোদিন ও আমায় মা বলে ডাকে না! কোলে মাথা রেখে ঘুমায় না। ওর ঐভাবে নির্লিপ্ত ভাব যে আমি আর মানতে পারছি না!

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই বাবা বলে উঠলেন,

-নিহা, তোমায় এখানে এসে নিজেকে শক্ত রাখতে বলেছিলাম। তুমি এভাবে কাঁদলে এই মেয়েটা কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখবে বলো তো!

বলেই চোখ ঘুরিয়ে পানি গুলো সন্তর্পণে মুছে নিলেন। নিজেই নিজেকে শক্ত রাখতে পারছেন না! আবার আরেক জনকে শক্ত হতে বলছেন। আশ্বাস দিয়ে কিছু বলতে যাবো এমনসময় মা এমন একটা কথা বললেন যেটা শুনে দু কদম পিছিয়ে গেলাম।

মা আমার দু বাহুতে হাত রেখে বললেন,

-আমার ছেলেটাকে নিয়ে আর কোনো আশার আলো দেখছি না আমি। তুই এভাবে আর নিজের জীবনটাকে অগোছালো করে রাখিস না। তোরও একটা জীবন আছে। নিজের সুখের জন্য হলেও তোর বিয়ে করা উচিত। এভাবে একটা মানুষের জীবন চলে না, মা!

থমকে গিয়ে পিছিয়ে গেলাম। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাতেই বাবা সায় জানিয়ে বললেন,

-হ্যাঁ, মা। সামনে তোমার পুরো ভবিষ্যৎটাই পড়ে আছে। এভাবে দিন চললে তোমার একটা মুহুর্ত ও শান্তিতে কাটবে না। সেজন্য তুমি মুভ অন করো।

হাত দিয়ে ওড়না মুচড়ে ধরলাম। নিজের বাবা-মায়ের মুখে এই কথা গুলো শুনে ততোটা কষ্ট লাগেনি। কিন্তু আজ ওনাদের মুখে শুনে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে যেন! সত্যিই কি নির্জন আর ফিরবে না? তাদের নিজের সন্তানের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই! নির্জন এটা কী শুরু করেছে? সেদিন আমিই মরে যেতাম। তাহলে আজ এমন দিন দেখতে হতো না! চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

.

নির্জনের কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। সে বরাবরের মতোই ঘুমিয়ে আছে। কোনো সাড়া নেই। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-কী পেয়েছো তুমি, হ্যা? সবাইকে এভাবে কাঁদাচ্ছ, কষ্ট দিচ্ছো! এভ্রিথিং হ্যাজ আ লিমিট, নির্জন। সবারই ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। কিসের জন্য এতো শাস্তি দিচ্ছো আমায়? সেদিন তোমায় প্রতারক বলেছিলাম বলে? ঘৃণা করি বলেছিলাম বলে? তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না বলেছিলাম বলে? নাকি নিজের চাহিদা পূরণের জন্য আমায় বিয়ে করতে চাইছো বলেছিলাম, সেজন্য? তুমি সেদিন বলেছিলে আমার ভুল আমি বুঝতে পারবো। কিন্তু ততোদিনে অনেক বেশি দেরি না হয়ে যায়! দেরী হয়ে গেছে, নির্জন। সত্যিই আমার বুঝতে দেরি হয়ে গেছে। সে শাস্তি তো আমি পেলাম, বলো? পাঁচ বছর কি কম সময়? আমার শাস্তি কি এখনো শেষ হবে না? আচ্ছা, দাও শাস্তি। কিন্তু এভাবে দিও না। আমায় মেরে ফেলো, তাও এভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে থেকো। এতে তো তোমার বাবা-মাও কষ্ট পাচ্ছে! ওনারা তো কোনো দোষ করেননি! অনেক হয়েছে এবার ওঠো, প্লিজ। সহ্য হচ্ছে না আমার। একটুও সহ্য হচ্ছে না।

নির্জনের বেডের সামনে মাথা গুঁজো ফ্লোরে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললাম কথাগুলো। নির্জন হাত-পা নাড়ছে। রাগ লাগছে প্রচুর। চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললাম,

-উঠবে না তুমি, তাই না? সারা জীবন শুধু এই আধো আধো হাত নাড়াবে? চোখ মেলে তাকাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছো, তাই তো? বেশ! থাকো তাহলে তুমি নিজের মতো। আমি এক্ষুনি সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাবো! তোমাকে ছেড়ে, আমার পরিবারকে ছেড়ে, ইভেন এই দেশকে ছেড়ে। কারো সাথে কোনো কানেকশন রাখবো না। হারিয়ে যাবো আমি। অনেকদূর হারিয়ে যাবো। তুমি চোখ মেলে হাজারো খুঁজলেও, আকুতি জানালেও আমায় আর পাবে না। কোথাও খুঁজে পাবে না আমায়!

বলেই পা ঘুরিয়ে কয়েক কদম এগোতেই পেছন থেকে ওড়নায় টান পড়লো। থমকে গেলাম। অশ্রু সিক্ত চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম, নির্জন ওড়না খামচে ধরে চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। সেই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চাহনি দেখেই আমি পুরো পাথর হয়ে গেলাম।

হঠাৎ নির্জন চেহারার রং পাল্টে ফেললেন। জোরে জোরে কতোগুলো শ্বাস ফেলে অতি কষ্টে থেমে থেমে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললেন,

-আ্ আমি এ্ এখানে ক্ কেন? আম্ আমার ক্ কী হয়েছে? আ্ আপনি ক্ কে?…………….

শেষোক্ত প্রশ্নটা শুনে আমার পুরো পৃথিবীটাই উল্টেপাল্টে গেল যেন!

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে