জোড়া শালিকের সংসার পর্ব-৯+১০

0
2273

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৯

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে নির্ঝর আর খেয়া।বিয়ের সাজে খেয়াকে মানুষ বলে ভ্রম হচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে!

একটু দূরে দাঁড়িয়ে নুহা অবাক হয়ে তাকিয়ে দুজনকে দেখছে।তার দু চোখে রাজ্যের বিস্ময়।

জমিলা খালাও বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তবে তাকে বেশ হাসিখুশিও লাগছে।মনে হচ্ছে, বিয়েটাতে সে বেশ খুশি।বেশ না,অনেক বেশি খুশি।

নির্ঝর এগিয়ে এসে নুহাকে কোলে তুলে নিল।কপালে চুমু খেয়ে খেয়ার পাশে বসাল।খেয়া তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো।

__’আন্টি, তুমি আজ এত সেজেছো কেন?’

__’তোমার পছন্দ হয়েছে আমার সাজ?বলো তাহলে কেমন লাগছে আমায়?’

খেয়া হাত বাড়িয়ে নুহাকে কোলে বসাল।নুহা খেয়ার শাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল,

__’কি সুন্দর লাগছে তোমায়।তুমি এত সুন্দর কেন?’

__’আমার নুহা মাও তো আমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।কি সুন্দর গুলুমুলু।’

__’তুমি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর! ‘

__’না,তুমি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর।’

নুহা ঠোঁট উল্টে বলল,

__’বললাম তো তুমি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর!আচ্ছা, বাবাই তুমি বলো আমি বেশি সুন্দর নাকি আন্টি বেশি সুন্দর?’

নির্ঝর এক পলক খেয়ার দিকে তাকিয়ে নুহার পাশে বসে বলল,

__’অবশ্যই আমার মামণি বেশি সুন্দর।তার সুন্দরের কাছে পৃথিবীর কোনো কিছুর তুলনা হয় না।’

নুহা খুশি হয়ে নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরলো।নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

__’চলো, রুমে যাই।সন্ধ্যা হবে হবে!’

সবাই উঠে দাঁড়ালো।খেয়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমের দিকে পা রাখতেই নির্ঝর পেছন থেকে ডাক দিল।

__’খেয়া?’

খেয়া পেছন ঘুরে তাকাল।

__’জ্বি!বলুন!’

__’একটু আমার রুমে আসো।কথা আছে।তুমি বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলে না নুহার মা কে?সেটা নিয়ে! সব বলবো আজ।’

খেয়ার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।চকিতেই তার নির্ঝরের রুমের বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ছবিটার কথা মনে পড়লো।

অনেকটা অগোছালো ভাবে সে নির্ঝরের রুমের দিকে পা বাড়াল।

তিনজন বেলকনিতে রাখা টি টেবিলে বসলো।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জমিলা খালা দুকাপ চা রেখে গেল।নুহা বারণ করা স্বত্তেও চা খাওয়ার বায়না ধরলো।খেয়া তাকে পিরিচে ঠেলে একটু চা দিল।

নুহা চা খাওয়া শেষ করে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,

__’বাবাই,আন্টি এত সেজেছে কেন?’

নির্ঝর নিজের কাপে এক চুমুক দিয়ে বড় করে দম নিল।তারপর নুহার দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

__’নুহা তুমি না আগে বলতে আমার মা কই?আমার মা কই?আমি তোমাকে বলতাম, তোমার মা হারিয়ে গেছে।বাচ্চারা মেলায় যেমন হারিয়ে যায় অনেকটা সেরকম।আজ তোমার মাকে নিয়ে আসলাম।নতুন করে তোমার কাছে নিয়ে আসলাম।তোমার খেয়া আন্টিই তোমার মা।আজ থেকে তাকে আন্টি বলে ডাকবে না। মা বলে ডাকবে।কি ডাকবে না?’

নুহা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।সে বলল,

__’আন্টি আমার মা হবে কি করে?’

নির্ঝর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,

__’তোমার মায়ের যে ছবিটা তোমার কাছে ছিল, ওটা নিয়ে আসো তো মা।দেখো, তোমার খেয়া আন্টির সাথে মিলে কি না?’

নুহা এক দৌঁড়ে বেলকনি থেকে বের হলো। খেয়া ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আছে।কিসের ছবির কথা বলছে?সেদিন নির্ঝরের রুমে বইয়ের আড়ালে যে ছবিটা দেখেছিল সেটা?

কিন্তু সেটা তো তার ছবি।সে নুহার মা হবে কি করে?তার কপাল দিয়ে চিকন ঘাম বের হতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে নুহা দুহাতে ধরে একটা বাঁধানো ছবি নিয়ে এসে দাঁড়াল।সে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।অতঃপর খেয়ার দিকে তাকাল।

তারপর এক দৌঁড়ে খেয়ার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।খেয়া তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো ঠিকই, কিন্তু তার চোখে মুখে হাজারো প্রশ্ন ফুটে উঠেছে।

সে নুহাকে জড়িয়েই নির্ঝরের দিকে তাকাল।নির্ঝর তাকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল।আশ্যস্ত করলো পরে তাকে সব বুঝাবে।

নুহা হঠাৎ কান্না করে বলল,

__’মা!সত্যি তুমি আমার মা?কিন্তু এতদিন বললে না কেন?জানো,তোমার কথা কত মনে পড়েছে?তোমার কথা মনে পড়লেই তোমার ছবি দেখতাম।’

নুহা আরো অনেক কিছু বলছে।কিন্তু কিছুই খেয়ার কানে যাচ্ছে না।সে চোখ বন্ধ করলো।নুহার মুখে মা ডাকটা তার মধুর মতো লাগছে।কি যে ভালো লাগছে!নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।

একটুপর চোখ খুলে নুহার হাতে ধরা ছবিটার দিকে তাকাল।সে চমকে উঠলো।সত্যি ছবিটাতে সে।তার ষোলো-সতেরো বছর বয়সের ছবি।

এই ছবিটা নির্ঝরের আলমারিতে রাখা সেই ছবি নয়।এটা অন্য ছবি।দুটো ছবিতেই সে!

তবে তার চেহারায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।সেজন্য নুহা এত কাছে থেকেও বুঝতে পারেনি ছবিটার মানুষ সে!

ছবিটার মানুষ সে!কথাটা উচ্চারণ করতেই সে চিন্তিত হয়ে পড়লো। ছবিটার মানুষ সে কি করে হবে?অসম্ভব!সে কি করে নুহার বায়োলজিক্যাল মাদার হবে?

|১৩|

নিজের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে খেয়া নির্ঝরের রুমের দরজায় টোকা দিল।নির্ঝর নুহাকে যেভাবে বুঝিয়েছে তাতে তাকে আজ থেকে নির্ঝরের রুমে এবং নির্ঝরের সাথে ঘুমাতে হবে।নইলে নুহা নানা প্রশ্ন করবে।

নির্ঝর রুমের ভেতর থেকে বলল,

__’ভেতরে আসো।পারমিশন নেয়ার প্রয়োজন নেই।আজ থেকে রুমটা তোমারও।’

খেয়া উত্তর দিল না।অন্যমনষ্ক ভাবে রুমে প্রবেশ করলো।তার গায়ে গোলাপি শাড়ি।রাতের বেলা বেশিরভাগ সময় সে শাড়ি পড়ে না।ঘুমাতে সমস্যা হয় বলে।তবে সে আজ ইচ্ছে করে শাড়ি পড়েছে!কেন, জানা নেই।

তার কাছে অনেক কেন’রই উত্তর অজানা।

__’সোফায় বসো।’

খেয়া দ্বিরুক্তি না করে বসে পড়লো।নির্ঝর এক পলক খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়ার শাড়ির রঙ আর তার রুমের দেয়ালের রঙ মিশে গেছে।

নুহা তার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে।নির্ঝর বালিশের পাশ থেকে মোবাইল অন করলো।রাত এগারোটা বাজে প্রায়।

সে নুহার গায়ে ভালো মতো কম্বল পেঁচিয়ে সরে আসলো।খেয়াকে বলল,

__’আসো বেলকনিতে বসি।’

বেলকনির ডানপাশে দেয়ালের সুইচে চাপ দিল নির্ঝর।সঙ্গে সঙ্গে সবুজ রঙের বেশ কিছু বাতি জ্বলে পুরো বেলকনি আলোকিত করলো।

খেয়া টি টেবিলের উপর উপুড় করে রাখা দুটো বাঁধানো ছবি দেখতে পেল।সে চেয়ার টেনে বসে ছবি দুটো হাতে নিল।

সে অবাক হলো না দেখে।কারণ সে জানে ছবি দুটোর মানুষ সে নিজেই।

ততক্ষণে নির্ঝর তার সম্মুখের চেয়ার টেনে বসে পড়েছে।সে দুহাতে হাতের তালু ঘষে বলল,

__’ছবি দুটো ভালো করে লক্ষ্য করো।কোনো তফাৎ খুঁজে পেলে?’

(চলবে)

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১০

__’ছবি দুটো ভালো করে লক্ষ্য করো।কোনো তফাৎ খুঁজে পেলে?’

নির্ঝরের প্রশ্নে খেয়া মাথা তুলে তার দিকে তাকাল একবার।তারপর মাথা নেড়ে বলল,

__’না!’

নির্ঝর এবার টেবিলের নিচ থেকে অন্য একটা বাঁধানো ছবি বের করে বলল,

__’ওই দুটোর সাথে এটা মেলাও তো।কোন বৈসাদৃশ্য বা অমিল চোখে পড়ে?’

খেয়া নতুন ছবিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠল।এটা তার কয়েক মাস আগের ছবি।জাহিদের সাথে বিচ্ছেদের পর পার্কে বসে যখন কান্না করছিল তখনকার ছবি।তার পরণে তখন সবুজ শাড়ি ছিল।

সে ঝটপট বলল,

__’আমার ছবি কখন তুলেছিলেন?’.

__’আপাতত সে প্রশ্ন রাখো।ছবি তিনটি ভালো মতো লক্ষ্য করো।তোমার কি মনে হয় তিনটি ছবির মানুষ এক?নাকি ভিন্ন?’

__’ভিন্ন হবে কি করে?তিনটা ছবিতেই তো আমি হওয়ার কথা।’

__’আমি যদি বলি তিনটি ছবির মানুষ এক নয়।তারা দুজন।তুমি কি বিশ্বাস করবে?’

খেয়া অস্ফুট একটা শব্দ করলো।এটা কি করে সম্ভব?দুজন বলতে নির্ঝর কি বুঝাতে চাইছে?তার জমজ বোন টাইপ কিছু?তার জমজ বোন আছে?

খেয়ার শরীর কাঁপছে রিতীমতো।নির্ঝর খেয়ার টেবিলে রাখা অনবরত কাঁপা হাতটার উপর নিজের ডান হাত রাখলো।খেয়া হাত সরিয়ে নিল না।উল্টো নির্ঝরের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।

নির্ঝর শান্ত গলায় বললো,

__’ভয় পাওয়ার বা চমকে উঠার মতো কিছু নেই।সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে নেবে।তোমাকে সব বলছি।কিন্তু তোমাকে কিন্তু আমার প্রতিটা কথা বিলিভ করতে হবে।কারণ আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।’

খেয়া উত্তর দিল না।নির্ঝর আবার বলল,

__’এখানে তিনটে ছবিতে দুজন আলাদা মানুষ রয়েছে।তারা এতটাই আলাদা যে , যে কেউ চট করে তাদের আলাদা করতে পারবে না।একমাত্র যারা তাদের অতি কাছে থাকবে বা তাদের সাথে সময় কাটিয়েছে তারা শুধু বুঝতে পারবে। তোমার সামনে সবুজ শাড়ি পরিহিতা বাইশ বছরের তরুনীটি তুমি।মিসেস খেয়া জুবায়ের।আর কিশোরী বয়সের ছবি দুটি তুমি নও।ওটা পুষ্প।টোটালি অন্য একজন মানুষ।’

খেয়া বিস্ফারিত নয়নে কোনো রকমে বলল,

__’অসম্ভব!হতেই পারে না।’

নির্ঝর একটু থেমে বলল,

__’হতেই পারে না বলতে অলরেডি হয়েছে এবং জলজ্যান্ত আমি তার চাক্ষুষ প্রমাণ।নিজের চোখের সামনে এটা ঘটেছে।সত্যি বলতে পৃথিবীতে অসম্ভব বলতে কিছু নেই।

আমাদের চারপাশে অস্বাভাবিক কিছু, অবিশ্বাস্য কিছু ঘটলে সেটাকে বলে প্যারাসাইকোলজি।প্যারাসাইকোলজিক্যাল ঘটনা আমাদের চারপাশে বহু ঘটে।কিন্তু এটা এতটাই এবনরমাল যে কাউকে বলে বিশ্বাস করানো যায় না।সেজন্য সবাই চেপে যায়।

তুমি, আমি সবাই জানি যে মাইল, মাইল দূরে বা কয়েক যোজন দূরে কারো সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল কোনো ডিভাইস।কিন্তু তুমি এটা বিশ্বাস করো, দুজন মানুষ যোজন যোজন দূরে থেকেও একজন আরেক জনের মনের কথা বুঝতে পারছে এবং তারা মনে মনে সর্বদা যোগাযোগ করছে?হয়তো বিশ্বাস করবে না।বিশ্বাস না করারই কথা।

কিন্তু এসব ঘটছে।তবে ঘটার পরিমাণ এতটাই রেয়ার যে কেউ জানতে পারে না।কিন্তু এসব প্যারাসাইকোলজির ব্যাখ্যা বিজ্ঞান আজও দিতে পারেনি।

তুমি হয়তো শুনে থাকবে যে বিজ্ঞানের একটা গবেষণা থেকে অনেকটা প্রমাণিত যে পৃথিবীতে একই চেহারার ৬ জন মানুষ আছে এবং শতকরা ৯ ভাগ পসিবলিটি আছে একজন আরেকজনের সাথে দেখা হওয়ার।

তুমি আর পুষ্প আমার দেখা এমন প্যারাসাইতোলজির অংশীদার।কিন্তু আফসোস!তুমি আর পুষ্প একে অপরকে দেখতে পারলে না।আর ভবিষ্যতেও পারবে না।’

নির্ঝর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।খেয়ার চোখ ভরে উঠেছে।তার খু্ব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেন পুষ্পকে দেখতে পারবে না?পুষ্পর সাথে কি তার কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারবে না?

কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না।

নির্ঝর নিজেই কয়েক মিনিট পর বলল,

__’তুমি হয়তো ভাবছো পুষ্প কে?পুষ্প আমার খালাতো বোন।তার চেয়ে বড় পরিচয় সে নুহার মা!’

খেয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না।সে জিজ্ঞেস করে ফেলল,

__’তাহলে পুষ্প আপনার প্রথম স্ত্রী?আপনিই নুহার বায়োলজিক্যাল ফাদার?’

__’না! আমি নুহার বায়োলজিক্যাল ফাদার না।সত্যি বলতে তুমি বাদে আজ পর্যন্ত আমি অন্য কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি।তবে তোমার আগে কোনো ভাবে পুষ্প আমার মনে ছিল।তুমি কি এটা শুনে মন খারাপ করছো?’

__’না!’

খেয়া মুখে না বলল ঠিকই। কিন্তু তার তার বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো।কোথায় যেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে যে নির্ঝরের মনে অন্য কেউ ছিল।হোক না সেটা ক্ষণিকের জন্য!

নির্ঝর খেয়ার হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় এনে বলল,

__’তোমাকে শুরু থেকে সব বলছি।পুষ্প আমার বড় এবং একমাত্র খালার মেয়ে ছিল।ও আমার সমবয়সী ছিল।সমবয়সী বললে ভুল হবে।আমার তিন মাসের বড় ছিল।কিন্তু ছোটবেলা থেকে একত্রে বড় হওয়ার দরুন আমাদের মাঝে তুই তুকারি সম্পর্ক ছিল।

আমার যখন এগারো বছর বয়স তখন পুষ্পদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হয়।পুষ্পর জন্মদিন ছিল।জন্মদিন শেষে পুষ্প বায়না ধরে সবাই মিলে ঘুরতে যাবে।বড় একটা বাস ভাড়া করে ঘুরতে যাওয়ার পথেই এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হয়।ভাগ্যক্রমে শুধু আমি আর পুষ্প বেঁচে যাই।আমার বাবা অসুস্থতার জন্য সেদিন ঘুরতে গিয়েছিল না বলে তিনিও বেঁচে যান।এই তিনজন বাদে গাড়িতে থাকা ড্রাইভার সহ ২১ জনের মৃত্যু হয়।’

নির্ঝরের গলা ধরে আসে।খেয়া ঝরঝর করে কেঁদে দেয়।

ফের নির্ঝর বলে,

__’তারপর থেকে আমি আর পুষ্প এক বাসায় বড় হই।বাবা আমাদের দেখাশোনা করতো।কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বাবা পুষ্পকে একদম পছন্দ করতো না।হয়তো এক্সিডেন্টটার জন্য বাবা পুষ্পকে দায়ী করেছে।

পুষ্প ছোটবেলা থেকে অনেক রুড ছিল।তোমার থেকে টোটালি আলাদা এক চরিত্র।সে কথায় কথায় নাক টেনে কান্না করতো না।তার মধ্যে কোনো ইমোশন ছিল না।সহজে হাসতো না।

কিন্তু সেই পুষ্প কলেজে উঠে কার যেন প্রেমে পড়লো।গোপনে তারা বিয়েও করে ফেলল।আমি বা আমার বাবা তার কিছুই জানতাম না।পুষ্পর স্বামীকে আমি কখনো দেখিনি।পুষ্পর স্বামী আর্মিতে ছিল।ছেলেটা নাকি তাকে খুব ভালোবাসতো।

তাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায় যখন নুহা পুষ্পর পেটে আসে তখন তার স্বামী ফরেনের একটা অ্যাকশনে গিয়ে টেরোরিস্টের গুলিতে নিহত হয়।তার লাশ পরে বাংলাদেশে এনে সমাধি করা হয়।

পরে পুষ্পর প্রেগনেন্সির কথা যখন আমরা জানতে পারি তখন বাবা অনেক রাগারাগি করে।পুষ্প এক পর্যায়ে সব বলে দেয়।

নুহার কথা ভেবে পুষ্প বেঁচে ছিল হয়তো।নয়তো তার স্বামীর মৃত্যুর পরে নিজেকে শেষ করে দিতো।ওই সময়টাতে একজন বন্ধু হিসেবে তাকে অনেক সাপোর্ট করি।

নুহার জন্মের সময় গ্রাম থেকে তাকে ঢাকা নিয়ে আসি।কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না।অতিরিক্ত ব্লিডিং এর কারণে পুষ্প মারা যায়।

নুহার জন্মের ঘন্টা খানেক পর পুষ্পর জ্ঞান ফেরে।তখন সে সব কথা আমায় বলে।নুহার দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে নিজে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নেয়।

সেদিন থেকে নুহা আমার সন্তান হয়ে যায়।সে নুহা থেকে হয় নুহা জুবায়ের।তবে নুহার জন্মের পর তাকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম।বাবা নুহাকে দেখতে রাজি হয়নি।নিজের রিটায়ার্ডের টাকা দিয়ে ঢাকাতে আমার নিজস্ব কোম্পানি দাঁড় করিয়ে দেয়।তারপর থেকে নুহা আর আমি একটা সংসার হয়ে আছি।

কিছু কথা।তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছো ছোটবেলা থেকে পুষ্প আমার ক্রাশ ছিল।তার উপর এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করতো।কিন্তু তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারলাম সেটা স্রেফ ভালোলাগা ছিল।পুষ্পকে কখনো ভালোবাসতে পারিনি।তাহলে নতুন করে তোমার মায়ায় জড়াতাম না।

আমি কিন্তু পুষ্পর রিপ্লেসেবল হিসেবে তোমাকে দেখি না বা তুমি হুবহু পুষ্পের মতো দেখতে বলে তোমাকে ভালোবাসি তেমন না।তুমি তুমিই বলে তোমাকে ভালোবাসি।

পুষ্পকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি।কিন্তু সেদিন শীতের সকালে তোমার কান্নারত মুখ দেখে নিজের অজান্তে তোমার মাঝে হারিয়ে যাই।তোমাকে দেখে এমন এক অনুভূতির জন্ম হয় যা পুষ্পকে দেখে কোনোদিন হয়নি।তোমাকে দেখে কিন্তু আমার এটা মনে হয়নি তুমি পুষ্প।আমি জানতাম তুমি অন্য কেউ এবং এই অন্য কেউ এর মাঝে না জেনেই হারিয়ে গেলাম।একদম বিলীন হয়ে গেলাম।’

নির্ঝর দম নিল।একটু ঠিক হয়ে বলল,

__’পুষ্প আর তুমি জমজ হওয়ার কোনো চান্স নেই।কারণ পুষ্প আমার সমবয়সী ছিল।কিন্তু তুমি আমার চেয়ে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট।

একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম এক্সো ফেরারি নামের একটা লোক ১৯৪৪ সালে মারা যান।ঠিক ১৯৪৪ সালেই হবুহু তার মতো দেখতে,তার কার্বন কপি ফুটবলার মেসোট ওয়াজিদ জন্ম নেন।দুজনের মাঝে কোনো তফাৎ ছিল না।হুবহু এক দেখতে।

এরপরও কনফিউজড থাকলে ছবি দুটো ভালো করে লক্ষ্য করো।প্রথম ছবিটায় পুষ্পের কানে তার মায়ের শেষ স্মৃতি চিহ্ন স্বর্ণের ভারী কানের দুল পরিহিত।তোমার নিশ্চয়ই এমন কানের দুল কোনোদিন ছিল না।তারপর দুটো ছবির ড্রেস গুলো লক্ষ্য করো।ব্যাপক চেঞ্জ।দেন, সবচেয়ে বড় এবং প্রধান ডিফারেন্স হলো পুষ্পর ঠোঁটের নিচে তিল ছিল।কিন্তু তোমার ডান গালে তিল।আরো বিস্তারিত বলবো?’

খেয়া মাথা নেড়ে না জানাল।তার কেমন কেমন যেন লাগছে।সবকিছু গোছালো জিনিসও কেমন অগোছালো লাগছে।সে টেবিলে মাথা রেখে বলল,

__’আমি ঘুমাব।মাথায় কেউ হাতুড়ি পেটা করছে।’

__’বেশি চাপ নিয়ো না।রুমে গিয়ে নুহার পাশে শুয়ে পড়ো।আমি পাশের রুমে বা সোফায় ঘুমাব।’

খেয়া কোনো কথা বলল না।সোজা গিয়ে নুহার পাশে শুয়ে পড়লো।চকিতেই তার মনে পড়লো আজ তার নির্ঝরের সাথে বিয়ে হয়েছে।সে নির্ঝরের বিয়ে করা বউ!

সে কি নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করবে?নতুন করে আশায় বুক বাঁধবে?নতুন করে কাউকে নিজের মরা বাগানের ফুল বানাবে?একদম চিরজীবী ফুল?

বড্ড ভয় হয় যে!

খেয়া নুহার কপালে চুমু দিয়ে তাকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।আপাতত তার মাথা হ্যাং হয়ে গেছে।

নির্ঝর বেলকনির বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি মেললো।তার মন ফুরফুরে।মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বড় একটা ভার নেমে গেছে।সে পুষ্পর কথা বহু বার খেয়াকে বলতে চেয়েছে৷ কিন্তু কখনো পার্ফেক্ট সময় বা সুযোগ কোনোটাই হয়ে উঠেনি।আজ সে বলে দিয়েছে।সব!সবকিছু!

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে