তিলেত্তমা পর্ব ১১,শেষ পর্বের প্রথম খন্ড

0
1080

তিলেত্তমা পর্ব ১১-ক (শেষ পর্ব,প্রথম খণ্ড)

-‘অ্যাই, ডালাটা এদিকে দে, সিফু ভালো সাজাতে পারে এসব। এদিকে দে, এদিক দে!’- মেয়ের গুণগান করতে করতে বড়খালার চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়িঘর একেবারে মাথায় উঠেছে। আমাদের সেই পুরনো আমলের ভাড়া বাড়িটা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে একদম। আমার দুই মামা, দুই খালা, দুই ফুপু, দুই চাচার বাড়িসুদ্ধ সবাই জমায়েত হয়েছে আজ। আমার এতদিনের শোবার ঘরটায় শোলার তৈরি বড় বোর্ড টানানো হয়েছে। তাতে লাল-নীল অক্ষরে নকশা করে লেখা-

‘আজ রাত্রির গায়ে হলুদ’

কী অদ্ভুত! আজ রাত্রির গায়ে হলুদ! আজ তবে সত্যি সত্যিই রাত্রির গায়ে হলুদ!

অকারণ ভালোলাগায় সমস্ত অন্তরাত্মা এমনভাবে ছেয়ে আছে যে গত দু-চারদিন ধরে আত্নীয়-স্বজনদের টিপ্পনী দেয়া কথাগুলিও কানের কাছে এসে এসে ফিরে গেছে, ভালোলাগার বর্মঘেরা মনটা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি! এইযে রঙ মেখে সঙ সেজে স্টেজে বসে আছি, বাতাসে ভেসে ভেসে কত কথাই তো কানে আসছে। এই যেমন একটু আগে বাটা হলুদ ভরা বাটিটা রাখতে এসে ফুপু গুনগুন করে গেলেন-

-‘বিয়াইত্তা, এক মাইয়ার বাপ পাত্র ধইরা আনসস রাত্রি! এরচে আমগো কাউসার কুনদিক দিয়া খারাপ ছিল রে? তোগো এই যুগের মাইয়াগো মতিগতির কিছু বুঝিনা আমি…’-গুনগুন, গুনগুন… গুনগুন…

কিংবা, ডালা সাজাতে সাজাতে সাগুফতা ওর ভারী হয়ে যাওয়া পেটটা নিয়ে পাশে এসে বলছিলো-

-‘তোর হবু বর কিন্তু বেশ দেখতে রে রাত্রি! তোর সাথে মিলেছে ভালোই, বল?- একেবারে মানিকজোড়!’

বড়খালা পাশেই বসে ছিলেন। মেয়ের দিকে চেয়ে চোখ টিপে বললেন-

-‘তা অমন বাচ্চাসমেত বর বিয়ে করলে তোর জন্যেও সিনেমার হিরো নিয়ে আনতে পারতাম রে সিফু! আমার জামাই কম কীসে শুনি? নাহয় রং টাই একটু ময়লা…’

-‘আর হাইটটা একটু কম! সাগুফতা বেচারি তো হাই হিল পরতেই পারেনা একেবারে!’- পেছন থেকে ছোটখালার গলা ভেসে আসে ঠিক সময়মত। ছেলেবেলা থেকে এই মানুষটিই একমাত্র নিঃস্বার্থভাবে আদর করে গেছেন আমাকে! অনেকে বলে আমাদের চেহারাতেও নাকি মিল আছে, পাশাপাশি দাঁড়ালে দুই বোন বলে ভ্রম হয়।

ছোটখালার দিকে আগুনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিফু আর ওর মা গটগট করে হেঁটে চলে যায়। অথচ, এসবে একদমই কিছু যাচ্ছে আসছে না আমার। একগুচ্ছ পতঙ্গ কানের কাছে গুনগুন করছে কেবল, করুক! পাবোনা পাবোনা করেও যখন ঠিক ঠিক ফুলের সন্ধান পেয়ে গেছে একটা কালো কুচকুচে মৌমাছি, বাকি রঙিন মৌমাছিদের তখন জ্বলবেই বৈকি!

এতক্ষণে নিশ্চিত বুঝে গেছেন, সেই দিবস রাইয়্যানের সাথেই আজকে গায়ে হলুদ হচ্ছে আমার। কীভাবে? সে এক আজব কাহিনী!

নিশার রিলিজের পরদিনই দিবসের মা ফোন দেন আমার মা’কে। ছোটোছেলের বদলে বড় ছেলের জন্যে নাকি চেয়ে বসেন মায়ের কাছে তার মেয়েকে! ব্যারিস্টারের বদলে ইঞ্জিনিয়ার- মা বেশ খুশিই হয়েছিলেন শুনে। কিন্তু, দিবসের আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো এবং সেখানের এক মেয়েও আছে একথা শুনতেই একবাক্যে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন মা। আমি তখনো নিশিতার ঘরে বসে বসে হাউমাউ করে কাঁদছি আর উপরওয়ালাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করছি। ঠিক সেসময় মা আমাকে ফোন দেন-

-‘পেয়েছে কী এরা? দুইদিন আগে ছোটোছেলের জন্য বড়ছেলে নিজে প্রস্তাব নিয়ে এলো আর দুইদিন পরে বড়ছেলের জন্যে মা প্রস্তাব নিয়ে এলো! বিয়ে করা দোজবরে ছেলে, যার কীনা আবার একটা লেজুড়ও আছে- এরচে তো আমাদের কাউসারালী ভালো পাত্র!’

ধপাস করে হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পরে গিয়েছিলো আমার। একসাথে অনেকগুলি অনুভূতি এসে ঘিরে ধরেছিলো বুকের ভেতরটাকে। শেষমেশ খানিকটা থিতু হলাম যখন, একটা প্রশ্নই কটকট করে খোঁচাতে লাগলো তখনোও- ‘দিবস কি তবে তার মায়ের ইচ্ছার বলি হলেন শেষমেশ?’

তাই যদি হয় তো এই বিয়েটা কোনোদিনই করবো না আমি! কালো হয়ে জন্মেছি বলে এতটাই কি ফেলনা? এ ওকে, ও তাকে, সে অন্যকে সাধাসাধি করে যাবে আমায় বিয়ে করবার জন্যে? দরকার হয় তো করবনা বিয়ে! বাচ্চা-কাচ্চা, মাতৃত্ব কিংবা সংসার- লাগবেনা আমার কোনো কিছুই! ভাবনাগুলো একে একে জড় হয়ে মাথার ভেতর রাগের পোকাটাকে নাড়িয়ে দিলো আমার। জীবন আমাকে প্রতি পদে পদে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে, তাই খুব সহজে রেগে যাইনা আমি। কিন্তু, ঐ সদা ঘুমন্ত রাগপোকাটা যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন আর নিজেকে সামলাতে পারিনা। মাটি থেকে টুপ করে ফোনটা তুলে নিয়েই power on করে দিবসের নাম্বারটায় ডায়াল করে বসলাম!

-‘রাত্রি!’- ওপ্রান্তের ডাকটা একটা হিমশীতল অনুভূতি ছুঁইয়ে দিলো মেরুদন্ড বেয়ে। বুকের ভেতর একটা তীব্র হাহাকার উঠলো, মিছিমিছি ফিসফিসিয়ে বললো- ‘ছেড়ে দে না! যেভাবে খুশি সেভাবেই করুক না বিয়ে, তোর কী তাতে? সারাজীবন এই কণ্ঠে এই ডাকটা শুনতে পাবি- এই ই তো ঢের!’

-‘একদম কথা বলবি না মিছিমিছি! আমার রাগ উঠে গেছে, জানিস না?’- এক ধমকে ওকে থামিয়ে দিয়ে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে একগাদা অক্সিজেন ভরে নিলাম ফুসফুসের ভেতরে।

-‘দেখুন, আপনারা আমায় ভেবেছেন কী বলুন তো? আজ আপনার কথায় আপনার ছোট ভাই আমায় বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে তো কাল মায়ের কথায় আপনি এসে বর সেজে দাঁড়াচ্ছেন! আমার মতটা তো একবার…’

-‘আপনার মতটা তো আমায় জানিয়ে দিলেন সেদিন ই! তার ভিত্তিতেই তো আমি মা’কে বললাম যে কেবল নিশার নয়, আমারও আপনাকে চাই!’

অ্যাঁ! বলে কী এই ছেলে!

-‘ম…মানে? আমার মত আপনাকে কবে, কখন জানালাম? আমি তো…’

-‘ঐযে, সেদিন কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে! ঘুমুতে ঘুমুতেই তো বললেন…’- দিবসের গলায় কৌতুকের সুর। এটুকু বলেই থেমে যায় সে।

-‘কী বললাম? শেষ করুন কথা!’

-‘এমা! আপনার মনে নেই? আমি তো নিজের মতন কথা বলছিলাম, হঠাৎ দেখি আপনি ঢুলছেন! নাম ধরে দু’বার ডেকে আপনাকে জাগানোর চেষ্টা করলাম, আপনি চোখটা মেললেন শুধু! তারপর নিজে নিজেই তো কত কী বলে গেলেন! বললেন- ‘আপনার ভাইকে তো আমি চিনিনা দিবস, ওঁকে তো আমি বিয়ে করতেও চাইনি! আপনারা দুই ভাই বলেছিলেন না? আপনার ভাইকে নয়, আপনার ভাইয়ের ভাইকেই তো চেয়েছিলাম আমি! ঐ দিব্যটাকে গিয়ে বলে দেনগে যান- আমায় ওঁর দয়া দেখাতে হবেনা।’ আরও কতকিছু বলেছিলেন, সবটা আমি বুঝিওনি!’

হায় খোদা! ছিছিছি! কী বিষম লজ্জার কথা!

দিবসের মুখে কথাগুলি শুনতেই ধাঁ করে সেদিনকার অনেকটুকু কথা মনে পরে গেলো আমার। এই কথাগুলিই বলেছিলাম আমি! আর বলবনা ই বা কেনো? তার আগে দু’দিন ধরে তো মিছিমিছির সাথে এগুলোই আওড়েছি বসে বসে! মাথার ভেতরের রাগপোকাটা আবার গুটিশুটি মেরে শোবার আয়োজন করছে, একরাশ লজ্জা আর সঙ্কোচ তার বদলে জায়গা করে নিচ্ছে মাথার ভেতরে!

-‘রাত্রি! আপনি নিজেকে এত ছোটো ভাবেন কেনো আমি জানিনা। আপনাকে দয়া করবার যোগ্যতা আমার কিংবা দিব্য কারুর নেই। নিজেকে আপনার যোগ্য মনে হয়নি বলেই আমি দিব্যর জন্যে আপনাকে পছন্দ করেছিলাম… অথচ আপনি কীনা উল্টে কীসব ভেবে নিলেন! আপনাকে চাইবার সাহস আমার হয়নি, নিজের ভাঙাচোরা জীবনের সাথে আপনার জীবনটা জড়ানোর মত স্পর্ধা আমার হয়নি রাত্রি! অথচ মনে মনে সেই প্রথমদিনই আপনাকে পরম আরাধ্য ভেবে বসে ছিলাম, সেই যখন একবাক্যে নিশার জন্যে ওর মাম্মাম হতে রাজি হয়ে গেলেন- সেদিন! রূপের মোহে মজবার মত বয়েস আমার আর নেই রাত্রি। জীবন দিয়ে জেনেছি, মানবের পরম আরাধ্য যদি কিছু থাকে তো সেটা হলো মন, সেটা হলো হৃদয়! সবার মত একসময় আমিও সৌন্দর্যের মোহে পড়ে ছিলাম, কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার পর জেনেছি- প্রেম বলুন, বিয়ে বলুন কিংবা দুজন মানুষের মধ্যেকার যেকোনো সম্পর্কই বলুন- তার ভিত হচ্ছে হৃদয়ের যোগাযোগটুকু, গায়ের রঙ কিংবা রূপের ছটা নয়! যাইহোক, আপনি যদি এখনো বিন্দুমাত্র আপত্তি জানান তো এই বিয়েটা যে করেই হোক বন্ধ করবো আমি… ভয় নেই আপনার তরফ থেকে আপত্তি এসেছে সেটা জানবেনা কেউ!’

এপ্রান্তে তখন আমি বাক্যহারা হয়ে বসে আছি। বেশ কিছু মুহূর্ত পর দিবসের ‘হ্যালো হ্যালো’ ডাকে ঘোর কাটলে হাউমাউ করে উত্তর দিই-

-‘যদি আর সবার মত আপনিও একদিন বদলে যান? জানেন তো, সবাই কেমন বদলে বদলে যায় বারবার! মা আজ বলছেন কাউসারালী ছাড়া গতি নেই তো কাল তার ডাক্তার মেয়েকে নিয়ে গর্ব করছেন! ফুপু গতকাল বলছেন ‘তোর ভালো চাই বলেই পাত্র খুঁজে এনেছি’ তো আজ যখন তার আনা পাত্রের চেয়ে ভাল প্রস্তাব আসছে তখন মুখ বেজার করছেন… আমি কাকে বিশ্বাস করবো বলতে পারেন? আপনিও যদি এমন করে কোনোদিন বদলে যান তখন…’

-‘রাতের আকাশে হাজার হাজার তারা ওঠে, রাত্রি! কিন্তু নাবিকেরা কেবল ঐ ধ্রুবতারার ওপর নির্ভর করেই দিক খুঁজে নেয়! আমি কি আপনার জন্যে সেই ধ্রুবতারা হতে পারিনা? শুধু শেষবারের মতো কাউকে বিশ্বাস করে দেখুন, ধ্রুবতারা হয়ে বাকি জীবনটা সে-ই নাহয় আপনাকে দিক-বেদিক চিনিয়ে দেবে!’

মন কি সায় দিলো আমার? আরেকবারের মতো কাউকে বিশ্বাস করবে বলে…

-‘পার্লারে না গেলে কেমন করে হবে! একবারই বিয়ে হয় মানুষের, তাও বুঝি না সেজেগুজে, শুধু মুখে হবে?’

-‘কারো কারো একবারের বেশিও হয় গো খালামনি!’- সাগুফতা ফোঁড়ন কাটে পাশ থেকে। সুযোগ পেলেই দিবসের আগের বিয়ের কথাটা বলবার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে মেয়েটা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রায়ই একথা সেকথা বলছে, সরাসরি কিছু বলতে এলে ছেড়ে দেবোনা আমি। তার আগ পর্যন্ত বলুক! যা খুশি বলুক! তবু শান্তি পাক!

-‘আমি এতশত বুঝিনা! পার্লারে তুই যাবি। সিফুটা সুস্থ থাকলে তো ও-ই সাথে যেতো, সবকিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতো। মেয়ে একটা হয়েছিস, সাজগোজের স্বরে অ, স্বরে আ- টাও তো জানিস না! আপাতত তোর কোনো বান্ধবীকে নিয়ে যা। কিন্তু, বউসাজ ছাড়া স্টেজে উঠবি না এই বলে দিলাম! একে বিস্তর আয়োজনে মাথার ঠিক নেই, এই নিয়ে আর যেনো কিছু না শুনি রাত্রি!’- কড়কড়ে গলায় ধমকি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন মা।

উপয়ায়ন্তর না দেখে দিবসকে বললাম মা’কে মানাতে। সেও উল্টে বলে দিলো বউ সেজে ভিডিও কল করে তাকে দেখাতে হবে, তবে বরযাত্রী রওনা করবে!

তা বেশ! সকলের এতই যখন শখ তখন কী আর করার! নিশিতাকে সাথে করে নিয়ে বাড়ির কাছেরই একটা পার্লারে গেলাম। যাবেনা যাবেনা করেও শেষ অব্দি সিফু রওনা করলো আমাদের সাথে… ঠিক কেমন করে অন্ধকার রাত্রিকে সাজিয়ে দিবালোকে রুপান্তর করবে সেই অভাবনীয় দৃশ্য দেখবার লোভ বেচারি আর ছাড়তে পারলোনা!

মোটামুটি ঘন্টা চারেক সময় অযথাই নষ্ট হলো এই সাজগোজে! আমার সাজ প্রায় শেষ, শাড়ি পরছি ঠিক তখন পার্লারের মেয়েটা বারবার অনুরোধ করে সিফুকেও খানিকটা সাজিয়ে দিলো। বারবার আফসোস করছিলো মেয়েটা, আমার চুলগুলি কেনো সিফুর মত স্ট্রেইট নয়, কিংবা নাকটা কেনো ওর মতন টিকালো নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার অভ্যেস আছে, দিব্যি হজম করে যাচ্ছিলাম সেসব কিন্তু বেঁকে বসলো নিশিতা। কাটা কাটা গলায় মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললো-

-‘এসব জানার জন্যে তো আর আপনাকে এখানে এনে বসিয়ে রাখেনি! কনে সাজাবার কথা, কনে সাজিয়ে দিন! চেনেন না, জানেন না যার-তার সাথে তুলনা করে যাচ্ছেন, আপনি জানেন ও যে একজন ডাক্তার? না শিখেছেন তো কেবল চুল, চোখ, নাক আর গায়ের রঙ নিয়ে গবেষণা করতে…’

-‘আহ নিশি! চুপ কর তো! এসব গা সওয়া হয়ে গেছে আমার!’- টেনে ধরে নিশিতাকে থামালাম। মুখ ভেংচি দিয়ে মেয়েটা সিফুকে সাজাতে লেগে গেলো আবার। নিশিতা সেই ফাঁকে ফটাফট কতগুলো ছবি তুলে নিলো আমার সাথে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সাজগোজের পর বেশ ভালো দেখাচ্ছে আমাকে! এমনকি সিফুও ঘুরে ঘুরে দেখেশুনে টেনে টেনে বললো- ‘নাহ, তোর ফেস কাটিংটা আসলে বেশ ভালই রে রাত্রি! কেবল রংটা ময়লা বলে ওরকম দেখতে লাগে…’

শাড়ি আর ওড়নাটা পরানো হলে কথামতো দিবসকে ভিডিও কল দিলাম। দুয়েক মিনিট কথা বলার পরেই খেয়াল করলাম এখনো গোলগলা একটা টিশার্ট পরে ঘুরছে সে! চেহারাটাও কেমন শুকনো, শুকনো…

-‘তৈরি হননি এখনো? বেরুবেন কখন আপনারা?’- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

-‘উম..ম, রাত্রি একটা সমস্যা হয়ে গেছে! ঠিক কীভাবে কি বলব বুঝতে পারছিনা…’- শুকনো মুখেই উত্তর করলো দিবস।

-‘মানে? কী সমস্যা?’- ঢোঁক গিললাম অজান্তেই। এই শেষ ঘন্টায় এসে আবার কী সমস্যা হলো!

-‘আ… মানে, মিহির ফিরে এসেছে রাত্রি! সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সে আবার ফিরতে চায়… আমি… আমি না করতে পারিনি!’

-‘কিহ!’- তীব্র একটা চিৎকার গলা বেয়ে বেরোয় কেবল আমার।

-‘আমায় মাফ করে দিও রাত্রি। আমি… আমি আসলে…’- দিবস ঠিক কী বলছিলো কিচ্ছু মাথায় ঢোকেনি আমার! ফোনটা হাতেই ধরা ছিলো শক্ত করে, ধপ করে সামনে রাখা চেয়ারটার বসে পরলাম। ভিডিও কলটা লাউডস্পিকারেই ছিলো, ওরাও সবটা শুনেছে তাই। নিশিতা দৌড়ে এসে ধরলো আমায়… এটুকুই মনে আছে। এরপর সম্ভবত জ্ঞান হারাই আমি। মিনিট কয়েক চোখেমুখে পানির ছিটে পেয়ে সম্বিত ফেরে আমার, টলমল করতে করতে পার্লারের লাগোয়া ওয়াশরুমটায় ঢুকি নিজের অজান্তেই। কোনো কিছু ভাবার বা চিন্তা করার মত অবস্থায় ছিলাম না তখন, কেবল যন্ত্রের মত মস্তিষ্কে আঘাত হানা দুর্বল আত্নঘাতি ইচ্ছেগুলি একের পর এক মিটিয়ে যাচ্ছিলাম বোধহয়! একটানে খুলে ফেললাম চোখে লাগানো নকল আইল্যাশজোড়া, টিস্যু ঘষে ঘষে তুলে ফেললাম লিপস্টিক, মাশকারা, আইলাইনার, মুখের মেকাপ- সব! তারপর ঘোর পাওয়া মানুষের মত হাঁটতে হাঁটতে যেয়ে বসলাম নিচে অপেক্ষারত গাড়িটাতে। নিশিতা আর সিফুও ছিলো সাথে। নিশিতা আমায় ধরে ছিলো পুরোটা সময়, আর সিফুর হাতে তখন ফোন। বাড়ির সকলকে খবরটা জানানো হয়ে গেছে এরমধ্যেই ওর।

-‘হ্যাঁ রে সিফু, তারপর কী বললো রে?’- বড়খালামনির উৎসুক কণ্ঠটা ঝনঝন করে বাজে। সিফুকে ঘিরে সকলে মিলে আসর জমিয়েছে বসার ঘরে। আমি দরজা আটকে নিজের ঘরের মেঝেতে বসে আছি চুপচাপ। একটু পর পর ওঘর থেকে একেকজনের উৎসাহী কণ্ঠ কানে আসছে কেবল।

-‘আর কী বলবে, মা! বললাম ই তো, ঐ আগের বউ মিহির না ফিহির..’

-‘আরে কীসের মিহির ফিহির। তিষমা, তিষমা! ঐ টিভির নায়িকা তিষমা তিলোত্তমা বলে মেয়েটা, সে ই তো ছেলের আগের ঘরের বউ গো!’

-‘হ্যাঁ অইতো, ঐ মেয়েই নাকি ফিরে আসবে আবার সেজন্যে আর এই বিয়ে করবেনা সে।’

-‘ওরে আল্লাহ! ও মেয়ে যে সুন্দুরীর সুন্দুরী! সে ফিরলে কি আর আমাদের রাত্রিকে মনে ধরবে গো কারুর?’- গলাটা সম্ভবত মেজমামীর।

একজনের পর একজনের কটুক্তিতে বিষিয়ে যাচ্ছে আশপাশ… যাক! আর কোনো কিচ্ছুতেই কিছু যায় আসে না আমার! যে নাবিক ধ্রুবতারা চিনে নিতে ভুল করে, জীবন সমুদ্রে তার ডুবে মরাই ভালো।

-‘কী শুরু করেছ তোমরা রুমানা? মেয়েটাকে দুদন্ড শান্তি দেবেনা, নাকি? আমার কথা তো আবার এ বাড়ির কারোর পছন্দ হয়না। গ্রাম থেকে উজবুক ধরে এনে এমন যোগ্য মেয়ে পার করতে চেয়েছিলে, তার চেয়ে বিয়ে না করে থাকাও ঢের ভালো! দু’দিন বাদে ভালো প্রস্তাব যখন এলো তখন তো সবাইই খুশি হয়েছিলে, আজ সুযোগ পেতেই বিষ উগলাচ্ছে একেকজন!’- মেজমামীকে উদ্দেশ্য করে বললেও ফাঁকতালে সকলের ওপরেই ঝাল ঝাড়লেন বড়মামী। এই মানুষটাকে কেনো জানিনা মায়েরা কেউ দেখতে পারেনা। খুব সম্ভবত, সবসময় উচিত কথাটি বলেন বলে সকলেই তার ওপরে ক্ষেপা!

বড়মামীর কথা বাতাসে মিলিয়ে যায় বোধহয়। মায়ের বিলাপ মেশানো কথাগুলি কানে আসে এরপর-

-‘পণ্ডিত হইসে, বিদ্বান হইসে! কাউসাররে মনে ধরেনা তার! দূরদেশের রাজকুমার লাগবো রাজকইন্যার! হইলো না এখন? লাগলো তো মুখে চুনকালি?…’

ধমকে উঠে মা’কে থামাতে যান বাবা। অপরদিক থেকে ফুপুর গলা বেজে ওঠে-

-‘বলসিলাম আমি? বলসিলাম? দাঁত থাকতে যারা দাঁতের মর্যাদা দেয়না তাদের এমনই হয়! শুনো সোহেলী, বলি এখনো সময় আছে। দুই গলি পরেই কাউসারের মেস, আমি অনুরোধ করলে হয়ত রাজি হবে। আত্নীয় স্বজন সবার সামনে আর অপমান হইও না। এমনেই দুইবার বরবদল হইয়া গেসে মেয়ের, আরেকবার করলা নাহয়! তাও এই ফাঁকে বিয়াটা করায়া দেও, নাইলে কইলাম আজীবনের জন্যে ঝুইলা যাইবো…’

বোধহয় এই প্রস্তাবটা মনে ধরে মায়ের। আমি তখনো ঠায় বসে আছি একইভাবে। যা হয় হোক, কিচ্ছু যায় আসে না আর!

বড়মামী শেষ চেষ্টা করেন-

-‘আপা, এই ভুল কইরেন না! আপনের এই মেয়ে লাখে একটা! এইভাবে যার তার সাথে …’

-‘তুমি থামো বড়বউ! মায়ের চে’ যার দরদ বেশি সে হইলো ডাইনী, বুঝছো?’- ফুপু খেঁকিয়ে ওঠেন।

বাইরে থেকে চাবি দিয়ে আমার ঘরের দরজার লক খোলে কেউ, আবার লক আটকে দিয়ে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে-

-‘একদম এদের কথা শুনবিনা তুই রাত্রি! তোর বাবা আছেন, ছোটোখালামনি আছেন, আমি আছি- যেন তেন একটা ছেলে ধরে আনলেই হলো নাকি?’- বড়মামী এসেছেন টের পাই। এর আগে কখনও তেমনভাবে কথা হয়নি উনার সাথে আমার, অথচ আজ সর্বশক্তি দিয়ে আমার হয়ে দাঁড়িয়েছেন উনিই!

-‘মামী, আমার আর কিছুতেই কোনো আপত্তি নেই। মা যা চান তাই-ই করুক!’

আমি নিশিতা বলছি, রাত্রির ডায়েরির এই অংশটা আমার লেখা। আসলে এই অংশটা লিখে রাখার লোভ সামলানো গেলোনা, তাই রাত্রির অনুমতি নিয়ে আমিই লিখেছি। যে সময়ের কথা লিখছি, সেসময় কোনোদিকে দেখবার মত অবস্থা রাত্রির ছিলোনা। কাঠপুতুলের মতো মাটির দিকে দৃষ্টি ফেলে চুপচাপ বসে ছিলো কেবল।

-‘দেখুন ফুপ্পি আম্মা, আমি তোহ আপনাকে বলেইছিলাম প্রোপার এড়েঞ্জম্যান্ট হোলে এই বিয়েটাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আপনাদের মিয়েই রাজি ছিলো না বোধহয়, সেজন্যিই সেদিন আমাকে ফোলস কথাবাত্রা বলে বিদেয় করেছিলো…’

-‘এই গেছো বাঁদরটার সাথে আন্টি তোর বিয়ে ঠিক করেছিলো!’- রাত্রির কানে কানে বললাম।

-‘এছাড়া আর কোনো অপশন যখন নেই…’

-‘হুউ! বলেছে!’

-‘দেখ বাবা, আমার অনুরোধ তুই ফেলতে পারবিনা আমি জানি। রাত্রি আমার ভাইয়ের মেয়ে বলে বলছিনা, খুব লক্ষ্ণী মেয়ে আমাদের। হয়তো তোকে কিছু বলেছিলো, বিয়েতে মত ছিলোনা বলে….ওরকম কত কিছুই তো বলে লোকে! এখন আর তুই সেসব কথা ধরে বসে থাকিস না যেনো…’

-‘ফুপ্পিআম্মা, আপ্নাড় কথা তোহ আমি ফেলতে পাড়বোনা, বাট!’- তর্জনী নাচিয়ে একটা ক্লাইম্যাক্স আনবার চেষ্টা করে বাক্যটা শেষ না করেই আধাআধি এসে থেমে গেলো কাউসার।

-‘বাট?’- সাগুফতা চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলো

-‘বাট আমাড় তোহ কিছু ডীম্যাণ্ড ছিলো…’

-‘ওহ! সেসব আমরা ভুলিনি বাবা। আজকে বিয়েটা ভালয় ভালয় মিটে গেলে পরে…’- এবারে কথা বললেন রাত্রির মা। আঙ্কেল মানে রাত্রির বাবা ঘরে দরজা দিয়ে বসে আছেন। এই বিয়েতে কোনোভাবেই মত দেন নি উনি। রাত্রিটা গোঁ ধরে বসে আছে, মায়ের কথামতই আজ বিয়ে করবে সে।

-‘ও-খে! তাহ্লে ইটস ফাইনাল! আমি তো ড়েডী নই, ঘরের পোশাকেই চলে এসেচি…’

-‘ওসব ব্যাপার না বাবা! কবুল বলতে পারবে তো? তাতেই হবে!’- রাত্রির মা এখন এই কথা বলছেন! অথচ আজ সকালেই রাত্রিকে পার্লারে পাঠাবার জন্য কী তোড়জোড়টাই না করলেন, সাজগোজ ছাড়া নাকি বিয়ে সম্পূর্ণই হয়না! হুউউ! দিবস তবে ঠিকই ধরেছিলেন!

কাউসার আলীর চেহারায় একটা আলগা গাম্ভীর্যের ভাব এসেছে। এইযে বাড়িসুদ্ধ সকলে তাকে তোয়াজ করছে- এই বিষয়টা যে সে ভেতরে ভেতরে বেশ enjoy করছে সেটা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। কী একটা নমুনা রে বাবা! একে এরা খুঁজে পেলো কোথায়!

-‘আর আমার আম্মু-আব্বু তো ভিলেইজ-এ আছেন। প্রিস্থিতির চাপে পরে তাদেড়কে ছাড়াই বিয়েটা কড়া… এটা আসলে এক্টূ টাফফ!’- অতিশুদ্ধ ভাষা বলতে যেয়ে যখন যেখানে খুশি র-ফলা আর ‘ড়’ বসিয়ে কীসব জগাখিচুড়ি বলে যাচ্ছে এই লোক সেই কখন থেকে!

বড়মামী আর ছোটোখালা দূরে দাঁড়িয়ে কেবল ফুলছেন। বাকি সবাই এই নন্দদুলালকে তোয়াজ করছে অনবরত। সাগুফতার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটেছে। খানিক আগেই বড়খালার কাছে যেয়ে বলছিলো- ‘এতক্ষণে রাত্রির সমান সমান পাত্র পাওয়া গেলো, বলো মা? ঐ নায়ক দিবস না ফিবস কে নিয়ে তো ভয়েই ছিলাম, সুমনকে ওর পাশে বেমানান লাগতো। এই কাউছারালী মাকাল ফলটার পাশে অন্তত তোমার মেয়েজামাইকেই বেশি কদর দেবে সবাই, কী বলো?’

-‘কচু দেবে! সেই আশাতেই বসে থাকো!’ মনে মনে বললাম আমি। একদম শুরু থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা অন করে রেখেছি, প্রত্যেকের কাজকর্ম ভিডিও করে রাখার দায়িত্বটা যে আমার!

যাইহোক, আমার লেখালেখি প্রায় শেষের দিকে। আপাতত পরিস্থিতি, না না… ‘প্রিস্থিতি’ হচ্ছে এমন- বসার ঘরে গাধাপাত্র বসে আছে উজির-নাজির পরিবেষ্টিত হয়ে, ভারী গম্ভীর মুখভঙ্গি করে। আর রাজকন্যা খিল দিয়েছেন ঘরে যেয়ে। কাঁদছেন না, কেবল পাথর হয়ে বসে আছেন চুপচাপ। আমি রাজকন্যার সখী, ক্যামেরাটা বন্দুকের মতো করে এর-ওর মুখের দিকে তাক করছি।

আর রাজপুত্র?

-‘মাম্মাম! দরোজা খোলো-ও ও!’- একটা আধো আধো চিৎকার, অনেকটা স্বপ্নের মত ঘোর লাগিয়ে দেয় মেয়েটার ভেতর-বাহির সমস্ত সত্তায়।

কে ও?
স্বপ্ন না সত্যি?
কল্পনা নাকি বাস্তব?

দুদ্দাড় করে ছুটে দরজা খুলে দাঁড়ায় মেয়েটা।

বাস্তব! সমস্তটা বাস্তব!

আড়াই বছরের মিষ্টি বাচ্চাটা ঝাঁপিয়ে পরে মেয়েটার কোলে। মেয়েটার পরনে একটা লাল বেনারশী, একেবারে আলুথালু হয়ে গেছে সেটা। চুলের খোঁপাটা কেবল স্থির অবস্থায় আছে, বেশ বসনের বাকি সবকিছুর একেবারে ছন্নছাড়া দশা! ক’গাছি স্বর্ণালঙ্কার আর খোঁপায় আটকে থাকা ওড়নাটাই কেবল মেয়েটার বধূসাজের সাক্ষী হয়ে আছে, সমস্ত চেহারায় আর কোনো সাজগোজের লেশমাত্র নেই। বাচ্চাটাকে কোলে জড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে মেয়েটা, মুখ তুলে দুই গাল আর কপাল চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয় অবিরত।

-‘হোয়াটিজ হ্যাপিনিং হিয়ার? এই মিয়েটা… দিজ গাড়ল- কুত্থেকে এলো এখানে?’- মিষ্টি মেয়ে আর তার ‘মাম্মাম’-এর যুগলবন্দি মিঠে মিঠে দৃশ্যটা মুহুর্তেই জগাখিচুড়ির মত ঘেঁটে যায় একেবারে!

উপস্থিত প্রত্যেকে রীতিমত হাঁ করে তাকিয়ে আছে, যেন চোখের সামনে কোনো সিনেমার শুটিং চলছে! রাজকন্যা আর গাধাকুমারের বিয়ের প্রায় সব আয়োজন যখন ঠিকঠাক, কাজী সাহেব খাতাপত্তর নিয়ে সবে বসেছেন… ঠিক তখনি ‘বর এসেছে, বর এসেছে!’ বলে চিৎকার করে এই সিনেমার শুরু করেছিলো নিশিতা মেয়েটা, নিজেকে রাজকন্যার সখী বলে দাবি করছে যে!

-‘অ্যাই মেয়ে! কী হয়েছে তোমার! ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছো…- ফুপুর মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। সদর দরজা ঠেলে প্রায় ছ’ফুট লম্বা, সুদর্শন রাজপুত্র ঘাড় হেলিয়ে ঘরে ঢোকে। আগাপাশতলা সুন্দরের দেবতা রাজপুত্রের সবচেয়ে সুন্দর যে চোখজোড়া, একটা ফ্রেমলেস চশমায় সেখানা ঢাকা পড়ে আছে!

-‘এ ক্ক কী! তুমি মানে তোমরা! আপনারা… আপনাদের তো আসবার …’- রাজকন্যার মায়ের মুখে কথা সরেনা। কোনোমতে থেমেথেমে এ’কটা শব্দ উচ্চারিত হয় কেবল। ছোট্ট মেয়েটা ততক্ষণে ‘ মাম্মাম! দরোজা খোলো-ও ও’ বলে বলে সুর তুলেছে।

-‘খুব জরুরি একটা কারণে রাত্রিকে মিথ্যে করে ওসব বলেছিলাম আমি। যদি অনুমতি দেন তো দু’মিনিটের জন্যে রাত্রির সাথে কথা বলতে পারি?’- রাজপুত্রের কণ্ঠটা গমগম করে ওঠে।

কে দেবে অনুমতি! সকলে কেবল মূর্তিবৎ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিয়ে শেষমেশ রাজপুত্র নিজেই পায়ে পায়ে এগোয়।

-‘কেবল এটুকু বলবো- আপনি ধ্রুবতারা চিনতে ভুল করেননি রাত্রি! আপনাকে নিজে নিজে দিক চিনে নিতে সক্ষম করবার জন্য সে কেবল মেঘের আড়ালে চলে গেছিলো। সবকিছু খুলে বলবার জন্যে বেশ অনেকটা সময়ের দরকার… এখন সেই পরিস্থিতি নেই। যদি অনুমতি দেন বিয়ের কাজকর্ম শেষ হলে গুনে গুনে সবকিছুর ব্যাখ্যা দেবো।’

কবে কোন রুপকথায় রাজপুত্রকে চিনে নিতে ভুল করেছে রাজকন্যা?
কবে কোন নাবিক ভুল করেছে ধ্রুবতারা চিনতে?
কোন গল্পে গাধাকুমারের কাছে হেরেছে রাজকুমার?
আর, কবে কোন ইতিহাসেই বা মেঘ এসে কেড়ে নিয়েছে নাবিকের আরাধ্য তারাটিকে?

তবু মন খচখচ করছিলো রাজকন্যার। অকারণ ছেলেখেলায় যে রাজপুত্র এক মুহূর্তের জন্যে হলেও তার সঙ্গীনিকে হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি নেয়, এত সহজে, কেবল দু’খানা স্তোতবাক্যে কি তাকে আবার বিশ্বাস করা যায়?

-‘রাত্রি, আমি আগাগোড়া সমস্তটা জানি রে! বিশ্বাস কর, আজকে যা যা হয়েছে সব তোর ভালর জন্যেই! তোর জন্যে দিবস ভাইয়ের মত যোগ্য আর কেউ নাই… অমত করিস না আর, প্লিজ!’- নিশিতার কণ্ঠ আশ্বাস যোগায়।

দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে রাজকন্যা অবশেষে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দেয়।

-‘দিস ইজ ঠূঊ মাছ! দিস ম্যান এন্ড দিস লিটিল গাড়ল… এরা এরা ফ্রত্যেক বারে আইসা বাগড়া দেবে নাকি! হেই ইউ মিস্টাড়… ড়ায়ান! হোয়াটিজ ইউর পবলেম?’- গাধাকুমার অবশ্য সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নয়। অধিকৃত সিংহাসনখানা ছেড়ে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ফট করে মাম্মামের কোল ছেড়ে নেমে আসে বাচ্চা মেয়েটা, দৌড়ে এসে গাধাকুমারের পথ আটকে দিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে সুর করে বলে-

-‘ওকানে যেও-না, ওকানে হাপ আছে!’

গোলমাল শুনে ততক্ষণে রাজকন্যার বাবাও দরজা খুলে বেরিয়েছেন। নিশিতা তার কানে কানে কিছু একটা বলতেই মৃদু হেসে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানান তিনি।

তারপর?

তারপর আর কী?

গাধাকুমারের বিদেয় ঘটে, সঙ্গে তার ‘কিছু ডীম্যাণ্ড’-এরও! সমস্ত রুপকথার গল্পগুলিকে সত্যি করে দিয়ে রাজপুত্র-রাজকন্যার মিলন ঘটে।

আমার কথাটি ফুরোলো,
নটে গাছটি মুড়লো…. ওহ না! আরোও একটু বাকি আছে যে!

(ওয়ার্ড লিমিটের কারণে শেষ পর্ব দুই ভাগে দিতে হচ্ছে।)
https://m.facebook.com/groups/1213611582153087?view=permalink&id

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে