তনুশ্রী পর্ব-১৬

0
1371

#তনুশ্রী
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
#পর্ব_১৬

মইনুল উতলা হয়ে বাইরে দাড়িয়ে। তির্থ বসে আছে। তূর একবার এপাশে আরেকবার ওপাশে হাটাহাটি করছে। চারিদিক থেকে কেমন ঝি ঝি পোকার ডাক। জঙ্গলের এমন অংশে বানানো হয়েছে হাসপাতালটা যেখানে কারো আসা সম্ভব নয়। ইশয়াখ বাঘের ভয় রটিয়েছে! এতে অনেক শিকারী অনাহারে দিন যাবন করছে। চার রমনী মোটা শাল গাছের পিছনে। একটু পরপর তারা উঁকি মারে! সেইযে দরজা বন্ধ হলো খোলার নাম নেই। ভয়ে তাদের হাত পা ঝিমাচ্ছে একপ্রকার। আর এদিকে জুঁই অপেক্ষাকৃত বেশি ভয়ার্ত! একটু আগেই সে সাপ দেখেছে! সবসময় টগর আর চুমকির সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে।

_______________
-ছুড়িতে নোংরা? ছিহ্! ‘
ডাক্তার ছুড়ি পরিষ্কার করতে টেবিলের সামনে যায়। তনু সে সুযোগেরই সৎ ব্যাবহার করে। মুখ থেকে উগলে ফেলে দেয় ঔষধ! পানি সাথে থাকায় ঔষধ গলে গেছে! অনেকটা গলার ভেতরেও গেছে। তনু তবুও সবটা ফেলে দেয় যথাসম্ভব। আস্তে করে কোমরে হাত দিবে তখনি ডাক্তার তনুর দিকে ফেরার জন্য উদ্যত হয়। হাতে থাকা কাদা, যা জঙ্গলে কুড়িয়ে নিয়েছিলো তা কাঁচিতে মাখায়। আবারো শুয়ে পড়ে। ডাক্তার এবার বিরক্ত হয়! এর আগে যতবার অপরেশন করা হয়েছে ততবারই সবকিছু নতুন ও চকচকে ছিলো। স্বরে বিরক্তি,
– ইশয়াখ সরঞ্জামে নোংরা কেন? ‘
উত্তর আসে না বাইরে থেকে। ডাক্তার আবারো সেটি মুছতে যায়। সুযোগের সৎ ব্যাবহার করে তনু। উঠে দাড়িয়ে কোমর থেকে ছুড়ি বের করে। ধারালো ছুড়ি বাল্পের আলোয় চকচক করছে! দেয়ালে কোপ দিলেও যেন তা ভেদ করবে। আস্তে করে পিছনে যায় ডাক্তারের। দেয়ালে আটকানো তোয়ালাতে কাচি মুছছেন ডাক্তার। চোখ বুজে একটু শ্বাস নিয়ে তনু, ডাক্তার হাতে দেয় ছুড়ি বসিয়ে। লম্বা ছুড়ি দেয়ালের সাথে গেঁথে যায়। ডাক্তার চিৎকার দিয়ে ওঠে! হাত বেয়ে ঝড়ে তরতাজা রক্ত! সাদা রঙা মেঝেতে তা টপটপ বৃষ্টির ন্যায় পড়ে। তনু একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে বেঁধে ফেলে ডাক্তারের মুখ! আর সেটা তোয়ালে দিয়ে।

বাইরে সবাই অপরেশন রুমের দরজার দিকে তাকায়। আর কোন শব্দ আসে না। ইশয়াখ হাঁক ছাড়ে কয়েকবার! সারা নেই। হয়তো কাজ করতে গিয়ে ছুড়ি হাতে লেগেছে। আবারো সকলে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়।
আধঘন্টা অপেক্ষার পর দরজায় একটু নড়া দেয় তনু। বুক হাপড়ের মতো ওঠা নামা করছে। দরজা লোহার তৈরি! বাইরে থেকে কেউই তা খুলতে পারবে না। ইশয়াখ দরজার সামনে এসে বলে,
– কাজ শেষ ইকবাল?
তনু এবার জোরে জোরে ধুপধাপ শব্দ করে। ইশয়াখ ভ্রু কুঁচকে দাড়ায়। সকলে দরজার সামনে আসে। চার রমনী একটু সস্তি পায়। পরকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। এবার পালা তাদের। তির্থ ডাক্তারখানা থেকে জঙ্গলের দিকে হাটা ধরে আচমকা! ইশয়াখ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,
– কই যাচ্ছিস?
– প্রস্রাব করতে।
তির্থে সোজা সাল গাছের পেছনের দিকে যায়। চার রমনী প্রস্তুত! চুমকি গোজ থেকে দড়ি খুলে। তির্থ সবে বসেছে! যথার্থ সময় এটিই! পেছন থেকে চারজন মিলে হামলা করে। দুজনে শক্ত করে বাধার চেষ্টা করে। আর চম্পা গলায় ধরে ছুড়ি। প্রানের মায়ায় তির্থ দমে যায়। ততক্ষণে বাধা হয়ে গেছে। তির্থ চাইলেও আর কিছু করতে পারবে না। চম্পা পাও বেধে নেয়। কিন্তু মুখ? তারা এখান থেকে গেলে যে তির্থ চেঁচাবে না তার কোন বিশ্বাস আছে? বাধ্য হয়ে চম্পা নিজের মুখের কাপর খুলে। তির্থ চমকে যায়। তার বিশ্বাস হতেকষ্ট হচ্ছে এগুলো তাদের পরিবারের বউ,চাচিরা। তির্থ রাগে ভ্রু কুঁচকে নেয়। কন্ঠে চাপা রাগ,
– তুই? মা* ছাড় আমায়। নইলে..
উত্তরে হাসে চম্পা। গলায় ছুড়ি ধরে বলে,
– কত কত নিষ্পাপ শিশুদের তোরা কষ্ট দিছিস! কত পথের শিশু মারাও গেছে! অপরেশনের পর পরিমিত খাওয়া,সুরক্ষা না পাওয়ায় কত ছেলে মেয়ে মারা গেছে! তোরাতো খুনি। তোদের অবস্থা কতটা করুন হবে তুই ভাবতেও পারছিস না! ‘
– তুই তুই তুকারি করছিস আমার সাথে? ‘
কথা শেষ হওয়ার আগেই চুড়ি জোরে চেপে ধরে চম্পা। তরল খানিক রক্ত চুইয়ে পড়ে গলা বেয়ে। গলার নিচে তাকাতেই তির্থ ফোস করে ওঠে। জ্বলছে খুব! সাদা অংশ বেড়িয়ে এসেছে গলার। তির্থ খটমটে আওয়াজ তোলে,
– তোকে আমি..ছাড় আমায়! ‘
– শিক্ষা হয়নি? আরও লাগবে?
– ন*র ঝি! একবার খালি মুক্তি পাই…!
চম্পা একটা কথা আর বাড়ায় না। জোরে খিচে মুখ বেধে ফেলে। গলা অসম্ভব অসহ্য ভাবে জ্বলছে তির্থর! চম্পার সখ জাগে ওতে মরিচ দিতে!

ভেতরের আওয়াজ আবারো কমে আসে। ইশয়াখের মাথায় কিছুই ডুকছে না। মইনুল না পেরে চেয়ারে বসে পরেন। তূর ডাকে বারকয়েক! সারা নেই। রমনীরা প্রস্তুত! আস্তে করে দরজার কিঞ্চিৎ খুলে তনু। খুলেই চোখ পড়ে ইশয়াখের দিকে। বাইরে তাকিয়ে! বেড়িয়ে পিছ থেকে ছুড়ি গেঁড়ে দেয়! ইশয়াখের ভাগ্যক্রমে তা তা এক কোনে লাগে। এপিট ওপিট ছুড়ির মাথা দেখা যায়। তনু ছুড়ি টেনে তোলে। মইনুল তূর এসব দেখতেই উঠে দাড়ায়। আর আবির্ভাব ঘটে চারজনের। ছুড়ি হাতে কালো পোষাক পড়ে দাড়িয়ে চারজন! মইনুল শুকনো ডোগ গিলে ভয়ার্ত মুখ নিয়ে তাকায়। তূর চেয়াল খিচে এগিয়ে আসতেই তনু এগোয়। রক্তমাখা ছুড়ি সামনে নিয়ে বলে,
– চুপ থাকেন। বিশি বারাবাড়ি করবেন তো শেষ করতে হাত কাঁপবো না আমার। ‘
মাথায় বাজ পড়ে তূরের! এই কি সেই তেরো বয়সি তার পিচ্চি বউ? এ কেমন রুপ তার? তূর বলে,
– কি বলছো তনু?
– ঠিকিই কই। আজ আমি সগ্গলকে শেষ করবো। আমার মায়ের খুনির সাথে আপনেরাও যে জড়িত তা আমি জানিনে বুঝবার পারছেন? আমি সব জানি! ‘
তূর থতমত খেয়ে যায়। সত্যিইতো মেয়েটার সাথে করা হয়েছে অন্যায়! সেদিন তূর যদি মইনুলের সাথে গিয়ে না বলতো তাহলে তাকে অনাথ হতে হতো না! মইনুল তেড়ে আসে। তনু এক কোপে বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে দেয়। চিটকে দূরে পড়ে মইনুল। তুন এগিয়ে গিয়ে বলে,
– আমার মামীরে এত দিন যে নির্যাতনটা করছেন তার শাস্তি পাইতেই হইবল! ‘
তনু ছুড়ি আকাশোনে তুলে সবে প্রস্তুত হয়েছে মইনুলকে মারতে তখনি পেছন থেকে ডাক,
– থামুন! ‘
তনু বিদ্যুৎ গতিতে তাকায়। অফিসার সহ অনেক হাবিলদার এসেছেন। সকলকে ধরতে নির্দেশ দেয় অফিসার। হাবিলদার ভেতরের ডাক্তার সহ সবাইকে ধরে নেয়৷ জঙ্গলে বাঁধা তির্থকেও! যাওয়ার আগে তূর একবাক্যে তনুকে বলে,
– আমি অপেক্ষা করবো! তুমিও করো। পারবো না তোমায় ছেড়ে থাকতে! ‘
কথাটা বুকে তোলপাড় এনে দেয় তনুর। চেয়ে রয় একদৃষ্টিতে! তার বরংবার মনে হচ্ছে সে পক্ষপাতিত্ত করেছে! সবাইকে চাকুর আঘাত করেছে তনু! অথচ পারেনি তূরকে ছুতে! কেন পারেনি? সেতো সবাইকে ঠকালো! পুলিশ তনুর সামনে এসে বলে,
– ধন্যবাদ আপনাকে। আপনারা সাহসী। চলেন পৌছে দি। ‘
তনু মাথা তুলে তাকায়। বলে,
– আমিও তো চুড়ির আঘাতে ইশয়াখের পেটের কোনা কেটে দিয়েছি! আমার শশুড়ের এক নখ কাটছি। শাস্তি তো আমারো পাওনা তাইনে? ‘
– আত্নরক্ষায় করেছেন! এটাতে সমস্যা নেই। থাকলেও আমি সামাল দিবো। চলেন! ‘
– আপনারা যান। আমরা যেতে পারবো। ‘
অফিসার চলে যায়। তনু ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। গলা ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে! চারজন সহ রিমি পাশে এসে বসে তনুর। আগুন জ্বলছে! দাউদাউ আগুনে তনুর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে! তূরের শেষ কথাটা কাটার মতো ফুটছে অন্তরে! রিমি তনুর মাথায় হাত রাখেন। সকলে গুনগুনিয়ে কাঁদছে! তনু রিমিকে প্রশ্ন করে,
– আফনি কিভাবে জানছেন আমরা এইহানে? আর পুলিশ? ‘
– প্রেত্তেক দিনিই আমি ফজরে উপর তলায় হাটাহাটি করি। আইজও করছি! চুমকির ঘর থেকে করা তোমাগোর সমস্ত পরিল্পনা কানে আসছে আমার। আইচ্ছা তোমরা লক্ষ করছো এইহানে চম্পাও আছে? তোমরা কি চম্পারে সাথে নিছিলা? ‘
সকলে চম্পাকে একপলক দেখে। রিমি আবার বলে,
– এরপর আমি ওকেও সব কয়ে তোমাদের দলে ডোকাই। পুরে পথে নুড়ি পাথর ফেলে চম্পা। বাড়িতে কেউ না থাকায় আমি সোজা পুলিশ ঘরে যাই। তাদের সব কই! তারাও নাকি এই দেশদ্রোহীদের দলটাকে খুজতাছে। অতঃপর…. ‘
তনু আজ নিঃস্ব! মা বাপ আর এখন স্বামী! আলতো করে মাথা রাখে রিমির বুকে তনু।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে