জোড়া শালিকের সংসার পর্ব-১৭

0
2015

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৭

২৩.

__’আজ অফিস যাবেন?’

নির্ঝর সোফায় বসে ফাইল চেক করছিল।সে চোখ তুলে খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়া বেড গুছিয়ে রাখছে।

আবার চোখ নামিয়ে ফাইল ঠিক করতে করতে বলল,

__’হুঁ!অনেক দিন হলো যাই না।আজ কনফার্ম যেতে হবে।’

খেয়া বেডে বসে বলল,

__’মাত্র দুদিন আগে সেলাই খোলা হয়েছে।একটু সাবধানে থাকবেন।’

__’ভাবছি তোমায় অফিসে নিয়ে যাবো।কোনো প্রয়োজন হলে বা হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ি যদি?যাবে?’

খেয়া চিন্তিত হয়ে পড়লো।নির্ঝরের সাথে গেলে নির্ঝরের খেয়াল রাখতে পারতো।কিন্তু তাকে আজ মিতুর কলেজে যেতে হবে।গতকাল মিতুকে সে নতুন ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।আজ প্রথম ক্লাস।মিতু তো ভয় পাবে একা যেতে!বাচ্চা মেয়ে!

সে চিন্তিত গলায় বললো,

__’আজ তো মিতুর কলেজে প্রথম দিন।ওকে নিয়ে যেতে হবে।আপনি বরং একাই যান।কোনো সমস্যা হলে ফোন করবেন।’

নির্ঝরের মিতুর কথা মনে পড়লো।জমিলা খালার ছোট মেয়ে মিতু।পিচ্চি মেয়ে।কয়েক দিন হলো এ বাসায় এসেছে।ড্রয়িং রুমে একবার দেখেছে সে।

সে নিজেই অবশ্য খেয়াকে বলে তাকে কাছাকাছি এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।বাচ্চা মানুষ।পড়তে থাকুক।

নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,

__’তুমি তাহলে আজ মিতুকে সাথে করে কলেজে দিয়ে আসো।কাল আমার সাথে অফিসে যাবে।’

খেয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল।নির্ঝর ওয়াশরুমে ঢুকতে নিতে আবার ঘুরে দাঁড়াল।খেয়া অবাক হয়ে বলল,

__’কিছু বলবেন?’

__’ইয়ে মানে……. ‘

__’কি?’

নির্ঝর কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো।তারপর এগিয়ে এসে খেয়ার সামনে দাঁড়ালো।খেয়া পেছন দিকে একটু হেলে বলল,

__’ক-কি হলো আপনার আবার?কিছু বলবেন?’

নির্ঝর ঝপাৎ করে নিচু হয়ে খেয়ার বাম গালে চুমু দিল।খেয়া বিস্ফারিত নয়নে তার দিকে তাকাল।কিন্তু সে খেয়ার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো!

খেয়া কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় বেডে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।স্বাভাবিক হতেই রুম থেকে বের হলো।

মিতু নিচের তলায় ড্রয়িং রুমের সাথে যে গেস্ট রুম আছে সেখানে থাকে।খেয়া তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

__’মিতু রেডি হয়েছো তুমি?’

খেয়ার কন্ঠ কানে যেতেই এক লাফে দরজা সরিয়ে এক কিশোরী মেয়ে এসে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল।নিঃসন্দেহে সুন্দরী একটা মেয়ে।কি সুন্দর চোখ দুটো!তবে মেয়েটার চোখ দুটো মায়াবী হলেও মুখে সবসময় এক ধরনের কাঠিন্যতা।

খেয়া মনে মনে ভাবলো,এই কাঠিন্যটুকু না থাকলে মিতুকে বেমানান লাগতো।এই কাঠিন্যের জন্যই তাকে আরো অপরূপ লাগে।

__’মিতু,কেমন আছো?’

মিতু নামের মেয়েটা টানা টানা চোখে চেয়ে বলল,

__’ভালো,আপা!’

__’রেডি হয়েছো?’

__’জ্বি।’

__’ব্যাগ গুছাও।আমি শাড়ি বদলে আসছি।’

মিতু মাথা নাড়লো।খেয়া তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল।মিতু ছোটবেলা থেকে গ্রামে বড় হলেও তার কথাবার্তা একদম শুদ্ধ।গ্রাম্য টান নেই!

মিতুকে দেখলেই তার কিশোরী বয়সের কথা মনে পড়ে যায়।যদিও সে সময়টা সুখকর ছিল না।তবুও ভাবতে ভালো লাগে।কারণ স্মৃতি সবসময় সুন্দর হয়।

পরমুহূর্তে মনে হলো সত্যিই কি সব স্মৃতি সুন্দর হয়?বেদনার হয় না?জাহিদের সাথে কাটানো সময় গুলো কোন স্মৃতির মাঝে পড়ে?সুখের নাকি বেদনার?

সে চুপচাপ সিঁড়িতে পা রেখে উপরে উঠে গেল।

রুমে যেতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে মানুষটাই এমন।এই হাসি,এই কান্না।খুব দ্রুত মন খারাপ হয়,আবার দ্রুত মন ভালো হয়ে যায়।

বড় করে শ্বাস নিয়ে ওয়ারড্রব থেকে মেরুন রঙের শাড়ি বের করে ওয়াশরুমের দরজার উপর হাত রাখলো।

দরজা ভেতর থেকে লক করা।নির্ঝর এখনো বের হয়নি।হয়তো শাওয়ার নিচ্ছে।সে নির্ঝরকে ডাকতে নিয়ে লজ্জা পেয়ে সরে আসলো।তখন ঘড়ির দিকে নজর পড়লো।সময় নেই একদম!

সে লজ্জার মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে একটু জোরে বলল,

__’আপনার আর কতক্ষণ লাগবে?’

নির্ঝর ভেতর থেকে জবাব দিল,

__’কেন?আমাকে মিস করছো?’

__’জ্বি।আমি চেঞ্জ করবো।’

__’কি চেঞ্জ করবে?’

খেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,

__’আপনাকে!’

নির্ঝর হো হো করে হেসে উঠলো।

খেয়া আরেক বার ঘড়ির দিকে তাকাল।সময় বয়ে যাচ্ছে।লেট হয়ে যাবে তো!

সে ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে রুমেই শাড়ি চেঞ্জ করলো।

২৩.

মিতুর আজ কলেজে প্রথম দিন।সে আড়ষ্ট হয়ে টিফিন পিরিয়ডের আগের প্রতিটি ক্লাস করলো।তার বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক।এই বুঝি কোনো টিচার পড়া ধরলো বলে!

টিফিনের ঘন্টা পড়তেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।সে ব্যাগ রেখে রুম থেকে বের হলো।

একাকী পুরো কলেজে হাঁটলো সে।সে মানুষটা বন্ধু বানাতে পারে না একদমই।এই যে টিফিনের আগের ক্লাসগুলো করার সময় তার পাশে বসা মেয়েটির নাম পর্যন্ত সে জানে না।মেয়েটি শুধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,

__’তুমি কি নতুন?’

__’জ্বি!’

__’নাম কি তোমার?’

__’মিতু!’

ব্যস!এইটুকুই।তারও উচিত ছিল অন্তত মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করা।কিন্তু সে করেনি!সামান্য ভদ্রতাটুকু বজায় রাখারও ক্ষমতা তার নেই।

সে মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে পুরো কলেজটা একবার চোখ বুলালো।অনেক বড় কলেজ!অনার্স লেভেলের স্টুডেন্ট পর্যন্ত!

সব ছেলে মেয়ে গ্রুপ গ্রুপ।একমাত্র সেই হয়তো একা।হাতঘড়ির দিকে তাকাল সে।৩৫ মিনিট টিফিন টাইমের মাত্র ৬ মিনিট পেরিয়ে গেছে।

সে হেঁটে মাঠের দক্ষিণের দিকের বটগাছটার নিচে বসলো।বসার জায়গাটা ইট,সিমেন্টের ঢালাই করে উঁচু করা।তাদের গ্রামের ইদগাহ মাঠেও এমন বিশাল বটগাছ ছিল!

মিতুর থেকে কয়েক হাত দূরে এক বয়ষ্ক লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করছে।সে দশ টাকার কিনতে চাইলো।পরমুহূর্তে কি মনে হয়ে কিনলো না।

তার কাছে যে টাকা নেই, এমন না!খেয়া আপা আসার সময় তার হাতে অনেকগুলো নোট আর খুচরা টাকা গুঁজে দিয়েছে।সে গুণে দেখেনি কত টাকা!খেয়া নামক মানুষটাকে তার অনেক পছন্দ হয়েছে।তাকে ছোটবোনের মতো আদর করে।প্রতিদানে সে কি তাকে বড়বোনের মতো ভালোবাসতে পারবে?

প্রথম দিকে ঢাকা আসার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।গ্রামেই ভালো ছিল সে।কিন্তু তার মা যে অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতো সেটা তাকে বড্ড পীড়া দিতো।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভালো করে পড়াশোনা করে মাকে ভালো রাখবে।অনেক ভালো রাখবে।

তার গভীর চিন্তার মাঝেই দেখলো কলেজ মাঠে দূর থেকে হাঁকতে হাঁকতে একটা মিছিল আসছে।খেয়া আপা তাকে বার বার বারণ করে দিয়েছে এসব মিছিলের মাঝে যেন না পড়ে।

সে বড় বড় করে পা ফেলে মাঠ ত্যাগ করতে নিল।কিন্তু পারলো না।তার আগে মিছিলের সামনে এসে পড়লো।সে ভয় পেয়ে এক দৌঁড়ে সরে আসতে নিতেই কারো দেহের সাথে বড়সড় ধাক্কা খেল।

সে পড়ে যেতে নিতে নিজেকে সামলে বসে পড়লো।চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড বড় বড় করে দম নিল।তারপর চোখ খুলে ডান পায়ের জুতার দিকে তাকাল।ছিঁড়ে গেছে।

কলেজের প্রথম দিন এতসব কাজ হলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে তা মিতু জানে।তার জায়গা অন্য কোনো মেয়ে থাকলে কান্নাও করে দিতো।কিন্তু সে ছোটবেলা প্রচুর কেঁদেছে।বড় হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কাঁদবে না সে!কাঁদবে না মানে নো ক্রাইং!

__’হেই পিচ্চি গার্ল?তুমি অখে?’

এমন অদ্ভুত কথা বলার ভঙ্গি দেখে মিতু চোখ তুলে তাকাল।তার সামনে ফর্সামতো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।বয়সে যে তার থেকে বেশ বড় তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।এর সাথেই ধাক্কাটা লেগেছে!

সে কিছু বলল না।আরেক নজর ছিঁড়ে যাওয়া জুতার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।ছিঁড়া জুতা পড়েই টিপে টিপে পা ফেলল ক্লাসের দিকে।

__’কি হলো?টক করছো না কেন?’

মিতু সামনের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো ছেলেটা তার পাশাপাশি আসছে।সে এবারও উত্তর দিল না।

ছেলেটা এবার অবাক হয়ে বলল,

__’তুমি মিউট হয়ে আছো কেন?’

মিতু কঠিন মুখে কিছু একটা বলতে নিয়েও থেমে গেল।সে মানুষটা বড্ড কঠিন।

__’তোমার নেইম কি?’

এবার সে দাঁড়িয়ে পড়লো।ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’মিতু!আমার নাম মিতু!’

ছেলেটা একগাল হেসে বলল,

__’বাহ!কি বিউটিফুল নাম।কোন ক্লাসে স্টাডি করো?’

__’কলেজে!প্রথম বর্ষ!মানবিক শাখায়।আর কিছু?’

__’ইয়েস!না মানে আ’ম রাহাত!রাহাত আহমেদ।আই থিঙ্ক, আই লাভ ইউ।’

মিতুর মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেল ছেলেটার কথা শুনে!

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে