ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-২১+২২

0
2380

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২১
#Arshi_Ayat

দেখতে দেখতে সম্পর্কের দুইমাস অতিবাহিত হলো।ইয়াদ আগের থেকেও বেশি যত্নশীল হয়ে গেলো মধুর প্রতি।আর মধু তার থেকেও এক ধাপ ওপরে।ইতিমধ্যে ইয়াদ ওর বাবা মা কে মধুর কথা জানিয়েছে।ওর বাবা মা আপত্তি করে নি।খুব সুন্দরভাবেই মেনে নিয়েছিলো।তবে টেস্ট পরীক্ষার প্যারায় এই সপ্তাহে একবারো ইয়াদ দেখা করে নি।পরীক্ষার আগের দিন কড়া করে বলে দিয়েছিলো পরীক্ষায় যেনো ৯০% নাম্বার আসে।আর পরীক্ষা চলাকালীন কোনো রকম দেখা করা চলবে না।মধু অবশ্য বলেছিলো একদিন পরপর দেখা করার কথা কিন্তু তার আবদার ইয়াদের শাসনের কাছে ধোপে টিকলো না।

মধু ১.১০ এ কলেজ থেকে বের হলো।পরীক্ষা শেষ ১.০০ টায়।দশমিনিট বান্ধবীদের পরীক্ষার খবর টবর নিয়েই বেরিয়ে পড়লো কলেজ থেকে।এখন হোস্টেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে আবার পড়তে বসতে হবে।কালকেই শেষ পরীক্ষা।আর কালকে বিকেলেই ইয়াদের সাথে দেখা হবে।মধুর যেনো তর সইছে না!তবে কিচ্ছু করার নেই যেহেতু এতোদিন ধৈর্য ধরেছেই আরেকটা দিনও নাহয় ধরবে।
————-
সময়টা ৪.০০টা বেজে ৫৩ মিনিট।অতি মনোযোগে জৈবযৌগের বিক্রিয়া লিখছিলো মধু।হঠাৎ তার মনযোগ পন্ড করে পাশের বেডের শিমলা বলল,’আপু,তোমার পার্সেল এসেছে।দারোয়ান দিয়ে গেলো।’
এটা বলেই শিমলা একটা শপিং ব্যাগ মধুর হাতে ধরিয়ে দিলো।মধু একটু অবাক হলো।ভাবলো ওকে পার্সেল দেওয়ার মতো কে আছে?ইয়াদ দিয়েছে?না ইয়াদ তো যা দেওয়ার সামনাসামনি দেয়।নাকি পরীক্ষার জন্য সামনে না এসে পার্সেলে পাঠিয়েছে!কিন্তু কেনো পাঠাবে?মধু দ্বিধাদ্বন্দে ব্যাগটা খুললো।

এতে একটা মেরুন রঙের শাড়ি,এক জোড়া নুপুর,একজোড়া ঝুমকো,একটা মেহেদী,একডজন রেশমী চুড়ি,একটা গাজরা আর একটা চিঠি আছে।মধু চিঠিটা হাতে নিলো।চিঠিটা খুলতেই দেখলো মার্জিত হাতের লেখায় কিছু লেখা আছে।মধু চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

“”””মধু”””””
‘এগুলো তোমার জন্য।আমি নিজেই দিতাম তবে এখন তোমার পরীক্ষা চলে তাই আর আসলাম না।’

মধু এবার বুঝলো এগুলো ইয়াদ দিয়েছে তাই আনমনেই একটু হাসলো।তারপর ব্যাগটা রেখে আবার পড়ায় মন দিলো।
——————
পরীক্ষা শেষ পাঁচ মিনিট আগে।মধু,আরিয়াসহ সব বান্ধবীরা মিলে প্রশ্ন মিলাচ্ছে।প্রশ্ন মিলানো শেষে আরিয়া আর মধু কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়লো।হাটতে হাটতে আরিয়া বলল,’আজকে ভাইয়া আসবে?’

‘হুম দুইটার সময় আসবে।’

‘তো তাড়াতাড়ি হোস্টেলে যা।রেডি হতেও তো সময় লাগে নাকি!”

‘হুম,যাচ্ছি।আল্লাহ হাফেজ।’
এই বলে মধু হোস্টেলে দিকে চলে গেলো আর আরিয়া নিজের বাসার দিকে।হোস্টেলে ফিরে মধু শাওয়ার নিলো তারপর ফ্যানের নিচে বসে চুল শুকালো।চুল আধো শুঁকানোর পর।চুলে হাতখোপা করে শাড়ি পড়া শুরু করলো।ভাগ্য ভালো মেরুন রঙের একটা ব্লাউজ ছিলো ওর কাছে নাহলে ধার করতে হতো।শাড়ি পড়ে হালকা সাজলো।তারপর চুলে আঁচড়ে খোপা করে তাতে গাজরা বসালো।মোটামুটি রেডিই বলা যায়।আয়নায় নিজেকে একবার দেখে মধু নিচে নামলো।এখনো ইয়াদ আসে নি!গেটের কাছে মধু ইয়াদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

মধুকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি।ইয়াদ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসলো।এসেই মধুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার পর্যবেক্ষণ করে বলল,’যদি বউ সাজো গো আরো সুন্দর লাগবে গো।’

মধুও ইয়াদের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,’বলো,বলো আরো বলো লাগছে মন্দ নয়।জীবনের এই স্বপ্ন ওগো সত্যি যেনো হয়।’

দুজনই দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেললো।তারপর একটু এগিয়ে ইয়াদ একটা রিকশা নিলো।রিকশায় উঠে মধু বলল,’আপনিতো বলেছিলেন আজকে আপনাদের বাসায় নিয়ে যাবেন।তাহলে এখন কোথায় যাচ্ছি?’

‘হ্যাঁ বাসায় তো যাবো।কিন্তু তার আগে আমরা একটু একা থাকবো।একটা সপ্তাহ তোমাকে দেখি নি,জানো আমার চোখে খরা পড়ে গিয়েছিলো।’

মধু খুব খুশী হয়ে হাসি মুখে বলল,’তাই বুঝি?’

‘হ্যাঁ তাই।তোমার কষ্ট হয় নি?’

মধু একটু জ্বালানোর জন্য বলল,’নাহ!একদম না।’

ইয়াদ মধুর শয়তানি বুঝতে পেরে বলল,’ও আচ্ছা তাহলে বাসায়ই চলো।’

এটা বলেই রিকশাওয়ালাকে বলল,’মামা রিকশা ঘুরান তো।’

মধু চট করে বলে উঠলো,’না মামা রিকশা ঘুরাবেন না।সোজা চলে যান।’

এবার ইয়াদ বলল,’ওমা,রিকশা ঘুরাতে বারণ করলে কেনো?বাসায় যাবে না?’

‘হ্যাঁ যাবো তো।তার আগে আপনার ইচ্ছা পূরণ করবো।’

‘আমার কোনো ইচ্ছাই নেই।’অনেকটা অভিমানী সুরে ইয়াদ বলল।

‘কিন্তু আমার আছে।’
এভাবেই দুজনে খুনসুটি করতে করতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এদিক সেদিক টইটই করে ঘুরলো।তারপর ইয়াদের বাসার সামনে এসে মধু অবাক হয়ে বলল,’ওয়াও!আপনাদের বাসাটা অনেক সুন্দর।’

‘হ্যাঁ,গতমাসেই কাজ কম্প্লিট হলো।এইজন্যই মা বলল তোমাকে নিয়ে আসতে।’

মধু ইয়াদের ডানহাত শক্ত করে ধরে বলল,’আমার না খুব লজ্জা লাগছে।’

ইয়াদ হেসে বলল,’স্বাভাবিক,প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়ি আসতে একটু লজ্জা লাগেই।’

‘আচ্ছা চলুন।’

ইয়াদ দরজা নক করলো।দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো।ভেতরে অন্ধকার।লাইট জালানো হয় নি।ইয়াদ হাতড়ে হাতড়ে লাইট সুইচ দিলো কিন্তু লাইট জ্বলে নি।তারমানে কারেন্ট নেই।কিন্তু কেউ তো লাইট ধরাবে নাকি!বাড়িতে কি কেউ নেই।ইয়াদ গলা ছেড়ে ডাক দিলো,’আব্বু,আম্মু’।

কোনো আওয়াজ আসলো না।তারপর ইরিনকে ডাক দিলো এরপরও কোনো আওয়াজ আসলো না।আর এদিকে মধুর রিতীমত ঘাম ছুটছে।মনে হচ্ছে হলিউড মুভির কোনো ভুতুড়ে বাংলোতে ওরা এসেছে।এখনি ভুতুড়ে আত্মাগুলো এসে ওদের ঘাড় মটকে দেবে।মধু ভয়ের চোটে ইয়াদের হাত খামচি দিয়ে ধরলো।ইয়াদও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।পকেট থেকে ফোনটা বের করে যেই ইরিনকে ফোন দিতে যাবে তখনি ঘরের লাইটগুলো জ্বলে উঠলো।আর সাথে সাথেই ইয়াদসহ সবাই চিল্লিয়ে বলে উঠলো,’হ্যাপি বার্থ ডে মধু।’

মধু চমকে গেলো।ইয়াদের বাবা,মা,ইরিন আর ইয়াদ গোল হয়ে মধুর চারপাশে দাড়ালো। ইয়াদের মা মধুকে জড়িয়ে ধরে বলল,’সুখী হও মা।’

মধু ইয়াদের মা বাবাকে সালাম করলো।ওরা ওকে নিয়ে সোফায় বসালো।ইরিন কেক নিয়ে এলো।তারপর কেক কাটা হলো।প্রথমে ইয়াদের বাবা,মা আর ইরিনকে খাইয়ে তারপর ইয়াদকে খাওয়ালো কেক।

মধু ভুলেই গেছিলো আজকে যে ওর জন্মদিন।ও ভেবেছিলো হয়তো অন্য কোনো কারণে ইয়াদ ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে।তবে এখানে এসে মধু যতোটা না সারাপ্রাইজড হয়েছে তার থেকে বেশি খুশী হয়েছে।ছোটবেলা থেকে কখনো মধু জন্মদিন পালন করে নি।পালন তো দূরের কথা বান্ধবীরা ছাড়া কেউ উইশও করে নি।কিন্তু আজকে তো ওরাও করে নি।হয়তো মনে নেই!

কেক খাওয়া শেষে ইয়াদের বাবা বলল,’জানো সব প্ল্যান ইয়াদের ছিলো।এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রতিদিন বলতো তোমার জন্মদিন সারপ্রাইজ দিতে হবে।আমাদের অতিষ্ট করে ফেলেছিলো।’

ওনার কথা শেষ হতে না হতেই ইয়াদের মা বলল,’আজকে যেতে পারবে না।’

মধু বিচলিত হয়ে বলল,’না আন্টি হোস্টেলে ফিরতে হবে।তা নাহলে সমস্যা হতে পারে।’

‘কিচ্ছু হবে না।তুমি আজকে থাকবে মানে থাকবেই।’

ইয়াদের মায়ের জোরের কাছে মধু হেরে গেলো।তাই ফয়সালা হলো আজকে মধু এখানেই থাকবে।
—————–
ইরিন মধুকে ওর ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের ড্রেস দিলো।মধু শাড়ি চেঞ্জ করে ড্রেসটা পরে আবারও বসার ঘরে আসলো।ওখানে ইয়াদ,ইরিন,আর বাবা মা সহ সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলো।আড্ডার মাঝে হঠাৎ বেল বাজায় ইরিন গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো ইফাজ এসেছে।ইফাজ ঘরে এসে মধুকে দেখতে পেয়ে চমকালো।বিষয়ট বুঝে উঠতে পারলো না ইফাজ।

ইফাজকে দেখে ওর মা বলল,’দেখ বাবু তোর ভাই তোর থেকেও ফাস্ট।
তুই এখনো কাউকে পছন্দই করতে পারলি না আর ও পছন্দ করে নিয়েও এসেছে।’
ইয়াদের মায়ের কথায় মধুসহ সবাই হাসলেও ইফাজ হাসলো না। একবার মধুর দিকে তাকাতেই ইফাজের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।তাই আর সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

রাতের খাবার খাওয়ার আগে ইফাজ একবারও রুম থেকে বের হয় নি।আর কেউ বিরক্তও করে নি।হয়তো কাজ আছে এইজন্য!খাবার টেবিলে এসে মধুর মুখোমুখি বসলো তবে ওর দিকে একবারের বেশি তাকালো না।তাকালেই দেখা যায় মধু আর ইয়াদ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।খাওয়ার একপর্যায়ে ভুল করে মধু ইফাজের পায়ের ওপর পা দিতেই ইফাজ সরিয়ে ফেলে।মধু বুঝতে পেরে জিভে কামড়ে দিয়ে ফেললো।তারপর খাওয়া শেষে ইফাজ চলে যাওয়ার আগেই বলল,’সরি ভাইয়া।’

ইফাজ মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।

চলবে…

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২২
#Arshi_Ayat

মধু চুপিচুপি ইরিনের রুম থেকে বের হলো।প্রায় সবাই ঘুমে আছে এখন।ইরিনও ঘুমিয়ে গেছে আর ইয়াদের বাবা মায়ের রুমের দরজা বন্ধ।তবে ভেতরে আলো জ্বলছে।ঘন্টা দেড়েক আগেও সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছিলো।তারপর রাত বাড়ছে বলে সবাই শুতে চলে গেলো।আজকে রাতে ইরিনের সাথেই মধু ঘুমাবে।তাই মধু যখন ইরিনের রুমে আসতে নিলো তখনই ইয়াদ লোক চক্ষুর আড়ালে মধুর হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিলো।পরে ইরিনের ওয়াশরুমে গিয়ে চিরকুট’টা খুলে দেখলো ওতে লেখা আছে

“”সাড়ে বারোটার সময় সবাই ঘুমিয়ে যাবে।তখন তুমি ছাদে চলে এসো।আমি অপেক্ষায় থাকবো।””

মধু চিরকুট’টা মুচড়ে ফেলে দিলো।তারপর রুমে এসে ইরিনের সাথে কিছু সময় বকবক করে শুয়ে পড়লো।কিছুক্ষণের মধ্যে ইরিন ঘুমিয়ে পড়লেও মধু ঘুমালো না।সাড়ে বারোটা বাজতেই সাবধানী পা ফেলে ইরিনের রুম থেকে বেরিয়ে দো’তলার সিড়ির দিকে রওনা দিলো।দো’তলার একটা রুমে ইয়াদ আরেকটায় ইফাজ থাকে।ওদের রুম ক্রস ছাদের সিড়ি ধরে ওপরে উঠতেই দেখলো ছাদের দরজা আধখোলা।বাতাসা দরজাটা মৃদু দুলছে।মধু আস্তে আস্তে উঠে এলো।

আজ আকাশ পরিস্কার।চরাচর ভাসানো জ্যোৎস্না নিয়ে আজকের রাতের আকাশে উদ্ভাসিত হল পূর্ণিমার চাঁদ।চারদিকে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।মধু ধীর পায়ে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসলো।তারপর রেলিঙের দিকে মুখ করে থাকা তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

কিন্তু বিপরীত পাশে ঘোরা মানুষটা যখন মধুর হাত তার গলা থেকে ছাড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকালো তখন মধু চাদের উজ্জ্বল আলোতে দেখলো এ তো ইয়াদ না।চমকে উঠলো মধু।একটু পিছিয়ে গিয়ে অপরাধী ভঙ্গিতে বলল,’সরি ভাইয়া,আমি বুঝতে পারি নি।ভেবেছিলাম ইয়া…’

মধুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ইফাজ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’বুঝতে পেরেছি।ইট’স ওকে।’

মধু সৌজন্যমূলক একটা হাসি দিলো।ও ভেবেছিলো কি না কি ভেবে নেয় ইয়াদের ভাই।যাক উনি বুঝতে পেরেছে এটাই বেশি।মধু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আর নিজের বলদামির জন্য নিজেকে কয়েকদফা গালি দিলো মনে মনে।এরমধ্যেই ইয়াদও চলে এলো।ভাইকে দেখে সহাস্যে বলে উঠলো,’আরে,ভাইয়া তুমি এখনো ঘুমাও নাই?’

ইফাজ হেসে বলল,’না ঘুমিয়ে কি তোর ক্ষতি করে ফেললাম নাকি?’

ইয়াদ এগিয়ে এসে বলল,’আরে না।তুমি চাইলে শুনতে পারো আমাদের প্রেমালাপ।’

ইয়াদের কথা শুনে ইফাজ বলল,’আমি তোর মতো বেহায়া না।’
এটা বলে একবার মধুর দিকে তাকিয়ে যেতে যেতে বলল,’বেশিক্ষণ থাকিস না।’

‘আচ্ছা।’ইয়াদ বলল।ইফাজ নেমে যাওয়ার সময় দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো।ইফাজ যাওয়ার পর ইয়াদ বলল,’সরি,দেরি হয়ে গেলো।আর বইলো না।যেই আসতে নিছিলাম সেই দুই নাম্বারটা ধরছিলো এইজন্যই দেরি হইছে।’

মধু ইয়াদের কথায় হেসে দিলো।তারপর বলল,’আপনার এমনই হবে।দেখা যাবে আমাদের বিয়ের সময় যখন কবুল বলার সময় আসবে তখন আপনি বলবেন “আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে।ঐখান থেকে এসে কবুল বলবো।’

এটা বলেই মধু আবার হাসলো আর ইয়াদ চোখ বাঁকা করে মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,’এমন হলে যতোকিছুই হোক কবুল বলেই ওয়াশরুমে যাবো।’

ইয়াদের কথা শুনে মধুর হাসির বেগ আরো বেড়ে গেলো।হাসতে হাসতেই দেখলো ইয়াদ অভিমান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।মধু অনেক কষ্টে নিজের হাতে চিমটি কেটে নিজের হাসি কন্ট্রোল করলো।তারপর ইয়াদের মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে ইনোসেন্ট চেহারায় ‘সরি’ বলেই আবার হেসে ফেললো।এবার ইয়াদও হাসলো।হাসি থামতেই ইয়াদ জিগ্যেস করলো,’ভাইয়া কিছু বলেছে তোমাকে?’

মধু ভাবছে ইয়াদকে কি বলে দিবে যে ও ভুল করে ইফাজকে জড়িয়ে ধরেছিলো।নাকি বলবে না!না বললে মধুর নিজেরই শান্তি লাগবে না।তার চেয়ে বলে দেওয়াই ভালো।তাই মধু বলল,’জানেন,আমি ছাদে এসে দেখি ইফাজ ভাইয়া রেলিং এর দিকে ঘুরে দাড়িয়ে ছিলো তো আমি ভেবেছিলাম আপনি দাড়িয়ে আছেন।তাই আমি আপনাকে চমকে দেওয়ার জন্য ইফাজ ভাইয়াকে আপনি ভেবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি।যখন ভাইয়া আমার দিকে ফিরলো তখন আমি নিজেই চমকে যাই।ভাইয়া কি না কি ভেবেছেন।আমার কেমন জানি লাগছে।’

ইয়াদ ঝেড়ে ফেলল দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’বাদ দাও তো।এমন ভুল তো কতোই হয়।রিল্যাক্স,ভাইয়া কনজার্ভেটিভ মাইন্ডের না।ও কিছুই মনে করে নি।আর ও আমার ভাই মানে তোমারও ভাই সো ইট’স নর্মাল।’

ইয়াদের কথায় মধু একটু হালকা হলো।তা নাহলে বুকের মধ্যে একটা খচখচানি থেকেই যেতো।
——————-
রুমের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে আছে।যেনো মনে হচ্ছে রুমের ওপর দিয়ে বেশ তীব্র মাত্রার কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে ইফাজ নিজের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো।বলা বাহুল্য রুমের এই অবস্থা সে নিজেই করেছে একটু আগে ছাদের থেকে এসেই।সন্ধ্যা থেকে বহুকষ্টে নিজেকে আটকে রেখেছিলো কিন্তু এখন আর পারছে না।বুকের পাজরে পাজরে ফাটল ধরেছে।ছোটোবেলা থেকেই ইফাজ ইন্ট্রোভার্ট।ইয়াদের মতো সবকিছু এক্সপ্রেস করার ক্ষমতাটা ইফাজের নেই।এইজন্য কম মাসুল দিতে হয় নি ইফাজকে তবুও কখনো ইফাজ নিজেকে নিয়ে অভিযোগ করে নি।নিজেকে অসহ্য লাগে নি।কিন্তু আজ লাগছে।চরমভাবে অসহ্য লাগছে!
হাতের সামনের ফুলদানিটা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সজোরে মারলো।সাথে সাথে আয়নার শত টুকরা হয়ে নিচে ঝরে পড়লো।একটা কাচ ইফাজের পায়ের এসে ঢুকলো।ইফাজ এলোমেলো হওয়া খাটের ওপর বসে পা থেকে কাচটা তুলে নিলো।

তারপর সাবধানী পায়ে বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে কন্ট্রোল করে রুমে এসে সবকিছু ঠিকঠাক করলো।পায়ে ব্যান্ডেজ করে খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো।ইফাজের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠলো।নাহ!এতো সহজেতো হার মানা যায় না।এতো সহজে তার প্রয়সীকে সে কারো সাথে দেখতে পারবে না।ইফাজ ভাবলো কালকে ইয়াদকে ও সব বলবে।আর ইফাজ শিওর ইয়াদ সবকিছু জানলে মধুকে ছেড়ে দিবে।আর মধু ইয়াদকে ভুল বুঝবে।এই সুযোগটা ইফাজ ভালো ভাবেই কাজে লাগাতে পারবে।
————-
ইয়াদ মধুর কাঁধে মাথা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।মধুও নিজের মাথাটা ইয়াদের মাথায় ঠেকিয়ে ইয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করছে।হাঠাৎ নিরবতা ভেঙে মধু বলল,’আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?’

‘করো।’

‘যদি কখনো আপনার পরিবার আর আমার মধ্যে কাউকে বাচাতে হয় আপনি কাকে বাঁচাবেন?’

ইয়াদ মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,’অবশ্যই পরিবারকে।পরিবারকে বাঁচিয়ে,তোমাকে নিয়ে মরে যাবো।’

মধু হেসে ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরলো।জীবনে এমন কাউকেই চেয়েছিলো মধু।এই চারটা মাস ইয়াদ যতোটা সম্ভব মধুকে খুশী রেখেছে।মধুর মাঝেমধ্যেই ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়।সেই সময়টা বাবাও এমন করে হাসাতো,আদর করতো খেলতো।মাঝখানের সময়টা মধুর জন্য বিভীষিকাপূর্ণই বলা যায়।তবে এখন মনে হচ্ছে নাহ!জীবনে আরো অনেকবছর একসাথে দুজনকে বাঁচতে হবে।
——————–
এখন সকাল ৮ টা ৩০ বাজে।সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে।আজকে ইরিন আর ইয়াদের মা মধুর দুইপাশে বসেছে আর ইয়াদ ইরিনের পাশে বসেছে।ইফাজ কালকে রাতের মতো আজও মধুর সামনাসামনি বসেছে।তবে ইচ্ছাকৃত নয় এসে এখানেই জায়গা পেয়েছে তাই বসে পড়েছে।

এদিকে নাস্তা করার মাঝখানেই ইয়াদ ইরিনকে খোঁচাচ্ছে ওর জায়গাটা ইয়াদকে দেওয়ার জন্য।ইরিনও কম ইতড় না।ডাট মেরে বসেছে তো বসেছেই মানে কোনোভাবেই সে এই চেয়ার ছেড়ে উঠবে না ভুমিকম্প হয়ে যাক তবুও না।ইয়াদ কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচির পর কোনো ফয়দা না করতে পেরে মনে মনে ইরিনের মুন্ডুপাত করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
—————
নয়টা বাজতেই ইরিন,মধু,ইয়াদ আর ইফাজ বেরিয়ে পড়লো।ইফাজের হসপিটালে যেতে হবে আর ইয়াদ ইরিন আর মধুকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বেরিয়েছে।যাওয়ার সময় ইফাজ ইয়াদকে ডেকে বলল,’তুই ওদেরকে দিয়ে একটু হসপিটালে আসিস।’

ইয়াদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।আর ইফাজও ওর চেম্বারের দিকে রওনা হলো।

রিকশায় বসে ইফাজ ভাবছে কি বলবে ইয়াদকে।কি কি বললে ইয়াদ সবটা মানবে।আচমকাই নিহা রাস্তার এপাশ থেকে ইফাজকে হাত নাড়লো।ইফাজের মেজাজ খারাপ হলেও রিকশাটা নিহার সামনেই থামালো।নিহা অনুরোধে সুরে বলল,’ইফাজ,একটু লিফট দেবে?দেখো না!একটা রিকশাও পাচ্ছি না।’

ইফাজ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আসলেই আসলেই কোনো খালি রিকশা নেই।অগত্যা ইফাজ চেপে বসে নিহাকে জায়গা করে দিলো।নিহা উঠে বসে ইফাজকে বিনীত কন্ঠে ধন্যবাদ দিলো।ইতিমধ্যে রিকশাও চলতে শুরু করছে।নিহার অফিসের সামনে আসতেই ও রিকশা থেকে নেমে নিজের ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করে ইফাজের হাতে দিয়ে বলল,’আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।আগামী শুক্রবার বিয়ে।আসবে কিন্তু।অপেক্ষায় থাকবো।’

এটা বলেই অফিসের দিকে পা বাড়ালো।ইফাজ কার্ডাটা অবহেলায় নিজের ব্যাগে রেখে দিলো।এই কার্ডটা দেখার একটুও প্রয়োজন মনে করছে না ইফাজ ওর মাথায় তো অন্যকিছু ঘুরছে।
————
ইরিন আর মধুকে কলেজে দিয়ে ইয়াদ ভাইয়ের হসপিটালের দিকে রওনা দিলো।

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে